নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি বিপুল শেখ, গাইবান্ধার সাইনদহ থেকে। পেশায় কম্পিউটার অপারেটর। প্রযুক্তি, এক্সেল ও ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি বিষয়ে আগ্রহী। “Tech Bristy” ইউটিউব চ্যানেলের নির্মাতা ও “পদ্ম কাহিনি” গল্পের লেখক।\n\n

বিপুল শেখ

লেখক

বিপুল শেখ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভুলের পাপ - বিপুল শেখ

২৩ শে জুন, ২০২৫ বিকাল ৫:৩২

ময়মনসিংহের সেই আলাদা পৃথিবী
( ভুলের পাপ )
লেখকঃ বিপুল শেখ
শহরের কোনো এক কোনে! যেখানের রাতের আলো গুলাও ফ্যাকেসে দেখায়। সেখানেই টিকে আছে এক ভিন্ন পৃথিবী। সেই পৃথিবীর আনাচে-কানাচে মিশে থাকে অনেক অনেক কষ্ট, কিছু অদম্য স্বপ্ন আর অসংখ্য হারানোর বেদনা এবং নির্যাতন যন্ত্রণা। এখানেই বাস করে মাহী আর সুমী, দু’জন নারী। যারা একই ছাদের নিচে থেকেও যেন আলাদা ব্যক্তিত্ত। এই আঁধার পথে তাদের আসার কারণটা আলাদা, কিন্তু ভেতরের যন্ত্রণাটা, সে তো বড় চেনা। দুজনেরই যন্ত্রণা একই।
মাহী, পাবাইলের সেই চঞ্চল মেয়েটা, যাকে দেখলে মনে হতো খুবই ফুরফুরে আর দুষ্টিমিতে ভরা। পড়ালেখা তার কাছে ছিল এক বড্ড অপছন্দের বোঝা। বই-খাতার চেয়েও তার আকর্ষণ ছিল পাড়ার মোড়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকা আর স্বাধীনভাবে জীবন কাটানো। ক্লাস নাইন পাশ করেই সে পড়াশোনা ছেড়েছিল, কারণ লেখাপড়া তার খুব একটা মনে ধরত না। তার জগৎ ছিল রূপকথার মতো, যেখানে পরিশ্রম ছাড়াই সব পাওয়া যায়। প্রেম-ভালোবাসা নিয়েও তার ধারণা ছিল বেশ ফুরফুরে। স্কুলের ক্লাসেরই একটা ছেলে একদিন তাকে ভালোবাসার কথা জানালো। মাহি সেগুলো পাত্তা না দিয়ে নিজের মত করেই চলতে থাকলো। তবে, মাঝে মধ্যে ছেলেদের সাথে একটু আধটু মিশে ঝাল-মুড়ি, ফুচকা-চটপটি খেতো। মাহি জানতো না, জীবনের সবচেয়ে বড় খেলাটা তার জন্য অপেক্ষা করছে সামনে।

