নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জিম মরিসন

সে এক বিরাট ইতিহাস!!

জিম মরিসন › বিস্তারিত পোস্টঃ

পতন... চুড়ান্ত পতন

১৭ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৪

সময় যেন থেমে গেছে এই মুহূর্তে। থেমে গেছি আমিও... পৃথিবীটা শুধু ধীরে ধীরে স্থির আমাকে ফেলে উঠে যাচ্ছে উপরে। গাছপালা, পাহাড়ের খাড়া দেয়াল, সুনীল আকাশ... মহাকালের নিয়ম ভেঙে কোথায় যাচ্ছে চলে সব!

না... আমি স্বপ্ন দেখছি না, দুঃস্বপ্ন তো নয়ই! প্রকৃত সত্যি এটাই, আমি একটা পাহাড়ের খাদে পড়ে যাচ্ছি। স্কুলে পড়া পড়ন্ত বস্তুর সূত্র মেনেই পতন হচ্ছে আমার। কিন্তু বলছিলাম যা, সে কথা গুলোও সত্যি! মনে হচ্ছে আমার, আমিই থমকে আছি... পৃথিবীটা শূন্যে উঠে যাচ্ছে... এবং সেটা যেন স্লো মোশনে!

আমি কে? এখন কি পরিচয় দেবার সময়? আমি হচ্ছি... তুমি, সে, কিংবা এই পৃথিবীর যেকোন মানুষ... পাহাড়ের একটা খাড়া খাদে যার পতন হচ্ছে। কয়েকটি সেকেন্ড, তারপরই তো পরিচয় হবে- মৃতদেহ! না... পরিচয় আমি দিচ্ছি না। তবুও ব্যক্তি 'আমি'র কথা যদি চাও জানতে, তবে এটুকু বলি, ব্যর্থ এক জীবনের কাছ থেকে পালাতে এসেছিলাম এই বিজন পাহাড়ে। গল্প উপন্যাসে যেমন নাটকীয় ফেরার জীবন দেখানো হয়... জীবন থেকে পালায় মানুষ... আস্তানা ফেলে কোন এক নির্জনতার পাহাড় বা ছবির মতো সুন্দর কোন গ্রামে! মানুষের জন্য বিসর্জন করে জীবন... স্কুল কিংবা হাসপাতাল... নিদেনপক্ষে সেই এলাকার মানুষের বিপদে এগিয়ে যাওয়া! অথবা কোন পাহাড়ি উপজাতি মেয়ের প্রেম... ভালবাসার টানে ফিরে যাওয়া স্বাভাবিক জীবনে?

না... এইসব কিছুই আমাকে দিয়ে হওয়ার কথা যেমন ছিলো না, তেমন হয়ওনি! জনসমুদ্রের শহরে আমি যেমন একা ছিলাম, এখানেও আমি একা হয়েই থাকতাম! সাধারণ... খুবই সাধারণ!

অদ্ভুত... মারা যাচ্ছি আমি, আর এমন সময়ে পরিচয় নিয়ে এইসব ফালতু কথাগুলো কেন বলছি? শেষ এই কয়েকটি সেকেন্ড বরং গুরুত্বপূর্ন কথাগুলো বলে পার করা যাক।

আমার একটু আফসোস হচ্ছে, দুঃখই বলতে পারো। একবার মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগ যদি মিলতো? আচ্ছা, যমদূত কেমন স্বত্তা? একটি দিনের আয়ু চাইলে দেবেন?? আমি মৃত্যুর দুয়ারে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি, দেখা হলে যমদূতকে অনুরোধ করে দেখবো... যদি মেলে একটি দিন!

