নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি বিপুল শেখ, গাইবান্ধার সাইনদহ থেকে। পেশায় কম্পিউটার অপারেটর। প্রযুক্তি, এক্সেল ও ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি বিষয়ে আগ্রহী। “Tech Bristy” ইউটিউব চ্যানেলের নির্মাতা ও “পদ্ম কাহিনি” গল্পের লেখক।\n\n

বিপুল শেখ

লেখক

বিপুল শেখ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শান্তি নেই মনে। (একটা জান্নাতি মানুষ)

১০ ই জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪

শান্তি নেই মনে। (একটা জান্নাতি মানুষ)
নাহ, কোথাও শান্তি নেই। কারো মনেই শান্তি নেই।
চলুন, আজকে আমার কেনো শান্তি নেই লিখে ফেলি। আমি রক্তে মাংসে গরা মানুষ। মাঝে মধ্যেই ভুল করে ফেলি, আর এই ভুলের কারণেই অনুতপ্ত হয়ে শান্তি হারিয়ে ফেলি। এইতো সব ভালই চলছিলো, হঠাত করেই কিযে হলো-
কে জানে? জড়িয়ে পরলাম বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে। ঘটা করে দিনকাল পার হচ্ছিলো। মনে প্রাণে ভরপুর শান্তি।
বিয়ে করেছিলাম একটা জান্নাতি মানুষকে।

আসলে জান্নাতি মানুষেরা সব সময় ন্যায়পরায়ন হয়। তারা সবার সাথে সব পরিবেশেই মিশতে পারে। খুব যত্ন করতে পারে স্বামীর এবং স্বামীর সাথে জড়িত মানুষদেরও। খুব ভাল মনের মানুষ হয় জান্নাতিরা। স্বামীর মনে কষ্ট আসতে পারে এমন কাজ থেকে সব সময়ই দূরে থেকে। স্বামীর বিপদে আপদে, ভালো মন্দ সবটা জুরেই তারা পাশে থাকে। বলছিলাম, কহিনুর পারভীন অর্থাৎ জান্নাতের আম্মুর কথা। আমার প্রথম স্ত্রী। আমার প্রথম প্রেম, আমার জান, প্রাণ, কলিজা।
আমার বাবা-মা কেও অনেক ভালোবাসতেন, যেনো তার নিজের বাবা মা।

কেনো জানিনা বার বার মনে হত- মানুষের জীবনে সুখ বেশি দিন টিকে থাকেনা। কহিনুর সব সময়ই আমার প্রিয় একজন বন্ধু ছিলো। যাকে চোখ বন্ধ করেও বিশ্বাস করা যায়। খুব বিশ্বাস। কি নেই সেই বিশ্বাসের গল্পের মধ্যে। তবুও কেনো জানি মেয়েটা কখনোই রাগ, অভিমান, ঘৃণা কিছুই দেখাতো না। আমি মেয়েটারে খুবই ভালোবাসতাম। নাম ধরেই ডাকতাম “কহিনুর” তার খুব মিষ্টি উত্তর আসতো “হ্যাঁ, যাই”। ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিলেই কেমন এক প্রশান্তি। থাকুকগে সেই সব কথা।

মেয়েটার মনটা খুবই নরম আর দয়ালু। কখনো মানুষকে দান করতে পিছুপা হাটেনা, কাওকে ফিরাতেও পারেনা, খুবই নিরুপায় হলেও পরে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতো। রাত যত গভীর হোক না কেনো, আমার তার হাতের সিঙারা, সমুচা, নুডুলস, কেক ইত্যাদি মাঝে মধ্যেই খেতে মন চাইতো। সেও রাতের তোয়াক্কা না করে- আমার আবদার পূরণ করতে মরিয়া হয়ে উঠতো। যেনো তার জন্মই হয়েছে আমার আবদার গুলো মেটানোর জন্যে।
বাচ্চা খুবই পছন্দ তার। যে কারো ছোট বাচ্চা দেখলেই, কোলে নিয়ে গাল দুটো টেনে দিতো। বিয়ের আগেই সে মাতৃতের স্বাধ পেয়েছে।

