![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নগরীর খালগুলো মানব দেহের শিরা-উপশিরার সঙ্গে তুলনীয়। শিরা-উপশিরা বন্ধ হয়ে গেলে যেমন মানবদেহ অচল হয়ে যায়, তেমনি একটা নগরী বা জনপদের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে নগরীটিও অচল হয়ে যেতে বাধ্য। দেশের রাজধানীশহর ঢাকার হয়েছে ঠিক তেমনি এক দশা। এর অভ্যন্তরভাগে প্রবহমান খালগুলো দখল আর ভরাটের কবলে পড়ে এখন প্রায় নাভিশ্বাস পরিস্থিতি।
এক সময় ঢাকা ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত। যার মূলে ছিল শহরের অভ্যন্তরে বয়ে চলা এইসব খাল। যেগুলি নগরীর চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতালক্ষা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এই প্রাকৃতিক সুবিধাই মুঘলদের ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে আকর্ষণ করে। এই খালগুলো দিয়ে শহরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করা যেত। স্বাভাবিক কারণেই পরবর্তী সময়ে এই এলাকায় নৌপথের মাধ্যমেই মালামাল পরিবহন ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটতে থাকে। সেই সময়ের যোগাযোগ প্রধানত নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উপরই নির্ভরশীল ছিল। ঢাকা শহরের খাল দিয়ে নৌকা, স্টিমারযোগে এর অলিগলিতে চলাচল করা যেত। ওই সময় রাজধানীতে কোনো জলাবদ্ধতা ছিল না, পরিবেশ ছিল স্বাস্থ্যসম্মত। অর্ধশত বছরের ব্যবধানে খালগুলো দখল-ভরাটে অর্ধেকের বেশি হারিয়ে গেছে। ফলে তীব্র জলজট, জলাবদ্ধতা এবং চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে রাজধানীর সড়কগুলোয়।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, একসময় রাজধানীতে ৪৭টি খালের অস্তিত্ব ছিল। সেখানে বর্তমানে আছে ২৭টির অস্তিত্ব। খালের এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। অবিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের ২০০৮ সালের এক জরিপে বলা হয়, রাজধানীতে একসময় ৪৪টি খাল ছিল। যার মধ্যে ৩৫টি খাল শুকিয়ে গেছে। অনেক খাল ভরাট করে সড়ক, ড্রেনেজ লাইন করে ফেলা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা এবং ঢাকা জেলা প্রশাসনের যৌথ জরিপের তথ্যমতে, খালের সংখ্যা ৪৩। বর্তমানে ২৬টি খাল আছে, তাও শুধু তালিকায় আছে, বাস্তবে নেই। তার মধ্যে আবার ১৩টি খালের প্রস্থ ১০ ফুটের বেশি নয়। সেগুলোরও কোনো না কোনো অংশ অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। দখলদাররা খালের ওপর যেসব অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণ করেছে, তার মধ্যে আছে-বহুতল পাকা ভবন, আধাপাকা ঘর, কাঁচাঘর, টঙঘর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সীমানা দেয়াল, দোকান, ওয়ার্কশপ, মাছের ঘের, রাস্তা, করাতকল, আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, পলিথিন কারখানা, রিকশার গ্যারেজ, ট্যানারি, বেকারি, আবাসিক ভবন ইত্যাদি।
