![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ওয়ান ইলেভেন। বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম বাঁক পরিবর্তনের দিন। হঠাৎ আসা ঝড়ে হতচকিত হয়ে পড়ে বিএনপি। যে ধাক্কা এখনও সামলাতে পারেনি দলটি। ভুল ছিল কোথায়? কেনইবা বাড়ানো হয়েছিল বিচারপতিদের বয়স। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় কৌশলের খেলায় কোথায় হেরে গেছে বিএনপি। অনিবার্য ক্রান্তিকালে দাঁড়ানো বিএনপির ভেতরে-বাইরে উচ্চারিত নানা প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করেছেন আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা কাফি কামাল। তার লেখা ‘বিএনপির ময়নাতদন্ত’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হলো তৃতীয় পর্ব-
এরশাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের পর সর্বসম্মতভাবে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশকে ভুল প্রমাণ করে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনে গঠিত ১১ দিনের সংসদে বিএনপিই প্রতিষ্ঠা করে তৎকালীন বিরোধী জোটের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বাসভবনে উভয় পক্ষের মধ্যে একটা আপোষ হয়েছিল, সেই সূত্রেই ওই বিল পাস হয়। অনেকের মতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সংলাপ করেনি কখনও। তারা বলেন, সংলাপ কখনও সমাধান দেয়নি। কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী ছিল পর্দার আড়ালের সংলাপ ও বোঝাপড়ার ফল।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তিন মাসের মধ্যেই বিদায় নেন। একইভাবে ২০০১ সালে নির্বাচনের পর বিদায় নেন বিচারপতি লতিফুর রহমান। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় নতুন জটিলতা। এ ঘটনায় বেঁকে বসে আওয়ামী লীগসহ অনেক রাজনৈতিক দল। তারা অভিযোগ করে, প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার জন্যই বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয়। শুরু হয় জোরেশোরে এসবের প্রচার ও আন্দোলন।
উইকিলিকস প্রকাশিত ২০০৬ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর ঢাকার সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস পাঠানো তারবার্তায় উল্লেখ করেছেন, খোদ শেখ হাসিনাই জানিয়েছেন, বিচারপতি কেএম হাসান বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার পিতার হত্যাকাণ্ডের দুই দণ্ডিতের আত্মীয়। হাসানকে মানতে না পারার ক্ষেত্রে সেটাই ছিল ‘প্রকৃত, খুবই আবেগপূর্ণ’ কারণ। আর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করতো না আওয়ামী লীগ। এখানে বিএনপির ভুল ছিল আওয়ামী লীগের বিরোধের আসল কারণ অনুসন্ধান না করা ও বিকল্প চিন্তা না করে প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। এরকম একটি নাজুক সময়ে বিএনপি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পদে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত কোন জ্যেষ্ঠ ও বিশেষজ্ঞ ধরনের কাউকে নিয়োগ দেয়নি। বরং মোখলেসুর রহমান চৌধুরীকে নিয়োগ দিয়ে আরও কাঁচা কাজ করেছিল। ড. আকবর আলি খানসহ কয়েকজন বিশিষ্ট উপদেষ্টা তার বিরুদ্ধে ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তির’ অভিযোগ এনে পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। অথচ বিএনপি এধরনের একটি সম্ভাব্য অবস্থার উদ্ভব ঘটার কথা কল্পনাই করতে পারেনি।
সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদত্যাগ করে এবং ১২ই জানুয়ারি ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদিও এক-এগারোতে দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তারের পরে প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসা মন্তব্য করেছিলেন যে, কেএম হাসানকে মানতে না পারা ছিল আওয়ামী লীগের ভুল সিদ্ধান্ত। রাজনীতিক বিশ্লেষকদের বিবেচনায়, বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর পর বিএনপি দ্বিতীয় ভুলটি করেছে ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে। মূলত ৮ম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী ২০০৬ সালের শেষদিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর পেছনে ছিল সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী। যদিও এটা সত্য যে, বিচারকদের বয়সসীমা বাড়ানোর দরকার ছিল এবং এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সকল বিচারক এটা চাইছিলেন। কিন্তু মওদুদ আহমদরা বুঝতে পারেননি যে, কেএম হাসানের ফারুকের ভায়রা পরিচয়ের স্পর্শকাতর কার্ডটি খেলতে আওয়ামী লীগ কোন দ্বিধা করবে না। অনেকেরই ধারণা, এ সংশোধনীর মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসরের বয়স না বাড়ানো হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ অনেক সীমিতই থাকতো। অন্যদিকে দেশে চরম রাজনৈতিক সংকটকালে আবির্ভাব ঘটেছিল ওয়ান-ইলেভেন সরকারের। সে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান উভয়ে বিএনপি সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত হিসেবেই অতীতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