তার ভাইয়ের ছোট মেয়েটা- ঊর্মি। সে যেনো তার নিজের পেটে ধারণ করা মেয়ের মতই। ছোট বেলা থেকেই ঊর্মি কে সে আদর যত্ন করতো সব সময়। ঊর্মির খাবার খাওয়া থেকে শুরু করে, যাবতীয় দিক গুলো কহিনুর নিজে হাতেই যত্ন নিত। উর্মির মা, সেতো নাম মাত্র ছিলো। কহিনুরের সাথে আমার বিয়ের দিনই জানতে পারলাম, উর্মি সম্পর্কে। সেও কহিনুর কে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। ভাইয়ের ছেলেকে আদর যত্ন করে সে নিজের পেটে ধারণ করা জান্নাতের স্বাধ নিয়েছে। তার এই বাচ্চা প্রেমি মন দেখেই উপর ওয়ালার ইচ্ছায় হয়তো – তাসফিয়া জান্নাত দুনিয়ায় আসার জন্য প্রস্তিতি নিচ্ছিলো।

খুবই সুন্দর ছিলো সেই দিন গুলো। প্রথম যখন জানা গেলো তার প্রেগন্যান্সির কথা, খুশির অন্ত ছিলোনা আমার এবং কহিনুরের মনে। আমার কেনো জানি মেয়ে বাচ্চা খুব ই পছন্দের ছিলো। আমি সব সময়ই বলতাম মেয়ে হবার জন্য। সেও আমার ইচ্ছে দেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করতো, মেয়ে বাচ্চাই যেনো হয়। আমি মেয়ে বাচ্চা নিয়ে ফেসবুকে প্রচুর পরিমাণে লেখা লেখি করতাম। বাচ্চার কি নাম রাখা হবে, আব্বু নাকি বাবা, আম্মু নাকি মা, স্কুল নাকি মাদ্রাসা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে খুবই প্লান ছিলো। দিন যেতো রাত হতো ধীরে ধীরে তার কষ্ট বাড়তে থাকে। প্রেগন্যান্সির দিন গুলোতে যে কী রকম কষ্ট হতে পারে, তা খুবই কাছে থেকে দেখেছি। তবুও এই বাজে রকমের কষ্টের পরেও তার মুখে ছিলো একটা জান্নাতি হাসি। যেনো কোনো কষ্টই হচ্ছেনা, কিংবা শত কষ্টের পরেও পেটে থাকা বাচ্চাটা দুনিয়ায় এলেই তার শান্তি।

দেখতে দেখতে প্রায় আটটা মাস পার হলো, তার এই আটমাসেও নানা ধরনের কর্মকান্ড ছিলো। যা কিনা তার জান্নাতে যাবার তিন বছর পর এসে লিখছি। এই প্রেগন্যান্ট অবস্থায়ও খুব ভোরে উঠে রান্না বসাতো। ভাড়া বাড়িতে থাকি, এখানে রান্নার প্রতিযোগিতা চলে। যে আগে রান্না বসাবে সেই রান্না করতে পারবে, দেড়িতে ঘুম থেকে উঠলে চুলা পাওয়া যায় না। গোসলের বেলাতেও তাই। সে খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গরম পানি বসাতো। তখন ছিলো শিতকাল, তারপর গরম পানি হয়ে গেলে ভাত চাপিয়ে দিত। আর আমি তখনো ঘুমেই থাকতাম, এবং সে গোসলখানা’তে আমার জন্য বালতি, লুঙ্গি, গামছা রেখে এসে ডেকে দেয়। তার জন্য অনেক কষ্টের ছিলো দিন গুলো, আমি কিছুই বুঝতে চাইতাম না। অফিসে যাবার আগে- ভাত বেরে দিতো খাবার জন্য। খাবার খেয়ে আমি অফিসে চলে যেতাম, এবং ফিরে এসে দেখতাম সে রান্নাবান্না সব শেষ করে ফেলেছে এবং সেই সাথে ঘরের পুরো পরিবেশ গুছিয়ে পরিপাটি। প্রতিবেশিরা হিংসে করতো বলতো- বিপুল ভাজ্ঞ্য করে কহিনুরের মত একটা লক্ষি বউ পেয়েছে। আসলে তারা তো জানতো না, যে সে আসলে জান্নাতি মানুষ। আর জান্নাতিরা পরিপাটি, সুন্দর আর গোছালো মনেরই হয়।

