নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কিছু মুঠোভরা অন্ধকার

সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে ...

শামীম শরীফ সুষম

just another brick in the wall

শামীম শরীফ সুষম › বিস্তারিত পোস্টঃ

হাত

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১:১৪





১.



সর্ন্তপনে এদিকে ওদিকে তাকায় রাইসুল । নাহ , কেউ দেখেনি ।



মৃত হাবিব মোল্লার শার্টে রক্তমাখা ছুরিটা মুছে নেয় সে । চেঁচিয়ে ডাকে জহির আর ইলিয়াস কে । তারপর বস্তায় তোলে লাশটা , যাবার পথে ছুরিসহ ব্রিজের ওপর থেকে ফেলে দিলেই হবে ।



অন্ধকার রাত , অল্প যে একটু চাঁদ আছে ; তাও মেঘের আড়ালে , কেউ দেখলেও চিনতে পারবে না । হাতে হাতে মোবাইল ক্যামেরা থাকায় হয়েছে বিপদ , কে কখন ছবি তুলে নিয়ে বিপদে ফেলবে ।



কাজের ব্যাপারে নিজের মা’কেও বিশ্বাস করে না রাইসুল । ঠেকে শেখা জিনিস । এখনো তার শরীরে কালো মহিষের শক্তি , কোঁকড়ানো চুলের নিচে বুদ্ধিক্ষিপ্ত দুটি চোখ । কিন্তু একদিন এই শরীর শ্লথ হয়ে যাবে , মাথা কাজ করবে না আগের মত , আর সেইদিন , রাইসুল জানে , তার মালিক তাকে ঠিক কোন বস্তায় ঢুকিয়ে ব্রিজ থেকে ফেলে দেবার পায়তারা করবে ।



গাড়িতে উঠে একটা সিগারেট ধরালো রাইসুল । মনে মনে ভাবলো হাবিব মোল্লার কথা । রাজনীতিতে নামতে চেয়েছিলো বেচারা ; বুঝেনি কালাম শেখ কি জিনিস । সাপ ফণা তুলবার আগেই পিষে ফেলা , এই নীতির জন্যই কালাম শেখ আজ কমিশনার । হাবিব মোল্লার উচিৎ ছিল বাসায় ফেরার পথে সাথে দুই একজন রাখা , অবশ্য থাকলেও খুব বেশি লাভ হত না ; রাইসুল জানে , বিপদ আসলে কেউই বাঁচাতে আসতো না হাবিব মোল্লাকে ।



অবশ্য মরার আগে আহাজারি কম করেনি হাবিব মোল্লা । আমগাছের সাথে ঠেসে ধরে রাইসুল বড় ছুরিটা বের করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে হাবিব মোল্লা , ‘ আমারে ছাইড়া দেন ভাই , আমারে যাইতে দেন । ছোট ছোট তিনডা বাচ্চা আছে আমার ভাই , ওগো এতিম কইরেন না ..যাইতে দেন আমারে” ..



রাইসুলের এসব গা করলে চলে না । ওস্তাদ শিখিয়েছিলো , কাজে যাবার আগে গলা ভিজিয়ে নেবার জন্য , বুকে সাহস পাওয়া যায় । গলার দুগ্লাস পড়ার পর কোন কিছুকেই আর তোয়াক্কা করতে ইচ্ছা করে না , তখন এইসব রোনাজারিকে অগ্রাহ্য করা কঠিন কিছু হয় না। রাইসুলের অবশ্য এগুলোর কিছুই দরকার হয় না ।আর সেজন্যই রাইসুল ওস্তাদকেও ছাড়ায়ে গেছে ।



গাড়ির গদিতে শরীর এলিয়ে দেয় রাইসুল , পরিশ্রমের কাজ ; শরীরে এড্রেনালিনের স্রোত বয়ে গেছে , ঘামে ভিজে গেছে শরীর ।



“ঝুপ!!” – রাতের অন্ধকারে মৃদু কিন্তু নিশ্চিত একটা শব্দ হয় । ইলিয়াস আর জহির খারাপ পাড়ায় যাবে , নতুন টাকা পকেটে ; ফূর্তি না করলে পোষাবে না। রাইসুল বিবি-বাচ্চাওয়ালা আদমি , বউকে ভালোবাসে ভীষণ , সে হাটা দেয় বাড়ির দিকে।ফূর্তির জীবন ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই , এখন ছোট্ট মেয়েটার মুখ না দেখলে রাতে ঘুম আসে না । রাস্তায় মোবাইল করে জানিয়ে দেয় কালাম শেখকে , কাজ শেষ । তাড়াতাড়ি পা চালায় সে বাড়ির দিকে ।



২.