যে রাজনৈতিক ভুলের সূত্র ধরে ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের সুযোগ তৈরি হয়, সেটাকে ভুল হিসেবেই উপলব্ধি করতে পারেনি বিএনপি। ফলে বিএনপি ওই সরকারের বিরোধিতা করলেও আওয়ামী লীগ তাকে তাদের ‘আন্দোলনের ফসল’ আখ্যায়িত করে একটি সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে। ফখরুদ্দীন সরকার যেদিন শপথ নেয়, সেদিন আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে অংশ নিলেও বিরত থাকে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদসহ সে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপি নেতাদের জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল অস্থিরতা। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এবং ঢাকার তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তাদের কাছে একটি ফোন আসে। বলা হয়, বঙ্গভবনে কি আর কখনও যাননি। বার্তা বুঝতে পেরে বাসায় ফিরে যান তারা। কেন তাদের এ ফোন করা হয়েছিল তা নিয়ে বিএনপির ভেতরে নানা আলোচনা রয়েছে। জানা যায়, বিএনপির তখনকার থিঙ্কট্যাঙ্কের দু’জন সদস্য দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে ক্যু হয়েছে। এখন আমাদের বঙ্গভবনে যাওয়া হবে ওই ক্যুকে সমর্থন করা। পর্যবেক্ষকরা বলছেন এটাই ছিল বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত। সেদিন রাগ-ক্ষোভ এড়িয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলে অন্তত সে সরকারের রোষানলে পড়ে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তো না বিএনপি। পরবর্তীকালে বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক সদস্যকে ঘরোয়া আলোচনায় এ নিয়ে আক্ষেপ করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে উইকিলিকসে প্রকাশিত তারবার্তা সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের ১০ই জুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিকে তৎকালীন উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, বেসামরিক উপদেষ্টারা কারাবন্দি দুই নেত্রীর সঙ্গে সমঝোতার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলেও সে সরকারের উপদেষ্টাদের ব্যাপারে বিরোধী মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিএনপি।
৫ম সংশোধনী মামলাটি কতদূর গড়াতে পারে তা ধারণা করতে পারেনি বিএনপি। ২০০৫ সালে রায়ের পরে মধ্যরাতে তারা কোর্ট বসিয়ে ওই রায় স্থগিত করিয়েছিল। অথচ তার কোন দরকার ছিল না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে এবিষয়ে ভুল পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল মুন সিনেমা হলের মালিকানা ফেরতের দাবিতে। বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৫ সালে হাইকোর্ট সেই মামলার রায়ে বাতিল ঘোষণা করা হয় সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চম সংশোধনী। বিএনপি সরকারের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকার পরও রহস্যজনক কারণে মামলার আপিল শুনানি করা হয়নি। বিএনপি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর সে মামলায় পক্ষভুক্ত হন দলের তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। কিন্তু সরকারপক্ষের অবস্থান বদলে যায়। আর আপিল বিভাগেও হাইকোর্টের রায় বহাল থাকায় বাতিল হয়ে যায় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল করা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও বাদীপক্ষ সিনেমা হল ফেরত না পেলেও রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বিএনপি।
হাইকোর্ট তার রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত জারি করা সব ধরনের ফরমান কতিপয় বিধানের মার্জনা সাপেক্ষে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে খন্দকার মোশ্তাক আহমাদ, একই বছরের ৬ই নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ এবং সামরিক শাসন জারি অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি বলে ঘোষণা করা হয়। পরিহাস হলো এই রায়েই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এবং বিচারপতি নিয়োগ নীতিমালা সহ জিয়ার প্রবর্তিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান বহাল রাখা হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি নেতারা তা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেননি। জিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ফরমান জারি করেননি। তাই বিএনপি সামরিক শাসনের নিন্দা করে একই সঙ্গে জিয়ার সংস্কারের পক্ষে দাঁড়াতে পারতো। কিন্তু সেদিকে তারা যায়নি।
ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাড়ির বিষয়টি ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এই বাড়ি নিয়ে আদালতে না যেতে খালেদা জিয়ার প্রতি পরামর্শ ছিল দলটির একাধিক নেতার। কিন্তু দুইজন প্রভাবশালী আইনজীবী নেতার বুদ্ধিতে সেই পথেই হাঁটে বিএনপি। ২০১০ সালে উচ্চ আদালত বিএনপি চেয়ারপারসনের আবেদন খারিজ করে দিলে বাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নেয় ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। ১৩ই নভেম্বর খালেদা জিয়াকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। বাড়ি রক্ষার জন্য আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি নিয়ে পরে দলীয় ফোরামে নেতারা অনেক সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতাই করেছে বিএনপি।