![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষ বলে কিছু একটা আছে এই পৃথিবীতে আমার মনে হয়।
নারী পুরুষ সমান, তাদের অধিকার অভিন্ন: এই হচ্ছে নারীবাদ। একে মনে হয় সরল, দিবালোকের মতো স্বচ্ছ, সত্য বলে; কিন্তু পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে মানা হয়নি এ-সরল সত্যটুকু। নারীবাদীরা মনে করেন মৌল যৌগ্যতায় কোনো পার্থক্য নেই নরনারীতে;নারী ও পুরুষের মূল পরিচয় তাদের স্ত্রী বা পুংলিঙ্গ নয়, তাদের মূল পরিচয় তারা মানুষ। মানুষের প্রকৃতি ও যোগ্যতা লিঙ্গ নিরপেক্ষ। কিন্তু পিতৃতন্ত্র এটা মানে নি। নারীমুক্তি তো বহু দূরের পথ। সম্প্রতি মার্ক্সীয় নারীবাদ কিছুটা ভিন্নরূপ নিয়েছে, যা ধ্রুপদী মার্ক্সীয়নারীবাদের সাথে যুক্ত করেছে কিছু নতুনত্ব। তারা মনে করেন "সাম্যবাদ-ই নারীমুক্তির পূর্বশর্ত, তবে সাম্যবাদ-ই যথেষ্ট নয়; কেননা সাম্যবাদী সমাজেও বিরাজ করতে পারে লিঙ্গবাদ। তাই নারীমুক্তির জন্য বদলে দিতে হবে সামাজিক সম্পর্কের সম্পূর্ণরূপটিকেই।
সাধারণত নারীবাদী উপন্যাসে যা ঘটে- নারী নিজের কণ্ঠস্বর নিয়ে পুরুষের সমাজে ঢুকে পড়ে। তাতে তাঁর যন্ত্রণা-ক্ষোভ-হতাশা-জেদ এক সর্বব্যপী তীব্রতা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। অধিকন্তু, নারীবাদী রচনার লক্ষ্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ক্রুটি দেখিয়ে দেয়া ওপিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আঘাত করা। পুরুষ কিভাবে নিজের ইচ্ছামতো নারীর ভাবমূর্তি গড়ে তোলার সহায়ক ছক তৈরি করে রেখেছে, নারীকে দিয়েছে ‘দেবী’ ও ‘দানবীর’ প্রতিকৃতি এবং তাকে বুদ্ধিবৃত্তির বাইরে রাখার ‘ব্যবস্থা ও কর্মকাণ্ড গুলো’পাঠকের সামনে তুলে ধরা হল :
* ভার্জিনিয়া উলফের ‘A ROOM OF One's OWN’ (1929) ।
* সিমোন দ্য বোভেয়ার ‘THE SECOND SEX’ (1949) ।
* ক্যাথরিন এম রার্জাসের ‘দি ট্রাবলসম হেল্পমেট’ (১৯৬৬)।
ইত্যাদি গ্রন্থে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতি এমন মনোভাবেরই পরিচয় মেলে।
নারী যে ‘লৈঙ্গিক’ রাজনীতির শিকার এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় সে নিজের কণ্ঠস্বর নিয়ে উচ্চকিত হতে পারে। আঘাত করতে পারে পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোকে। এইসব দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে নারীবাদী সাহিত্য।
নারীবাদী সাহিত্যের অনিবার্য প্রসঙ্গ দু’টি-
(১) লৈঙ্গিক রাজনীতি।
(২) কণ্ঠস্বরের স্বাতন্ত্র্য।
কেইট মিলেটরের ‘সেক্সুয়াল পলিটিক্স’ (১৯৬৯) গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায় ‘লৈঙ্গিক রাজনীতি’ নারীদের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমাদের নারীসমাজের অনেকেই সোচ্চার হয়েই নারী ও পুরুষের সমাধিকার ও সমসুযোগ প্রাপ্তির জন্য দাবী তুলেছেন। যারা এই চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সেচ্চার হবার মতো সাহস বা দ্রোহের প্রকাশ করতে অক্ষম, তারা সুনিশ্চিতভাবেই অন্তরেরঅন্তঃস্থলে তেমন আকাঙ্খা লালন করেন। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন তাদের কন্ঠ এমনভাবে চেপে ধরে আছে যে তাঁরা তাদের মনের এই আদম্য আকাঙ্খাকে প্রকাশ করতে অক্ষম। বরং এখনো অধিকতর যেসব চোখে পড়ছে খুব স্বাভাবিকভাবে যত্রতত্রতা হলো-
১. পুরুষের সমাজে ‘নারী’ সিদ্ধান্তের গুরুত্ব না থাকা
২. নারী হয়ে জন্মানোকে অভিশাপ হিসেবে দেখা
৩. নারীর নিরাপত্তা হীনতা জনিত উদ্বেগ
৪. সামাজিক, পারিবারিক, বৈষয়িক ও মানসিকভাবে নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখা
৫. নারীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে পুরুষের স্বার্থোদ্ধার
পরিবার নামের যে প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির বিকাশ ও জীবনযাপনের ক্ষুদ্র এলাকাটিতেও নারীর প্রতি পুরুষশাসিত সমাজের মনোভাব ও আচরণ উলঙ্গভাবে আছড়ে পড়েছে। শৈশব থেকেই পরিবার তাকে উপেক্ষা ও অসম্মানের কাজটি শুরু করে দেয় এবং প্রাপ্তবয়স্কঅবস্থাতেও তা অব্যাহত থাকে। সেখানে বাইরে তাঁর নিরাপত্তা অস্বাভাবিক নয়। অথচ সেই নিরাপত্তার জন্য নারীকে পুরুষের দারস্থ হতে হয়।
আমাদের সমাজের নারী অগ্রদূত বলতে বেগম রোকেয়ার কথাই উঠে আসে ও পর্যায়ক্রমে সুফিয়া কামাল। তবুও প্রশ্ন হলো রোকেয়ার জন্মের শতবর্ষ পরও আমাদের নারী সমাজে এই আদর্শ প্রতিফলন ঘটেছে কিনা যা আমরা আশা করি/করছি?
উত্তরে বলা যায়, আমাদের দেশে নারীশিক্ষার হার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে, অবরোধ প্রথা হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯০ থেকে দুজন নারী নেতা প্রায় পালাক্রমে সরকার প্রধান ও বিরোধী দলের নেতা হয়ে আসছেন। বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব পদ ও কর্মভার কয়েকজন মহিলা নেতার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদে কোন নারীকে আজ অব্দি আমরা পাই নি। এইসব তথ্যকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়, নারীসমাজের উন্নতি সাধনের পথ এরপরও কি মসৃণ হয়েছে?
পরিবারিক আইন বা Family Code প্রতিষ্ঠার কথায়- যে আইন দ্বারা সকল ধর্মের নাগরিকের জন্যই বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং উত্তরাধীকারীত্বের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একটি ব্যবস্থাই থাকবে। বাংলাদেশের নারীসমাজ ও নারীসংগঠনগুলোর বহুকালের এই দাবীটি এই উভয় নারী নেতা ক্রমান্বয়ে উপেক্ষা করে চলছেন। এই ব্যপারে প্রক্রিয়াশীল নাগরীকদের ভোটের সংখ্যার হিসেব যে তাদের নিকট অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে এমন ধারণা করা অযৌক্তিক নয়। এখানে আরো উল্লেখ্য, দুই দশকেরও অধিক কালের নারী নেতৃত্বের পরও আমাদের দেশে আজও গ্রামীণ সালিশে ধর্মীয় "ফতেয়া" দিয়ে এই একবিংশ শতাব্দিতেও নারীদের অত্যাচারিত ও উৎপীড়িত করা হচ্ছে। সমাজের নানা অবস্থানে নারী ও বালিকারাও নানা ধরণের যৌননির্যাতনের শিকার হয়ে অপমানের জ্বালায় আত্মঘাতী হচ্ছে। নারীমুক্তি সাধনের লক্ষ্য যোগ্য নারী নেতৃত্ব যে আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি সেকথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
সপ্তম শতকে টমাস হবস, আরো পরে জন লক, রুশো ও ইমান্যুয়েল কান্ট প্রমুখ একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা গড়ার স্বপ্নকে অবলম্বন করে মানবমুক্তির স্বপক্ষে যুক্তি দেখালেও তাদের পূর্ণ মতামত ব্যক্ত করতে অক্ষম ছিলেন। A Vindication of the Rights of Woman- এ সর্বপ্রথম নারীবাদীদের মতই সামগ্রিক অর্থে নারীর মানবাধিকারের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন ওলস্টোনক্রাফট।
তিনি নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য একটি ও একই মানদন্ড দাবী করেন, এবং 'নারীও যে মানুষ' এবং পুরুষের সমমানেরই মানুষ সেই সত্যিটি যৌক্তিকতার সাথেই বিবৃত করেন। তিনি বলেন, 'Truth can but have only one standard'.