আমার প্রতি ছিলো না তার কোন অভিযোগ, রাগ, অভিমান কিছুই না। হ্যাঁ মাঝে মধ্যে আমিই অভিমান করতাম, ছোট ছোট বিষয় নিয়ে খুব করে অভিমান করতাম। আর সে বাচ্চাদের মত নিষ্পাপ হয়ে যেতো, খুবই চেষ্টা করতো আমার অভিমান ভাঙানোর। দিন গুলো এখন খুবই মিস করি, কষ্ট দেয় অনেকটা। মাঝে মধ্যে মনে হয়, সে যদি আমার সাথে রাগ অভিমান করতো, ঝগরা করতো তাহলে হয়তো সেগুলোর কথা মনে এনেও ভুলে থাকা যেতো।

আটমাস পরে চলে এলো সেই দিনটা, আমার আব্বু এলো কহিনুর কে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। লিখতে গিয়েও বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে উঠছে। রান্না করতে জানিনা, বলে একজন মহিলাকে দায়িত্ব দিয়েছে। সে আমারে দিনে দুইবার রান্না করে দিবে। বুদ্ধি করে বাজার কি কি করা উচিত সবটা করে রেখে দিলো। ঘরদোর গুছিয়ে সব কিছু থেকে পরিপাটি করে শেষ বারের মত, আমার কপালে একটা চুমু একে বিদায় নিয়ে চলে গেলো এই এলাকা ছেরে বাড়ির উদ্দ্যেশে। দিন গুলো যে কি পরিমাণে মিস করতাম, তা লিখে বুঝানো যাবেনা।
প্রত্যেকদিন কথা হত নিয়ম করে করে। তার সমস্থ না বলা কথা গুলো জমিয়ে রাখতো, ফোন দিলেই জিজ্ঞেস করতো ‘কেমন আছো? খেয়েছো? শরীর কেমন এখন?” অথচ এগুলো আমার জিজ্ঞেস করার কথা ছিলো। আমাকে দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করতো সব সময়ই। খুব করে কান্না করতো, দিনের কোলাহল থেমে পাখিরাও যখন ঘুমিয়ে পরে। ঠিক তখন ফোন কানে নিয়ে ফিসফিস করে বলতো, প্লিজ একটা দিন চলে এসো… তোমায় না দেখে থাকতে পারছিনা। আমি খুবই মিস করি তোমায় সব সময়। আমি চাকরির ভয়ে বলতাম, ‘প্লিজ সোনা বোঝার চেষ্টা করো। গার্মেন্টস এর চাকুরি, হারাবার ভয় অনেক। ছুটি চাইলেও ছুটি মিলেনা।’ সে সবটা বুঝতো, খুবই বুদ্ধিমতি ছিলো।

যাইহোক খুব কষ্টের পর একদিন সরকারী ছুটি পেলাম সাথে সুক্রবার। তাকে না জানিয়ে গাড়িতে চেপে বাড়ির উদ্যেশে রওনা দিলাম। মাঝ রাস্তায় আমার শশুর ফোন দিয়ে বললো- বাবা, তুমি নাকি বাড়িতে আসতেছো? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি করে জানলেন? সে উত্তর দিলো- কহিনুর বলেছে। সেদিন বুঝলাম মনের টান কাকে বলে। যাইহোক, সেদিন শেষ বারের মত তার সাথে সাক্ষাত হলো। আমাকে পেয়ে সে কতটা খুশি হয়েছিলো, সেটা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।