নিপা মন খারাপ করে বসে আছে ।



তার মাটির বড় পুতুলটার মাথা পড়ে আছে মাটিতে , পাশে পুরো দেহ । আজকে সকালেও সে খেলেছে পুতুলটা দিয়ে , খেলে আলমারির উপরে তুলে রেখেছিলো । সন্ধ্যায় বাইরে থেকে খেলা শেষে ফিরে দেখে কিভাবে যেন পুতুলটা পড়ে গেছে আলমারি থেকে । চোখে একফোঁটা একফোঁটা করে অশ্রু জমতে থাকে তার ।



মা গার্মেন্টসে গেছে , রাতে ফিরবে … বাবাও বাইরে গেছে কাজ আছে বলে । কিছুই ভালো লাগছে না নিপার । পুতুলটা তার অনেক প্রিয় ছিল । ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে সে ।



কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে নিপা … বুকের কাছে ভাঙা পুতুলটা নিয়ে ।



৩.

সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে , মালিকের দুর্ব্যবহার ভালো লাগে না মনোয়ারার ।



তার উপর যদি হতো বেতনটা ভালো , তাও না । কোনমতে দিন চলে যাওয়ার মত , কিন্তু মনোয়ারার মত কপাল যাদের , তাদের জন্য তিনটা হাজার টাকাই অনেক ।



সুপারভাইজারের দিকে তাকালো মানোয়ারা , পেটমোটা , চোখে-মুখে লোভ আর কাম চকচক করছে … যে কোন বয়সের গার্মেন্টস কর্মী হোক , সে দেখতে যেমনই হোক , কোন না কোন ছলে সুপারভাইজার তার গায়ে হাত দেবেই । ‘শোন ভইন’- বলে সে যখন কালো আঙ্গুলগুলো বোলায় মনোয়ারার পিঠে , গা ঘিনঘিন করে ওঠে তার । কিন্তু , কিছু করার নাই … গত দশ বছর থেকে এই সুপারভাইজার আছে ; মালিকের দুরসম্পর্কের ভাগিনা .. অভিযোগ করে কোন লাভ হবে না । প্রতিমাসে একটা করে মহিলা পেট বাধাবে , তারপর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে সেই সুপারভাইজারই তাকে নিয়ে বের করে দেবে ফ্যাক্টরি থেকে , এটাই নিয়তি ।



মনোয়ারার দিকে তাকিয়ে তেলতেলে একটা হাসি দেয় সুপারভাইজার । লোকটা যখনই তাকায় , বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তার দৃষ্টিতে কোন লজ্জা বা শঙ্কা থাকে না । সে এবং মনোয়ারা , দুজনেই জানে , চাকরিটা মনোয়ারার কতোখানি দরকার ।



গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মনোয়ারা … রাইসুল যখন তাকে বিয়ে করে আনে তখন তাদের সংসারে অভাবের লেশমাত্র ছিলো না , রাইসুল ছিলো মুষকো জোয়ান , সারাদিন ক্ষেতে খেটে খেত লোকটা … এক বসন্তে বাঁশ কিনে নিজেই একটা ঘর তুলে ফেললো …. সংসারে সুখের কোন কমতি ছিলো না তাদের ।



তারপর সেই বন্যা … পদ্মানদী কামড়ে খেয়ে ফেললো তাদের চাষের জমি , আর প্রলংঙ্কারী বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে গেল বাশের সেই বাসা …. তারপর শহরের দিকে যাত্রা , রাইসুলের হাত ধরে অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা ।



একসপ্তাহ ঠিকমতো খেতে পায়নি দুজনে … একসময় রাইসুল একটা স্টিলমিলে জুটিয়ে ফেললো কাজ , সেখান থেকেই পরিচয় কালাম শেখের সাথে ।

