নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

জুল ভার্ন

এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস... খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে... কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়। আমার অদক্ষ কলমে... যদি পারো ভালোবেসো তাকে... ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে, যে অকারণে লিখেছিল মানব শ্রাবণের ধারা.... অঝোর শ্রাবণে।।

জুল ভার্ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলার প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী...

২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:০৪

বাংলার প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী...

ময়মনসিংহ গীতিকা প্রকৃতপক্ষে একক কোনো কাহিনী নির্ভর বই না। 'ময়মনসিংহ গীতিকা' হচ্ছে কবিতা বা গানের সংকলন, যা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের মুখেমুখে প্রাচীন কাল থেকে ভিন্নভিন্ন ঘটনা/কাহিনী নির্ভর ভিন্ন ভিন্ন কবিদের রচিত এবং পালাগান হিসাবে প্রচারিত হয়ে আসছে। ১৯২৩- ১৯৩২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সেইসব কবিতা, গান সংগ্রহ করেন চন্দ্রকুমার দে। চন্দ্রকুমার দে সংগৃহিত দশটি পালা গানের সমাহার হিসেবে 'ময়মনসিংহ গীতিকা' নামে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩৩ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করেন। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের 'ময়মনসিংহ গীতিকা' পড়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন পাবলিক লাইব্রেরীতে। 'ময়মনসিংহ গীতিকা'য় কবি চন্দ্রাবতী সম্পর্কে যৎসামান্য লেখা হয়েছে।

বেশ কয়েক বছর আগে সম্ভবত প্রথম আলো পত্রিকার সাহিত্য পাতায় একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম 'লোককবি চন্দ্রাবতী'র উপর। তখন থেকেই কবি চন্দ্রাবতী সম্পর্কে আরও জানতে তার সম্পর্কে লেখা বই খুঁজেছি। এবারের বই মেলায় খান ব্রাদার্স প্যাভিলিয়নে মাহবুবুল আলম এর লেখা “ময়মনসিংহ গীতিকা” নাম দেখে বইটি সংগ্রহ করেছি। অনেক বইয়ের মধ্যে সিরিয়াল মেন্টেন করে এই বই পড়তে শুরু করি সপ্তাহ আগে। এই বইয়ে একটা চ্যাপ্টার আছে- "বাংলার প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী"। সেই চ্যাপ্টার থেকেই খুব সংক্ষেপে চন্দ্রাবতী সম্পর্কে লিখেছিঃ-

কিশোরগঞ্জ জেলার ফুলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী ছোট্ট গ্রাম পাতুয়াইর। সেখানে টোল, মানে গুরুগৃহ খুলেছেন মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা, ষোড়শ শতকের বিখ্যাত কবি বাঙালি ব্রাহ্মণ দ্বিজবংশী দাস ভাট্টাচার্য। আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিজবংশী দাস ভট্টাচার্য এবং অঞ্জনা দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।

দ্বিজবংশী তার অন্যান্য সন্তানদের থেকেও চন্দ্রাবতীকে অধিক স্নেহ করেন, এর অন্যতম কারণ হলো চন্দ্রাবতীর কাব্যপ্রেম এবং যেকোনো বিষয়ে মুখেমুখে কাব্য রচনার গুনে মুগ্ধতায়। দ্বিজবংশীর একজন প্রিয় ছাত্র হলো জয়নন্দ চক্রবর্তী। পাতুয়াইর পার্শ্ববর্তী গ্রাম সুন্ধ্যায় তার বাড়ি। একদিন সকালে কিশোরী চন্দ্রাবতী পুকুরপাড়ে গিয়েছে পূজার ফুল তুলতে। জয়নন্দ সে সময় টোলে আসতে গিয়ে দেখতে পায় সুমিষ্ট কণ্ঠে এক নারী গান গাচ্ছে এবং ফুল তুলছে। কাব্যরসিক জয়নন্দ কিশোরীকে উদ্দেশ্য করে গেয়ে উঠে-

“চারকুইনা পুষ্করিণীর পাড়ে চম্পা নাগেশ্বর,
ডাল ভাইঙা পুষ্প তোল কে তুমি নাগর?”