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ২৪ জন নিহত ও তৎকালীন বিরোধী নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গুরুতর আহত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জন্য এটা ছিল দ্বিতীয় রক্তাক্ত আগস্ট। চারদলীয় জোট সরকার এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সুষ্ঠু তদন্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে এ ঘটনায় ‘জজ মিয়া নাটক’ পুরো বিষয়টির দায়ভার বিএনপির দিকে ঠেলে দেয়। সেদিন বিএনপি যদি বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারতো তাহলে পরবর্তীতে প্রতিহিংসার রাজনীতির মুখে পড়তে হতো না দলটিকে। অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির গবেষণা কেন্দ্র হাওয়া ভবন ও তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে ঘিরে নানা ধরনের নেতিবাচক তথ্য প্রচার হয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে। কিন্তু বিএনপি সেসব অপপ্রচারের কার্যকর প্রতিবাদ বা সৃষ্ট অপধারণার জাল ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়। বলতে গেলে নেতিবাচক প্রপাগান্ডা মোকাবিলায় ন্যূনতম দক্ষতাই দেখাতে পারেনি দলটি। এ প্রচারণায় দলের একটি অংশের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেনি বিএনপি।
উইকিলিকসের তারবার্তায় দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী হাওয়া ভবনকে বলতেন ‘উইন্ড টানেল’। সে ‘উইন্ড টানেলে’ তারেক রহমানের কতিপয় চিত্তবিকারগ্রস্ত বন্ধু রয়েছে। এছাড়া, অনেক মন্ত্রী-এমপিও তখন স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় বিক্রি করেছেন হাওয়া ভবনের নাম। কিন্তু এমন অপপ্রচারের বিষয়টিও বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে কোন উদ্যোগ নেয়ার দরকার মনে করেনি বিএনপি। এছাড়া, ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং দলের নেতাদের ব্যাপারে নানা মহলে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার ব্যাপারে তদন্ত এবং ব্যবস্থা গ্রহণের কোন উদ্যোগই দৃশ্যমান করেনি বিএনপি নেতৃত্ব। অন্যদিকে গণমাধ্যমকে বোঝা ও তাকে হ্যান্ডেল করতে না পারার ব্যর্থতাকে দলটির একটি বড় ভুল হিসেবে বিবেচনা করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিএনপির আমলে গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে বিকশিত হলেও নিজেদের ভুল ও অদূরদর্শী পলিসির কারণে তার কোন সুবিধা বা সহায়তাই পায়নি তারা। উল্টো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গণমাধ্যম পরিণত হয়েছে দলটির অদৃশ্য প্রতিপক্ষে। উপযুক্ত লোকের বদলে অনভিজ্ঞ ও সুবিধাবাদী লোকজনের হাতে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ায় এ পরিণতি ঘটে। বেশির ভাগ গণমাধ্যমের মালিকানা চলে যায় আওয়ামী লীগ নেতা বা তাদের রাজনীতির প্রতি অনুগতদের হাতে। এরপরও গণমাধ্যমের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে এবং সুবিধা পেতে ব্যর্থ হয় দলটি। গণমাধ্যমের সঙ্গে দলটির নেতাদের যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতেই ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি। বিএনপি ভাবতেই পারেনি এটি কতদূর যেতে পারে। তরুণ প্রজন্ম দারুণভাবে এই ইস্যুটি নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ তাই ক্ষমতায় এসেই সে বিচার শুরু করে। কিন্তু এ ইস্যুতে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি অবলম্বন করে বিএনপি। অথচ তারা এবিষয়ে পলায়নপর নীতি না নিয়ে পরিষ্কার অবস্থান নিতে পারতো। প্রায় ৮শ’ দণ্ডিত রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী কিভাবে বেরিয়ে গিয়েছিল তার তদন্ত দাবি করে বিএনপি মাঠে নামতে পারতো। জিয়ার বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয়েছে তিনি তাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ ৫ম সংশোধনীতেই বিধান ছিল যে, দালাল আইন বাতিল করা হলেও এই আইনে দণ্ডিতরা মুক্তি পাবেন না। অথচ বিএনপি নেতারা জিয়ার এই বিধানের পক্ষে কোনদিন কথা বলেননি। নতুন প্রজন্মকে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করাতে পেরেছে যে, এই বিচার কোনদিন হয়নি, যা এবার আওয়ামী লীগ করছে। এমনকি এই বিষয়ে বিচার করার বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাও আওয়ামী লীগ মুছে দিতে পেরেছে। নাইন ইলেভেনের পরের বদলে যাওয়া বিশ্বে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে সরকার করেছে। আবার আইএস (ইসলামিক স্টেট)-এর যুগে এসে বিএনপি সেই জামায়াতকে নিয়েই সরকার পতনের আন্দোলনে নিয়োজিত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে এক আধজন নেতা যারা অভিযুক্ত হয়েছিলেন তাদের থেকে দল নিজকে আলাদা করতে পারতো। কারণ তাদের কেউ বিএনপির কোন গ্রুপের সদস্য নন এবং কখনও ছিলেন না।
বিচার প্রক্রিয়ার শুরুতেই কেবল জামায়াত নয়, ‘‘বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিক’’ হিসেবে পরিচিত জামায়াতের নেতাদের একের পর এক গ্রেপ্তার করা হয়। আর প্রথম থেকেই বিএনপির প্রতিটি আন্দোলন ইস্যুকেই যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের আন্দোলন হিসেবে দেখাতে থাকে আওয়ামী লীগ। বিএনপি এর কোন পাল্টা কৌশল নির্দিষ্ট করতে পারেনি। তাই সহজেই এরকম একটি প্রচারণা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে সরকার। অন্যদিকে ঠিকই জামায়াতের সঙ্গে তার তৈরি হতে থাকে ভেতরগত ফারাক। এক পর্যায়ে বিএনপির একাধিক নেতাকে এ বিচারে যুক্ত করা হয় ঠিকই কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, বিচারের বিষয়ে তাদের নীরবতা বা পলায়নপরতার নীতি কোন সুফল আনেনি।
