নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস... খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে... কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়। আমার অদক্ষ কলমে... যদি পারো ভালোবেসো তাকে... ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে, যে অকারণে লিখেছিল মানব শ্রাবণের ধারা.... অঝোর শ্রাবণে।।
সৌন্দর্যের রূপঃ
সৌন্দর্যের রূপ বিকশিত হয় আনন্দের আনন্দযজ্ঞে। সৌন্দর্য যেহেতু সমন্বিত বহু আনন্দের দ্বারা সৃষ্ট মিশ্র আনন্দ। তাই আনন্দের ছোটো ছোটো রূপের ভিতরেই রয়েছে সৌন্দর্যের রূপ। রূপ থাকলেই সৌন্দর্যের কথা আসে। রূপ না থাকলে সৌন্দর্যের বসবার ঠাঁই নাই। অনেক সময় সৌন্দর্যের ভিতর দিয়ে রূপের জন্ম হয় বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে তা হয় না। সৌন্দর্য হলো একাধিক আনন্দের সমন্বিত অবয়ব। সৌন্দর্য মাত্রেই রূপের আশ্রয়ী। ধরা যাক কেউ একজন অচেনা কোনো সুর বাজাচ্ছেন। সে সুরের প্রতিটি স্বর আনন্দ দান করছে। সময়ের সাথে সাথে আগের বাজানো স্বর অতীত হয়ে যায়। কিন্তু স্মৃতিতে তা জাগ্রত থাকে। প্রতি মুহূর্তের স্বরপরিবর্তনের সাথে সাথে, অতীতের আনন্দবিন্দুগুলো একত্রিত হয়ে একটি অয়য়ব পায়। কান শোনে তাৎক্ষণিক শব্দ , কিন্তু 'আমি' শোনে অতীত-বর্তমানের সমন্বয়ে সৃষ্টি একটি সুরের ধারা। তাই আমির কাছে সুরের সৌন্দর্য ধরা পরে একটি বড় রূপের ক্যানভাসে। সৌন্দর্যের আনন্দযজ্ঞের সকল অনুভব সকল 'আমি' নিতে পারে না। আবার সৌন্দর্যের সকল দিক সবার কাছে একইভাবে প্রকাশিতও হয় না। সৌন্দর্যের রূপে থাকতে পারে− উগ্রতা, স্নিগ্ধতা, রহস্যময়তা ইত্যাদি। সৃষ্টি করতে পারে মুগ্ধতা বা বিমুখতা। এসবই আমি' যেভাবে নেয়, তাই।
অনেক সময় একটি বিশেষরূপ যে সৌন্দর্য দান করে, একাধিক রূপের সমন্বয়ে তা আরও সুন্দর হয়ে উঠে। সুন্দর খাবার− সুন্দর পরিবেশে আরও বেশি সুন্দর হয়ে উঠে। মানুষের যৌন-সৌন্দর্যে দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণের আবেদন অপরিসীম। শিশুর কাছে মায়ের স্পর্শ, মুখমণ্ডল, গায়ের গন্ধ এর সবই পরম রমণীয়। বাঙালি মেয়েরা টিপ পড়ে। টিপের একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। তা কপালে থাক আর, আয়নায় বসানো থাক। দুই ভ্রূর মাঝখানে বসে টিপ ভ্রূদ্বয়ের সুসমন্বিত একটি রেখার জন্ম দেয়। উপরের প্রশস্ত কপাল নিচের নাক, ঠোঁট এবং থুতনির বরাবর একটি উলম্ব রেখার যোগসূত্র তৈরি করে। সবমিলিয়ে টিপ একধরনের জ্যামিতিক সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে। এর সাথে যুক্ত হয় টিপের রঙ আকার। নারীমুখের কপাল, ভ্রূ, নাক, ঠোঁট, কপোল এসবের যে ছোটো ছোটো সৌন্দর্য রয়েছে, টিপ তার একটি অংশ হয়ে ভিন্নতর সৌন্দর্যের রূপকে প্রকাশ করে।
মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি যে রূপের জন্ম দেয়, তার সাথে অনেকক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক অবয়বের যোগসূত্র থাকে। কিন্তু মানুষের মনের ভিতর এমন কিছু রূপের জন্ম হয়, যা সম্পূর্ণই অনুভবের। রবীন্দ্রনাথের গানে পাই 'আমি রূপে তোমায় ভোলাব না/ভালোবাসায় ভোলাব'। এ গানের রূপ হলো সৌন্দর্য। এ রূপ দেখার, আর ভালোবাসার রূপ অদেখার। যে রূপ দেখার, তা দেখার চেয়ে বেশি কিছু দান করে না। এ রূপ হলো ব্যঞ্জনা। যে রূপ মোহিত করে, তা অনুভবের, তা সৌন্দর্যময়। সে রূপ যদি ভালোবাসার হয়, অহঙ্কারের সাথে বলাই যায়, ভালোবাসায় ভোলাব। স্পর্শের রূপ আছে। দেহ দিয়ে স্পর্শ করলে দেখা যায়, তার রূপ একপ্রকার। মন দিয়ে মন ছুঁয়ে যাওয়াটা ভিন্নতর রূপ। ভালবাসার রূপ তৈরি হয় দেখা ও না-দেখার যুগপৎ অনুভবে, ছোঁওয়া না-ছোঁওয়ার রোমাঞ্চে। যিনি ভালোবাসেন তিনি অরূপ রূপের সন্ধান পান।