এভাবেই পরিচয় হয় জয়নন্দ এবং চন্দ্রাবতীর। সেই যে পুষ্পবনে শিবপূজার ফুল তোলার সময় পরিচয়, তা পরিণত হয় গভীর প্রেমে। দু’জনে মুখে মুখে কতো পদ রচনা করে! এমনকি কবি দ্বিজবংশীর অনেক রচনায় তাদের দুজনের রচিত ছোট ছোট অনেক পদ স্থান পেতে থাকে। দেখতে দেখতে বালিকা চন্দ্রাবতী ষোড়শী হয়। জয়নন্দ চন্দ্রাবতীর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় গুরুর কাছে। দ্বিজবংশী খুশি মনে রাজি হয় এবং বিবাহের দিনও স্থির হয়।

তবে বিবাহের দিন ধার্য হওয়ার পরেই ঘটে অঘটন। একদিন পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী নদীতে গোসল করতে যাবার পথে জয়নন্দ দেখতে পায় স্থানীয় মুসলিম কাজীর মেয়ে আসমানীকে। তার অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে যায় জয়নন্দ। প্রেমে অন্ধ হয়ে কাব্যচর্চা এবং চন্দ্রাবতী থেকে মুখ ফিরিয়ে আনে সে। একের পর এক চিঠি পাঠাতে থাকে সে আসমানীকে। আসমানীর পিতা তা জানতে পারলে জয়নন্দকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করালেন। ধর্মান্তরিয় হয়ে জয়নন্দ হয়ে গেলো জয়নুল এবং আসমানীর সাথে মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেলো তার।

জয়নুল ও আসমানীর বিয়ের দিনটি হওয়ার কথা ছিলো জয়নন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিয়ের দিন! সেদিন সন্ধ্যাবেলায় চন্দ্রাবতী বধূ সেজে অপেক্ষায় ছিলো প্রিয় সখার। দ্বিজবংশী ভগ্ন হৃদয়ে কন্যাকে জয়নন্দের বিবাহের সংবাদ এনে দেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পরেন চন্দ্রাবতী।

“না কাঁদে, না হাসে চন্দ্রা নাহি কহে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।
জানিতে না দেয় কন্যা জ্বলি মরে মনে।”

এরপর শুরু হলো চন্দ্রাবতীর বিরহ-বিধুর জীবন। দ্বিজবংশী কন্যার শোকে বিচলিত হয়ে পাত্র খুঁজতে থাকেন কিন্তু চন্দ্রাবতী পিতার কাছে আর্জি করলেন- চিরকুমারী থাকার। কন্যার অনুরোধে দ্বিজবংশী তার কন্যার জন্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে বানিয়ে দেন এক শিব মন্দির। সেখানে চন্দ্রাবতী শুরু করেন তার নতুন জীবন। শিবের আরাধনা এবং কাব্যচর্চাই হলোই তার নতুন সঙ্গী। একে একে তিনি লিখতে থাকেন দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারাম, মলুয়া পদ্মপুরাণ প্রভৃতি কাব্যগীতি।

ইতিমধ্যে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর জয়নন্দ বুঝতে পারে, আসমানীর প্রতি তার টানটা ছিলো মোহ মাত্র। অনুতপ্ত জয়নন্দ ছুটে যান চন্দ্রাবতীর মন্দির প্রাঙ্গণে। কিন্তু হায়, বদ্ধ কপাট! জয়নন্দ চন্দ্রাবতীকে পত্র লিখে পাঠায়। পত্র পড়ে চন্দ্রাবতীর সংযম ও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। অশ্রুসিক্ত বদনে পিতার কাছে বিধান চাইলো সে। কন্যার মনের অস্থিরতা কমাতে দ্বিজবংশী তাকে রামায়ণ রচনার নির্দেশ দেন। জয়নন্দকে পত্রদ্বারা নিষেধ করে চন্দ্রাবতী শুরু করলেন রামায়ণ রচনা।