প্রথমেই বিএনপি এ বিচারের পক্ষ নিলে সাধারণ মানুষের সমর্থন যেমন তাদের দিকে ঝুঁকতো, তেমনি অপপ্রচারের দায় চাপতো না কাঁধে। সরকারও অধিকতর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়া চালাতে পারতো। এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জোটে থাকলেও জামায়াতের বহু সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ওয়ান-ইলেভেনের পর দেশের শীর্ষ দুই নেত্রী যখন কারারুদ্ধ তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে জামায়াত। প্রকাশ্যেই তারা ঘোষণা দিয়েছে, বিএনপির দুর্নীতির দায় নেবে না জামায়াত। দলটির সবাই বিশ্বাস করেন বিএনপির সঙ্গে সরকারে থেকে তাদের গায়ে কালি লেগেছে। অথচ ফখরুদ্দীন সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যেতে রাজি না হলেও জামায়াতের চাপের কারণে সে নির্বাচনে তাকে অংশ নিতে হয়। সে নির্বাচনের পর প্রায় এক বছর দল দুইটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোন আলাপ-আলোচনা পর্যন্ত হয়নি। বিএনপির অনেকে এখন বলেন, জামায়াত বাগড়া না দিলে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের তকমাটা আওয়ামী লীগের ললাটে ২০০৮ সালেই লেপন করা যেত। আর তাহলে সেই ‘একতরফা নির্বাচনে’ জিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে আজ যেখানে নামিয়ে এনেছে সেখানে আনতে পারতো না।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দ্বিতীয় উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে রীতিমতো দ্বৈরথ জুড়েছে জামায়াত। সরকারের সঙ্গে সমঝে চলে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিজেদের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করলেও তাদের এ আচরণে চেয়ারম্যান পদে হেরেছে বিএনপি প্রার্থীরা। লক্ষণীয় যে, সাম্প্রতিক ঢাকা সিটি নির্বাচনেও দেখা গেছে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে গেলেও জামায়াত তার প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে তক্কে তক্কে থেকেছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে।
জামায়াতের কারণে বিএনপির আন্দোলনের প্ল্যাটফরমে যুক্ত হয়নি সরকারের বাইরে থাকা একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। উল্টো জামায়াতের কারণে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামসহ অনেক জেলায় সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। সেখানেই শেষ নয়, উইকিলিকস সূত্রেই জানা যায়, ওয়ান-ইলেভেনের আগে চারদলীয় জোটে যোগ দেয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করে এরশাদ বলেছেন, ‘কেয়ারটেকার সরকার আসার আগেই চারদলীয় জোটে আসার ঘোষণা দেব।’ কিন্তু জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দলের পক্ষে মার্কিন দূতাবাসকে বলেছিলেন, ‘চারদলীয় জোটে এরশাদের প্রয়োজন নেই। শরিকদের সঙ্গে আলোচনা না করে জাতীয় পার্টিকে চারদলীয় জোটে ডাকার এখতিয়ার তারেক রহমানের নেই।’ অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে অস্বস্তির বিষয়টি নতুন নয় বিএনপিতে। উইকিলিকস প্রকাশিত তারবার্তায় দেখা যায়, ২০০৫ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তদানীন্তন জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী মার্কিন দূতাবাসের সাবেক চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জুডিথ শামাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামী, জেএমবি প্রসঙ্গে তাঁর বিপরীত মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। কামাল সিদ্দিকী জুডিথকে বলেছিলেন, বিএনপির ৫০ জন এমপি ক্ষমতাসীন জোট সরকার থেকে জামায়াতকে সরিয়ে দিতে চান। সরকার (চারদলীয় জোট সরকার) জেএমবি’র সন্ত্রাসী চরিত্র অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মহল ও বিদেশী কূটনীতিক মহলের স্বস্তির বিষয় হচ্ছে- বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সমপ্রতি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে বলেছেন, ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। ধর্মভিত্তিক দল সম্পর্কে তারেক রহমানের বক্তব্য আসলে তিন যুগ আগে দেয়া দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একটি বক্তব্যের প্রতিধ্বনি। সামগ্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পর্কে তার এ বক্তব্য দলটির উপলব্ধির প্রকাশ ধরে নেয়া যায়। অনেকের মতে বিএনপির উচিত তারেকের এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটিকে গ্রহণ করতে সচেষ্ট হওয়া। তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত রাষ্ট্র ধর্ম করা কখনও জিয়ার এজেন্ডা ছিল না। মওলানা ভাসানী ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ গ্রহণ করেছিলেন। ৭ দলীয় জোটের নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের অষ্টম সংশোধনীর বিরোধিতা করেছিলেন।
ফখরুদ্দিনের অস্থির অপেক্ষা
©somewhere in net ltd.