কালাম শেখ লোকটাকে কখনোই ভালো লাগে না মনোয়ারার , সারাক্ষন মুখে হাসি , কিন্তু চোখের মাঝে একটা অশুভ ছায়া … লোকটাকে দেখে ভীষণ ভয় লাগে মনোয়ারার …. তাই রাইসুল যেদিন রাত্রে তাকে বলে সে কালাম শেখের সাথে কাজ করতে যাচ্ছে , মনোয়ারা মোটেও খুশি হতে পারেনি ।



কিন্তু উপায়ও আর ছিলো না তখন ; স্টিলমিলে আর কত টাকা আসে .... রাইসুল কাজ শুরু করার পরে অবশ্য সংসারে টাকা ঠিকই আসতে থাকে , কিন্তু ঢাকা শহরে একজনের আয়ে তিনজনের সংসার চলে না । মনোয়ারা নিজেই একদিন বলে গার্মেন্টসে চাকরির কথা , পাড়ার সব মেয়েরা যায় - সে গেলে সমস্যা কোথায় ?



সংসারের পাশাপাশি অন্য উদ্দেশ্য ছিল মনোয়ারার । কিছু টাকা জমাতে চেয়েছিলো সে । রাইসুল হাতখোলা মানুষ , সে কখনোই কোন টাকা জমাতে পারবে না । মেয়ে বড় হচ্ছে , কিছু টাকা এখনই না জমানো শুরু করলে শেষে বিয়ে দেয়া যাবে না ।



গার্মেন্টসে চাকরির কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেল রাইসুল । " হারামজাদী , বান্দি - আমি কি তোরে খাওন দেই না "... চিৎকার করে পুরো পাড়া গরম করে ফেলল সে । পরে পাড়ার লোকজনই রাইসুলকে বোঝায় - গার্মেন্টসে কাম করা খুব খারাপ কিছু না । সংসারে টাকাও আসে , খাটনিও খুব বেশি নাই । কিছুক্ষণ গাইগুঁই করে একসময় রাজি হয়ে যায় রাইসুল ।



এখন মনে হয় সিদ্ধান্তটা মনোয়ারা ভুল নিয়েছিল । টাকা আসছে , কিন্তু খাটুনির তুলনায় খুবই কম । বয়স হয়েছে , এখন কিশোরী মেয়েদের মত একটানা কাজ করতে পারেনা মনোয়ারা । চোখ ধরে আসে , মাজা ব্যাথা করে । তারপর সুপারভাইজার তো আছেই । মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে মনোয়ারা , এই মাস গেলে আর কাজে আসবেনা সে ।



সিদ্ধান্তটা নিয়ে খুশি হয় মনোয়ারা । কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে । অসহ্য গরম উপেক্ষা করে সেলাই করে চলে মনোয়ারার হাত ।





৪.



সদরুল ডাক্তার চিৎকার করার সময়টা পায়না , তার আগেই গলায় ছুরি চালিয়ে দেয় রাইসুল।



মানুষ মারা যাওয়া দেখাটা কষ্টকর । মরার সময় একক মানুষ একেক রকম কাজ করে । এই যেমন , পাড়ার স্বনামধন্য ডাক্তার , সদরুল ডাক্তার এখন খাবি খাচ্ছে ... গলা বেয়ে ফিনকি দিয়ে নামছে তাজা রক্তের ধারা .... একটুপর ধারাটার তেজ কমে আসবে .... তবে এই মূহুর্তে হাতে সময় নাই বসে বসে দেখার ... কেউ দেখে ফেলার আগেই ফিরতে হবে ... জোরে পা চালায় রাইসুল ।



কিছু কিছু কাজ আছে যেটা মানুষকে দেখাতে হয় । এই যেমন সদরুল ডাক্তারের লাশ । চাইলেই লাশ গুম করা যেত , কিন্তু মানুষকে কালাম শেখ কি চীজ দেখানো দরকার । তাই লাশ ফেলে আসা । সবাই দেখবে সকালে , জানবে , পুলিশ আসবে , ময়নাতদন্ত হবে .... কেস কোনদিন কোর্টে যাবে না , সেই ব্যবস্থা করা আছে । কিন্তু আগামী ৬ মাস আর কেই কালাম শেখের সাথে গাদ্দারী করার সাহস পাবে না ।