আমার বিদায় বেলাতেও যতদুর সম্ভব এগিয়ে দিয়ে গেলো। স্মৃতির কোনে থাকবে দিনটা। যতদিন এই দেহে প্রাণ থাকবে, আর আমার ব্রেইন ঠিক থাকবে ততদিন সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারব না। রোজ আগের মতই নিয়ম করে চলতো কথা বলা, তার আমার প্রতি যত্নশীলতা। তারপরে চলে এলো সেই বীভৎস দিনটা, যেই দিনটার কথা মনে পড়লে আজও বুকের ভেতর টা দুমড়ে মুচরে ভেঙ্গে যায়। সকাল সকাল তার সাথে আমার কথা হলো, দিনটা ছিলো ২৭ মার্চ ২০২২ – রবিবার।

জানতে পারলাম তার পেটের ব্যথাটা ক্রমেই বেরে যাচ্ছে। এবং ডাক্তারের দেয়া তারিখের সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। আমি তখন গার্মেন্টসে কাজ করি। দুপুরের দিকে জানতে পারলাম কহিনুর পারভীন কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সাস্থ্যকর্মীর বাড়িতে। বুকের ভিতর তখন খুব ব্যথা হচ্ছিলো। খুব ইচ্ছে করছিলো তার সাথে কথা বলতে, কিন্ত সুযোগ মিলেনি। আমার শশুরের কাছে ফোন দিলাম কয়েকবার সে ইচ্ছে থাকা সত্যেও কথা বলিয়ে দিতে পারেনি। একপর্যায় শশুরের সাথে কিছুটা রাগারাগী করলাম। হয়তো বেয়াদবী করেছি, জানিনা ওনি আমায় কতটা মাফ করে দিয়েছেন। খুব কষ্ট হচ্ছিলো, আমার আপা তহামিনা ছিলো তখন কহিনুরের সাথে। আপার সাথে যোগাযোগ করেও, আমার কলিজার টুকরা কহিনুরের সাথে কথা বলতে পারিনি। সে তখন প্রসবের বেদনায় অচেতন। কাজে কিছুতেই মন দিতে পারছিলাম না। অবশেষে গার্মেন্টস ছুটির পর ফোন দিলাম। জানতে পারলাম, তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ‘মা ক্লিনিকে’।

আল্লাহ যেনো এই ক্লিনিকের সাথে জড়িত সকল মানুষদের দুনিয়ার উপর এবং নিচে উভয় জায়গাতেই কঠোর থেকে কঠোর তব বিচার করেন। আমিন। (তাদের কিছুটা অবহেলা ছিলো)

রাত তখন ১২ টার কিছুটা পরে, আমার কাছে ফোন আসলো ‘কহিনুরের নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না হওয়ায় সীজার করতে হয়েছে’ এবং আমার মেয়ে জান্নাত ভালো আছে। ফোন দিয়ে সংবাদ টা জানালো আমার জ্যাঠাতো সমন্দি সামিউল ভাই। আমি পাগলের মত জিজ্ঞেস করতে থাকলাম ‘ভাইয়া, কহিনুর কই। আমি পাগলিটারে একটু দেখতে চাই’ ভাইয়া বললো মোবাইলে এমবি নেই, কার্ড ভরাতে হবে। আমি পাগলের মত বার বার ফোন দিতেই থাকলাম। এবং প্রায় আধা ঘণ্টা পরে, আমাকে কহিনুরের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হলো। কিন্ত তার কোনো উত্তর ছিলো না। শুধু চোখ বন্ধ, আমি বার বার ‘এই কহিনুর এই পাগলি বলে বলে ডাকতেছিলাম।’ প্লিজ চোখটা খোলো বার বার বলায়, সে চোখটা মিললো। তবে শেষ বারের মত, দুচোখ দিয়ে আমার দিকে একটি বার তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করলো। কথা গুলো লিখতে গিয়ে অঝোরে চোখের পানি ঝরে যাচ্ছে।
আমাকে আর কথা বলার সুযোগ দেয়া হলো না। তার নাকি নিশ্বাঃস নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। তাই অক্সিজেন দেয়ার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো। এবং আমাকে জানানো হলো, আমি যেনো চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পড়ি। বোকার মত আমিও কোনো চিন্তা না করেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