মাহির পরিবারের অনেক অভাব ছিল, বাবা-মা দিনরাত খেটেখুটেও দু'বেলা দু'মুঠো মুখে তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। মাহী এই দৃশ্য দেখে বড় হয়েছে, কিন্তু সমাধানের পথ তার জানা ছিল না। সে শুধু চাইত, যেকোনো উপায়ে এই অভাব থেকে মুক্তি, একটা ঝলমলে জীবন। ঠিক তখনই তার জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দিল এক আনএক্সপেক্টেড ঘটনা।
একদিন মাহীর সাথে দেখা হলো তার পুরনো এক বান্ধবীর, যে ময়মনসিংহ থাকে। বান্ধবীকে দেখে মাহীর চোখ কপালে! হাতে দামি মোবাইল, ঝলমলে মেকআপ, গায়ে ঝলমলে দামি পোশাক আর কানে-গলায় চকচকে গয়না—বান্ধবীকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো ফিল্মের নায়িকা। মাহী বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে জানতে চাইলো, “কিরে, তুই ময়মনসিংহে কী এমন চাকরি করিস যে এত টাকা?” মাহীর চোখের কৌতূহল বান্ধবী এড়াতে পারলো না। ফিসফিস করে সব সত্যিটা বললো, "আমি আসলে ময়মনসিংহের একটা পতিতালয়ে থাকি, আর জানিস, এখান থেকে আমার রোজগার হয় প্রচুর। দিনেই যা আয় হয়, তা দিয়ে তোর গ্রামের মাসের খরচ চলে যাবে।" এই কথা শুনে মাহীর মনে এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা জাগলো না, উল্টো একটা ভিন্ন আকর্ষণ অনুভব করলো। গ্রামের অভাবী জীবনের টানাপোড়েন, বাবা-মায়ের অসহায় মুখ আর নিজের চঞ্চল মনের রঙিন স্বপ্ন—সবকিছু মিলেমিশে মাহীকে যেন টেনে নিয়ে গেল সেদিকে। দ্রুত টাকা উপার্জনের নেশা তার চোখে তখন ঝিকমিক করছে। সে ভাবলো, এটা তো মন্দ নয়! সহজ পথ, আর হাতে আসবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এই পেশাকে সে শুধু টাকা উপার্জনের একটা মাধ্যম হিসেবেই দেখছিল, আবেগ বা অনুশোচনার কোনো স্থান ছিল না তার মনে—তখনো। পরিবারকে ময়মনসিংহে গার্মেন্টসে চাকরির মিথ্যা কথা বলে, মাহী বান্ধবীর হাত ধরে এক অজানা গন্তব্যের দিকে রওনা দিল। তার মনে তখন এক অদ্ভুত চিন্তাভাবনা, যেন সে কোনো কঠিন জীবনের চাল চেলেছে, যেখানে শুধু জয়ী হওয়াটাই আসল।