হাটতে হাটতে কালাম শেখের বুদ্ধির তারিফ করে রাইসুল । মাথায় মাল আছে লোকটার , আর এইজন্যই পুরো এলাকায় তার দাপট । ঢাকায় গেছে কালাম শেখ এখন , সামনে নির্বাচন আসতেছে , এমপির নমিনেশনের তদবীরের একটা ব্যাপার আছে । তাছাড়াও সদরূল ডাক্তারের মারা যাওয়ার সময় এলাকায় থাকাটা ভালো দেখায় না ।



পুকুরে গোসল সেরে চায়ের দোকানে বসে কড়া লিকারের রং চায়ে চুমুক দেয় রাইসুল । হাত এখনো অল্প অল্প কাঁপতেছে । মানুষ মারতে কারোই ভালো লাগে না । কিন্তু তার লাগে। এটাই রাইসুলের সাথে অন্যদের পার্থক্য । অন্যেরা মানুষ মারার আগে ইত:স্তত করে , দুশ্চিন্তায় ভোগে - রাইসুল এক কোপে কল্লা নামায়ে দেয় , বসে বসে রক্তের ফিনকি দেখে , তার ভালো লাগে।



এই জিনিসটা প্রথমবার বুঝতে পারে রাইসুল যখন অভাবের তাড়নায় কালাম শেখের জন্য প্রথম কাজটা করে সে । পেটে চাকু ঢুকিয়ে দেবার পর যখন আতা মিয়ার চোখ বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল - সেই দৃশ্যটা অদ্থুত একটা তৃপ্তি এনে দিয়েছিল রাইসুলের মনে । বেঁচে থাকার তৃপ্তি , পরাভূত করার তৃপ্তি , উপার্জন করার তৃপ্তি .... আর সবার উপরে , হত্যা করার আনন্দ ।



এই আনন্দ কাউকে বলতে , কাউকে বোঝাতে পারে না রাইসুল । মাঝে মাঝে নিজের প্রিয় ছুরিটার সাথে কথা বলে সে , বিড়বিড় করে বলে চলে প্রতিটি খুনের উত্তেজনা ।



খুন করার পরে অদ্ভুত একটা তৃপ্তি আসে মনে , শরীরটা হালকা লাগে তখন । মাসে একটা কাম না করতে পারলে এখন রাইসুলের কষ্ট হয় । কালাম শেখ সম্ভবত ব্যাপারটা বুঝে , আর বুঝে বলেই এখনো তার হাতে মেশিন তুলে দেয়নাই । দিবে একদিন , রাইসুল জানে ; রাজনীতিতে নামলে দিতে হবেই ।



চা শেষ করে সিগারেট ধরায় রাইসুল , মেয়ের পুতুল ভেংগে গেসে , নতুন পুতুল কিনতে হবে একটা । আর বাজারসদাই করা দরকার ; অন্ধকার , পাশবিক রাইসুলের এখন স্নেহময় পিতা , দায়িত্ববান স্বামী হবার সময় হয়ে গেছে ।



বাজারের দিকে রওনা হয় রাইসুল ।



৫.



নিপাকে নিয়ে আজকে গার্মেন্টসে এসেছে মনোয়ারা ।



মেয়ে সারাদিন বাসায় বসে কান্না করে । তাই এইখানে আনাই ভালো , গার্মেন্টস এর নিচে ছোট একটা জায়গা আছে , ওইখানে বসে খেললে মনোয়ারা চোখ রাখতে পারে ।



আজকে কাজের চাপ অনেক বেশি । মালিকের সাথে বেতন নিয়ে গন্ডগোল চলে ইউনিয়নের , তাই লোক ছাঁটাই করছে কিছু। যারা আছে তাদের উপরে চাপ অনেক বেশি পড়ে গেছে , হাতে সময় বেশি বাকি নেই।



মাঝেমাঝে মালিক আসে গার্মেন্টসে , সাদা একটা স্যুট পড়ে থাকে লোকটা । কালো চশমার মধ্য দিয়ে একজোড়া লোভী চোখ কর্মীদের বুকের মাপ নিয়ে চলে ... লোকটা কুৎসিত , কিন্তু তাতে কারো কিছু যায় আসে না ... সবাই তাকিয়ে থাকে তার চকচকে জুতার দিকে , দুধসাদা স্যুটের দিকে , পাছার পেছনে ফুলে থাকা ওয়ালেটের দিকে ।



একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মনোয়ারা .... তার যদি এতো টাকা থাকতো .... কষ্ট করে এই সংসার আর চালাতে হত না। নিজের কপালকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাই । খট্খট্ শব্দে সেলাই মেশিনটা চালাতে থাকে মনোয়ারা।





৬.