খুব ভোরে আমার সমন্দি আবার ফোন দিলো-
- বিপুল ভাল আছো?
- ভাইয়া, আলহামদুলিল্লাহ। কহিনুর কেমন আছে, আমার মেয়ে কেমন আছে?
- ভালই আছে, তবে কহিনুরের একটু সমস্যা ওরে রংপুর নিয়ে গেছে। আমি বাড়িতে এলাম।

খানিক বাদেই আমার আব্বু কল দিলো, মনটা কেমন যেনো নারা দিলো। আব্বু ফোন দিয়ে খুব শান্ত ভাবে, কষ্ট চাপা রেখে বললো ‘বাবা, বাড়িতে আসো। কহিনুরের অবস্থা ভালো না। ওরে রংপুর নিয়ে যাচ্ছি। আমি বললাম, আব্বু আমার কাছে টাকা নেই। আসলে সেদিন বুঝেছিলাম, টাকার মূল্য কতটা। খুব কষ্ট করে, ১ হাজার টাকা ম্যানেজ করে গাড়িতে উঠলাম। কান্নায় ভেংগে পড়ছিলাম বার। মৃত্যু নয়, অসুস্থতার জন্য। আমি বার বার কহিনুরের সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম, আব্বু বার বার সেটা স্কিপ করে যাচ্ছিলো।

তারগাছ গাজিপুর এলাকায় থাকি। অটোতে করে, বাইপাস পর্যন্ত যেতে হবে কাউন্টারে। রস্তায় প্রচুর জ্যাম। আমার ছোট সমুন্দি ইলিয়াস ভাইয়ারে কল দিলাম, ভাইয়া টঙ্গিতে থাকে। ভাইয়া ফোন ধরেই কান্না করতে করতে বললো, সে গাড়ীর টিকিট কেটে আবদুল্লাহপুর দিয়ে যাচ্ছে। আমি তখনো জানিনা আসল ঘটনা। কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কেটেও বাসে উঠে বসে থাকতে হয়েছে প্রায় ৪০ মিনিট মত। টিকিটের দাম যা ছিলো তার থেকে ১০০ টাকা আমার থেকে বেশি নেওয়া হয়েছে, গাড়ির ভিতর ফেরত দিবে বলে। আমি খুবই কান্না করতেছিলাম, বুকের ভিতর এক শুন্যতা অনুভব হচ্ছিলো। আর তার সাথে জড়িত সকল স্মৃতি গুলো চোখের সামনে কেনো জানি ভেসে উঠছিলো বারবার। আমি বার বার ফোন দিচ্ছিলাম আমার আব্বুর কাছে। আব্বু ফোন বন্ধ করে রেখে দিয়েছে আমার জন্য। সামিউল ভাইকেও কল দিলাম বার বার, আমার দুলাভাই আতিয়ার কেও অনেক ফোন দিলাম কেও ফোন ধরেনা। আমার শশুরের কাছে ফোন দিয়েও ফোন রিসিভ হলোনা।

আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, মাথার মধ্যে নানা ধরনের চিন্তা ভাবনা ঢুকে গেলো তখন। অবশেষে সামিউল ভাই ফোন ধরে জানালো, কহিনুর ভালো আছে। আমার মন বলছিলো কিছু একটা হয়েছে। সামিউল ভাইকে বললাম ভাই, আপনার পা ধরি আমায় সত্যিটা বলেন। আমার ফোন কেও ধরছে না কেনো। কহিনুরের কি হয়েছে। সামিউল ভাই বললো, কিছুই হয়নি। আমাদের তো বোন, কিছু হলে কি আমরা জানাতাম না। আমার স্পষ্ট মনে আছে, পিছনে কান্নার আওয়াজ শুনছিলাম। গলাটা কার চিনতে পারিনি। আব্বু ফোন দিয়ে বললো, বাবা তুমি সাবধানে আসো। আমি বললাম আব্বু তোমরা কোথায় এখন, আব্বু জানালো রংপুর যাচ্ছি। কহিনুরের অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করায় বললো- অবস্থা ভাল না, কি হয় বলা যাচ্ছে না। আব্বুর উত্তর আমার পছন্দ হলো না। আতিয়ার দুলাভাই ফোন ধরলো জিজ্ঞেস করলাম- ভাই কহিনুরের কি অবস্থা, ও কেমন আছে এখন? দুলাভাই কেমন যেনো অন্যরকম উত্তর দিলো। দুলাভাইয়ের উত্তর টাও পছন্দ হলো না। তবে দুলাভাই বললো- সে নাকি কহিনুরের কাছে অর্থাৎ রংপুর যাচ্ছে।

আমি সকলের কাছেই ফোন দিলাম, পরিচিত যত নাম্বার ছিলো কেওই সত্যিটা জানালো না। আমি বাসের মধ্যে খুবই কান্না করছিলাম। একা ছিলাম, আমার দিক থেকে। এভাবে প্রায় ১ ঘণ্টা পরে দুলাভাইকে ফোন দিলাম, দুলাভাই কেমন যেনো আমাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে বারবার। মনে হলো আমার কলে সে বিরক্ত। জিজ্ঞেস করলাম ভাই, কহিনুরের কাছে কি গেছেন। বললো না, এখনো যাইনি। একটা কাজে অন্য জায়গায় আসছি। আল্লাহর কশম তখন আমার বুকের মধ্যে দুলাভাইয়ের প্রতি কেমন যেনো বিরক্ত রাগ আর অভিমান হতে লাগলো।

আমার কান্না আটকাতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে আমার একশত টাকা বসের কন্টাকটরের থেকে ফেরত চাইলে সে আমার সাথে তালবাহানা শুরু করে। আমার মনের অবস্থা বুঝাতে পারব না। আব্বুর কাছে ফোন দিলাম, আব্বুকে জানালাম আমি রংপুর যাব নাকি পলাশবাড়ি অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে নামব। আব্বু বাড়িতে নামতে বললো, বলছে- আমরাই ফিরে আসছি। রংপুর আসার দরকার নেই। আমি তখনো বুঝিনাই কি হয়েছে। আমার মামা ফেরদৌস রহমান কে ফোন দিলাম। মামাও কেনো যেনো খুবই শান্ত গলায় আমার সাথে কথা বললো। আমার থেকে কিছুটাকা ফ্লেক্সিলোড চেয়ে নিলাম। মামা ইচ্ছে করেই কথা বাড়ালো না, শুধু জিজ্ঞেস করলো কতদুর আসছি। এরই মধ্যে আমার পরিচিত বন্ধুরা অনেকেই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে থকলো আমি এখন কতদুর। আমি সবটা কেমন যেনো মিলাতে পারছিলাম না, আমার মনের মধ্যে সকলের কথা গুলো এলোমেলো হয়ে আসছে। কহিনুরের স্মৃতি গুলো বার বার ফিরে ফিরে আসছে। আর আমি কান্না করছি, কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিনা।

