নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
প্রার্থণা
- মঞ্জুর চৌধুরী
ফাতেমা বেগমের শরীরের কলকব্জা বয়সের দোষে প্রায় সবগুলোই বিকল হয়ে গেছে।
দাঁত প্রায় সবকটাই পড়ে গেছে। চামড়া ঝুলে ঢলঢলে হয়ে গেছে। হাঁটা চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন সেই কবেই। পেশাব পায়খানা বিছানাতেই সারেন। নামাজও পড়েন সেই একই বিছানাতে।
চোখে প্রায় কিছুই দেখেননা। তবু প্রতি ফরজ নামাজ শেষে তিনি পরমকরুণাময়ের কাছে একটাই দোয়া করেন, তিনি যেন তাঁকে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার সুযোগ দেন।
ফাতেমা বেগম তাঁর ছোট ছেলের বাড়িতে থাকেন। ছেলের অভাবের সংসারে তাঁর যত্নআতি তেমন হয়না। বিছানা নষ্ট হবার পরেও তাঁকে অনেকক্ষণ সেই নোংরার মধ্যেই পড়ে থাকতে হয়। ডাকাডাকি করলেও কেউ এগিয়ে আসেনা। শেষে যখন দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে, তখনই কেবল কাজের মেয়েটা আসে। তাও গজগজ করতে করতে বিছানা বদল করে। তিনি তারপরেও দমেন না। বয়ষ্ক মাকে যে এখনও বৃদ্ধাশ্রমে ছেড়ে আসেনি, এইতো অনেক। ছেলের বউর নিজেরও বয়স হয়েছে অনেক। নাতি নাতনিদেরই বিয়ে হয়ে গেছে। অনেকেই তাঁর সামনে সরাসরি বলেন, "বুড়ি মরে না ক্যান? কত ভাল ভাল মানুষ মারা যায়, এ মরবে কবে?"
ফাতেমা বেগম অপমান গায়ে মাখেন না। তিনি তবুও হায়াতের মালিকের কাছে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার ভিক্ষা চান।
তাঁর মস্তিষ্ক তাঁকে বহুদিন ধরেই ধোঁকা দিতে শুরু করেছে। কোন কিছুই এখন আর মনে রাখতে পারেননা। প্রায়ই দুপুরে খাবার আধ ঘন্টার মধ্যেই মিনমিনে স্বরে ডাকেন, "কবির! ও বাবা কবির!"
কবির তাঁর ছোট ছেলের নাম। ছেলে হয়তো তখন মাত্রই ভাতঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, মায়ের ডাক শুনে অতি বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে সামনে এসে দাঁড়ায়।
"কী লাগবো কন।"
"ভুক লাগছে খুব, আইজকা কি ভাত দিব না?"
"এই মাত্রই না খাইলেন? এখন আবার ভুক লাগলো কিয়ের?"
"ও খাইছি নি? ভুইল্যা গেছিলাম। আইচ্ছা, ঠিক আছে, তুই যা।"
ফাতেমা বেগম সব ভুলে গেলেও কিছু ঘটনা তিনি একদমই ভুলতে পারেন না। যেমন তাঁর বড় ছেলে নাসির যেদিন হারিয়ে গিয়েছিল, সেদিনের প্রতিটা ঘটনার কথা তাঁর স্পষ্ট মনে আছে।
কয়েক মাস নিরুদ্দেশ থাকার পর এক মধ্যরাতে দরজায় টোকা দিয়ে নাসির চাপা গলায় ডেকে উঠেছিল, "মা! আমি নাসির। দরজা খুলেন!"
তিনি ছুটে এসে দরজা খুলে দিয়েছিলেন। দাড়িগোঁফের জঙ্গলের আড়ালেও ছেলেকে চিনতে তাঁর কোনই বেগ পেতে হলো না। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি চুমুতে চুমুতে ছেলের মুখ ভরে দিয়েছিলেন।
সেই মাঝ রাতেই ছেলের জন্য চুলায় পোলাও বসালেন তিনি। জবাই করা হলো পোষা মুরগি। ছেলে পোলাও কোর্মা খুব শখ করে খায়। এতদিন বনে জঙ্গলে কি খেয়েছে, না খেয়েছে!
সারারাত ছেলের গল্প শোনার জন্য তিনি ছেলেকে কোলে শুইয়ে বসে রইলেন।
ছেলে বলেছিল, ভোর হবার আগেই তাকে চলে যেতে হবে।
মা বলেছিলেন, "মাত্রইতো আইলি, অখনি কিয়ের যাওয়া যাওয়ি?"