নিপা একমনে খেলছে , পলিথিন ব্যাগ আর খড় দিয়ে ওরা বল বানিয়েছে .... বলটা তার খুব পছন্দ হয়েছে ।



নিপার সাথে ওরই মত আরো একদল বাচ্চা আছে ; এখানে এলে তাই ভালো লাগে নিপার । বাসার অন্ধকার ঘরের থেকে অনেক ভালো গার্মেন্টসের নিচের জায়গাটুকু , পা এলিয়ে দেয় নিপা ।



হঠাৎ গুমগুম শব্দে পেছনে তাকায় নিপা । সাপের মত একটা দাগ সাদা দালানটার গায়ে দেখে সে .... আস্তে আস্তে সাপটা বড় হতে থাকে .... একটা দুটো ইট এসে পড়তে থাকে চারপাশে.... দালানটা হঠাৎ ভয়ংকরভাবে বিকৃত হয়ে যায় ...... বালির ঘরের মত ধ্বসে পড়ে কুন্ডুলি পাকিয়ে ... বিশাল একটা স্রোতের মত নেমে আসে খেলতে থাকা ছোট্ট দলটার দিকে ....



তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়া সেই দালানে তার মা ছিল .... নিপা জানতে পারেনা তার মা কেমন আছে ...



কখনো জানতেও পারবেনা আর ।



৭.



রাইসুল যখন খবরটা পায় তখন দুপুর ২ টা ।



দুমড়েমুচড়ে যাওয়া দালানটার সামনে এসে যখন সে দাঁড়ায় তখন তাকে দেখে মানুষ বলে মনে হওয়ার কোন কারণ নেই । রক্তের মত লাল হয়ে আছে চেহারা , রূক্ষ চুল উড়ছে বাতাসে । চোখের কোণে হীরের মত চকচক করছে পানি । নিচের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয়না তার , বিশ্বাস হয়না এই ধ্বংসস্তুপের মাঝে কোথাও লুকিয়ে তার প্রিয়তম স্ত্রী , প্রাণপ্রিয় মেয়ে ।



উদ্ধারকাজ শুরু হতে হতে অনেক দেরী হয়ে গেল ।



রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম ... তার উপরে উৎসুক মানুষের ভীড় ... মানুষ এমন কখনো দেখেনি ... হাজার হাজার মানুষসহ একটা দালান এভাবে গুড়িয়েঁ পড়ার দৃশ্য মানুষ কখনো দেখেনি । চাপা পড়া মানুষের এমন আর্তচিৎকার মানুষ কখনো দেখেনি , দালানের দেয়াল বেয়ে রক্তের স্রোত মানুষ কখনো দেখেনি ....



হাজার হাজার মানুষের উৎসুক , অশ্রসজল , অসহায় দৃষ্টির সামনে শয়তানের মূর্তির মত দাড়িয়ে থাকে দালানটা । কিছুক্ষনের মধ্যে চলে আসে টিভি ক্যামেরা .... মাইক্রোফোন হাতে প্রতিবেদক , এওয়ার্ড উইনিং শট নিতে ডিএসএলআর হাতে আসে ফটোসাংবাদিক , আসে রাজনীতিবিদ , সেনাবাহিনী , কলেজের ছেলেমেয়েরা চলে আসে রক্ত দিতে।



সেই বিধ্বস্ত স্তুপের মাঝে একজন মানুষকে দেয়াল থেকে দেয়ালে ছুটে চলতে দেখা যায় । চোখের কোণে ধূলা , রক্ত আর অশ্র জমাট হয়ে থাকে রাইসুলের । লাশের সমুদ্রে হাউমাউ করে কাঁদে সে .... লাশের পর লাশ সরিয়ে যায় দুটি চেনা মুখের আশায় ।



