নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

তিন খানা গদ্য

১১ ই নভেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:৩৩

তিন খানা গল্প....

১.

সিলভেস্টার স্ট্যালোনের 'রকি' সিরিজ দেখে রাহিমের শখ হলো বডি বানাবার। বলিউডি হিরোদের মতন স্টেরয়েড বডি নয়, বক্সারদের মতন পেটা শরীরই তার লক্ষ্য।

রাহিমদের শহরে দুই একটা জিম আছে বটে, তবে ওখানে গিয়ে শরীর বানাবার মতন টাকা পয়সা তার নেই। সে কেবলই ক্লাস নাইনে পড়ে।

বিকল্প হিসেবে স্টেডিয়াম মার্কেটের এক দোকান থেকে দুইটা পাঁচ কেজি ওজনের ডাম্বেল কিনে এনেছে। রাহিমের ধারনা স্ট্যালোন হতে এই দুইটা ডাম্বেলই যথেষ্ট।

স্কুলের এক বন্ধু তাকে সাবধান করে বলল, "খবরদার, ডাম্বেল করিস না, তাহলে আর লম্বা হবি না।"

রাহিম অবাক হয়ে বলে, "ডাম্বেলের সাথে লম্বা হবার কী সম্পর্ক?"

বন্ধু বিজ্ঞের মত বলে, "আছে। সম্পর্ক আছে।"

তবে সম্পর্ক আর ব্যাখ্যা করতে পারেনা।

কাজেই রাহিমও নিয়মিত তিনটা কাঁচা ডিম ও এক গ্লাস দুধ খেয়ে বিশ মিনিট দৌড়াদৌড়ি এবং লাফালাফির পর গুনে গুনে একশবার ডাম্বেল তোলা নামা করে। তারপর খালি গায়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। বডি বিল্ডারদের মতন পোজ দিয়ে মনে মনে আনন্দ পায়। তার মনে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে, এইরকম চলতে থাকলে আগামী ছয় মাসের মধ্যেই তার শরীর ‘রকি’র মতন হয়ে যাবে।

ইদানিং তার ছোট ভাই রাফাতও তার সাথে বেয়ামে যোগ দিয়েছে।

বড় ভাইয়ের মতন দৌড়াদৌড়ি, ডন বৈঠক না করে রাফাত কেবলই 'ডাম্বেলিং' করে। তাও আবার ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট একটানা ওঠানামা, তাও আবার কেবল এক হাতে। পাঁচ মিনিট পর আবার অন্য হাতে। এইভাবে কয়েক দফা চলার পর যখন তার হাতের মাসল ব্যথায় টনটন করে, তখন সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ফুলে ওঠা রগ, মাংসপেশী দেখে সেও বড় ভাইয়ের মতন পুলকিত হয়।

দুইভাই একসাথে বেয়াম করায় সময়টা ভালই কাটে। বেয়ামের সময়টাও আরেকটু বাড়ে। রাহিমের মনে হয় এভাবে চলতে থাকলে স্ট্যালোন হতে পাঁচ মাসের বেশি লাগার কথা নয়।

যেভাবে হঠাৎ করেই একদিন শরীর চর্চা শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবেই একদিন হঠাৎ করেই রাফাত বেয়াম ছেড়ে দিল।

রাহিম এতে একটু হতাসও হয়। এই একমাসেই ভাইয়ের হাতের মাসল দারুণ হয়ে উঠেছিল। বাইসেপ, ট্রাইসেপ সব টনটন করতো। ফুলহাতা শার্ট পড়লে বুঝা না গেলেও হাফ হাতা শার্টে স্পষ্ট বুঝা যায়। এখন চর্চা থামিয়ে দিলে যে ওসব নষ্ট হয়ে যাবে!

আর তাকে আবারও একা একাই বেয়াম করতে হবে! তার পাঁচ মাসের টার্গেট আবারও বেড়ে ছয় মাসে গিয়ে ঠেকে।

সে ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করে, "কী রে, হঠাৎ বেয়াম ছেড়ে দিলি যে?"