অন্যদিকে, সুমীর গল্পটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম, তার মনটা ছিল ভালোবাসার রঙে রাঙানো। সে পাগলের মতো ভালোবাসতো জয়কে, আর জয়ও যেন তাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। জয়ের মিষ্টি কথায় আর অভিনয়ে সুমী এতটাই মুগ্ধ ছিল যে, অন্য কিছু তার চোখে পড়তো না। জয় সুমীর জন্য এমন সব পাগলামি করত, যা দেখে সুমীর মন গলে জল হয়ে যেত। সুমীর পছন্দের যাবতীয় জিনিস সে উপহার দিত, ছোট ছোট সারপ্রাইজ দিয়ে সুমীকে আনন্দে ভাসিয়ে রাখত। এমনকি, একবার তো সুমীর ভাইয়ের হাতে মারও খেয়েছিল শুধুমাত্র সুমীর জন্য। জয়ের এই গভীর ভালোবাসা আর ত্যাগের অভিনয় সুমীর কিশোরী মনকে খুব করে বেঁধে ফেলেছিল। সে তখন মাত্র ১৫ বছরের এক নিষ্পাপ কিশোরী, ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। সুমী জানতো না, এই ভালোবাসাই তার জীবনে নিয়ে আসবে এক ঘোর অন্ধকার।
দুই বছর ধরে তাদের প্রেম চলছিল। সুমী তখন শুধু জয়ের নামের মালা জপ্তো, স্বপ্ন দেখতো জয়ের সাথে ঘর বাঁধার, ভালোবাসাময় এক সুখের সংসারের। বাবা-মায়ের বারণ, সমাজের চোখরাঙানি, সব কিছুই তার কাছে মূল্যহীন ছিল। একদিন জয় সুমীকে বোঝালো, "আমার পরিবার কিছুতেই তোমাকে মানবে না, ওরা আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে দেবে। চলো আমরা পালিয়ে ঢাকা চলে যাই। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, মরে যাব!" জয়ের এই আকুতি, এই অভিনয় সুমীর কিশোরী মনকে আরও বেশি দুর্বল করে দিল। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে সুমী এক মুহূর্তও না ভেবে রাজি হয়ে গেল। ভালোবাসার মানুষটার সাথে নতুন জীবনের আশায়, সে সব ছেড়ে জয়ের হাত ধরে অচেনা ঢাকার দিকে রওনা দিল। তার চোখে তখন শুধু নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন, জয়ের হাতের উষ্ণ স্পর্শ আর হৃদয়ে এক বুক অনাবিল আনন্দ ভালোবাসা।
ঢাকায় এসে জয় সুমীকে নিয়ে একটা আবাসিক হোটেলে উঠলো। সে রাতটা ছিল সুমীর জীবনে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির রাত – ভালোবাসা, ভয়, উত্তেজনা আর এক অজানা ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সুমী তখনো ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, তার জন্য কী ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে। সেই রাতটি ছিল সুমীর জীবনের শেষ 'সাধারণ' রাত।
ওইদিকে মাহী যখন ময়মনসিংহের সেই নির্দিষ্ট বাড়িতে এসে পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বাইরে তখনও শহরের পরিচিত কোলাহল, কিন্তু এই বাড়ির ভেতরে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। বান্ধবী তাকে একটা ছোট ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা তেমন বড় না হলেও বেশ পরিপাটি, দেওয়ালে হালকা রঙের ফুল আঁকা। মাহী চারপাশে তাকালো, মনের কোণে তখনো কল্পনার রঙ লেগে আছে। সে ভাবছে, এই ঘরে বসেই টাকা আসবে, আর সব অভাব দূর হবে। তার চোখে তখনো নতুন জীবনের রঙিন স্বপ্ন।
বান্ধবী তাকে বুঝিয়ে দিল, "এখানে সবকিছু নিজের মতো চলে না। একজন সর্দারনী আছেন, তিনিই সব দেখাশোনা করেন।" এরপরই পরিচয় হলো সেই সর্দারনীর সাথে। বছর চল্লিশের মতো বয়স, চোখের দৃষ্টিতে এক তীক্ষ্ণতা, মুখে এক ধরনের কঠোরতা। সর্দারনী মাহীকে দেখেই যেন এক পলকে মেপে নিল। তার চোখে মাহীর চঞ্চলতা ধরা পড়লো, হয়তো তার মনের ভেতরের সরলতাকেও সে আঁচ করতে পারলো। সর্দারনী ঠান্ডা গলায় বলল, "এসব কাজ অত সোজা না। মন শক্ত রাখতে হবে। যা বলবো, তাই করতে হবে।" মাহী মাথা নাড়লো, তার মনে তখনো টাকার নেশা। সে ভাবছে, এইটুকুই তো, আমি তো টাকা কামাতে এসেছি। কষ্ট হোক বা না হোক, কিছুদিনের মধ্যেই তো আমি আবার নিজের সাধারণ জীবনে ফিরে যাবো, একটা সুন্দর সংসার গড়বো। সর্দারনীর কথার গভীরে সে ঢুকতে পারলো না।
প্রথম দিনগুলো মাহীর কাছে ছিল এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। নতুন মুখ, নতুন পরিবেশ। সে দেখলো, এখানে আরও অনেক মেয়ে আছে, কেউ তার চেয়ে ছোট, কেউ বা বড়। তাদের চোখে সে দেখলো ভিন্ন ভিন্ন গল্প, কারো চোখে ক্লান্তি, কারো চোখে হতাশা, আবার কারো কারো চোখে এক ধরনের ঘ্রীনা। তারা প্রত্যেকেই যেন ভিন্ন ভিন্ন নদী, যারা এসে মিশেছে এই এক অজানা সমুদ্রে। মাহীকে সাজিয়ে দেওয়া হলো, চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। আয়নায় নিজেকে দেখে মাহী প্রথমে একটু চমকে উঠলো, এটা সে নিজে? তার সেই চঞ্চল, ফুরফুরে মেয়েটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তার মনে তখনো একটাই ভাবনা—এসবই টাকা পাওয়ার জন্য। নিজেকে সে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিল, এটাই তার 'কাজ', এর বাইরে আর কিছু নয়। প্রথম খদ্দেরের সাথে দেখা হওয়ার মুহূর্তটা মাহীর জীবনে এক নতুন মোড় নিল, সে নিজেকে জোর করে বোঝালো, "এটা শুধু একটা লেনদেন, আর কিছু নয়।" কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা কাঁটা যেন বিঁধে গেল, যা হয়তো সে সারা জীবন বহন করবে।