রাইসুলের সামনে - পেছনে - ডানে - বামে ... শুধু লাশ আর লাশ .... কারো হাত চাপা পড়ে আছে বীমের মাঝে , কারও মাথা থেঁৎলে গেছে .... কারো অবাক চোখে শুধূই অভিযোগ .... লাল হয়ে আছে পুরো ধ্বংসস্তুপ ... কোথাও যেন কেউ কাঁদছে ...নিপা ...নিপার গলাই পায় রাইসুল , প্রাণপণে পাগলের মত সামনের দেয়াল সরাতে চেষ্টা করে সে ।



একসময় ক্লান্ত হয়ে আবার কাঁদতে থাকে রাইসুল , পাশে গর্তের মাঝে এক কিশোরী তাকে বলে কিশোরীর পা কেটে ফেলতে ... সে মরতে চায়না .... রাইসুল স্থানুর মত বসে থাকে ... তার বিশ্বস্ত ছুরি বের করতে পারে না সে .... তার চোখের সামনে কিশোরীর ভয়ার্ত চেহারা মলিন হয়ে যায় .... মৃত কিশোরীটিকে নিজের স্ত্রী এর মত লাগে রাইসুলের ..... সে আবার তাকিয়ে দেখে .... মনোয়ারা ...... নাহ ..... মনোয়ারা না ....



এভাবে লাশের পর লাশ চারপাশে জমা হতে থাকে রাইসুলের ... তার তৃপ্তি আসে না .... সে প্রতিটি মুখের মাঝে খুঁজতে থাকে তার প্রিয়জনের মুখ .... তার খুনি হাতে সে সরাতে থাকে ইটের পর ইট , দেয়ালের পর দেয়াল ... যেখানে আলোর দেখা নেই ... সেখানে অবলীলায় চলে যায় রাইসুল .... উদ্ধার করতে থাকে মানুষের পর মানুষকে ....



তার রক্ত দেখে ভালো লাগতো .... তার জবাই হওয়া মানুষ দেখতে ভালো লাগতো .... তার মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আর্তচিৎকার শুনতে ভালো লাগতো .... লাশ আর লাশের মত মানুষের মাঝে সেই রাইসুলকে বড় বেমানান লাগে ..... কথনো ডুকরে কেঁদে ওঠে সে .... রক্তাক্ত আর একজোড়া হাত আঘাত করে নিষ্ঠুর দেয়ালে ।



দেয়ালের ওপাশে নিথর কোন হাত বসে থাকে প্রত্যাশায় ...











বি: দ্র : লেখাটি সাভার-ট্রাডেজীতে নিহত সকল পোশাকশ্রমিকের আত্নার প্রতি উৎসর্গ করছি

মন্তব্য ২৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (২৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১:১৭

খেয়া ঘাট বলেছেন: ছবিটা ভালো লেগেছে । ছবির সাথে গল্পটাও ভালো লেগেছে। নিদারুন বাস্তবতার গল্প।

২| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১:২৮

মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌ বলেছেন: ভালো লাগলো লিখাটা!!!

৩| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ২:১২

অয়ন আহমেদ বলেছেন: অসাধারন হয়েছে।

৪| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ২:২১

নষ্ট কাক বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন । :) ভালো লাগা রইল ! +++

৫| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ২:২৭

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: মানুষ হত্যা করার শাস্তিটা রাইসুল ভালোই পেয়েছে দেখা যায়। তবে আরো ভালো হতো যদি রানা প্লাজায় মনোয়ারা আর নিপা না থেকে রাইসুলের নিথর দেহ থাকতো।

৬| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৩:০৯

সানফ্লাওয়ার বলেছেন: কান্না পাচ্ছে ভাইয়া। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে নিজের জন্য। নিপার সাথে আমি যেন সেই ভয়াবহ সময়ে সেই রুমে ছিলাম। ঠিক এমনটাই অনুভূতি হচ্ছে আমার। আমি বদ্ধ রুম খুব ভয় পাই। এখনও ভয় হচ্ছে আমি যেন আটকে আছি। হাত বের করে আছি কেউ আমাকে উদ্ধার করবে সেই অপেক্ষায়.।.।

