![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালুর চিন্তা
মঈন উদ্দিন খান
‘নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ প্রবতনের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ ব্যবস্থায় বহু দলের অস্তিত্ব থাকবে তবে বহু মত বা আদর্শ সেভাবে থাকবে না। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় যে ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, তার বিকল্প হিসেবে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। গত ৫ জানুয়ারি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিউটের (পিআরআই) ‘নিরাপত্তা সার্বভৌমত্ব ও সুবিচার’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্র্যাসির জন্য এখনো প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি। লিবারেল ডেমোক্র্যাসির মূল সমস্যা হলো আমাদের মানসিকতা। যারা ক্ষমতায় যান এবং ক্ষমতার চর্চা করেন তারা বিরোধী দলে থাকতে কী করেছিলেন তা দেখেন না।’ তিনি এ বিষয়টি বিবেচনা করে সংবিধানের সংস্কারের কথা ভাবা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। অথমন্ত্রী কী ধরনের সংস্কার সংবিধানে আনা হবে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেননি। তবে অন্য একটি সূত্র আওয়ামী লীগ এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর কথা ভাবছে বলে উল্লেখ করেছে।
এ ব্যাপারে সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যে বিভিন্ন ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী একাধিক বক্তব্যে ‘বাকশাল প্রতিষ্ঠা তখনকার সময়ে সঠিক পদক্ষেপ ছিল’ বলে উল্লেখ করেন। সেন্টার ফর ন্যাশনাল অ্যান্ড রিজিওনাল স্টাডিজের উদ্যোগে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর ওপর আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দলের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এতে আওয়ামী লীগ ঘরানার শীর্ষ পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বাকশাল খুবই ভালো ব্যবস্থা ছিল। বাকশাল ব্যবস্থা বলবৎ থাকলে বাংলাদেশ ১৯৮০ সালের মধ্যেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতো।’ সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত এতে সায় দেন। বাকশালব্যবস্থার পক্ষে এর আগে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের তেমন একটা বলতে শোনা যেত না। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর বাকশাল নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বক্তব্য রাখছেন সরকারি দলের নেতারা। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি সংশোধন করার ঘোষণা দেয়ায় কী ধরনের সংশোধনী হাইকোটে রায়ে আসছে, তার দিকে তাকিয়ে আছেন অনেকে। তবে আভাস পাওয়া গেছে হাইকোটের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার পরও এর মাধ্যমে গৃহীত কিছু বিষয়কে বৈধতা দেয়ার যে কথা বলা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা আপিল বিভাগের রায়ে থাকবে। এরপর সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) চালু করেছিল আওয়ামী লীগ। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল কার্যকর হওয়ার পর চলমান পরিস্থিতিতে সেই একদলীয় ব্যবস্থা আবারো ফিরে আসার আশঙ্কা রাজনৈতিক মহলের তরফ থেকে উচ্চারিত হলেও প্রাপ্ত সূত্র মতে, সরকারের শীর্ষপযায়ে একদলীয় শাসন নয়, বিধিনিধিষেদের বেড়াজালে বন্দী এক ধরনের গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো চালুর চিন্তাভাবনা চলছে। এ লক্ষ্যে খুবই সন্তর্পণে ও সুকৌশলে এগোচ্ছে সরকার। নানামুখী বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার এখন চতুর্থ সংশোধনীর এক দলীয় ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পরিবতে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বহাল রেখে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ন্যায়বিচারের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয় ভিন্নভাবে। এতে কোনো আইনি পরিবতন ছাড়া প্রাপ্ত সাফল্যে সন্তুষ্ট সরকারের নীতিনিধারকরা। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়নও সরকারের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র কায়েমের অংশ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে ’৭২-এর সংবিধানের রাষ্ট্রের চার মূলনীতিতে বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল না হওয়াসহ বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার জন্য এ ধরনের কিছু শর্ত থাকতে পারে। এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ ঘরানার রাজনৈতিক শক্তির দীঘদিন ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারের সাম্প্রতিক জামায়াত-শিবিরবিরোধী চিরুনি অভিযান এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হামলা-মামলায় যে ধরনের চিন্তার প্রকাশ ঘটানো হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি হিসেবে করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ‘বাকশাল’ এ দেশের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ধরনের ব্যবস্থায় আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। জনগণও তা গ্রহণ করবে না। আওয়ামী লীগেরও এ ধরনের চিন্তাভাবনা পরিহার করা উচিত। তিনি বলেন, দেশব্যাপী বিরোধী দলের ওপর যে দমন-পীড়ন-গ্রেফতার চলছে, সরকারের উচিত হবে আর সামনে না যাওয়া। গণতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী বিরোধী দলের সাথে আচরণ করতে হবে। তা আওয়ামী লীগের জন্যও মঙ্গল এবং দেশের জনগণের জন্যও মঙ্গল।
বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার ইতিহাস সংক্ষেপে পযালোচনা করলে দেখা যায়, সংবিধানের চতুথ সংশোধনীর মাধ্যমে এ দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ’ (বাকশাল) চালু হয়েছিল। রাজনৈতিক দল করার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তখন হরণ করা হয়েছিল। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ’৭৮ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবতন করেন। ৯০ ভাগ মুসলিমের এই দেশকে তিনি ‘রাষ্ট্রধম ইসলাম’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেন। গণতন্ত্র আবারো ব্যাহত অবস্থায় থাকে বর্তমান মহাজোট সরকারের অংশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে। এরশাদের হাত থেকে গণতন্ত্রে ফিরে আসতে সময় লেগেছে ১০ বছর। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ’৯১ সাল থেকে ফের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে দেশ। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু্ই বছর বাদ দিলে ’৯১-এর পর থেকে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে হলেও দেশ গণতন্ত্রের মধ্যেই ছিল। নবম সংসদ নিবাচন বিতর্কিত হলেও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে দিন বদলের স্লগান নিয়ে ক্ষমতায় আসা এই সরকারের গত একবছরের কর্মকাণ্ডে ‘গণতান্ত্রিক আচরণ’ কতটা বিকশিত হয়েছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বারবারই অভিযোগ করে আসছে, সরকার ফ্যাসিবাদী আচরণের মধ্য দিয়ে আবারো বাকশালীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে যেতে চাচ্ছে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ’৭২ থেকে ’৭৫ সাল পযন্ত যেভাবে দেশ চলেছে, এখন আবারো সে সব দৃশ্য ফিরে এসেছে।
বিরোধী দলসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অক্ষুণ্ন থাকবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপের মুখে রেখে অঘোষিতভাবে শর্তযুক্ত গণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া চালু হতে পারে। সরকারের শীর্ষ মহলের কথাবার্তায়ও এর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের কেউ বলছেন লিবারেল ডেমোক্র্যাসির ব্যর্থতার কথা, আবার কেউ বাকশালব্যবস্থার প্রশংসা করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রশংসা সরকারপ্রধানকে খুশি করতে কেউ কেউ বলে চললেও এ ধরনের বক্তব্যকে একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে দিকেই যাচ্ছে বলে তাদের আশঙ্কা।
জানা গেছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ‘দমন-পীড়ন নীতি’ সরকারের নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ। এ ক্ষেত্রে বিশেষত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীই মূল টার্গেট।
বিএনপিকে কোণঠাসা করতে বেশ কয়েকটি ‘ট্রাম্প কার্ড’ সরকারের হাতে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলা। জানা গেছে, বিরোধী দলকে ঘায়েল করতে এই তিনটি কার্ড ধীরে ধীরে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রায় তিন হাজার রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করা হলেও বিরোধী দলের কারো বিরুদ্ধে একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমানও রয়েছেন। বিএনপি কঠোরভাবে আন্দোলনমুখী হলে এসব মামলা ব্যবহার করা হতে পারে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ইতোমধ্যে চারদলীয় জোটের নেতাদের জড়ানোর চেষ্টা চলছে। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং জোট সরকারের সময়ে গ্রেফতার হওয়া মুফতি হান্নানকে এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের নানাভাবে জড়িত করার চেষ্টা চলছে।
অন্য দিকে ‘যুদ্ধপরাধী’ ইসু কাজে লাগিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকর্মী হত্যার পর দেশজুড়ে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এ অভিযানকেও নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালুর অংশ হিসেবে ভাবা হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখতে প্রধান বিরোধী দলগুলোকে কোণঠাসা অবস্থায় রাখা এবং বিচার বিভাগকে আজ্ঞাবহ রাখার এই কৌশল ক্রমান্বয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে।
১৫-০২-২০১০
নয়া দিগন্ত
©somewhere in net ltd.