রাফাত সরল গলায় বলে, "যে কাজের জন্য বেয়াম করতাম, সেটা পূরণ হয়ে গেছে। ওটার আর দরকার নেই।"

রাহিম ভাবে, ছোটভাই বোধয় ক্লাসের কোন এক সুন্দরীকে পটাবার জন্য বেয়াম করতো। এখন হয় মেয়ে পটে গেছে, অথবা অন্য কারও গার্লফ্রেন্ড হয়ে গেছে। কাজেই ভাই ভাবছে, এখন আর ঐ মাসলের দরকার নেই।

জিজ্ঞেস করতে ভাই আসল কারণ বলে।

রাফাতদের স্কুল বাসে চারটা ছেলের একটা 'গ্যাং' আছে। তারা নিজেদের 'নেতা' মনে করে। প্রকাশ্যেই বলে বেড়ায়, "আমরা এই বাসের ক্যাডার।"

তাদের চারজনের যখন যে সীটে বসতে ইচ্ছা হয়, তারা সেখানে গিয়ে বসে। আগে থেকে কেউ ঐ সীটে বসা থাকলে তাকে সীট ছেড়ে উঠে যেতে হয়। যদি উঠতে না চায়, তাহলে তার উপর জোর খাটানো হয়।

ওরা ক্লাস সিক্সে পড়লেও ক্লাস সেভেনের কিছু ছেলেও তাদের সমীহ করে চলে।

ওদের নামে স্কুলের হেড মাস্টারের কাছে কমপ্লেইন করার সাহস কারোরই নেই। কারণ হেড মাস্টারের দৌড়তো স্কুল পর্যন্তই, স্কুলের বাইরে তাদের কে প্রটেকশন দিবে?

অন্যান্য ছাত্রদের তুলনায় রাফাত একটু বেশিই লম্বা। কাজেই তাকেও ঐ চারজনের টিজের শিকার হতে হয়। কখনও তাকে "কানা বগা" (বগা মানে বক এবং সে চশমা পড়ে বলে 'কানা' ডাকে) কখনো বা "তালগাছ" নামে ডাকা হয়। রাফাত দাঁতে দাঁত পিষে সব হজম করে। ওরা চারজন বলে ওদের কখনও কিছু বলেনা।

একদিন রাফাত ইচ্ছা করেই বাসে স্কুলে যাবার সময়ে ঐ চারজনের পছন্দের সীটের একটাতে গিয়ে বসে। ওরা উঠে দেখে রাফাত সেখানে বসে আছে।

একজন কাছে এসে বলে, "ঐ দেখা যায়, তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ.....কীরে কানা বগা? আমাগো সীট গরম করতাছোস ক্যান? নিজের সীটে গিয়া ব!"

রাফাত কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। জানালা আরেকটু খুলতে পারলে ভাল লাগতো, হাওয়াটা বেশ লাগছে।

দলের একজন বলল, "কানা বাবা কী এখন থেইকা বয়রা বাবা হয়া গ্যাছোস?"

এই কথায় বাসের অনেকেই মজা পায়। বাসে মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠে।

ক্ষমতাবানদের কখনও চামচার অভাব হয়না। সেটা রাজনীতির মাঠেই হোক, অথবা স্কুল বাসেই হোক।

রাফাত ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নেয় কারা কারা হাসছে।

জিসানের দাঁত ক্যালানো দেখে সেও মনে মনে হেসে উঠে। এই ছেলে আড়ালে এই চারজনের বিরুদ্ধে পারলে প্রায় জিহাদ ঘোষণা করে, অথচ সামনে এলেই ম্যানা গাই হয়ে যায়।

‘শালা মিচকা শয়তান!’

দলের একজন মধুর স্বরে বলে, "স্যার, আপনারে উঠার লাইগা কী অখন দাওয়াত পত্র পাঠাইতে হইবো?"

আরেকজন সেইরকমই তিক্ত কন্ঠে ধমক দেয়, "হারামির পুত! উঠবি নাকি দিমু একখান?"

রাফাত এবারে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, "আমি আগে আসছি, আমার ইচ্ছা আমি কোন সীটে বসুম।"

বাসের সবাই অবাক হয়ে গেল। এমনকি দলের চারজনও। তাদের মুখের উপর এইভাবে কেউ কখনও কোন কথা বলে নাই। কারও কখনও সেই সাহস হয় নাই।

একজন রেগে গিয়ে তাকে মারতে তেড়ে এলো। রাফাত কেবল তার মার ঠেকিয়ে একটা চড় দিল।

এক মাস ধরে নিয়মিত দশ কেজি ওজনের ডাম্বেলিংয়ের ফল (তাও আবার প্রতিবার প্রতিহাতে টানা পাঁচ মিনিট করে) সে হাতে নাতে পেল। তার ডান হাতের প্রচন্ড চড়ের জোরে ছেলে ছিটকে গিয়ে পাশের সীটে গিয়ে পড়লো।

বাকি তিনজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।

তাদের স্বাভাবিক হবার সুযোগ না দিয়েই রাফাত ওদের আরেকটাকে ধরে আরেকটা চড় দিল। সেও ছিটকে আরেক সীটে পড়ল। তৃতীয় চড় দিতে তৃতীয়টাকে ধরতেই সে এবং চতুর্থজন তার পা চেপে ধরলো।

"ভাই, মাফ কইরা দে! প্লিজ ভাই মাফ কইরা দে! আর ভুল হইবো না!"