১|
০৭ ই জুলাই, ২০১৫ ভোর ৪:৩৩
লিঙ্কন বলেছেন:
বিএনপির ময়নাতদন্ত
ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব। মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার স্বীকৃতি মিলেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেই। তবে তার ক্ষমতা আরোহণ বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। যদিও ব্যক্তিগত সততার জন্য তিনি ছিলেন প্রশংসিত। ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৮। আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির। জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যু এ দলের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়লেও খালেদা জিয়ার হাত ধরে এগিয়ে যায় বিএনপি। একটি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তারেক রহমানও। চারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া দল বিএনপি এখন এক অনিবার্য ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন বিপর্যয় দলটি অতীতে কখনোই মোকাবিলা করেনি। সামনে কী আছে তা জানেন না বিএনপির কেউই। এমনকি রাজনৈতিক পণ্ডিতরাও। দলটির জন্য এ এক অনিশ্চিত ঘোর অমানিশার সময়। কেন এ বিপর্যয়? বিএনপির শেষ গন্তব্যই বা কোথায়। এমন সব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করেছেন আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা
কাফি কামাল। তার লেখা ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব-
স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম পাঁচ বছর বাংলাদেশের জাতীয় জীবন ছিল চাওয়া-পাওয়ার এক জটিল হিসাব-নিকাশের পর্ব। আওয়ামী লীগ তার হিরন্ময় ঐতিহ্য বাঁচাতে চায়নি, ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে খুন হলেন, আওয়ামী লীগ হঠাৎ ছিটকে পড়লো। উত্তরণ ঘটলো নতুন এক রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির। এই দুই অবস্থার অন্তর্বর্তীকালে স্বাভাবিক গণতন্ত্র নিভে গিয়েছিল, এসেছিল তাঞ্জানিয়ার জুলিয়াস নায়ারের কর্তৃত্বপরায়ণ মডেলের সরকার ব্যবস্থা -বাকশাল।
তাজউদ্দীন আহমেদ ও ড. কামাল হোসেনের মতো বঙ্গবন্ধুর অনেক ঘনিষ্ঠজন হতবিহ্বল আর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের ভাষায়, স্বাধীনতার শত্রুরা হয়েছিল উল্লসিত। একজন ত্রস্ত বিচলিত কামাল হোসেন লন্ডনে দেশান্তরী হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে সাহস করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমি আপনার মৃত্যুসনদে (বাকশালে সমর্থন) সই দিতে পারি না।’ ’৭৫-এর বিয়োগান্তক পটপরিবর্তন পরবর্তী তিন মাস ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অস্থির-অনিশ্চয়তাময় এক ঘোর অমানিশা। নির্মোহ জীবনদৃষ্টির অধিকারী জিয়াউর রহমান অন্য অনেকের মতোই যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে চলে যান অনেকটাই পেছনের কাতারে। কিন্তু তাঁর অবদান ও যোগ্যতার স্বীকৃতি তিনি বঙ্গবন্ধুর হাতেই পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেন। জিয়াকে সেনাবাহিনী প্রধান করতে না পারার ক্ষতিও মুজিব পুষিয়ে দিতে বিশেষভাবে উদ্যোগী হন। তার প্রমাণ হলো যা উপমহাদেশে কখনও ছিল না, জিয়াকে সম্মানিত করতেই মুজিব সৃষ্টি করেছিলেন সেনা উপপ্রধানের পদ। সুতরাং মুজিব পরবর্তী বাংলাদেশেই কেবল জিয়া পাদপ্রদীপে এসেছিলেন তা ঠিক নয়। তিনি তাঁর বিশেষত্বের স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর হাতেই পেয়েছিলেন। জিয়াকে জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েও শেখ মুজিব তা জিয়ার অনুরোধেই বাতিল করেছিলেন। সুতরাং মুজিব-জিয়া সম্পর্কে কোন চিড় নেই। সম্প্রতি জিয়ার জন্মদিনের আলোচনায় অধ্যাপক বি. চৌধুরী বেগম খালেদা জিয়ার সামনেই বলেন, শহীদ জিয়া কখনও মুজিবের সমালোচনা করেননি। আর আজ বিএনপি নেতারা কি করেন।
আজ যারা মুক্তিযোদ্ধা জিয়াকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা আসলে প্রকারান্তরে শেখ মুজিবের প্রজ্ঞাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেন। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে কি করেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে কি করেছেন, তার সবটাই ঘটেছে ১৯৭২ সালে মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে। সুতরাং মুজিবের জিয়া মূল্যায়নের তারিখ ও ঘটনাবলী বিবেচনায় নিলে জাতীয় রাজনীতিতে তিক্ততা কিছুটা হলেও দূর হতে পারে। অবশ্য জিয়া কি প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষে এলেন, সেটা বিচার্য। অনেকের মতে জিয়া যদি কোন কারণে ক্ষমতায় না গিয়ে আওয়ামী লীগকে দ্রুত ক্ষমতায় বসাতে সক্ষম হতেন, বিএনপি গঠন না করতেন, তাহলে জিয়া আওয়ামী লীগের অনেক বেশি প্রিয়ভাজন হতেন। কিন্তু কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হলো, জিয়ার হাতে যখন ক্ষমতা এসেছিল তখন আওয়ামী লীগ সরকারিভাবে লুপ্ত ছিল। আর বাকশাল পুনরুজ্জীবন যে সম্ভব ছিল না, তার প্রমাণ হলো আওয়ামী লীগ নিজেই কখনও আর বাকশাল হতে চায়নি।