সুমীর ঘুম ভাঙলো এক তীব্র ব্যথায়। তার শরীরজুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা, মনে এক গভীর শূন্যতা। চোখ খুলতেই দেখলো—সে একটা অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ঘরে একা একা শুয়ে আছে। জয়ের উষ্ণ স্পর্শ, জয়ের প্রতিশ্রুতি, সব যেন এক নিমেষে মিথ্যে হয়ে গেল। এই ঘরটা তার চেনা হোটেলের ঘর নয়। আতঙ্কিত হয়ে সে উঠে বসলো, চারপাশটা ভালোভাবে দেখলো। ঘরের কোণে কয়েকটা অচেনা মুখ, তারা সুমীর দিকে তাকিয়ে হাসছে। সেই হাসিটা সুমীর কাছে বীভৎস মনে হলো। তার বুঝতে বাকি রইল না—সে কোথায় আছে। এই নরকটা সম্পর্কে সে আগেও শুনেছিল, কিন্তু কখনো ভাবেনি যে তার জীবনে এমন কিছু ঘটবে।
তার প্রথম ভাবনা ছিল মা-বাবার কথা। অবাধ্য হয়ে, ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ওপর ভর করে সে বাড়ি ছেড়েছিল। এখন কীভাবে তাদের মুখ দেখাবে? নিজেকেই সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করতে লাগলো সুমী। কেন সে জয়ের মিষ্টি কথায় বিশ্বাস করলো? কেন সে এত বোকা ছিল? নিজের প্রতি এক তীব্র ঘৃণা আর অসহায়ত্ব তাকে ঘিরে ধরলো। তার পুরো শরীর তখন কাঁপছে। সে চিৎকার করে উঠলো, "জয়! জয় কোথায়?" কিন্তু তার চিৎকারে কেউ সাড়া দিল না, শুধু সেই অচেনা মুখগুলো আরও বীভৎস হাসি হাসলো।
খানিক বাদেই একজন মহিলা ঘরে ঢুকলেন, যার চোখগুলো সর্দারনীর মতো তীক্ষ্ণ আর নিষ্ঠুর। তার হাতে একটা মোটা লাঠি। মহিলাটি সুমীর দিকে একটা নোংরা হাসি দিয়ে বললেন, "জয় এখন তোর মালিক না। এখন আমি তোর মালিক। আর এখানে জয় নামের কেউ নাই। জয়রা শুধু মেয়ে সাপ্লাই দেয়, বিনিময়ে টাকা পায়।" এই কথাগুলো যেন সুমীর বুকে শেলের মতো বিঁধলো। সে বুঝতে পারলো, জয়ের ভালোবাসা ছিল কেবলই এক ব্যবসার ফাঁদ। জয় শুধু সুমীর সাথে নয়, আরও অনেক মেয়ের সাথে এমন নির্মম প্রতারণা করেছে। সুমীর হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তার কিশোরী মনে তখন শুধু ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। কিন্তু তার অসহায় অবস্থা তাকে কিছু করার সুযোগ দিচ্ছিল না। সে কাঁদতে লাগলো, কিন্তু তার চোখের জলের কোনো মূল্য ছিল না এই অন্ধকার জগতে। জয় নাকি তাকে মাত্র ২০ হাজার টাকায় সুমিকে বিক্রি করে দিছে, এই নরক পতিতালয়ে।