৭| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ৭:২০

অর্পণ! বলেছেন:
এমন অসাধারণ একটা লেখায় মোবাইল ভিউ থেকেও লাইক দিতে পারলাম না :(

৮| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ৮:০০

ভয়ংকর বোকা বলেছেন: দারুন। একটানে পড়ে ফেললাম। আপনার ছবি তোলার মত লেখার হাত ও অসাধারন। নিয়মিত লিখবেন প্লীজ।

৯| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:৫২

আর.হক বলেছেন: অসাধারণ। আর কোন মন্তব্য নাই।

১০| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:১০

মাহমুদা সোনিয়া বলেছেন: ফেসবুক থেকে দেখে এলাম অনেক দিন পর ব্লগে! এক কথায় চমৎকার লিখেছো!!

১১| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:২৯

আরজু পনি বলেছেন:

প্রত্যাবর্তনে অভিনন্দন জানাই !:#P !:#P

যে এতো ভালো লিখে তার ফিরে আসাটা আমাদের মতো তুলনামুলকভাবে জুনিয়র ব্লগারের জন্যে আশীর্বাদ স্বরূপ ।।



পরে আবার আসছি ।

১২| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:০১

নাজিম-উদ-দৌলা বলেছেন:
আমার মনে আছে ব্লগে যখন একেবারেই নতুন ছিলাম তখন আপনার শিরোনামহীন এক মানুষের শিরোনামহীন কোন গল্প লেখাটা পড়েছিলাম। সেটা ২০১১ সালের দিকে হবে। অনবদ্য একটা লেখা ছিল। অনেক দিন পর আপনাকে ব্লগে দেখে ভাল লাগল।

ভাল থাকুন আর ব্লগে নিয়মিত হন-এই কামনা করব।

১৩| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:১৯

এহসান সাবির বলেছেন: একটানে শেষ করলাম। অনবদ্য একটা লেখা..

১৪| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৩৪

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:

দারুন লিখেছেন।

১৫| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:১৮

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: গল্পের হঠাৎ মোচড়ে ফুটে উঠল একটা সম্পূর্ণ কথকতা!

দারুণ লেগেছে।

১৬| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪০

আরিফ আরাফাত রুশো বলেছেন: ভাল হোয়েছে, আপনি না আমার ফেসবুক এ ছিলেন? এখন আর পাই না আপনাকে। আপনার কোন পিক ও পাইনা গ্রাসহপার এ। আপনার একাউন্ট কি ডিএক্টিভেট?

১৭| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩৬

আরিফ আরাফাত রুশো বলেছেন: Click This Link

পড়বেন আশা করি

১৮| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:১০

সোমহেপি বলেছেন: লেখায় ভাল লাগা শরীফ ভাই

অনেক দিন পর।

শুভকামনা

১৯| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৫৫

আরজু পনি বলেছেন:

দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে :(


আমরা ভুলে গেছি মনোয়ারাদের কথা !

গরম গরম স্ট্যাটাস আর ব্লগ পোস্ট দিলে তো হিট বেশি পাব, তাই এখন আর মনে নেই তাদের কথা ।

ভুলে যা্ওয়া সময়কে দারুণ করে তুলে আনায় লাল সালাম জানাই আপনার মানসিকতাকে ।

আশা করি নিয়মিত লিখবেন ।

শুভকামনা রইল সুষম ।।

২০| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:০৪

মাসুম আহমদ ১৪ বলেছেন: মুগ্ধপাঠ

২১| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:০৮

আমি তুমি আমরা বলেছেন: ফিনিশিংটা অপ্রত্যাশিত ছিল। ভেবেছিলাম রাইসুল তার গডফাদারের হাতে নিহত হবে বা এরকম কিছু।

ভাল লাগল :)

২২| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০১

হাসান মাহবুব বলেছেন: মর্মস্পর্শী।

২৩| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৫

সমুদ্র কন্যা বলেছেন: হায় সেই অভাগাদের কথাতো ভুলেই গিয়েছে লোকে...

খুব মন খারাপ হয়ে গেল লেখাটা পড়ে সুষম।

২৪| ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১১:৫৭

আরজু পনি বলেছেন:

ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল সুষম ।। !:#P

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.