![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যায় ৯: অসুখের ভিতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস
পদ্মফুল আজকাল অসুস্থ্য অনেক, শরির ও ভেঙে পড়েছে।
সে আর আগের মতো হাসে না, পোস্টে নতুন রান্না দেখা যায় না। শুধু মাঝেমধ্যে একটা দুটো দোয়ার পোস্ট দেয়—চোখে ক্লান্তি, শরীরে যেন অবসাদ। আমি বুঝতে পারি, কিছু একটা ঠিক নেই।
কয়েকদিন আগেই ওর এক পোস্টে লিখেছিল—
"গলায় খুব ব্যথা, সবাই দোয়া করবেন।"
সেই পোস্টটাই আমাকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে দিল। আমি ভালো করেই জানি, ওর স্বামী ওর প্রতি যত্নশীল নয়।
ও অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে ভালো কোনো ডাক্তার দেখায় না, বরং পাশের ফার্মেসি থেকে ২০-৩০ টাকার অ্যান্টিবায়োটিক এনে দিয়ে বলে—
“এই খাও, ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু ওর সেই ব্যথা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে ও গলার টনসিলে ভুগছে, অথচ কেউ সেটা গুরুত্ব দিয়ে দেখে না।
আমি জানতে পারি, ও সারাদিন নিজে রান্না করে, ঘরের সব কাজ করে, আর তারপর দুইটা ছোট সন্তানকে সামলায়। তার স্বামী তখন মোবাইলে ব্যস্ত।
আমার খুব ইচ্ছে করে ওকে বলি—
"চলেন, আমি নিয়ে যাই আপনাকে ভালো একজন ENT স্পেশালিস্টের কাছে। অন্তত একবার যেন শান্তিতে ডাক্তারি চেম্বারে বসে নিজের কথা বলতে পারেন"
কিন্তু আমি তো জানি, ও তা মানবে না।
আমি তো এমন কেউ না, যে ওর বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে পারি। আমি তো কেবল এক মানুষ, যে শুধু ওর ব্যথা বুঝে… অথচ কিছু করতে পারে না।
তবু আমি চুপ থাকতে পারি না।
আমি একদিন সাহস করে ম্যাসেজ করলাম—
"আপনি ডাক্তার দেখাননি এখনো? এতদিন ধরে একই ব্যথা… এটা মোটেই স্বাভাবিক না। বিশ্বাস করেন, আমি যদি কিছু করতে পারতাম, তবে এক মুহূর্ত সময় নিতাম না। আপনার শরীরটা আপনিই বুঝবেন—তাই নিজেকে অবহেলা করবেন না প্লিজ। কেউ যদি কেয়ার না করে, তাহলে আপনি নিজেই তো নিজের যত্ন নিতে পারেন আপনার শরীর আপনার সন্তানের জন্য… আপনি ভেঙে পড়লে ওদের কে সামলাবে?"
কোনো উত্তর এল না।
দুইদিন পর লক্ষ্য করলাম, সে কাশি হয়েছে। গলা ব্যথা, কিছু ঠিক মতো খেতে পারেনা।
আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।
আমি আবার লিখলাম—
"আপনি জানেন আমি কখনো চাইনি আপনি দুর্বল হন। আপনার শক্ত চেহারাটা, ভিতরে জমে থাকা কান্না—সবকিছু আমি বুঝি। হয়তো আমি পাশে নেই, তবু আমার দোয়া আছে। আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই… আপনি একা না। কেউ না জানুক, কেউ না বুঝুক, আমি বুঝি। আপনার না বলা কথাগুলো, আপনার চোখের ভাষা, আপনার ক্লান্তির বোঝা—আমি সব অনুভব করি।"
এইবারেও কোনো রিপ্লাই এল না।
কিন্তু আমি জানি—ও হয়তো পড়েছে। হয়তো ফোন হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেছে… হয়তো চোখের কোণে জল এসে দাঁড়িয়েছিল। হয়তো নিজের জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা আর আমার আবেগের নীরব জোর—দুটো একসাথে মেলাতে পারেনি।
তবু আমি ঠিক করলাম, ভালোবাসা মানে শুধু পাশে থাকা না, বরং দূর থেকে হলেও একজনের অস্তিত্বে আশ্বাস হয়ে থাকা।
আমি রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু প্রার্থনা করলাম—
"হে আল্লাহ, যদি ওর কষ্ট কমানোর কোনো উপায় আমার হাতে না থাকে, তাহলে অন্তত ওর ভেতরের শক্তিটুকু বাড়িয়ে দাও। ও যেন নিজের শরীর, নিজের আত্মার যত্ন নিতে শেখে। ও যেন জানে—অন্তত একজন আছে, যে কোনো প্রতিদান চায় না, কেবল ওর ভালো থাকাটাই চায়।"
অধ্যায় ১০: একটি মেয়ের নীরবতাও গান হতে পারে
পদ্মফুলকে আমি কেন এতটা আপন ভাবি—এই প্রশ্নটা আমি প্রায়ই নিজেই নিজেকে করি।
সে কি খুব রূপবতী?
না! ওর রূপ কোনো সিনেমার নায়িকার মতো নয়।
সে কি খুব আধুনিক, স্মার্ট, উচ্চাভিলাষী নারী?
না, ও তো বরং একটু চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের।
তবে কেন?