এদিকে প্রথম কয়েকটা দিন মাহীর কাছে সবকিছুই কেমন যেন অচেনা লাগছিল। প্রতিদিন নিয়ম করে সাজা, অচেনা পুরুষদের সাথে কাটানো সময়—এসব তার ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি করছিল। শুরুতে সে নিজেকে বোঝাত, "এটা শুধু একটা কাজ, আর কিছুই না।" কিন্তু এই 'কাজ' তাকে দিনে দিনে কেমন যেন অন্য একজন মানুষে পরিণত করছিল। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে মাহী চমকে উঠতো। সেই পাবাইলের চঞ্চল, ফুরফুরে মেয়েটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তার চোখে এখন এক ধরনের কাঠিন্য, মুখে এক ক্লান্তির ছাপ। টাকার জন্য সে এসেছিল, টাকা আসছিলও বটে। কিন্তু সেই টাকা যেন তার আত্মার ওপর এক ভারী বোঝা হয়ে চেপে বসছিল।
সর্দারনী তাকে কঠোরভাবে পরিচালনা করত। ক্লায়েন্ট বাছাইয়ে মাহীর নিজের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। সর্দারনী যখন যাকে খুশি পাঠাতো। মাহীর ভেতরের চঞ্চলতা ধীরে ধীরে নিভে আসছিল। অন্য মেয়েদের সাথে মিশে সে আরও অনেক গল্প শুনতো—কারো প্রতারিত হওয়ার গল্প, কারো অভাবের তাড়নায় স্বেচ্ছায় আসার কাহিনী। এই মেয়েগুলোর চোখে সে নিজেকেই দেখতে পেত। তাদের ক্লান্তি, তাদের হতাশা, আর কিছু মেয়ের চোখে এক ধরনের গভীর ঘৃণা মাহীর ভেতরেও ছড়িয়ে যেতে লাগল। সে বুঝতে পারছিল, এই পথ থেকে মুক্তি পাওয়াটা যতটা সহজ ভেবেছিল, ততটা সহজ নয়। তার মনে তখনো একটাই স্বপ্ন—যথেষ্ট টাকা জমিয়ে একদিন এই অন্ধকার জগৎ ছেড়ে একটা স্বাভাবিক সংসার গড়া, অতীতকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়া। কিন্তু সেই স্বপ্নটা যেন দিনের পর দিন আরও ঘোলাটে হয়ে আসছিল। প্রতিটি নতুন খদ্দেরের পর তার মনে বাড়ছিল এক নতুন কাঁটা, যা তাকে তিলে তিলে বিঁধে যাচ্ছিল।
মাহী নিজেকে সান্ত্বনা দিত, সে তো সুমীর মতো অসহায় নয়। সে নিজের ইচ্ছায় এসেছে। এইটুকু স্বাধীনতা তার আছে। কিন্তু সর্দারনীর কঠোর নিয়ম, আর এই জগতের অলিখিত বন্ধন তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এখানে ইচ্ছা বলে কিছু হয় না। এখানে একবার এলে, সহজে বের হওয়া যায় না। মাহীর মনে এখন টাকার লোভের চেয়েও বেশি কাজ করছিল নিজের স্বপ্নের প্রতি দায়বদ্ধতা। সে জানতো, তাকে এই নরক থেকে বের হতেই হবে, যেকোনো মূল্যে।