দুলাভাই কল দিয়েছে কথা বলার মত স্থির থাকতে পারছিনা, শুধু কান্না আসছে। কথা বলতে গিয়েও পারিনি, শুধু এতটুকু বুঝলাম দুলাভাই আমায় বললো পাশের কাওকে মোবাইল টা দেয়া জন্য। নয়ন নামের একটা ছেলে ছিলো, বাসে উঠার পরে পরিচয় হয়েছিলাম। আমাদের পাশের এলাকায় তার বাড়ি। তাকে ফোন টা এগিয়ে দিলাম, দুলাভাই তার সাথে কি কথা বলেছে জানিনা। তবে নয়নের উত্তর গুলো ছিলো এমন-
“ঠিক আছে ভাই। আমি পাশের এলাকারই। আচ্ছা, আমি ওনার সাথে আছি। না, বলব না। ঠিক আছে, মোবাইল আমার কাছেই রাখছি”
এইসব কথা। নয়ন ভাই আমার মোবাইলের লক টা জেনে নিয়ে আমার পাশে এসে বসলো। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, বললো কিছুই না। আপনার ওয়াইফ অসুস্থ তাকে রংপুর হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সে এখন ভাল আছে। আমার মন তখনো নানা বিষয় নিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। কেনো জানি মনে হচ্ছে কহিনুর বোধ হয় আর নেই। এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা পর, মোহাসিন নামের এক বড় ভাই। আমাদের পাশের এলাকায় বাড়ি। সে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, আমি কতদুর। বললাম ভাই যমুনা সেতুর কাছাকাছি। সে আমায় বলতে থাকলো- বিপুল, মানুষ আসলে বেশিদিন থাকেনা। সবটাই আল্লাহর ইচ্ছে।
আল্লাহর জিনিস আল্লাহই নিলে কারো হাত নেই। আমি ওনার কথার আগা গোরা না বুঝে বার বার জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, ভাই কি হয়েছে আমারে সত্তিটা বলেন। আল্লাহর দোহাই লাগে, আপনার পায়ে ধরি। সে বললো কেনো- কেনো তুই জানিস না? আমি বললাম ভাই আমার সাথে কেওই ভাল ভাবে কথা বলছে না। অনেকেই ফোন ধরছেও না। আমারে বলেন প্লিজ।

সে বললো তোর বউ মারা গেছে।
আল্লাহর কসম করে বলছি, আমার পায়ের নিচে মাটি মনে হয় ছিলো না। একেবারে হঠাত করেই কান্না থেমে গেলো আমার। কি বললো বুঝতে পারলাম না, ভাবলাম হয়তো ভুল শুনলাম। সে আবার বললো, মরন কারো হাতে থাকেনা। তোর বউ বাচ্চা ডেলিভারির পর মারা গেছে। তাকে এখন রংপুর থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতেছে। আমি আর কোনো কথাই বলতে পারিনি। কান্নার ধরন আমার পরিবর্তন হয়ে গেলো। আর তেমন কিছুই মনে নেই। তবে একটা জিনিস খুব করে মনে আছে। মনষত্ব। মানুষের নিক্রৃষ্ট মনমানসিকতা। আমার কান্না শুনে, গাড়ির কিছু যাত্রী আমায় ধমক দেইয়া শুরু করলো। বললো বউ মরলে মানুষ কাদে নাকি। বউ মারা গেলে নাকি মানুষ খুশি হয়, এটা নাকি খুশির সংবাদ। আমায় খুব বাজে বাজে কথা বলতে লাগলো, আমি নাকি কাপুরুষ ইত্যদি। হয়তো এই সব লোকের জন্যেই রংপুর কে মানুষ মফিজ বলে। আমার তাদের কথার উত্তর দেয়ার মত ধৈর্য্য সাহস শক্তি কিছুই ছিলো না। তাই জবাব দিতে পারিনি।

সেদিন বুঝেছিলাম, মানুষ আসলে কতটা মনষত্বহীন হতে পারে। বাসের কণ্টাকর এই ঘটনা জানার পরেও আমার ১০০ টাকা ফেরত দিতে চায়নি। আর আমার সহযাত্রীরা আমার প্রতি অনেকেই বিরক্ত ছিলো, কান্নার জন্য। বউ মরে গেলে কেনো কান্না করছি এজন্য। অথচ সেইসব লোকদের অন্য লোকেরা নিষেধও করেনি। তারপরের দৃশ্য গুলো সম্পর্কে আর কিছুই বলার নেই। শান্তি নেই মনে। হ্যাঁ, তার মৃত্যুর পর থেকেই হারিয়ে ফেলেছি শান্তি।
আল্লাহ যেনো আমার পাগলি কহিনুর পারভীন কে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকাম দান করেন, আমিন।

-বিপুল শেখ
১০ই জুলাই ২০২৫

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.