![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার দেখা নিষেধ, আমার কিছু করা নিষেধ, আমার কিছু বলাও নিষেধ! তবে আমি নাকি শুধু শুনতে পারবো! এটা কি শান্তি? নাকি শাস্তি?
মফ:স্বলের লেখাপড়া শেষ করে রূপা ঢাকায় এসেছে। অনার্স নিয়ে পড়ছে। অসংখ্য নতুন মুখ। ক্লাসের রুটিনবাঁধা জীবন। ছেলেমেয়েরা টি, এস, সি তে দলবেধে বসে আড্ডা দিচ্ছে। এখানে পরস্পর পরস্পরকে জেনে নেবার সুযোগ, কখনো ক্লাসনোট বিনিময় করতে গিয়ে, কখনো কোনো সেমিনারে যুক্ত থাকতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে।
রূপা চায় এমন একজন ওর মনের মানুষ হবে যার থাকবে গভীর জীবনবোধ ও প্রজ্ঞা। যাকে সবাই ঈর্ষা করবে। আশিক মাহমুদ সদ্য ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেছেন। আশিকের স্পষ্ট উচ্চারণ ও বিষয়ের উপস্থাপনা রূপাকে আন্দোলিত করেছে। চশমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ওকে স্পর্শ করেছে।
আশিক একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। এই কর্মকান্ডের সূত্র ধরে ক্রমশ ওরা নিবিড় হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধের উত্তাল সময়ে বাবা- মায়ের মতে ওদের বিয়ে হয়। ক'মাস সুখে সংসার করার পর আশিক যুদ্ধে চলে যায়। যে ক'দিন রূপা সংসার করেছিল সেখানে আশিক ছিল অত্যন্ত দায়িত্ববান। জীবনে আসে নতুন অভিজ্ঞতা।
যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর প্রথম আক্রমণ বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিজীবীর উপর। এতে আশিকের কিছু বন্ধু শহীদ হন। কিছু লাশ এলে আশিক স্থির থাকতে না পেরে নিজেও মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখালেন। যুদ্ধে যাবার পূর্বে যখন আশিক রূপার কাছে অনুমতি নিতে এলো তখন কোথা থেকে যেন সাহসের পাহাড় এসে ভর করে। হাসিমুখে ছোট্ট একটি কথায় স্বামীকে বিদায় দিল এই বলে -"আমার বিশ্বাস তুমি এবং এ দেশের সবাই সার্থক হবে এ যুদ্ধে, দেশ স্বাধীন হবেই। "
বাইরের আবহাওয়া তখন খুব খারাপ। আশিক ক্যাম্প থেকে বন্ধু সেলিম কে দিয়ে বলে পাঠালেন দেশে বাবা-মায়ের কাছে চলে যেতে। রূপা গেল না তার স্বামীর স্মৃতিজড়িত বাড়ি থেকে। তার কথা মরলে সে এ বাড়ি থেকেই মরবে।
আল্লাহ্র রহমতে রূপার কিছু হয়নি যুদ্ধে কিন্তু আশিক এক পা হারালো। দরজায় করাঘাত শুনে দৌড়ে এসে দরজা খুলতেই দেখে তার প্রাণপ্রিয় স্বামী ক্রাচে ভর দিয়ে দাড়িয়ে। রূপা চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলে " আশিক এতো আমি চাইনি, এতো আমি চাইনি। "
পরোক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, যাক, আমার স্বামীর পা হারিয়েছে সেতো দেশ স্বাধীন করবার জন্যে, এও কি কম গৌরবের। এরপর আর আশিকের চাকুরী করা হয় না। অনেক কষ্টে রূপার একটা চাকরি হয়। ওর আয় দিয়ে সংসার চলতে থাকে। এরপর দু'টো সন্তান আসে ওদের সুখের সংসারে। সংসার অনেক কষ্টে চালাতে হয়। এভাবে দিনগুলো কোনোমতে পার করে যাচ্ছিল রূপা।
সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে অর্নি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে "মা আজ আমার জন্মদিন না?" চমকে ওঠে রূপা। জানলো কি করে ও? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে ক'দিন আগে আশিক অর্নির সামনে বলেছিলো জানো ১৭ মার্চ আমাদের অর্নি মামনির বয়স সাতে পড়বে। সজল তখন বারান্দায় খেলছিল। দৌড়ে এসে বলল, মা সবাই জন্মদিন পালন করে বন্ধুদের বলে, আমরাও বলবো অর্নির জন্মদিনে।
ওরা শুনে ফেলেছে দেখে তাড়াতাড়ি রূপা বলে ছি: বাবা, জন্মদিন টন্মদিন করতে নেই। ওসব বড়লোকেরা করে। তোমরা বরং পরীক্ষায় ভালো করো তখন তোমাদের বন্ধুদের খাওয়াবো কেমন? রূপা লক্ষ্য করলো আশিকের মুখে একখণ্ড বেদনার মেঘ ছায়া ফেলেছে।
জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকী, ঘরোয়া জলসা ইত্যাদি উৎসব মুখর দিনগুলো আজ শুধু স্বপ্নের মতোই আবেশে জড়ানো স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
রূপার কষ্ট দেখে একদিন আশিক রূপাকে নিবিড় সান্নিধ্যে এনে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল "আমি যুদ্ধ করেছিলাম দেশ স্বাধীন করবার জন্য এবং তা করতে গিয়ে একটি পা হারিয়েছি। আর আজ তুমি যুদ্ধ করছো আমাদের এই সংসারের সকলকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য। এ যুদ্ধের যেন শেষ নেই। মাঝে মাঝে বড় ভয় হয় রূপা, এই যুদ্ধ করতে করতে যদি একদিন তোমাকেই হারিয়ে ফেলি। তখন আমি কাকে নিয়ে,কি নিয়ে বাঁচব।"
আশিকের ঠোঁটে আঙ্গুল চাপা দিয়ে রূপা বলেছিল, ও কথা বোলো নাগো, তোমার ভালোবাসা পেলে আমি সব দু:খ-কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে নেব।
ক'দিন পরে সজল এসে বলছে মা দু'মাসের মাইনে বাকি, অর্নি বলছে মা স্কুল ড্রেস না বানালে ম্যাডাম বলেছেন ক্লাসে ঢুকতে দেবেন না। রূপা বলে, হবে মা,সব হবে। ঘরে ঢুকে স্বামীকে ঔষধ খাওয়াতে গিয়ে দেখে শিশি খালি। মহাচিন্তায় পড়লো। হাতে তেমন টাকা নেই। এখনো মাসের ৮/১০ দিন বাকি।
চিন্তা করতে করতে ট্রাঙ্ক খুলে কাপড় তচনচ করে ওল্টাতে লাগলো কোথাও কোনো কাপড়ের ভাজে কোনো টাকা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু না কোথাও নেই। নিজের মনে গালি দিতে লাগলো, হায়রে স্বাধীন দেশ। যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিলো, পঙ্গু হলো তাঁদের কোনো সাহায্য এলো না। তাঁদেরকেই এখন পথে বসতে হচ্ছে। সেই যে যুদ্ধের পর থেকে সুখের মুখ দেখিনা, আর কবে দেখব তাও জানিনা।
পেছনে কখন যে আশিক ক্রাচে ভর করে এসে দাঁড়িয়েছে রূপা তন্ময়তার মাঝে বুঝতেই পারেনি। রূপার পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলে "আচ্ছা তোমার সুখ নামের অচল শব্দটিকে মুছে ফেলতে পারো? যদি পারো দেখবে অনেক স্বস্তি,অনেক শান্তি। "
আশিকের কথাগুলো রূপার কানে করুন কান্নার মতো শোনালো।
©somewhere in net ltd.