নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানবসম্পদ ও কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনা আমার পেশা হলেও, লেখালিখির মাধ্যমে নিজের ভাবনাগুলো ভাগ করে নিতে আমি সবসময় আগ্রহী।

শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু

আমি ইতিবাচক চিন্তার শক্তিতে বিশ্বাস করি এবং আমার কাজ এবং কথার মাধ্যমে অন্যদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করি। আমার ব্লগে আসার জন্য ধন্যবাদ। আসুন, একসাথে কাজ করে সফলতার পথে এগিয়ে যাই!

শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছায়ালেখা

২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:২১



ঈশ্বরের ভুল ছায়া সিরিজ এর প্রথম গল্প

রূপসা নদীর পাড়ঘেঁষা খুলনা আলিয়া মাদ্রাসার পুরোনো হোস্টেল ভবনটা দিনের আলোয় যেমন নিষ্প্রাণ, রাতের নীরবতায় যেন আরও বেশি গভীর। এই ভবনের তৃতীয় তলার এক কোণে বাস করে তাওহীদ মুজিব—সতেরো বছরের এক ছেলেকে বলা যায়, তবে সে নিজেই জানে, তার বয়স তার চেয়ে বেশি। কারণ, তার মনের ভিতর যে ধরনের চিন্তার ঢেউ উঠে, তা এই বয়সের কারও নয়।

তাওহীদের বাড়ি বাগেরহাট জেলার শরনখোলা থানার এক ছোট্ট গ্রামে। চারপাশে লবণাক্ত মাটির জমি, কাঁকড়া চলাচল করে এমন কাঁচা রাস্তা, আর দূরে সুন্দরবনের সবুজ রেখা। সেখান থেকে উঠে এসে মাদ্রাসায় পড়তে এসেছিল বছর তিনেক আগে। প্রথম প্রথম বন্ধু বানাতে চেয়েছিল, চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝে গেছে—সবাই তাকে বোঝে না। সে নিজেও সবাইকে বোঝে না।

তাওহীদ আত্মমগ্ন। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা না বলে বসে থাকতে পারে। ক্লাসের পর সে চলে যায় ছাদে, কিংবা রূপসার তীরে। বসে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। জোয়ার-ভাটার শব্দ তার মনে কিছু বলে, যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কখনো সে মনে মনে ভাবে—এই জগৎটা কি সত্যি? নাকি সবকিছু একটা পর্দার পেছনের ছায়া? হোস্টেলের

তার রুমমেট আনিস—চটপটে স্বভাবের, একটু রসিকও। প্রথম বর্ষে ওদের বন্ধুত্ব গাঢ় ছিল। আনিসই একমাত্র ছিল যে তাওহীদের নিরবতা বুঝতে চেষ্টা করেছিল। তাদের একবার স্কুলের বার্ষিক খেলাধুলায় অংশগ্রহণের কথা মনে পড়ে—তাওহীদ দৌড় প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়েছিল, আর আনিস বলেছিল, "তুই জিতলি না ঠিকই, কিন্তু তোর চোখে আমি কিছু দেখেছি, যেটা অন্যদের চোখে নাই।" সেই মুহূর্তের বন্ধুত্ব আজও তাওহীদের মনে ছায়ার মতো গেঁথে আছে।

এক রাতে, হেমন্তের হালকা ঠাণ্ডা ভেজা বাতাসে ভেসে থাকা হোস্টেলের ঘরে, সে এক স্বপ্ন দেখে।

স্বপ্নে সে দেখে—এক বৃদ্ধ লোক, পাঞ্জাবি পরা, কাঁপতে কাঁপতে কুয়াশায় ঢাকা এক রাস্তায় হাঁটছে। হঠাৎ তিনি হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। আশপাশে কিছু লোক জড়ো হয়। একজন যুবক এসে তাকে ধরে ওঠায়। দৃশ্যটা খুব সাধারণ, কিন্তু হঠাৎ—স্বপ্নের দৃশ্য থেমে যায় না।

তাওহীদ স্বপ্নেই দেখতে থাকে—বৃদ্ধ লোকটি যুবকের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,

"তুমি জানো না, ঠিক এই মুহূর্তটাই আবার হবে। আবার… এবং আবার। তুমি যতবার দেখবে, ততবারই আমি পড়ে যাব, আর তুমিই আমায় ধরবে।"

যুবক থমকে যায়। কুয়াশায় তার মুখ স্পষ্ট নয়, তাওহীদের মনে হয় সেই যুবক যেন তার মতোই।

যুবক জিজ্ঞেস করে,
"তাহলে কি আমরা ছায়া? সময়ের একটা অনুরণন মাত্র?"