অনেক সময় আমরা কুরূপ বা সুরূপ বলি। নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে, রূপের কু বা সু বলে কিছু নেই। 'আমি' রূপকে কিভাবে গ্রহণ করে, তার উপর নির্ভর করে সু বা কু। একজনের কাছে কোনো বিশেষ রাগ সু বা কু হতে পারে। একই দৃশ্য দেখে সবাই সমানভাবে মোহিত নাও হতে পারে। কারও কাছে রজনীগন্ধার চেয়ে গোলাপের গন্ধ বেশি ভালো লাগে। মিষ্টির চেয়ে কেউ ঝালকে বেশি পছন্দ করতে পারে। সাধারণভাবে যা ভাল লাগে তা এক ধরনের স্বস্তি। আর তীব্রতর স্বস্তি-বোধ থেকে জন্ম নেয় আনন্দ। প্রবহমান আনন্দের ধারায় অনুভূতি যে রূপ পায়, তার সামগ্রিক আনন্দের ধারায় জন্ম নেয় সৌন্দর্য।
এমনি মানুষের মনের ভিতর যে রাগ, হিংসা, স্নেহ, মমতা ইত্যাদি রয়েছে, আমরা তার বহির্প্রকাশ দেখি মাত্র। তার রূপটা ধরা পুরোপুরি ধরা পরে না। রাগের বশে যে অন্যের মাথায় বাড়ি দেয়, সেটাও তার রাগের অংশ মাত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে, বাংলাদেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ যেভাবে ঘৃণা করে, তার প্রকাশ কি যথাযথভাবে পাওয়া যায়। আমাদের অনেক ভাবনাই আমাদের বোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই তার সবটুকু যথাযথভাবে প্রকাশিত হয় না।
মানুষের মনের ভিতরে অন্য জগতের সৃষ্টি হতে পারে। কল্পজগতের লীলাভূমিতে আনন্দ-বেদনার জোয়ার-ভাটা যদি চলে, তাহলে সেখানে সৌন্দর্য তৈরি হবে নিজের তৈরি কল্পসত্যে। অনেকে আছেন নিজের তৈরি এই কল্পসত্যে বুঁদ হয়ে থাকেন। কোনো কোনো গুণীজন সে কল্পসত্যকে গল্পে, গানে, ছবিতে তুলে আনেন। তখন তাঁর কল্পসত্যের সৌন্দর্যে অন্য মানুষ মোহিত হয়।
ইন্দ্রিয়বাহিত বা দেহাভ্যন্তরীণ অনুভূতির সূত্রে যে সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা হয়, তা ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতির কারণে পার্থক্য গড়ে তোলে। দেখা, শোনা, স্বাদ গ্রহণ করা, স্পর্শ লাভ করা, ঘ্রাণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের উপস্থাপনকে ভিন্নভাবে গ্রহণ করে। ছবির সৌন্দর্য কখনোই সঙ্গীতের মতো নয়। আবার একাধিক ইন্দ্রিয়গ্রাহী অনুভূতি মিশ্র সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ সঙ্গীতসহযোগে নৃত্য পরিবেশনা। কিম্বা একটি সুগন্ধী বৈঠকখানা। এই মিশ্র সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় রসভঙ্গ হয়। প্রায়ই আমরা নৃত্যানুষ্ঠানে সঙ্গীতের তারিফ করি কিন্তু নাচের করি না। বা নাচের অংশটিকে ভালো বলি, গানের অংশকে ভালো বলি না। প্রকৃতির কোনো নান্দনিক রূপ দেখে যখন বিমুগ্ধ, তখন পচাগলা কোনো গন্ধ তার রসভঙ্গ করে। অতি প্রিয়গান প্রিয়জনের মৃত্যুতে বেদনার সৃষ্টি করতে পারে। সৌন্দর্য থাকাটাই সৌন্দর্য উপভোগের একমাত্র তার শর্ত নয়। এর সাথে দরকার উপযুক্ত পরিবেশও। এই পরিবেশ শুধু পারিপার্শ্বিক অবস্থাই নয়। মনের অবস্থাও মনের পরিবেশকে বলা হয় মেজাজ। কারণ মনের মেজাজ যে দশায় থাকে, তা কোনো পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
কোনো উপস্থাপিত বিষয় থেকে যেমন সৌন্দর্য সৃষ্টি হতে পারে, তেমনি সৌন্দর্যও পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্যকলায় এর অভিজ্ঞতা পাই। একটি করুণ সুর মানুষের মনকে আর্দ্র করে। নাটকের বেদনার দৃশ্য দেখে চোখে জল আসে। প্রকৃতিতে এমনটা রয়েছে। কুৎসিত এবং সুন্দরের সহাবস্থান। জঙ্গলে পচাগলা প্রাণীদেহের পাশে একটি অপূর্ব ফুল ফুটে আছে। উভয়ের সহাবস্থান মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু তারপরেও ফুল সুন্দর বলেও ভিন্ন পরিবেশেও সুন্দর। শুধু পরিবেশগত কারণে আরও সুন্দর হয়ে উঠে নি। কিন্তু এমন তো হ্য়ই, হঠাৎ কোনো গান শুনে হঠাৎ মনটা ভালো হয়ে যায়।
যেভাবেই হোক, যত ভাবেই হোক, সৌন্দর্যের একটি শাশ্বত রূপ আছে। সে রূপ আছে বলেই মানুষ বিচিত্ররূপের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারে। এই রূপ গ্রহণ বা ধারণ করার ক্ষমতা আছে বলেই মানুষ সুন্দরকে উপলব্ধি করতে পারে। সে কারণে বলা হয়ে থাকে, 'আমি' কোনো রূপকে সুন্দর বলে বলেই সুন্দর, 'আমি' তুলনা করতে পারে বলেই পরম সুন্দরের সন্ধান করে। আর পরম সুন্দরের অনুসন্ধানই হলো নন্দনতত্ত্বের লক্ষ্য।
©somewhere in net ltd.