রাফাত কলার চেপেই তাকে শুন্য থেকে প্রায় ছয় ইঞ্চি উপরে তুলে ফেলে বাতাসে কিছুক্ষণ ঝাকাঝাকি করে ছেড়ে দিল। এতেই তার কলিজা নড়ে গেছে। এরবেশি আর কিছুর দরকার নেই।

চতুর্থজন বলল, "ভাই, তুই বয়। কোন সমস্যা নাই। আমরা পিছের সীটে যাইতাছি। আইজ থাইকা এই সীট তোর।"

রাফাত বলল, "আমাকে তুই তুকারী কইরা কবি না। আমি তগো ইয়ার দোস্ত লাগি না যে ‘তুই’ কইরা কবি।"

"অবশ্যই তুই তুকারী করুম না। ভাই, তুমি কিছু মনে নিও না। ভুল করে ফেলেছি, আর ভুল হবে না।"

ভয়ে ওরা কেবল 'তুমি' ডাকাই শুরু করলো না, বরং শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলতে শুরু করলো।

বাসের ড্রাইভার কাকু জিজ্ঞেস করলেন, "পিছে কোন সমস্যা হইতাছে নাকি?"

"না, না, কোনই সমস্যা নাই। আপনে ঠিক মতন বাস চালান।"

তখনও চড় খাওয়া দুইজন গাল চেপে আছে। এতক্ষণ শোয়াই ছিল, মাত্র উঠে বসতে পেরেছে।



২.



দ্বীপ রাজধানীর একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। চতুর্থ সেমেস্টার। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তার ক্লাস থাকে। এবং সন্ধ্যায় সে একটি ক্লাস টুর বাচ্চা ছেলেকে পড়াতে আজিমপুর কলোনিতে যায়।

ছেলের নাম লিয়াম, খুবই হাসিখুশি এবং চুতুর বাচ্চা। অসম্ভব কথা বলে, এবং কথা বলতে বলতে মাথা ধরিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।

কিন্তু ইদানিং লিয়ামের কিছু একটা হয়েছে। সে একদমই চুপচাপ হয়ে গেছে।

প্রথমদিকে দ্বীপ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেও ছাত্রের এই হঠাৎ চরিত্র বদলে সে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কোথাও কোন তাল কেটেছে নিশ্চই। লিয়াম বলতে চাইছে না। লিয়ামের অধিক কথা বলায় অভ্যস্ত দ্বীপ এখন তার নিরবতাতে হাপিয়ে উঠেছে।

একদিন দ্বীপের কাছে অংক পরীক্ষা দিতে দিতে লিয়াম বলল, "স্যার একটা রিকোয়েস্ট করবো?"

"কী রিকোয়েস্ট?"

"আগে প্রমিজ করেন রাখবেন!"

দ্বীপ হেসে বলল, "তুমি যদি এখন আমার কাছে সব অঙ্কের সল্যুশন চাও, তাহলে স্যরি can't promise you that!"

স্যারের কথায় লিয়াম হাসলো না। সে বলল, "I promise, আমি ঐ রিকোয়েস্ট করবো না। অন্য একটা রিকোয়েস্ট।"

দ্বীপ জানতে চাইলো, "কী?"

"মমিকে বলবেন, আমাকে যেন বিকালে ফিল্ডে খেলতে না পাঠায়।"

দ্বীপ বলল, "কেন? তোমার খেলতে ভাল লাগেনা?"

"না।"

"তুমি না বলছিলে বড় হয়ে সাকিবের মতন অলরাউন্ডার হবে? মাঠে না খেললে কিভাবে হবে?"

"আমার অলরাউন্ডার হবার দরকার নেই স্যার। আমার ফিল্ডে যেতে ইচ্ছা করে না।"

দ্বীপ একটু বিরতি নিয়ে কিছু একটা ভেবে বলল, "তোমাকে কেউ কিছু বলেছে?"