অষ্টাদশ শতাব্দিতে প্রচলিত ও প্রায় সর্বজনগৃহীত নারীসমাজের অধিনস্ততার মতাদর্শ ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই Vindication টি একটি শক্তিশালী বিষ্ফোরন। নারীরা ঈশ্বর দ্বারা শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে নিন্মমানের হয়ে সৃষ্টি হয়েছে, এই ধর্মীয় ভাষ্যের মূল সূত্রটি তাদের মন ও মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে রাখায়, নারীশিক্ষাকে ঐ সীমার মধ্যে আবদ্ধ রেখে নারীকে পুরুষ অধীনস্থতার গন্ডির মধ্যেই যতটুকু অগ্রগতি সাধন সম্ভব সেই সম্বন্ধেই মতামত ছিলো প্রতিষ্ঠিত। ওলস্টোনক্রাফট এই মূল সূত্রটিকেইআক্রমণ করেন, এবং যে-সকল মনোভাব বা প্রবণতা এবং রীতি-নীতি নারীকে অধস্তন করে রাখার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছে সেগুলোকে পরিত্যাগ করে নারীবান্ধব এক নতুন সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করেই নারীমুক্তির সপক্ষে একটি স্থায়ী অবস্থান নেয়া সম্ভব বলেওতিনি মনে করেন। পুরুষের মনোরঞ্জন বা সেবা করে তার উপর একান্তভাবে নির্ভরশীলতাই নারীর একমাত্র কাম্য না হয়ে, মানুষ হিসেবে নিজস্ব মেধা ও কার্যক্ষমতার উন্নতিসাধন করার প্রতি যত্নশীল হওয়াই নারীর কর্তব্য এমন মতটি ব্যক্ত করতেও তিনিদ্বিধান্বিত হন নি। প্রতিটি নারীকে নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে সক্ষম করাই যথার্থ নারীশিক্ষার লক্ষ্য, এবং এই লক্ষ্যসাধনই নারীসমাজের সার্বিক অগ্রগতির পথে সহায়ক হতে পারে, এমনটিই তার বক্তব্য। তাঁর মতে নারীকে অধস্তন অবস্থানথেকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন এমনই একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করা এবং সমতাভিত্তিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমাজ কাঠামো সৃষ্টি করা। এই নতুন সমাজকাঠামোর ভিত্তি হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, যে চর্চার মাধ্যমে সকল সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকেপরিত্যাগ করে পথচলা সম্ভব হবে।
নারীর মানবাধিকার পূর্ণ প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি এটিই।
প্রতিটি নারীকে ধরিয়ে দিতে হবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের অমানুষিক গলদ। আর, অর্থহীনতা যে নারী ভাবমূর্তি তৈরি করতে চায় পুরুষের সমাজে, তার বিপ্রতীপে অবস্থান নিতে হবে। নিজের কণ্ঠ, ভাষা ও আচরণ নিয়ে ঢুকেপড়তে হবে পুরুষ কবলিত (যেখানে পুরুষ নিজের শাসন জোরদার করায় ব্যস্ত) পৃথিবীতে।
তথ্য ঋণঃ
১। নারী (হুমায়ূন আজাদ)
২। নারীমুক্তি বেগম রোকেয়া এবং অন্যান্য (হাসনা বেগম)
©somewhere in net ltd.