এই পৃথিবীতে মা-ই শুধু জানতেন আমার এই নিরুদ্দেশের ঠিকানা। মাকে চিঠি লিখতাম নিয়মিত, মা-ও উত্তর দিতেন। তবে তা গোপন ছিলো পুরো পৃথিবীর কাছে। মা আমার এই পালিয়ে বেড়ানোর ব্যাপারে আপত্তি করেননি! অদ্ভুত... পৃথিবীটা সত্যিই অদ্ভুত! মায়ের মত একজন নরম মনের মহিলার কাছে আমি এতটা শক্তি আশা করিনি। গত চারটি বছর মায়ের সাথে দেখা নেই! আশ্চর্য এটাই, মায়ের চারবছর আগের মুখটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না আমার... ছোটবেলায় যে মাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না... যে মা ভাত না মেখে দিলে পারতাম না খেতে... সেই মাকে মনে পড়ছে। একবার যদি মায়ের কাছে যেতে পারতাম! 'মা' বলে ডাকতে পারতাম!! পতনের এই মুহূর্তেও আবিষ্কার করি, আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে।

জুনায়েদের জন্যও খারাপ লাগছে... জানো? বেচারা আশা করে আছে জানি, আমি ফিরে যাবো একদিন। অন্তর্ধানের আগে জুনায়েদ বোধকরি বুঝতে পেরেছিল... আমাকে আবেগ দিয়ে করতে চেয়েছিলো বন্দী! বলেছিল, "মানুষ তো হারিয়েই যায়রে বন্ধু, তুই আমি সবাই হারাবো! তবুও তার আগে যাকিছু সুন্দর, তা আরও একবার অন্তত দেখে যাওয়া যেতে পারে! পৃথিবীর কল্যাণে কিছু একটা করে যাওয়া যেতে পারে! যে মানুষের চেয়ে মহীয়ান কিছু নাই- তাদের জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করাই ভালো... চলে যাওয়ার আগেই!"

আমরা বসেছিলাম জুনায়েদের বাসার ছাদে, সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলেছিলাম আমি, "দোস্ত, আগামী পূর্নিমা, কিংবা অমাবশ্যায়... সারারাত হাঁটবো বিরান প্রান্তরে, বিরামহীন! শুধু তুই আর আমি! আর দুঃস্থ পথশিশুদের জন্য একটা স্কুল খুলবো। এই শহরের সব পথশিশুরা একদিন গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাবে, দেখিস!" পরদিন দুপুরেই বাড়ি ছেড়েছি... পরিচিত জগৎ! জুনায়েদ কষ্ট পেয়েছিল জানি, তবুও সে আশা করে আছে... আমি ফিরে যাবো! তোকে আরও একবার ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছি জুনায়েদ... আর দেখা হচ্ছে না! এই পৃথিবীতে মানুষ মিথ্যেই আশা করে যায়... স্বপ্ন দেখে অহেতুক!

ছোটবেলায় স্কুলের দপ্তরী ছিলেন রহিম মামা। গলায় কোন সমস্যা ছিলো নিশ্চিত... অদ্ভুত এক ভয়েজ ছিলো তার! আমি ছিলাম ক্লাস ক্যাপ্টেন, টিফিন কম পড়লে ছুটে যেতাম টিচার্স রুমে। রহিম মামা ফ্যাসফ্যাসে গলায় গজগজ করতেন, চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত একটা টিফিন হাতে দিতেন ধরিয়ে! নিখাদ ভালবাসা... রহিম মামা কি বেঁচে আছেন এখনও? আমাকে মনে আছে তার?

অসম্ভব সুন্দর এই প্রখর রোদের দুপুরে আমি হারমোনিকা বাজিয়ে হাঁটছিলাম... আনমনে। নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড়ের পটভূমি... মুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম। পাখি, প্রজাপতি, রুক্ষ বুনো প্রান্তরের গান শুনছিলাম... খেয়ালই করিনি খাদের কিনারায় চলে এসেছি। তখন হঠাৎই মনে হলো... আজন্ম লালিত সাধ পূর্ণ কেন করছি না? সামনে গভীরতার আহ্বান... একটি পদক্ষেপেরই তো অপেক্ষা! তারপর থেকেই আমি ভাসছি, উড়ছি... অথবা আমার পতন হচ্ছে!