লিয়ামও সাথে সাথে জবাব দিল না। সেও বিরতি শেষে বলল, "আপনি মমিকে বলবেন, আমাকে যেন ফিল্ডে যেতে না বলে।"

দ্বীপ বলল, "ঠিক আছে।"

"You have to promise স্যার!"

"ওকে, আই প্রমিজ।"

"থ্যাংক ইউ!"

এই ধন্যবাদটাও খুব নিষ্প্রাণ শোনালো।

বেরিয়ে যাবার সময়ে দ্বীপ লিয়ামের মাকে বলল, "আন্টি, আমি আপনাকে কিছুক্ষণ পর ফোন করছি। কিছু জরুরী কথা আছে।"

"এখনই বল না।"

"এখানে বলতে চাইছি না। আমি ফোন করছি।"

লিয়ামের মা কিছু একটা বুঝলেন। তারপর বললেন, "ঠিক আছে। ফোনই কর।"



তিনি ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। প্রথম রিং শেষ হবার আগেই ফোন রিসিভ করলেন।

"হ্যালো, লিয়ামকে নিয়ে কিছু?"

"জ্বী আন্টি। আপনি একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেনতো লিয়ামের খেলার মাঠে কোন ঘটনা ঘটেছে বা ঘটে কিনা। ও আমাকে বলছিল যে সে মাঠে যেতে চায় না। আমার ধারণা something is going wrong, এবং সেটাও তার এই হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাবার সাথে রিলেটেড।"

"ঠিক আছে। আমি দেখবো।"

পরেরদিন লিয়ামদের খেলার মাঠে মোটামুটি একটা কেয়ামত হয়ে গেল।

লিয়াম যথারীতি মাঠে যেতে রাজি হচ্ছিল না। তার মা জোর করেই ছেলেকে পাঠান। লিয়াম কাঁদো কাঁদো চেহারায় খেলতে যায়। এবং তার মা আড়াল থেকেই তার উপর নজর রাখতে থাকেন।

তিনি দেখেন, লিয়াম মাঠে পৌছুলে রাহাত নামের একটা মোটাসোটা ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর সে লিয়ামকে 'বুলি' করতে থাকে। একটা পর্যায়ে লিয়াম দুই হাতে কান ধরে, এবং রাহাত টান দিয়ে লিয়ামের প্যান্ট খুলে দেয়। মাঠের অন্যান্য ছেলে মেয়েরা হাততালি বাজাতে বাজাতে তাদের ঘিরে ধরে। এবং লিয়াম হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। লিয়াম যতই কাঁদে, ওরাও ততই মজা পায়।

লিয়ামের মা আড়াল থেকে ছুটে আসেন। তাঁকে দেখে অন্যান্য সবাই পালিয়ে যেতে পারলেও তিনি সরাসরি গিয়ে রাহাতকে চেপে ধরেন। এক হাতে রাহাতের কান টেনে ধরে আরেক হাতে তিনি নিজের ছেলেকে সামলাতে থাকেন।

তিনি রাহাতকে বলেন, "বদমাইশ ছেলে কোথাকার! কয়দিন ধরে তুমি এই কাজ করছো?"

"আন্টি আমাকে ছাড়েন! প্লিজ! আমাকে ছাড়েন! ব্যথা লাগছে!"

তিনি এবারে লিয়ামকে জিজ্ঞেস করেন, "কয়দিন ধরে সে এই কাজটা করছে?"

লিয়াম মাকে জড়িয়ে ধরে। কিছু বলেনা। শুধু কাঁদে।

শিরিন নামের একটা মেয়ে এগিয়ে আসে। শিরিন লিয়ামদের সাথেই একই ক্লাসে পড়ে এবং একই মাঠে খেলে।

"আন্টি, রাহাত একেকদিন লিয়ামকে একেকরকম পানিশমেন্ট দেয়। মাঝে মাঝে তাকে ড্রেনেও ফেলে দেয়।"

লিয়ামের মার বুক ভেঙ্গে গেল। তিনি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "আমাকে বল নাই কেন এতদিন?"

ছেলে তখনও কাঁদছে। মায়ের উপর তার এক পাহাড় অভিমান জমাট বেঁধে ছিল। আজকে সব গলতে শুরু করেছে।

তখনও তিনি রাহাতের কান চেপে ধরে আছেন। রাহাত ব্যথায় চিৎকার করছে।

"আন্টি ছাড়েন! প্লিজ! আর করবো না। কান ছিড়ে যাচ্ছে!"