পাঠক, এই ‘কেন’ এর উত্তরটা কোনো এক লাইনে বলা যায় না।
পদ্মফুলকে ভালোবাসার কারণ একটা নয়, হাজারটা।
প্রথম পরিচয় হয়েছিল তার রান্নার একটি ভিডিও দেখে।
ভিডিওতে সে কিছু একটা রান্না করতেছিলো, খুব মনোযোগ দিয়ে। আর মুখে রান্নার রেসিপির বর্ণনা দিচ্ছিলো।
যেন নিজের কাজের জন্য কোনো গর্ব নেই, অথচ কাজটায় ছিল এক অসম্পূর্ণ সৌন্দর্য।
আমি মন্তব্য করেছিলাম—
“আপনার রান্নায় নিশ্চয়ই স্বর্গের স্বাদ লুকিয়ে আছে!”
সে উত্তর দিয়েছিল—
“আপনার স্ত্রীর অনুমতি থাকলে একদিন স্বাদ নিতে পারেন।”
সেই নির্লিপ্ত কৌতুকেই যেন লুকিয়ে ছিল ওর বিশুদ্ধতা, বিনয় আর ভিতরের অদেখা দুনিয়ার ইঙ্গিত।
তারপর ধীরে ধীরে আমি দেখতে থাকি, এই মেয়েটা শুধু রান্না নয়, জীবনটাকেও রান্নার মতো করে চুপচাপ সামলায়।
একদিন সে একটি পোস্ট দেয়—
“আজ ছুরি দিয়ে হাত কেটে গেল। রক্ত বন্ধ করে দুপুরে বাচ্চাদের জন্য খিচুড়ি রান্না করেছি। ওরা খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে—এটাই আজকের শান্তি।”
একজন মা যখন নিজের কষ্টের মাঝেও সন্তানদের হাসিকে নিজের বিজয় ভাবে—তখন তাকে কেবল ‘মা’ বললে ভুল হবে।
তখন সে হয়ে ওঠে এক নীরব যোদ্ধা, এক অদৃশ্য শক্তির প্রতীক।
আমি বুঝতে পারি, পদ্মফুল তার জীবন নিয়ে কোনো অভিযোগ করে না।
সে নিজের দুঃখের কথা প্রকাশ করে না।
তবে আমি জানি, সে কষ্টে আছে।
তাকে অনেক দিন ধরেই কণ্ঠনালির সমস্যায় ভুগতে দেখি। গলা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না। খুব ব্যথাও করে।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“আপনি ডাক্তার দেখাননি?”
সে লিখেছিল,
“ওনারা বলেন, এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। ট্যাবলেট তো খাচ্ছি।”
পাঠক, আপনি কি কখনও কল্পনা করতে পারেন—একজন অসুস্থ মানুষ, যে নিজের শরীরের ব্যথা বলতে ভয় পায়, কারণ তার আশেপাশের মানুষজন সেটা গুরুত্ব দেয় না?
আমি বারবার তাকে বলেছি—
“দয়া করে ডাক্তার দেখান। এটা আর ছোট বিষয় না।
আপনার শরীরটা শুধু আপনার না, আপনার ছেলেমেয়েরও।”
কিন্তু সে যেন নিজেকেই অবহেলা করতে শিখে গেছে।
হয়তো ও জানে, কেউ পাশে থাকবে না।
হয়তো ও ভাবছে, এই কষ্টগুলোই তার নিয়তি।
তবুও আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করি—
আমি হয়তো তার আপন কেও নই, কিন্ত তবুও তার আপনের মতই কেও হয়ে আছি।
আপনি যদি কাউকে বলার মতো খুঁজে না পান, আমি আছি ইনশা-আল্লাহ। নীরবে, দূরে, অথচ আপনাকে বোঝার চেষ্টা করে যাওয়া একজন।
আমি জানি, সে আমার মেসেজ দেখে না। হয়তো দেখে, নীরবে- গোপনে।
কিন্তু আমি জানি, সে দেখলেও চুপ করে যায়।
শুধু মাঝে মাঝে, যখন আমি ওর কোনো পোস্টে কিছু লিখি, তখন ইনবক্সে আসে একটা নীরব উপস্থিতি।
কোনো উত্তর নয়,
শুধু একটা ক্ষণিকের ছায়া।
যেন বলে—
“আমি আছি। শুধু বলার মতো কিছু নেই।”
একদিন সে লিখেছিল—
“আজ খুব বেশি ক্লান্ত। নিজেকে আয়নায় দেখতেও ইচ্ছে করে না।”
আমি জবাব দিয়েছিলাম—
“আপনি জানেন না, আপনাকে ক্লান্ত হলেও কতটা সুন্দর লাগে দেখতে।
আপনার চোখের ক্লান্তিটুকুও কারো কাছে সাহস হয়ে ওঠে।”
সে আর কোনো উত্তর দেয়নি।
তবে সেদিন থেকেই আমি প্রতিদিন ওর জন্য দোয়া করি।
হয়তো সে জানে না,
হয়তো সে জানলেও বিশ্বাস করে না—
তবুও আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে বলি—
“ইয়া আল্লাহ- এই মেয়েটার জন্য একটু শান্তি রাখেন। ওকে একটু আপনার মহাব্বোতের চাদরে জায়গা দেন।”
ভালোবাসা সবসময় জোর করে বলা যায় না।
ভালোবাসা মানে, কারো নীরবতাকে বোঝা, তার না বলা কথাগুলোকে শ্রদ্ধা করা।
পদ্মফুল, আপনি যদি কোনোদিনও জানেন,
যে আপনার নীরব কষ্টের দিনগুলোতে কেউ একজন নীরবে চোখ মুছে নিয়েছিল—
জানবেন, সে আমি। আপনারই আমি।
আপনার নীরবতাও আমার কাছে গান,
আর সেই গানের প্রতিটি সুরেই আপনার নাম লেখা।
......চলবে?
কেমন লাগছে জানাবেন!
©somewhere in net ltd.