স্বাধীনতার পর রাজধানী ঢাকার খাল উদ্ধারের তৎপরতা শুরু হয় । কিন্তু গত ৩৯ বছরেও তা সফল হয়নি; বরং খালের পরিধি কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ। জানা যায়, ষাটের দশকে ঢাকা শহরে খাল ছিল ২৫০ কিলোমিটার। বর্তমানে প্রবহমান খাল আছে ৭০ কিলোমিটার। তাও ভরাট-দখলে ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আগে একটি খালের সঙ্গে আরেকটি খালের সংযোগ ছিল। নগরীর উত্তর ও পশ্চিমে তুরাগ, দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা ও পূর্বে বালু নদীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল। এ খালগুলোকে ঢাকার নৌ-পথ বলা হতো। যেসব খাল ঢাকা শহরে ছিল, সেগুলোর মধ্যে রায়ের বাজার খাল, গোপীবাগ খাল, জিরানী খাল, সাতারকুল খাল ও পরীবাগ খাল্-এগুলো ভরাট করে সড়ক তৈরি করা হয়েছে। এসব খাল আর কোনোদিনই উদ্ধার করা সম্ভব নয় বলে নগরবাসী অনেকেরই ধারণা। এছাড়া ঢাকার বেদখলকৃত খালের মধ্যে রয়েছে- মান্ডা খাল, মেরাদিয়া খাল, নন্দিপাড়া খাল, কসাইবাড়ি খাল, হাজারীবাগ ও বাইশটোকি খাল, মাদারটেক ত্রিমোহনী খাল, বাসাবো খাল, বেগুনবাড়ি খাল, সেগুনবাগিচা খাল, মহাখালী খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, আবদুল্লাহপুর খাল, কল্যাণপুর খাল, গোপীবাগ খাল, ঝিগাতলা-শুক্রাবাদ খাল। সূত্রাপুর-লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার-আবদুল্লাহপুর থেকে তুরাগ, উত্তরখান হয়ে তুরাগ, মোহাম্মদপুরের বছিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, খিলক্ষেত ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা পর্যন্ত খালের অস্তিত্ব বর্তমানে প্রায় বিলীন। জানা গেছে, গুলশান, বনানী, বাউনিয়া, দিয়াবাড়ী, কাঁটাসুর, ইব্রাহিমপুর, কল্যাণপুর, শাহজাহানপুর খাল নামমাত্র টিকে থাকলেও সেগুলো ভূমিদস্যুদের থাবায় সংকুচিত হয়ে আসছে। রামপুরা-মেরাদিয়া খালও ভূমিদস্যুদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত।
পরিবেশবিদরা বলছেন, রাজধানীর খালগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে নিচ্ছে। ওয়াসা খাল উদ্ধারে স্থায়ী কোনো সমাধান করতে পারছে না। খালের পাড়ে হাঁটার রাস্তা নির্মাণ। দু’পাড় পাকা করা। খাল খনন। এ কাজ গুলো না করলে তো খাল উদ্ধার সম্ভব নয়। তাঁরা মনে করেন, প্রায় দেড় কোটি মানুষের এ শহরকে রক্ষা করতে দখলদারদের হাত থেকে খালগুলো পুনর্দখলের কোনও বিকল্প নেই। খালগুলো প্রভাবশালীদের দ্বারা দখল অথবা আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রায় ১০ কিলোমিটার জায়গা পরিণত হয়েছে কংক্রিট বক্সে।
ঢাকা ওয়াসার বক্তব্য, বিগত দিনে নগরীর খাল উদ্ধারে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সত্যিকারার্থে কোনো খাল উদ্ধার করা হয়নি। তবে বর্তমান সরকার সুদূর পরিকল্পনা নিয়ে খাল উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা ১৩টি খালের মালিক আরও ১৩টি মালিকানায় নেয়ার চেষ্টা চলছে। জীবিত খালগুলো আমাদের দখলে নিয়ে প্রথমে কাটব। দু’ধারে হাঁটার পথ তৈরি করা হবে। গাছ লাগানো হবে। খালের দু’পাড় পাকা করা হবে।
সর্বোপরি, ঢাকাবাসী মনে করে, খালগুলো অচিরেই উদ্ধারে জোর অভিযান পরিচালনা করা হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবকটি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে নিশ্চয়ই ঢাকার রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া আবারও শুরু হবে। সেইসঙ্গে রাজধানীবাসীর নাভিশ্বাস দশাও কাটতে শুরু করবে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সহযোগিতা নিয়ে তৈরি
©somewhere in net ltd.