সুমী ততদিনে প্রায় অর্ধমৃত। জয়ের দেওয়া আঘাত তার শরীরে আর মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। মাত্র পনেরো বছরের মেয়েটা যেন কয়েক মাসের মধ্যেই চল্লিশ বছরের বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছে। সে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়াও করেনা। তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে প্রায়। শরীরটা কেবল কঙ্কালসার। বাবা-মায়ের জন্য তার প্রাণ ছিঁড়ে যেত, কেন সে এত অবুঝ ছিল? কেন সে জয়ের মিষ্টি কথায় বিশ্বাস করেছিল? নিজেকে অপরাধী মনে হতো তার সবসময়।
প্রথম ক'দিন সুমী পাগলের মতো পালানোর চেষ্টা করল। দরজা খুললেই সে ছুট লাগাতো, কিন্তু প্রতিবারই সর্দারনীর লোকজন তাকে ধরে ফেলত। প্রথমবার যখন পালাতে গিয়ে ধরা পড়লো, সর্দারনী তাকে এমন মার মারলো যে সুমীর শরীর থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। পিঠে, হাতে, পায়ে লাঠির আঘাতের চিহ্ন। সর্দারনী চিৎকার করে বলত, "পালাবি? তোর বাপ-মা তোরে ২০ হাজার টাকায় বেচছে। তোর কোনো ভবিষ্যৎ নাই। এইখানে আইছস, এইখানেই মরবি।" এই কথাগুলো সুমীর মনে এমন ভয় ঢুকিয়ে দিল যে, সে আর পালানোর সাহস পেত না। এরপরও দু'একবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ফল একই রকম। প্রতিবারই নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। সুমীর শরীরে এখন অসংখ্য জখমের দাগ, যা তাকে জয়ের দেওয়া প্রতারণা আর এই জীবনের ভয়াবহতার কথা মনে করিয়ে দেয়।
অসুস্থ হলেও সুমীকে খদ্দেরের কাছে যেতে বাধ্য করা হতো। সে প্রতিবাদ করলে সর্দারনী তার উপর আরও চড়াও হতো। সুমীর শরীর আর মন দুটোই ভেঙে গেছে। তার বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও নিভে গেছে। অন্য মেয়েরা তার প্রতি সহানুভূতি দেখাত। তাদের অনেকেই সুমীর মতো ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে এখানে এসেছে। তারা জানতো সুমীর কষ্টটা কতটা গভীর। কেউ কেউ লুকিয়ে তাকে খাবার দিত, মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, কিন্তু তাদের নিজেদেরই যে কোনো মুক্তির পথ নেই। সুমী এখন শুধু নিঃশ্বাস নেয়, কিন্তু বাঁচে না। তার মনে এখন একটাই আকাঙ্ক্ষা—মৃত্যু। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ তার কাছে কেবল মৃত্যুই মনে হতো।
মাহী তার ভেতরের কস্ট নিয়ে একাই লড়ে যাচ্ছিল। প্রতিদিনের রুটিন বাঁধা জীবন, অচেনা পুরুষদের ভিড়, আর সর্দারনীর কঠোর শাসন—এসবের মাঝে মাহী যেন নিজের অস্তিত্বই হারাতে বসেছিল। তার সেই চঞ্চলতা ধীরে ধীরে এক কাঠিন্যে পরিণত হয়েছে। মুখে মিত্যে হাসি থাকলেও চোখের গভীরে ছিল একরাশ ক্লান্তি আর অনুশোচনা। সে তো টাকা কামাতে এসেছিল, কিন্তু এই টাকার বিনিময়ে কী হারাচ্ছে, সেটা দিনে দিনে আরও স্পষ্ট হচ্ছিল তার কাছে। খুব মনে হচ্ছে টাকার নেশার কারণেই আজ সে এই অন্ধকার জগতে।
এই একঘেয়ে, দমবন্ধ করা জীবনের মাঝেই একদিন এক নতুন খদ্দের এলো মাহীর কাছে। তার নাম সুমন। অন্যসব খদ্দেরের মতো সুমনের চোখে কোনো লালসা ছিল না, ছিল এক অদ্ভুত মায়া। সুমন শুধু শরীর চায়নি, সে চেয়েছিল মাহীর সাথে কথা বলতে। প্রথমদিকে মাহী অবাক হয়েছিল, এমন খদ্দের তো সে কখনো দেখেনি। সুমন মাহীর সাথে খোশগল্প করতে শুরু করল। তার কথার মধ্যে ছিল এক ধরনের সহানুভূতি, যা মাহী এই জীবনে কখনো পায়নি। সুমন জিজ্ঞেস করল, "আপনি কি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছেন? আপনার কোনো স্বপ্ন নেই?" মাহী প্রথমে চুপ করে ছিল, তারপর আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল তার স্বপ্ন—যথেষ্ট টাকা জমিয়ে একদিন এই অন্ধকার জগৎ ছেড়ে একটা স্বাভাবিক সংসার গড়ার। সুমন মনোযোগ দিয়ে মাহীর কথা শুনলো, কোনো বিচার বা কৌতূহল ছাড়াই। সেইদিন সুমন শুধু কথা বলার জন্য মাহীকে বাড়তি অনেক টাকা দিয়েছিল।
সুমন যখন চলে গেল, মাহী তখনো অবাক হয়ে বসেছিল। এই সামান্য ঘটনাই যেন তার মনে এক চিলতে আলোর রেখা নিয়ে এলো। সুমনের চোখে সে এক অন্যরকম মানবিকতা দেখলো, যা তার ধূসর হয়ে আসা স্বপ্নের আগুনটাকে আরেকটু উসকে দিল। তার মনে হলো, হয়তো এই পৃথিবীতে এখনো কিছু মানুষ আছে যারা শুধু স্বার্থের কথা ভাবে না, মানুষের কষ্টটাও বোঝে। ঠিক যেমন বিপুল শেখের লেখা ‘পদ্ম কাহিনী’ গল্পটা। সুমনের এই ছোট্ট মানবিকতা মাহীর নিভে যাওয়া আশার প্রদীপে যেন নতুন করে সলতে যোগ করলো। সে ভাবলো, হয়তো তার মতো একজন মানুষেরও স্বাভাবিক ভালোবাসার অধিকার আছে, একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে। এই ঘটনা মাহীকে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা যোগাল।