ছেলে বলে, "আমাগো এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকনের নিয়ম নাই।"
তিনি তখন বললেন, "তুই তোর মায়ের কোলে শুইয়া আছোস। তোরে কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবো না।"
রাত আড়াইটার দিকে হঠাৎ দরজায় ধুপধাপ শব্দ। সেই সাথে বাংলায় কেউ হুকুম করে, "দরজা খুলেন!"
নাসির লাফিয়ে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। রাস্তায় মিলিটারী ট্রাক দাঁড়ানো। সুসজ্জিত মিলিটারী পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। পালাবার কোনই পথ খোলা নেই।
এদিকে দরজা প্রায় ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম।
তিনি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চান। ছেলের বাবার অবস্থা বিহ্বল। ছোট ছেলে কবিরের মুখ ফ্যাকাসে।
নাসির নিজেই দরজা খুলে দিল।
ভিতরে ঢুকে এলেন একজন বাঙ্গালি। তাঁদেরই পাড়ার আব্দুল জব্বার। স্থানীয় শান্তি কমিটির মেম্বার। তার সাথে কিছু পাঞ্জাবি মিলিটারী ও বিহারী।
মিলিটারী প্রশ্ন করলেন, "নাসির কৌন হ্যায়?"
কেউ কিছু বলার আগেই আব্দুল জব্বার নাসিরকে দেখিয়ে বলে উঠলো, "এই যে, ইয়ে হ্যায় স্যার!"
অফিসার নাসিরের কাছে এসে জানতে চাইলেন, "তুমহারা নাম নাসির হ্যায়?"
"ইয়েস।"
অফিসার তাঁর লোকদের ইশারা করলেন। একজন বিহারী সৈনিক এগিয়ে এলেন।
"আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।"
"কোথায়?"
"থানায়। কিছু প্রশ্ন করে ভোরের আগেই ছেড়ে দেয়া হবে।"
ফাতেমা বেগম ঝাপিয়ে পড়লেন।
"আমার পোলারে নিয়েন না। নিতে হইলে আমারে নিয়া যান। আমার পোলা কিছু করেনাই, ও কিছু জানেনা।"
তাঁকে সবাই মিলে আটকাতে পারছিল না। তিনিও পারলেন না তাঁর ছেলেকে ধরে রাখতে।
যাবার কালে ছেলে একবার শুধু পেছন ফিরে বলেছিল, "মা, যাই?"
সেই যাওয়াই শেষ যাওয়া ছিল। এরপর আর তিনি ছেলের কোন খোঁজ পাননি।
দেশ স্বাধীন হলো, সবাই ফিরে এলো, তাঁর ছেলে তবু ফিরলো না। তাঁর কোলে মাথা রেখে তাঁর আর গল্প বলা হলো না।
স্বাধীনতার পর আব্বুল জব্বারদের আস্তানা থেকে এক বস্তা মানুষের চোখ উদ্ধার করা হয়েছিল। সেই অগণিত চোখের মধ্যে একজোড়া কি তাঁর নাসিরের?
সেই আস্তানার অদূরে এক গণকবর থেকে অসংখ্য মানব হাড় উদ্ধার করা হয়েছিল। সেখানেই কি তাঁর নাসিরের কবর হয়েছিল?
আব্দুল জব্বারদের বিচারের আশায় তিনি এখনও বেঁচে আছেন।
প্রতিবার নামাজে মোনাজাতের সময় তিনি পরম করুণাময়ের কাছে তাঁকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ করেন। তাঁর বিশ্বাস স্বাধীন(!!) বাংলাদেশে একদিন না একদিন তাদের বিচার হবেই।
স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর কেঁটে গেছে, এইটা তাঁর মনে থাকেনা।
বেশির ভাগ আব্দুল জব্বাররা বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকার পরে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে, সেটাও তাঁর মনে থাকেনা।
একদিকে ভালই হয়েছে যে ফাতেমা বেগম চোখে কিছু দেখেননা। দেখতে পেলে তাঁকে দেখতে হতো যে ওদের জানাজাতে লক্ষ্যাধিক মানুষের ভিড় হয়। ওদের বিচারের প্রতিবাদে রাজধানীতে বাস পুড়ানো হয়, সম্পদ ভাংচুর হয়, এমনকি কাউকে কাউকে প্রাণও হারাতে হয়।
একদিকে ভালই হয়েছে তাঁর মস্তিষ্ক তাঁকে ধোঁকা দিতে শুরু করেছে।
তাইতো তিনি পরম করুণাময়ের কাছে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার প্রার্থণা করেন।
১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:১৮
মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন:
©somewhere in net ltd.
১| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪১
পাজল্ড ডক বলেছেন: