![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো বাংলা সাহিত্য ডালপালা বিস্তার করে এখন বটবৃক্ষে রূপ নিয়েছে।যদিও দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্য মাত্র দুশ বছরে বৈচিত্র্যের পথে পা বাড়িয়েছে। সাহিত্য যেমন নানা শাখায় ভাগ হয়ে গেছে, তেমনি এর পাঠকশ্রেণিও নানা ভাগে বিভক্ত।বৌদ্ধ সহজিয়াদের চর্যাপদ থেকে যে সাহিত্যের যাত্রা শুরু, দীর্ঘকাল তা পদ্যসাহিত্যেই থিতু হয়ে ছিল। ঊনবিংশ শতক থেকে প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণ সাহিত্য, গল্প, নাটক, প্রহসন, রম্যরচনা, রূপকথা এবং অবশেষে একবিংশ শতকে এসে গোয়েন্দা কাহিনি, সায়েন্স ফিকশনে তার বিস্তৃতি ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যের সুপ্রাচীন ধারা কাব্যসাহিত্যের নির্মিত নতুন ধারা তো থাকছেই। এ অবস্থায় পাঠকগণ ইচ্ছেমতো বেছে নিতে শুরু করেন তার পাঠ্য বই।তার পড়ার রুচিতে আসে বৈচিত্র্য।যিনি প্রবন্ধ পছন্দ করেন, তিনি প্রবন্ধ পড়তে পারছেন, যিনি উপন্যাস কিংবা গল্প পছন্দ করেন, তিনি তা পড়তে পারছেন।সাহিত্যের শাখা-প্রশাখা সৃষ্টির পাশাপাশি এর পাঠকসংখ্যা বেড়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু কোন জাতীয় বইয়ের পাঠক বেড়েছে, সেটা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পাঠকরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।বাংলা সাহিত্যে লেখক-লেখিকা কেন্দ্রিক পাঠকশ্রেণিও তৈরি হয়েছে। বলা চলে, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র দিয়েই এই প্রবণতার সূচনা।তাঁদের সময়েই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে পক্ষ-বিপক্ষ পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হতে শুরু করে।যিনি রবীন্দ্রনাথ পড়েন, তিনি নজরুলে মজা পান না, যিনি নজরুল পড়েন তিনি শরৎচন্দ্রে আনন্দ পান না। এভাবে সাহিত্যের বিষয়-শ্রেণি নিয়েও মতভেদের সূচনা তখন থেকেই।এর মধ্যে নতুন একটি প্রশ্ন পাঠকের সামনে হাজির হয়, সেটি হলো কোনধারার সাহিত্য পাঠ পাঠকের পক্ষে উপযোগী? ভাববাদী সাহিত্য, ধ্রুপদী ধারার সাহিত্য, জনপ্রিয় ধারার সাহিত্য, গণমুখী সাহিত্য, ইসলামি সাহিত্য, কোনটি? এমনি নানা ভাগে বিভক্ত পাঠকরা।কিন্তু এরই মধ্যে পাঠকের পাঠাভ্যাস, রুচি, মেধা-মনন, পাঠকের শ্রেণি নির্দিষ্ট হতে থাকে। একালের পাঠকশ্রেণি তাদের রুচি-মনন-শ্রেণি অনুযায়ী উল্লিখিত কয়েকটি ধারায় আলাদা হযে গেছেন।তবে পাঠকশ্রেণি গড়ে ওঠার প্রবণতা জাতিগত প্রজ্ঞা তৈরিতে কতটুকু অবদান রাখছে তা মূল্যায়নের দাবি রাখে। পাঠকের রুচিবোধ, মননস্তর ইত্যাদি গড়ে ওঠার পেছনে সমকালীন রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক প্রবণতা ইত্যাদি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আমাদের পাঠপ্রবণতা ব্রিটিশ আমলে একরকম ছিল, পাকিস্তান আমলে আরেকরকম, আবার বাংলাদেশ আমলে উভয়আমলের সংমিশ্রণ, জাতিসত্ত্বার মতোই অনেকটা সঙ্কর উপায়ে আমাদের মানস গঠিত হয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সময়ে বাংলা সাহিত্য পাঠকদের পাঠ প্রবণতা কী! সাধারণভাবে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একধরনের পাঠপ্রবণতা, যারা বিশ্ববিদ্যালয় পড়েন না তাদের একধরনের পাঠপ্রবণতা, আবার ইসলামিক ধারার ছাত্র-ছাত্রী ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পাঠ প্রবণতা। বাংলা একাডেমির বইমেলার পাঠকদের শ্রেণি পর্য্ বেক্ষণ করলে আরেক ধরনের পাঠপ্রবণতা লক্ষ করা যায়। এদের মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে যারা পড়ালেখা করেন, তাদের বাইরে খুব কম পাঠকই আছেন, যারা হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, সায়েন্স ফিকশনে জাফর ইকবালসহ বহুল প্রচারিত সাহিত্যিকের বাইরে এসে সাহিত্য পাঠে মনোনিবেশ করেন।গণমাধ্যমে যারা যত বেশি পরিচিত, যিনি তার সাহিত্যকে যত বেশি পরিবেশন করতে সক্ষম, তাদের সাহিত্য পড়ার প্রতি পাঠকদের ঝোঁকটাও তত বেশি।আর গণমাধ্যমও তাদের কাছেই যায়, যারা সাহিত্যকে বাজারজাত করতে পারঙ্গম, যারা সাহিত্যের মানের থেকেও প্রচারমুখিনতায় এগিয়ে থাকেন। এখানে পরিশ্রমী পাঠকের সংখ্যা খুবই কম। একটু ঘেঁটে-ঘুঁটে জেনে-শুনে বই কিংবা সাহিত্য পড়বার পাঠক খুব বেশি নয়। সাহিত্যের সমঝদার রুচিশীল পাঠক এদেশে খুব বেশি গড়ে ওঠে নি।