বৃদ্ধ হেসে বলেন,
"সব স্বপ্ন যদি ছায়া হয়, তাহলে কে বলে আলোই বাস্তব?"

হঠাৎ ঘূর্ণির মতো দৃশ্যটা ভেঙে যায়। বাতাসের শব্দ, মানুষের কথোপকথন, কুয়াশার আড়াল—সব মিলিয়ে তা যেন বাস্তবের চেয়েও স্পষ্ট।

পরদিন সকালে, ক্লাসের ফাঁকে হোস্টেলের ছাদে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ সে নিচে তাকিয়ে দেখে—ঘটনাটা একদম সেই রকমই ঘটছে। হুবহু।

তাওহীদ থমকে দাঁড়ায়। হাতের তালু ঘামে ভিজে উঠে। গলা শুকিয়ে আসে। কিন্তু সে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। নিজের মনকে বোঝায়—এটা কাকতাল। একটা ডেজা-ভু।

কিন্তু এরপর এমন ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে।

এক রাতে সে দেখে—তার বন্ধু আনিস পা ভাঙবে। পরদিন খেলতে গিয়ে আনিস সত্যি সত্যি পড়ে যায়। তার এক শিক্ষক—কাজী হুজুর—হার্ট অ্যাটাক করেন, সেটাও সে আগের রাতে স্বপ্নে দেখেছিল। কাজী হুজুর ছিলেন কঠোর, কিন্তু নীরব তাওহীদের প্রতি একধরনের সহানুভূতি ছিল তার। মৃত্যুর আগে একবার তাওহীদকে ডেকে বলেছিলেন, "তোমার চোখে এমন কিছু আছে যা ভয় পাই। সাবধানে থেকো।"

সে কিছু বলে না। শুধু লেখে। একটি খাতায় প্রতিদিনের স্বপ্নগুলো লিখে রাখে। একরকম নিঃশব্দ আতঙ্কে সে দিন কাটাতে থাকে।

একদিন রাতে সে একটি স্বপ্ন দেখে, যা তার সমস্ত জগত পাল্টে দেয়। সে দেখে—রূপসার তীরে দাঁড়িয়ে আছে সে। দূরে নদীর স্রোত। কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। তার নিজের নিথর দেহ নদীতে ভাসছে। কোলাহলহীন। শীতল।

সকালে ঘুম ভাঙার পর তার গা ঘেঁটে ওঠে। তার মনে হয়, সে যেন একটু আগেই মরে গিয়েছিল। এখন সে শুধু হাঁটছে—মৃত্যুর আগের স্মৃতি নিয়ে।

সে স্থির থাকতে পারে না। খুঁজে ফেরে—কোথাও কোনো উত্তর আছে কি? পুরোনো লাইব্রেরিতে গিয়ে খুঁজে পায় এক পুরোনো পাণ্ডুলিপি। সেখানে এক ছাত্রের কথা বলা আছে, “যে স্বপ্নে সময় ছুঁতে পারত।” তার নাম অজানা, কিন্তু লেখা আছে সে একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। পৃষ্ঠার পাশে একটি নোটে লেখা:

“সে একদিন এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করেছিল, যে বলেছিল—‘ঘুমের মধ্যে সময় পলকে খুলে যায়। সেই পথ ঘোরাও হতে পারে।’”

আরও একটি কবিতা:

“চোখ বন্ধ করলেই, সময় খুলে যায়।
বাস্তব নামায় ছায়া—স্বপ্ন যেন ঠিক তার ভিতরেই বাঁচে।”


তাওহীদ ভাবে—তবে কি তিনিই সেই উত্তরাধিকারী? তবে কি স্বপ্নই বাস্তব?

সে বুঝতে পারে, এই ক্ষমতা অলৌকিক কিছু নয়। তার ভেতরের মনস্তত্ত্ব, তার গভীর পর্যবেক্ষণ, তার চেতন-অবচেতন মিলে তৈরি করে এমন এক দৃষ্টিশক্তি—যা বাস্তবতার সীমানা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—সে কি নিজের মৃত্যু ঠেকাতে পারবে?

