নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জিবন মানেই যুদ্ধ,যুদ্ধই সর্বজনীন !!

মামুন আকন

শেখার জন্য এসেছি,,,

মামুন আকন › বিস্তারিত পোস্টঃ

লৌহমানবী ইরম শর্মিলা, ১৬ বছরের অনশন কাহিনী

০৯ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:২৫




সালটা ছিল ২০০০। পয়লা নভেম্বর। দু বাক্স মিষ্টি কিনে এনেছিলেন উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্য মনিপুরের রাজধানী ইম্ফলের বাসিন্দা ২৮ বছরের এক তরুণী। কাউকে ভাগ না দিয়ে গাছের তলায় বসে একাই মিষ্টিগুলো খেয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
সেই মিষ্টির কথা এত বছর পরেও মনে রয়েছে তাঁর। নিজেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রকে এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন সেদিনের সেই তরুণী। ওই মিষ্টির বাক্সটার কথা মনে রাখার কারণও রয়েছে যে। সেটাই এখনও পর্যন্ত তাঁর শেষ শক্ত খাদ্য যে!
সরকারী পশু চিকিৎসা বিভাগের কর্মী ইরম নন্দ আর ইরম সাখির নয় ছেলে মেয়ের মধ্যে সবথেকে ছোট ইরম শর্মিলা তার কিছুদিন আগেই যোগ দিয়েছিলেন মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী হিসাবে। ১২ ক্লাসের পরীক্ষা শেষ করে – কিছুদিন স্টেনোগ্রাফি শেখার শেষে।
পরের দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। অনেক মনিপুরী হিন্দু নারীর মতো ওই তরুণী - শর্মিলাও প্রতি বৃহস্পতিবার উপোষ করতেন ঈশ্বরের আরাধনায়।
সেদিনই দুপুরে ইম্ফলের উপকণ্ঠে মালোমে ঘটে যায় এক হত্যাকাণ্ড।
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা দশজনকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলে আধাসামরিক বাহিনী আসাম রাইফেলসের সদস্যরা।


২০০০ সালে খাওয়া দু বাক্স মিষ্টিই ছিলো ইরম শর্মিলার শেষ শক্ত খাবার
নিহতদের মধ্যে ছিলেন ১৮ বছরের সিনাম চন্দ্রমণি। মাত্র ৫ বছর বয়সে নিজের ছোটভাইকে জলে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন জাতীয় সাহসিকতা পুরস্কার। চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। কিন্তু সেই সেনার গুলিতেই তাঁর মৃত্যু হল।
ঘটনাটা শুনে সাইকেল চালিয়ে মালোমে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলেন শর্মিলা।
রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা রক্তের দাগ দেখে হঠাৎ করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন শর্মিলা। মনিপুরে সেনাবাহিনীর এই আধিপত্য শেষ করতে হবে।
ফিরে এসেছিলেন মানবাধিকার সংগঠনটির নেতা বাবলু লইথংবামের কাছে। জানিয়েছিলেন যে তিনি অনশনে বসতে চান – যতদিন না সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহার করা হচ্ছে – ততদিন।
একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন মি. লইথংবাম।
“আমি বলেছিলাম ঝট করে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিও না। কিন্তু শর্মিলা তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল,” জানিয়েছেন বাবলু লইথংবাম।


১৬ বছর ধরেই ইরম শর্মিলা ছিলেন পুলিশ প্রহরায়
পরিবারের সদস্যরাও হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন অনশনের সিদ্ধান্তে। কিন্তু কিছুই টলাতে পারে নি শর্মিলাকে।
সেই যে একটা বৃহস্পতিবারে উপোষ শুরু হয়েছিল, সেই উপোষী চলেছে গত ১৬ বছর ধরে।
দুদিন পরেই গ্রেপ্তার হন শর্মিলা – অনশন করে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করছেন – এটাই অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে।
কিছুদিন পরেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে শর্মিলার। সরকারের নির্দেশে তাঁর নাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় - নল। প্রয়োজনীয় আধার তরল খাদ্য, পানীয় দেওয়া হতে থাকে।
অন্যদিকে শর্মিলার অনশনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকল মানবাধিকার আন্দোলন।
দিন- মাস-বছর যত ঘুরতে লাগল, এই শান্তশিষ্ট মনিপুরী যুবতী ততই প্রচারের আলোয় আসতে থাকলেন। সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহার করা নিয়ে ইম্ফলের লড়াইয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশেই।
শর্মিলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মনিপুরী নারীদের সংগঠন। তার সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন বহু নারী-পুরুষ।

বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ এই অনশনের কারণে ইরম শর্মিলা হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে প্রতিবাদের প্রতীক
হাসপাতালের চৌহদ্দিতে আত্মীয় স্বজন আর ঘনিষ্ঠ মানবাধিকার কর্মীরা দেখা করেছেন শর্মিলার সঙ্গে। ঠিক হয়েছে আন্দোলনের পন্থা।
রাজনৈতিক নেতা – নেত্রীরা অনুরোধ করেছেন অনশন তুলে নিতে। কিন্তু শর্মিলা অবিচল থেকেছেন তাঁর সিদ্ধান্তে – বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহার করার পরেই মুখে খাবার তুলবেন তিনি।
একের পর এক সরকার এসেছে – গেছে, কিন্তু সেনাবাহিনীর ওই বিশেষ ক্ষমতা আইন তুলে নেওয়া হয় নি। আর একই সঙ্গে ঘটেছে আরও বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনা।
সেইসব হত্যার ঘটনায় যেসব পরিবার হারিয়েছিল তাঁদের প্রিয়জনদের, তাঁরাও এসে দাঁড়িয়েছেন শর্মিলার পাশে।
২০০৪ সালে থঙজাম মনোরমাকে ধর্ষণ করে তারপরে গুলি চালিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
তার প্রতিবাদে মধ্য তিরিশের মনিপুরী নারীরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে আসাম রাইফেলসের দপ্তরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন । তাঁদের হাতে ছিল ব্যানার ‘ভারতীয় সেনা, আমাদেরও ধর্ষণ করো।‘
সেই প্রতিবাদী নারীরাও এসে দাঁড়িয়েছেন শর্মিলার লড়াইয়ের পাশে, তৈরি হয়েছে ‘শর্মিলা কানবা লুপ’।
মানবাধিকার পুরষ্কারও এসেছে দেশ-বিদেশ থেকে। বিশ্বের নামজাদা অথবা বেনামী সংবাদ মাধ্যম – সকলেই এসেছে ইম্ফলে। শর্মিলার লড়াইয়ের কাহিনী তুলে ধরতে।
এরই মধ্যে শর্মিলার জীবনে এসেছেন এক বন্ধু – পত্র মিতালির মাধ্যমে – ডেসমন্ড কুটিনহো। গোয়ার বাসিন্দা ব্রিটিশ নাগরিক মি. কুটিনহো মানবাধিকার কর্মীও বটে। তাঁর সঙ্গে পত্র মিতালী ধীরে ধীরে গড়িয়েছে স্থায়ী সম্পর্কের দিকে।
দেখা তো করা যেত না বেশী, তাই চিঠি অথবা চ্যাট-এই চলেছে তাঁদের প্রেম পর্ব।
শর্মিলার আন্দোলনের সঙ্গীসাথীরা অবশ্য মি. কুটিনহো-কে কখনই সহ্য করতে পারেন নি। সবসময়েই সন্দেহের চোখে দেখতেন তাঁরা। একবার তো নারী মানবাধিকার কর্মীরা মি. কুটিনহোকে মারতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
তবে শর্মিলার প্রতি ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা কিন্তু মনিপুরের মানবাধিকার কর্মীদের অটুট-ই থেকেছে সবসময়ে।


পত্রমিতা বন্ধু কুটিনহোকে বিয়ে করার করে সংসারী হবার ঘোষণাও দিয়েছেন ইরম শর্মিলা
প্রতিবছর নিয়ম করে অগাস্ট সেপ্টেম্বর অথবা নভেম্বর নাগাদ শর্মিলাকে মুক্তি দেওয়া হত জামিনে। তারপরেই আবারও গ্রেপ্তার করা হত।
আত্মহত্যার চেষ্টার মামলা নিয়মিত চলছিল আদালতে।
২৬ শে জুলাই ওই মামলাতেই হাজিরা দিতে আদালতে গিয়েছিলেন শর্মিলা।
সেখানে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন যে অনশন ভাঙ্গতে চান তিনি। তাঁর এই লড়াইয়ের সুফল পাওয়া যায় নি। সরকারকে বাধ্য করা যায় নি সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহার করে নিতে। তাই এবার লড়াই অন্য পথে। পরের বছরের বিধানসভা নির্বাচনে লড়তে চান তিনি। আইনসভায় গিয়েই লড়াই করবেন এবার।
একই সঙ্গে ঘোষণা করেন যে মি. কুটিনহোকে বিয়ে করে সংসারী হতে চান তিনি।
ঘোষণায় অবাক সকলেই – মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে তাঁর পরিবার।
সকলেই প্রশ্ন তুলছেন, হঠাৎ করে কেন একা একা এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি! কেন আন্দোলনের সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে একবার কথা বললেন না?

শর্মিলা অনশন ভাঙ্গার ঘোষণা দেয়ায় অবাক হয়েছেন মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে তাঁর পরিবার
মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে মনিপুরের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ, এমন কি মনিপুরের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন – সকলেই চেয়েছিলেন তিনি অনশন চালিয়ে যান, লড়াই চালিয়ে যান – যতদিন না বিশেষ ক্ষমতা আইন তুলে নেওয়া হচ্ছে।
তবে যে মালোমের ঘটনার দিন অনশন শুরু করেছিলেন শর্মিলা, সেখানকার মানুষ এখনও তাঁরই পাশে। তাঁদের কথায়, ওঁর জন্যই তো গ্রামের মানুষের ওপরে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের কথা সারা পৃথিবীর মানুষ জানে এখন।
সংবাদ মাধ্যমে আপীল করতে শুরু করলেন সকলেই – কারণ পুলিশী নজরদারি এড়িয়ে শর্মিলার কাছে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব। গত বছর থেকে চালু হওয়া এক বিধিতে অনাত্মীয় কেউ বন্দীদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আদালতের অনুমোদন লাগবে একমাস আগে। জমা রাখতে হবে এক লক্ষ টাকা।
তাই শর্মিলা নিজে ঠিক কী ভাবছেন, সেটা জানা কঠিন। কেন তিনি হঠাৎ অনশন প্রত্যাহার করলেন, কেনই বা তিনি নির্বাচনে লড়াই করতে চাইলেন – এসবের উত্তর একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন – মুক্তি পাওয়ার পরে।
তবে তিনি যেমন একার সিদ্ধান্তেই অনশন শুরু করে দিয়েছিলেন, তেমনই সেটা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তটাও একাই নিয়েছেন। আর সেই সিদ্ধান্তে তিনি অবিচলিত – ইস্পাত কঠোর। তাঁর এই মনোভাব জানেন মানবাধিকার আন্দোলনে তাঁর সতীর্থরা।
সেজন্যই তো ইরম শর্মিলা চানুর আরেকটা নাম লৌহমানবী।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.