এক সন্ধ্যায় জয়নন্দ আবার রওনা দিলো চন্দ্রাবতীর মন্দিরে। মন্দিরের দ্বারে এসে কয়েকবার ডাকলো সে চন্দ্রাবতীকে। কিন্তু তপজপে নিবদ্ধ ধ্যানে নিমগ্ন চন্দ্রাবতী সে ডাক শুনতে পেলোনা। ব্যর্থ প্রেমিক জয়নন্দ তখন লালবর্ণের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দ্বারে চারছত্রের একটি পদে চন্দ্রাবতী ও ধরাধামকে চিরবিদায় জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। কিছু সময় পর চন্দ্রাবতী মন্দির পরিষ্কার করার জন্য কলসী করে জল আনতে ফুলেশ্বরী নদীতে গেলেন। সেখানে দেখতে পেলেন জয়নন্দের প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে।

“একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।
জলের ওপরে ভাসে জয়চন্দ্রের দেহ।
দেখিতে সুন্দর কুমার চাঁদের সমান।
ঢেউ-এর ওপরে ভাসে পুন্নুমাসীর চান।
আঁখিতে পলক নাহি! মুখে নাই সে বাণী।
পারেতে খাড়াইয়া দেখে উমেদা কামিনী।”

ছোটবেলার প্রেমিকের মৃত্যুশোক চন্দ্রাবতী নিতে পারলেন না, ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করলেন তিনিও। তখন তার বয়স পঞ্চাশ বছর।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি চন্দ্রাবতীর এ করুণ কাহিনি আজও থেকে গিয়েছে কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের স্মৃতি আর শ্রুতিতে কিংবদন্তিরূপে। চন্দ্রাবতীর মৃত্যুর পর কবি নয়নচাঁদ ঘোষ রচনা করেন ‘চন্দ্রাবতী’ পালা, যা পরবর্তীকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ময়মনসিংহ গীতিকায়। মধ্যযুগে যখন সাহিত্য মানেই ছিলো দেবদেবীনির্ভর রচনা, চন্দ্রাবতী সে সময় তাঁর ‘মলুয়া’ ও ‘দস্যু কেনারামের পালা’—এই দুই পালায় তুলে এনেছেন সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রতিবাদ আর বীরত্বের জয়গান। এছাড়াও কবি চন্দ্রাবতী তার রামায়ণে প্রচলিত কৃত্তিবাসী ‘রামায়ণ’–কাহিনীকে অনুসরণ করেননি, বরং সেখানে কাহিনি গড়ে উঠেছে সীতাকে কেন্দ্র করে। তাই রামায়ণ লিখতে গিয়ে রামকে সমালোচনা করতেও পিছপা হননি তিনি। চন্দ্রাবতীকৃত রামায়ণের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক নির্মমতা থেকে নিপীড়িত-অপমানিত সীতাকে পৃথিবী-প্রকৃতির বুকে টেনে নেওয়ার দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে। কবি চন্দ্রাবতীর ভাষায়:

‘বসুমতি কয়, মাগো আইস আমার কোলে
দুঃখিনী কন্যারে লয়্যাগো
আমি যাইব পাতালে
সুখে থাউক রাজা রামগো রাইজ্য প্রজা লয়্যা
আমার কন্যা সীতারে আমিগো
লয়্যা যাই চলিয়া
...
দুষ্ট লোকের কথা শুইনাগো কী কাম করিলা
জন্মের মতন রামগো সীতারে হারাইলা
চন্দ্রাবতী কাইন্দা কয়গো কাহারো দোষ নাই
কর্মফল সুখ–দুঃখগো দাতা
বিধাতা গোঁসাই।’

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:৩৬

রবিন.হুড বলেছেন: চন্দ্রাবতীর অমর কাব্য থেকে আমরা সু শিক্ষা গ্রহণ করবো ইনশাল্লাহ।

২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:০৩

জুল ভার্ন বলেছেন: দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে- আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে অভ্যস্ত নই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.