অন্যদিকে সুমিরও সেই অন্ধকার আর হতাশার মাঝেও একদিন সুমীর জীবনে এক অপ্রত্যাশিত ছায়া এসে পড়ল। সে লক্ষ্য করল, একজন নতুন খদ্দের প্রায়ই আসে, কিন্তু অন্য কারো কাছে না গিয়ে শুধু তার জন্য অপেক্ষা করে। খদ্দেরের চোখে এক অদ্ভুত নীরবতা, যেন সে সুমীর সব কষ্ট অনুভব করছে। সুমী প্রথমে পাত্তা দিল না, হয়তো এটা তার আরেকটা ভুল। কিন্তু সেই খদ্দেরের দৃষ্টিতে ছিল এক গভীর মায়া, যা সুমীর ভেতরে এক সুপ্ত কৌতূহল জাগিয়ে তুলল। এই লোকটা কি জয়-এর মতো অন্য কোনো ফন্দি আঁটছে? নাকি এই অন্ধকারের মাঝেও কোনো আলোর রেখা লুকিয়ে আছে? সুমীর মনে তখনো ভয়, কিন্তু সেই সাথে এক ক্ষীণ আশা, যা সে নিজেও বুঝতে পারছিল না।
সেই অচেনা খদ্দেরটির নাম ছিল আশিক। আশিক অন্যসব পুরুষের মতো ছিল না। তার চোখে কোনো লালসা ছিল না, ছিল এক গভীর মানবিকতা। সুমীর কাছে আসার পর সে প্রথমে কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল, যেন সুমীর ভেতরের কষ্টগুলো অনুভব করার চেষ্টা করছে। তারপর শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, "তুমি কি এখানে খুশি? তোমার কি এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো স্বপ্ন নেই?" সুমীর ভাঙা মনে এই প্রশ্নগুলো ঢেউ তুলল। সে প্রথমে চমকে উঠলো। কেউ তো এমন কথা জিজ্ঞেস করে না! ভয়ে ভয়ে সুমী সব খুলে বলল। জয়ের প্রতারণা, তার বাবা-মায়ের কথা, বারবার পালানোর চেষ্টা আর সর্দারনীর অমানবিক নির্যাতনের কথা। তার প্রতিটি কথা যেন আশিকের মনে এক গভীর দাগ কাটছিল। আশিক মনোযোগ দিয়ে শুনলো, তার মুখে কোনো বিরক্তি ছিল না, ছিল শুধু সহানুভূতি।
আশিকের কাছে সুমীর এই অবস্থাটা এতটাই হৃদয়বিদারক লাগলো যে, সে সিদ্ধান্ত নিল—সুমীকে এই নরক থেকে মুক্ত করবেই। সে জানতো, এটা সহজ কাজ নয়। সর্দারনী সহজে সুমীকে ছাড়বে না। কিন্তু আশিক মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। পরদিন সকালে আশিক আবার এলো সেই পতিতালয়ে। এবার তার হাতে ছিল টাকার বান্ডিল। সে সরাসরি সর্দারনীর সাথে কথা বলল।
কেউ কল্পনাই করতে পারেনি এমনটা ঘটবে। আশিক কোনো দেনদরবার না করে, সর্দারনীকে অনেক অনেক টাকা দিল। এত টাকা যে, সর্দারনীও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না। যেন টাকার বানভাসি! সর্দারনী টাকার লোভে সব নীতি আর নিয়ম ভুলে গেল। সেই অন্ধকার জগতের সব নির্মম নিয়মকে উপেক্ষা করে, আশিক এক নিমিষেই সুমীকে মুক্তি দিল। সুমীর কাছেও এটা স্বপ্ন মনে হলো। সে প্রথমে ভেবেছিল এটা হয়তো আরেকটা নতুন প্রতারণা, হয়তো সে অন্য কোনো ফাঁদে পড়ছে। কিন্তু আশিকের চোখে ছিল দৃঢ়তা আর সত্যিকারের ভালোবাসা। সে যেন সুমীর হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসকেই ফিরে পেতে দিচ্ছে।
আশিক যখন সুমীর হাত ধরে সেই অন্ধকার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো, তখন সুমীর চোখে এক ঝলক বিস্ময় আর আশার আলো ফুটে উঠলো। বাইরে তখন ভোর হচ্ছে। ঢাকার আকাশে হালকা কমলা রঙের সূর্যের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। সুমী দেখলো, এই পৃথিবীতে এখনো কিছু মানুষ আছে যারা শুধু স্বার্থের কথা ভাবে না, মানুষের কষ্টও বোঝে। সেদিন সুমী জানলো, সব আশা হারিয়ে ফেললেও, জীবনে অপ্রত্যাশিতভাবে আলোর রেখা আসতে পারে। এটা হয়তো তার বাবা-মায়ের কাছে ফেরার পথ, হয়তো এক নতুন জীবনের শুরু।
মাহী তার ঘর থেকে জানালা দিয়ে দেখলো সুমীর চলে যাওয়া। তার চোখে তখন কী ছিল? হিংসা? নাকি নিজের জন্যেও এক টুকরো মুক্তির স্বপ্ন? কে জানে। তবে সুমীর এই মুক্তি হয়তো আরও অনেক সুমীর জন্য এক নতুন আশার জন্ম দেবে, যারা এই অন্ধকার জগতে আলোর স্বপ্ন দেখে। আর মাহীও হয়তো একদিন সুমনের মতো কারো কাছ থেকে পাবে সেই মানবিকতার স্পর্শ, যা তাকে তার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই পৃথিবীর কোনো এক কোণে, অন্ধকার পথের এই দুই পথিক হয়তো একদিন সত্যিই আলোর দেখা পাবে।
-বিপুল শেখ
২৩-০৬-২০২৫