তিনি রাহাতের কানে ধরেই তাদের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। লিয়াম তখনও মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। শিরিন ছাড়াও আরও কিছু ছেলে মেয়েও তাঁদের সাথে যাচ্ছে।

ঘটনা শুনে রাহাতের মা বললেন, "এসব কী বলছেন ভাবি? আমার ছেলে এমন করতেই পারে না। আপনার কাছে কোন প্রমাণ আছে?"

"এই যে এরা সবাই প্রতিদিন দেখে।"

শিরিনরা সাথে সাথে সাক্ষী দিল।

রাহাতের মা সুর পাল্টে বললেন, "ছেলেরা একটু আধটু দুষ্টামিতো করবেই। এজন্যইতো ওরা ছেলে। এ নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে?"

"এটাকে দুষ্টামি বলছেন? এটা কোন লেভেলের দুষ্টামি?"

"যাই হোক। আপনি আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার কে? আমরাই যেখানে ওদের গায়ে কখনও হাত তুলি না!"

লিয়ামের মা এবারে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, "আপনার ছেলের গায়ে আপনি হাত তোলেন না সেটা আপনার ব্যপার। কিন্তু আমার ছেলের সাথে যদি ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ফাজলামি করতে আসে, তবে আমি কথা দিচ্ছি আমি তাকে একদম ছিড়ে দুইভাগ করে দিব! সে দেশের প্রেসিডেন্টের ছেলে হলেও আমি পরোয়া করবো না।"

তারপর তিনি রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, "মনে থাকে যেন।"

রাহাতের কান তখনও ব্যথায় টনটন করছে। সে একহাত কানে রেখেই মাথা নাড়ল।

লিয়ামের মায়ের কথা তার মনে থাকবে।



৩.



মুহিব ক্লাসের সবচেয়ে রোগা ছেলে। এমনই রোগা যে তাকে দেখলেই প্রথমে মনে হয় যেন একটু জোরে বাতাস দিলেই সে উড়ে দূরে কোথাও চলে যাবে।

ক্লাসের বাংলা টিচার একবার তাকে নাম দিয়েছিলেন "পাট কাঠি।"

সেই নামটাই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে গেল। ক্লাসের সবাই তাকে ডাকতে শুরু করলো, "পাট কাঠি! পাট কাঠি!!" নামে।

ইদানিং অন্যান্য ক্লাসের বাচ্চারাও তাকে এই নামে ডাকতে শুরু করেছে। ছোট ক্লাসের বাচ্চারা আবার এক রতি বেশি বদ। আড়াল থেকে 'পাটকাঠি' ডেকে হাততালি দিতে থাকে। যখনই সে ফিরে তাকায় তখন তারা খিল খিল হাসতে হাসতে ভো দৌড়!

রোগা বলেই মুহিব সরাসরি প্রতিবাদ করার সাহস পায়না। সে পালিয়ে বেড়ায়। এতে ক্লাসের অন্যান্য ছাত্ররাও খুব মজা পায়। টিফিন পিরিয়ডে তাদের একটি পছন্দের খেলা হলো মুহিবের পিছনে দৌড়ে দৌড়ে তাকে পাটকাঠি বলে ক্ষেপানো।

সে একদিন টিচারস কমন রুমে গিয়ে বাংলা টিচারকে মিনমিনিয়ে বলল, "টিচার! ওরা সবাই আমাকে পাটকাঠি বলে ডাকে।"

কথাটা শুনে টিচার বললেন, "তুমিতো পাট কাঠিই। তোমাকে পাটকাঠি ছাড়া আর কিই বা বলবে?"

এতে অন্যান্য টিচাররাও খুব মজা পেলেন। ধর্ম টিচার বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললেন, "আজকালকার ছেলে মেয়েদের ক্রিয়েটিভিটিতে মুগ্ধ না হয়ে পারাই যায় না! কী নাম দিয়েছে! হিহিহি। পাটকাঠি!"

অঙ্ক স্যার কিছুক্ষণ হাসাহাসির পর তাকে কাছে ডেকে এনে বললেন, "বেশি করে খাও, বুঝলে? বেশি করে খেলে তোমাকে আর পাটকাঠি নামে ডাকবে না।"

ধর্ম টিচার জানতে চাইলেন, "তাহলে তার নতুন নাম কী হবে?"