মাৎস্যন্যায় যুগের অবসান ঘটিয়ে অষ্টম শতকে দেশবাসী বঙ্গের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন একজন সাধারণ গোপালকে। হতাশায় বিপর্যস্ত মানুষ সিপাহী-জনতার বিপ্লবের নামে নতুন প্রত্যয়ের প্রকাশ ঘটিয়ে নিজেদের নেতা নির্বাচন করেন জিয়াউর রহমানকে। ঘটনা পরম্পরায় তিনি হয়ে উঠেন এক অনিবার্য চরিত্র। বাংলাদেশের সিপাহি-জনতা সেদিন ঘোর অমানিশায় কারাবন্দি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের মধ্যেই দেখেছিলেন আলোকবর্তিকা। ষড়যন্ত্রকারীদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সিপাহি-জনতা জিয়াকে আসীন করেন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে। এটা লক্ষণীয় যে, আগস্ট অভ্যুত্থানের কুশলীবদের সঙ্গে জিয়ার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও ভাল ছিল বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং মোশতাক আহমেদ ও ফারুক-রশীদ সর্বদা জিয়ার প্রতি কমবেশি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কোন চেষ্টা তার জীবদ্দশায় দেখা যায়নি। অবশ্য তিনি জাতি গঠনের জন্য সব মত ও পথের দল ও গোষ্ঠীকে একত্রিত করার প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। ’৭৫-এর ১০ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট সায়েম সরকার গঠিত হলে সেনাপ্রধানের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র, শিল্প, বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট, শিক্ষা, বিজ্ঞান, কারিগরি গবেষণা, আণবিক শক্তি, অর্থ, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে সেদিনটিই ছিল মূলত ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ধীরে ধীরে প্রকাশ করতে থাকেন তার দূরদর্শী রাজনৈতিক ভাবনা। ’৭৬ সালের ১লা এপ্রিল খুলনা, ৬ই এপ্রিল কুমিল্লা স্টেডিয়াম ও ২৪শে এপ্রিল সিলেট স্টেডিয়ামের জনসভায় তিনি বলেন, ‘পার্টিতে পার্টিতে, গ্রুপে গ্রুপে অতীতের সকল পার্থক্য ভুলে দেশের প্রগতির জন্য ‘বাংলাদেশী’ রূপে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। যে কোন মূল্যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা হবে।’
অধ্যাপক বি. চৌধুরী মনে করেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোন সংঘাত নেই। জিয়া একে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাননি। এ বিষয়ে তারা পুস্তিকা করেছিলেন যা তারা বিলিয়েছেন। সাধারণত জাতীয়তাবাদ হয় নৃ ও ভাষানির্ভর। কিন্তু বাংলাদেশে একাধিক জাতিগোষ্ঠী বাস করে, আবার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আবাস্থলের কারণেও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ভর একটা জাতীয়তাবাদের দরকার পড়েছিল। ভারতীয় বাঙালির স্বাধীনতা আর বাংলাদেশী বাঙালির স্বাধীনতা এক নয়। ওপারের বাঙালির রাষ্ট্র নেই। এপারের বাঙালির রাষ্ট্র আছে। তাই তিনি নৃ, ভাষা ও ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি ভূখণ্ডকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একটি নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জন্য জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রয়োজন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মে দিবসের শ্রমিক সমাবেশের বক্তব্যে জিয়া তার জাতীয়তাবাদের দর্শন স্পষ্ট করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চত্য যেমনি, তেমনি ইসলামি বিশ্ব আবার চীনের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তিনি পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের মনোযোগ তিনি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। বিদেশে শ্রমবাজার সৃষ্টিতে যার বিরাট প্রভাব পড়েছিল। সার্ক এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধে মধ্যস্থতার একটা উদ্যোগ নিয়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন, সেটা সফল না হলেও বাংলাদেশ পরিচিতি লাভ করেছিল। দেশে শ্রমিক ও মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মৌলিক ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেন। ’৭৭-এর ২১শে এপ্রিল ‘ভগ্নস্বাস্থ্যের’ কারণে প্রেসিডেন্ট সায়েম দায়িত্ব ছেড়ে জিয়াউর রহমানকেই মনোনীত করেন নতুন কর্ণধার। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ এ চিন্তা থেকে তিনি একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ নেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সাত্তারকে আহ্বায়ক করে ’৭৮-এর ২২শে ফেব্রুয়ারি গঠন করেন জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী দল (জাগদল)। মে মাসে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ন্যাপ (ভাসানী), ইউপিপি, মুসলিম লীগ, লেবার পার্টি ও তফশিলি জাতীয় ফেডারেশনের সমন্বয়ে জাগদল রূপান্তরিত হয় ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’-এ। সে বছরই আনুষ্ঠানিক নির্বাচনে জেনারেল ওসমানীকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় বিএনপি গঠনের এ প্রাকপ্রস্তুতি পর্ব। ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৮। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির আনুষ্ঠানিক জন্মদিন। জাগদলের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র রমনা পার্কের খোলা চত্বরে ১৯ দফার ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ নামে প্রেসিডেন্ট জিয়া নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেন। এর রাজনৈতিক দর্শন ছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম কলেবর ছিল ৭৬। যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮৬ জনে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কতটুকু সফল ও সমপ্রসারিত হয়েছে বিএনপি? ২০০৬ সালের শেষ দিকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে বিএনপিকে অব্যাহতভাবে একটি প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। অনেকে বলছেন, এর আগে তারেক রহমান বগুড়ায় যে মডেলে দল গোছানো শুরু করেছিলেন এবং পরে যদিও তা পরিত্যাগ করেছিলেন, তাকেই আবার চাঙ্গা করা যায় কি না। তারেক রহমান গোপন ব্যালটে ভোটাভুটির মাধ্যমে গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪-এর ২৮শে ডিসেম্বর, জনগণের যেসব মৌলিক অধিকার স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তা দ্রুত ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট হন। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া গণমাধ্যম মুক্ত করেন, বিধিনিষেধ রহিত করেন, বিচারালয়ের স্বাধীনতা বিশেষ করে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের একটি নোটিশ দিয়ে বরখাস্ত করার মতো বিধান বাতিল করেন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শের বিধান প্রবর্তন করেন, যা সংবিধানে আজও টিকে আছে, যে বিধানের কারণে জাতি মাসদার হোসেন মামলার ঐতিহাসিক রায় পেয়েছে।
জিয়া মুজিব সরকারের অনুসৃত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নীতি বজায় রাখেন। দুই পরাশক্তির মধ্যে পাশ্চত্যের দিকে ঝোঁকটা একটু বেশি রেখেও সোভিয়েত ব্লককে একেবারে দূরে ঠেলে দেননি। জিয়াউর রহমানের আমলেই ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা গঙ্গার পানি বণ্টনে ৫ বছর মেয়াদি একটি স্থায়ী চুক্তি করা সম্ভব হয়। নদী বিশেষজ্ঞরা একমত যে, ফারাক্কা পয়েন্টে ন্যূনতম পানিপ্রবাহের ব্যাপারে যেভাবে গ্যারান্টি ক্লজ যুক্ত করা হয়েছিল, সেটা ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে রাখা সম্ভব হয়নি। সমুদ্রসীমা ও তালপট্টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে যৌথ আলোচনা আগে থেকেই চলছিল। অফশোর ব্লক মার্কিন তেল কোম্পানিকে ইজারা দেয়ার পরে ভারত বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল শেখ মুজিব বেঁচে থাকতেই। জিয়ার আমলে তালপট্টি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলেও বাস্তবে শক্তি প্রয়োগ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। যৌথ জরিপের মাধ্যমে তালপট্টি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে ও সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হয়েছিল। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তরেখা নির্ধারণ ও শরণার্থী সমস্যা আলোচনার উদ্যোগ, জাপানের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে টপকে দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ লাভ, ওআইসির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আল কুদস কমিটি, জোটনিরপেক্ষ ব্যুরো ও ওআইসি কাঠামোর মধ্যে যুদ্ধরত ইরান ও ইরাকের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শান্তি কমিটির একক প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ফলে তার সময়ে বহিঃসম্পদ প্রবাহ বেড়ে দাঁড়ায় ৬.৭৭২ মিলিয়ন ডলার। জিয়াউর রহমানই দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সমন্বয়ে সার্কের গোড়াপত্তন করেন, সম্প্রতি ঢাকায় এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।
রাজনীতিতে এসে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী দর্শনের ভিত্তিতে জন্ম দেন বিএনপির। তিনি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হন, বিএনপি একটি উদার ও মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল। ফলে মানুষ দলে দলে বিএনপিতে যোগ দেয়। স্বল্প সময়েই বিএনপি পরিণত হয় একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে। তখনকার সময়ে গণমাধ্যমের উপস্থিতিও ছিল সীমিত। টেলিভিশন বলতে ছিল শুধু বিটিভি। পত্রিকা ছিল মাত্র কয়েকটি। তার পরও জিয়াউর রহমানের একক প্রচেষ্টায় জাতীয়তাবাদী ও মধ্যপন্থি রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল দেশজুড়ে। কারণ সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। বিএনপি বাংলাদেশের বাস্তবতায় ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটেনি তেমনি ধর্মীয় চরমপন্থাকেও সমর্থন করেনি। লক্ষণীয় হলো, জিয়া রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার দিকে যাননি, যা এরশাদ করেছেন। রাষ্ট্রপরিচালনায় দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের প্রতিফলনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সামাজিক ন্যায়বিচার সমৃদ্ধ একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ার নির্দেশনা রয়েছে বিএনপির গঠনতন্ত্রে। ফলে বিএনপির দলীয় কর্মসূচি কিংবা রাষ্ট্রপরিচালনা সবখানেই দেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ইসলামী অনুশাসনের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। আবার জিয়া ও তাঁর অনুসারীরা কখনও শরিয়া আইন চালুর চিন্তাও করেননি। আশির দশকে বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল জাতীয়তাবাদী ও মধ্যমপন্থি রাজনীতি। কিন্তু ’৯০-এর দশকের পরের প্রজন্ম অর্থাৎ আজকে যাদের বয়স বিশ থেকে পঁচিশ-তাদের মধ্যে বিকাশ ঘটেনি জাতীয়তাবাদী ও মধ্যপন্থি রাজনীতির।
আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরির পাশাপাশি দলটি দীর্ঘ সময় পরিচালনা করেছে রাষ্ট্রক্ষমতা। তিন যুগের রাজনৈতিক ইতিহাসে চারবার (স্বল্পকালীন ষষ্ঠ সংসদসহ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে বিএনপি। প্রথমবার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এবং পরের তিনবার তারই সহধর্মিণী বিএনপির বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। প্রধান বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করেছে দুইবার। উন্নয়নের রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল বিএনপি। আর বাংলাদেশ যখন স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই নিহত হন জিয়া। বাংলাদেশ নিপতিত হয় এক দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের কবলে। এরশাদের পতনের পর ’৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি চমক সৃষ্টি করে বিজয়ী হয়। কারণ মিডিয়া এবং প্রায় সকল বিশ্লেষকরা ধরেই নিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন।
বিএনপি সরকার সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ফুলবাড়ি কয়লাখনি, কানসাট ও শনির আখড়ার বিদ্যুৎ-পানির আন্দোলন। এ সময় দেশব্যাপী জঙ্গি সন্ত্রাসের উত্থান, একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এই পর্বে বিএনপির বড় সীমাবদ্ধতা ছিল নাইন-ইলেভেন পরবর্তী বদলে যাওয়া বিশ্ব রাজনীতিতে তথাকথিত ইসলামী সন্ত্রাসবাদের প্রতি সৃষ্ট ভয়ানক সংবেদনশীলতা বুঝতে না পারা।
২০০৪ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সুবাদে ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটির বিরাট নেতিবাচক প্রচার পায়। যদিও বিএনপি সরকারই চিহ্নিত জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করেছিল। কিন্তু রাজশাহীতে বিএনপির কিছু নেতা বাংলাভাইকে গণসংবর্ধনা দিয়েছিল, ঢাকার রাস্তায় বাংলা হবে আফগান স্লোগান উঠেছিল। আরও তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল যে, জঙ্গি নেতাদের কারও কারও সঙ্গে জামায়াত ইসলামীর পুরনো সম্পর্ক ছিল। জামায়াত নেতারা এ কথাও বলেছিলেন, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। বিএনপি বুঝতে পারেনি যে, এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সন্ত্রস্ত ও সন্দিগ্ধ করেছিল। তবে সাফল্য হিসেবে দলটি দাবি করতে পারে, নকলমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, পরিবেশ দূষণ হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিটেন্স বৃদ্ধি, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা। আমদানি, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, প্রবাসী-আয়, খেলাপি ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, সরকারি ব্যয় অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ভাল ছিল। তার পরও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে দুর্ভোগ এনেছে মূল্যস্ফীতি। বিএনপির গত শাসনামলে তাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল নেতিবাচক প্রচার-অপপ্রচারের দিকে মনোযোগ না দেয়া। কাজ পেতে হলে বিশেষ বিশেষ স্থানে কমিশন দিতে হয়, এটাই প্রচার হয়েছিল সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। সেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মন্ত্রী-এমপি ও ব্যবসায়ী মিলে হঠাৎ ধনী কিছু প্রভাবশালী মানুষ। ফলে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রসহ নানাভাবে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিপর্যয় এবং নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে দলটি। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা রটনা ঘটনা, একটা কিছু হয়েই থাকতে পারে। তবে যতটা পারা যায় রাজনীতিবিদদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু নেতিবাচক প্রচারণার ব্যাপারে দলটির অমনোযোগের কারণে সম্ভবত সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয় তৃণমূল সম্মেলনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চলা তারেক রহমানকে। শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাকে বাধ্য করা হয় দেশত্যাগে। ওয়ান-ইলেভেনের সে সূত্র ধরে এখনও প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে বিএনপি। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে নানা ক্রান্তিকাল বিএনপি পার করে এসেছে। কিন্তু সব মিলিয়ে বর্তমানে বিএনপি একটি অনিবার্য ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে সে লড়াই হয়ে উঠেছে কঠিন থেকে কঠিনতর।
বিএনপির ময়নাতদন্ত