হারমোনিকাটা আমার হাতের মুঠোতেই এখনও... আচ্ছা, ঠিক এরকম সময়ে হারমোনিকা আবার বেজে উঠলে কি খুবই হাস্যকর লাগবে? নাকি খুব নাটকীয় একটা দৃশ্যের হবে জন্ম?? হারমোনিকাটা ছেড়ে দিলাম! আমার পিছু পিছু তারও শুরু হলো... পতন।

এই মূহুর্তে আমার পরিচয় পৃথিবী কি করছে? যে কুঁড়েঘরে আমি রাত কাটাতাম, তার পেছনেই একটা কদম গাছ লাগিয়েছি দুবছর হলো। বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে গাছটা এরই মাঝে, হয়তো এই বর্ষায় দেখা পেতাম ফুলের। গ্রীস্মেই থেমে যাচ্ছি... বর্ষা দেখা হলো না... দেখা হলো না বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলটাও! আর ওপাশের পাহাড়ের বড় যে শিমুল গাছটা, একটা অচেনা পাখি বাসা বেঁধেছে কদিন আগেই। ছোট ছোট কয়েকটি ছানা... ওদের সাথেও কথা হলো না আর!

ঘরের চালের একটা পাশ মেরামত করার দরকার ছিলো। বৃষ্টির জলের অবাধ আগমন আর আলো হাওয়ার অবারিত যাতায়াত... মেরামত সত্যিই জরুরি! আরে... সকল প্রয়োজনের উর্ধ্বে চলে যাবার আগেও আমার জাগতিক ক্ষুদ্র বিষয়গুলো মনে পড়ছে? তবে কি আমিও একজন মানুষ?

গেল শীতে পা মচকে গিয়েছিল, সপ্তাহখানেক ভুগেছিলাম। হাঁটতে পারছিলাম না, পড়েছিলাম যে পথে... পথচলতি এক বুড়ি আমাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল ঘরে। খাবার রেঁধে দিয়ে যেতো বুড়ি... প্রতিদিন! আশ্চর্য... তার নামটাও জানা হয়নি, উত্তর পাইনি হাজারবার জিজ্ঞেস করেও। নিশ্চুপ আগমন, কাজ শেষে ফিরে যাওয়া... মায়ের সাথে বড় মিল ছিলো বুড়ির! হলো না... আর একটিবারও দেখা হলো না!

মনে করতে চাইছিলাম না যার কথা... তাকেই মনে পড়ছে বারবার! আচ্ছা... চারুলতা কি করছে এখন? ঘুমিয়ে আছে? জেগে থাকলে গান শুনছে? গুনগুনিয়ে গাইছে? অথবা জানালার গ্রিলে হাত রেখে আছে কি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে? ওহ্... শুনেছি ওর বাড়ি এখন পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে। এই প্রখর রোদ্দুরের দুপুরগুলোতে... বন্ধ নিশ্চয়ই তার জানালা? আবার এটাও হতে পারে, চারুলতা বদলে গেছে। জানালা আর তাকে টানে না! আচ্ছা... ওর সময়ে অসময়ে মাথাব্যাথার রোগটা আছে এখনও? সন্ধ্যাবেলায় গোসলের অভ্যাস? তীব্র হলো আমার দুঃখবোধ! মানুষ কেন টেলিপ্যাথির ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না? অন্তত মৃত্যুর সময়েও যদি ক্ষমতাটা চলে আসতো অলৌকিক কোন মহিমায়! আমি এই কয়েকটি সেকেন্ডের অর্ধেকটা তার সাথে কথা বলে ব্যয় করতাম। চারুলতা... কেমন আছে সে?

নিচের গাছগুলো খুব কাছে এসেছে চলে। কতক্ষন সময় আছে আর? দু সেকেন্ড? চারুলতা বলতো, "এপারের না হলেও ওপারের পৃথিবী হবে আমাদের।"

মরনের এই মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম এক চিরসত্য... ওপারে কিছুই নেই! চারুলতার কথা ভেবে আমার কষ্ট হলো খুব... কান্না পেলো... বাঁচার আরও একবার সুতীব্র ইচ্ছে হলো! হাঁটু গেড়ে তার সামনে, বলতে ইচ্ছে হলো... 'ক্ষমা করো। ওপারে কিছুই নেই! অন্ধকার!'

তারপর... সব অন্ধকার!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.