ঠিক তখনই শুরু হয় অন্য এক চাপ। কে যেন তাকে হুঁশিয়ারি দেয়। তার খাতার পাতায় অজানা হাতে লেখা পাওয়া যায়—“সব জেনে ফেলো না, কিছু ছায়া জানলেই জ্বলে ওঠে।” সে অনুভব করে, কেউ হয়তো তার স্বপ্নে প্রবেশ করতে শিখেছে।

এক রাতে ঝড় ওঠে। হোস্টেলের জানালায় বাতাসের ধাক্কা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাওহীদ আবার সেই স্বপ্ন দেখে—সে নদীর দিকে হাঁটছে। এবার সে থামে না। পা এগোয়। এবং অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

পরদিন সকালে রূপসার তীরে পড়ে থাকে তার খোলা চটি। হোস্টেলের মসজিদের দালানে, তার খাতার পেছনের পাতায় পাওয়া যায় আরেকটি কবিতা:

“আমি যে স্বপ্ন দেখতাম, তা ছিল আমারই ছায়া—
ছায়া যখন ঘন হয়, তখন আলো হারিয়ে ফেলে মুখ।”


কেউ বলে সে আত্মহত্যা করেছে। কেউ বলে, সে পাগল হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ ফিসফিস করে—সে আরেকটা জগতের দরজা খুলে ফেলেছিল।

এক সপ্তাহ পর হোস্টেলের নতুন এক ছাত্র, নাম রুবায়েত, একটি পুরোনো খাতা খুঁজে পায় বিছানার নিচে। খাতায় প্রথম পাতায় লেখা:

“ছায়ালেখা – সময়ের ভেতর এক স্বপ্নযাত্রা।”

রুবায়েত যখন সেই খাতা পড়ে, তার মনে হতে থাকে—সেইসব দৃশ্য যেন সেও কোথাও দেখেছে। মাঝেমধ্যে হোস্টেলের করিডোরে সে অনুভব করে, কেউ হেঁটে যাচ্ছে। রাতের ঘুমে সে চমকে ওঠে, কারণ—স্বপ্নে সে দেখে, এক বৃদ্ধ লোক বলে উঠছেন—

“তুমি জানো না, এই মুহূর্তটাই আবার হবে…”

শেষ নয়, শুরু মাত্র।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৭:৪৭

কামাল১৮ বলেছেন: আত্মকেন্দ্রিক এক যুবকের কথা।এখান থেকে শিক্ষনীয় কিছু নাই।হাজার হাজার হেয়ালি সাথে যুক্ত হলো নতুন আরেকটা হেয়ালি।

২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:২৩

শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু বলেছেন: আপনার মতামতের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আত্মকেন্দ্রিকতার বৃত্তে আটকে থাকা চরিত্রের গল্প বলাই ছিল উদ্দেশ্য—একটা বিকৃতি, একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি, শিক্ষা দেওয়ার নয়। 'হেয়ালি' শব্দটা আপনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, সেটাই আমার গল্পের ছায়া—সব উত্তর পরিষ্কার নয়, সব চরিত্র আদর্শও নয়। তবুও আপনি সময় নিয়ে পড়েছেন এবং প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, এটাই আমার জন্য মূল্যবান। পাশে থাকবেন।

২| ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৭:৪৮

কামাল১৮ বলেছেন: তবে লেখায় মুন্সিয়ানা আছে।

২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:২৫

শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু বলেছেন: আপনার কাছ থেকে 'মুন্সিয়ানা' শব্দটা শুনতে পারা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। আপনার সমালোচনা যেমন আমাকে ভাবায়, তেমনি এই প্রশংসাটুকু সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেয়। গল্পের ছায়া ঘন হলেও, আপনার মতো পাঠকের চোখে তার রেখাচিত্র ধরা পড়েছে—এটাই বড় প্রাপ্তি। কৃতজ্ঞতা জানাই।

৩| ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৪৯

যামিনী সুধা বলেছেন:



ফ্যান্টাসীর সঠিক কোন শুরুও নেই, শেষও নেই; অফুরন্ত শাখা প্রশাখা

২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:০২

শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু বলেছেন: দারুণ বললেন। ফ্যান্টাসি সত্যিই একটা উন্মুক্ত জগত—যার শুরু-শেষ খোঁজার চেয়ে, তার শাখা-প্রশাখায় হাঁটতেই বেশি ভালো লাগে। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

৪| ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

রাজীব নুর বলেছেন: তাওহীদের বাড়ি সুন্দরবনের কাছে। সেখানে আমি গিয়েছি।

২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:০৪

শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু বলেছেন: তাহলে তো আপনি তাওহীদের চেয়েও বেশি সৌভাগ্যবান! সুন্দরবনের গন্ধ টের পেয়েছেন কাছ থেকে—গল্পের ছায়া এবার সেই স্মৃতির সাথেই মিশে থাকুক।

৫| ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:০৫

রাজীব নুর বলেছেন: আমার মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:১৯

শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু বলেছেন: আমার পোস্টে আন্তরিক একটি মন্তব্য করার জন্য আপনাকে আবারো ধন্যবাদ

৬| ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৪৫

এইচ এন নার্গিস বলেছেন: ভালোই হয়েছে

২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:২৪

শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে । আশা করি এই সিরিজের পরবর্তী গল্পগুলো পড়ে আপনার ভালো লাগবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.