এই সময়ের বাংলা সাহি্ত্য স্রষ্টাদের মধ্যে কিছু নাম উল্লেখ করা যায়, যাদের প্রত্যেকের কমবেশি আলাদা আলাদা পাঠকশ্রেণি রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বাজারমুখি সাহিত্যের কদরই বেশি। যেহেতু পাঠকরা গ্রন্থ বাছাই ও জ্ঞান অন্বেষণে খুববেশি পরিশ্রমী নন।একালে আমাদের সামনে শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, সেলিনা হোসেন, সুনীল, শীর্ষেন্দু কিংবা জাফর ইকবাল যেমন আছেন, তেমনি মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, আলাউদ্দীন আল আজাদ, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখও আছেন। সেলিম আল দীন, সৈয়দ শামসুল হকদের মতো নাট্যকারও আছেন।আমরা চাইলেই পড়তে পারি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, যতীন সরকার, আনিসুজ্জামান, হায়াৎ মামুদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, দ্বিজেন শর্মা, ড. ইনামুল হকের লেখা। এর বাইরেও অনেক সাহিত্যিক আছেন। কিন্তু ঘুরেফিরে আমরা পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বহুল চর্চিত কয়েকজন লেখকের মধ্যেই সীমিত থাকি।কোনো যুগের সাহিত্যিকদের নাম উচ্চারণ করা এবং নাম ধরে পাঠকশ্রেণি নির্দিষ্ট করা হয়তো কঠিন কাজ এবং বিতর্কিত কাজও বটে। তারপরও আমাদের সাহিত্য পাঠের ভুবনে এমনি একধরনের প্রবণতা যা সাহিত্যের পাঠকশ্রেণির মধ্যে বিদ্যমান, তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগই বা কোথায়! এবিষয়ে দায়িত্বহীনতার ফাঁক গলিয়ে একটি জাতির সাহিত্যপাঠের রুচির উর্ধ্বগমন বা নিম্নগমন সংঘটিত হতে পারে। জাতিগত বিনির্মাণের ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত ধারার অনু্প্রবেশ ঘটতে পারে।সস্তা ধারার সাহিত্য কিংবা দর্শনের ব্যাপক সংক্রমণ ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রকাঠামোর মাধ্যমে গোটা জাতির পাঠপ্রবণতাকে প্রণোদিত করবার নানা উপায় আছে। যার সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং তার প্রবণতাসমূহ। এখানে বিশেষ কোনো আগ্রাসন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো রাজনীতির বাস্তবয়ন, সস্তা কোনো প্রবণতার বাণিজ্যিক অনুপ্রবেশ ঘটছে কিনা তা তলিয়ে দেখবার অনেক পথই খোলা আছে।এবার সেই পথ অনুসন্ধানও আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
দেশের সবশেষ আলোচিত ঘটনা নতুন প্রজন্মের একটা অংশের মধ্যে জঙ্গি মানস কাঠামো তৈরি হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত যারাই ধরা পড়ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কাছে একধরনের ইসলামি জেহাদি ঘরানার কিছু বই-পুস্তক পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে জঙ্গি কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ জোগায়, দেশীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য বিমুখ কোনো মানসগঠনচেষ্টা আছে কিনা, ধর্মীয় উগ্রবাদ সাহিত্য-সংস্কৃতির মধ্যেও ঢুকে পড়েছে কিনা তা গভীরভাবে অভিনিবেশসহ লক্ষ করার প্রয়োজন রয়েছে। অথচ সেই ধরনের চেষ্টা কর্তৃপক্ষের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না।
বাংলা একাডেমির বইমেলায় বইবিক্রির প্রবণতা থেকে আমাদের পাঠকশ্রেণির ঝোঁকটা কোথায়, কোনদিকে তার একটা অনুমানভিত্তিক মূল্যায়ন হতে পারে! একইসঙ্গে সাহিত্য কিংবা অন্যযোকোনো পুস্তক পাঠে গোপনীয় কোনো প্রচেষ্টা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। যার সঙ্গে আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতির বিস্তর সাজুয্য রয়েছে।
©somewhere in net ltd.