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জুন, ২০২৫ সকাল ৮:৩৫

বিপুল শেখ বলেছেন: এটা একটা বাস্তব ধর্মী গল্প!

২| ২৪ শে জুন, ২০২৫ বিকাল ৪:০৬

সুলাইমান হোসেন বলেছেন: কিছুটা পড়ে, ভাবনায় ডুবে গেলাম।পৃথিবী অজানা এক ঘোর অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে।মাঝে মধ্যে মনে হয়,পৃথিবী যদি মানুষশুন্য থাকত,ফাঁকা থাকত তবেই ভালো ছিল। মাহীর মত কত হাজারো মেয়েরা নিজেদের জীবনকে ধ্বংস গহ্বরের অতলে ঠেলে দিচ্ছে তার খবর কে রাখে।পরিবারও এর কোনো খবর রাখেনা,পরিবারকে সহজেই ধোকা দিয়ে বোকা বানানো যায়।

২৪ শে জুন, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪২

বিপুল শেখ বলেছেন: জ্বি, ঠিকই বলেছেন। দেশে এরকম হাজারো মাহী আছে যারা নিজেই নিজের জীবনকে সেই অন্ধকার পৃথিবীতে লুকিয়ে রেখেছেন। এখন তারা ভিষন অনুতপ্ত, তারা খুব করে চায় যদি কোনো আশিক এসে তাদেরকেও উদ্ধার করে নিয়ে যেত এই গুন্ডি থেকে।
যদি তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারতো...
নোটঃ মাহীর আপডেট হচ্ছে, সেও সেখান থেকে বের হতে পেরেছে। এবং বর্তমানে সে পাবাইলেই আছে। আর তার পরিবার তাকে বিবাহ দেয়ার জন্য ছেলেও দেখছে।
কিন্ত প্রশ্ন থেকেই যায়, যেই ছেলেটা মাহীর মত এক পতিতাকে বিয়ে করবে তার জীবন..

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.