অংক স্যার বললেন, "জানিনা, সেটাও ওরাই হয়তো ঠিক করবে।"

বাংলা টিচার বললেন, "তখন হয়তো তার নাম হবে মূলি বাঁশ! হিহিহি।"

কমনরুমে আরেকবার হাসির রোল উঠলো।

মুহিব কাঁধ ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসে।

বাইরে তার জন্যই অপেক্ষা করতে থাকে তার ক্লাসমেটের দল।

"কিরে পাটকাঠি! টিচাররা কী তোকে এখন থেকে 'বেত' হিসাবে ব্যবহার করতে চায়? হিহিহি!"

আরেকজন বলে, "এই বেতে মারলে অনেক জ্বলবেরে.....বেত যত চিকন, তত বেশি জ্বলুনি!"

মুহিব ছুটে ক্লাসরুমে যায়। ওরা অবশ্য ক্লাসরুম পর্যন্ত তাড়া করেনা। টিফিন পিরিয়ড ক্লাসরুমে কাটানোর কোন মানে হয়না। পাটকাঠিকে ক্লাস পিরিয়ডেও ক্ষ্যাপানো যাবে।

ক্লাসের বেঞ্চিতে মাথা নিচু করে থাকা অবস্থায় 'পাটকাঠির' মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। তাকে ক্ষ্যাপানো দলের প্রধাণ হচ্ছে জাকির। জাকিরের মাই আবার স্কুলের বাংলা টিচার। “মা পুতে মিইল্লা, তারে খাচ্ছে গিইল্লা।” ওদের বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা তার নেই। তবে জাকিরকে শাস্তি দেবার যে কোন পথই খোলা নেই, এমনটা কে বলেছে?

সে নিজের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে গিয়ে দুরুদুরু বুকে জাকিরের ব্যাগের জিপ খুলে। যা খুঁজছিল তা সে পেয়ে যায়। জাকিরের একটা বিদেশী পেন্সিল বক্স আছে। লন্ডন থেকে সে নিয়ে এসেছে। দেখতে একটা গলফ সেটের মতন দেখায়, পেন্সিলগুলি আসলে গলফ ক্লাব, ইরেজারগুলো আসলে গলফ বল; আবার স্কেলে নয়টা হোলও আছে। এই ব্যতিক্রমধর্মী পেন্সিল বক্স দেখিয়ে জাকির অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সামনে খুব পার্ট নেয়।

ওকে পাটকাঠি নামে ডাকার শাস্তি স্বরূপ মুহিব পেন্সিল বক্সটা জাকিরের ব্যাগ থেকে সরিয়ে ফেলে।

টিফিন পিরিয়ড শেষে যখন আবারও ক্লাস শুরু হয় ব্যাগ খুলে প্রথমেই জাকির লক্ষ্য করে যে তার ব্যাগে পেন্সিল বক্স নেই। 'চোর' কে সেটা বুঝতে তার এক মুহূর্তও দেরী হয় না। সে সরাসরিই মুহিবকে জিজ্ঞেস করে, "আমার পেন্সিল বক্স কই?"

মুহিব খুবই অবাক হবার ভান করে বলে, "আমি কী করে বলবো তোমার পেন্সিল বক্স কোথায়?"

জাকির রাগে গজগজ করতে করতে বলে, "আমি কিন্তু তোমার ব্যাগ চেক করবো।"

"শিওর! কিন্তু যদি না পাও?"

জাকির কোন কথা না বাড়িয়ে মুহিবের ব্যাগ খুলে হাতড়াতে লাগলো। মুহিব নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লাসের বাকি ছেলে মেয়েদেরও কৌতুহলী দৃষ্টি তাদের ঘিরে।

কিছু না পেয়ে জাকির পুরো ব্যাগটাই উল্টো করে সব বইখাতা বের করে ফেলল। গোয়েন্দা গল্প বেশি পড়ে কিনা। তাই কোন গুপ্ত পকেট আছে কিনা সেটাও হাতড়ে হাতড়ে দেখলো।

টিচার এসে দেখলেন ক্লাসের এই অবস্থা। তিনি হুঙ্কার দিলেন।

"কী হচ্ছে এসব?"

জাকির হাহাকার করে বলল, "টিচার! আমার পেন্সিল বক্স খুঁজে পাচ্ছি না।"

মুহিব অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, "আর ও বলছে আমি সেটা চুরি করেছি!"

টিচার বললেন, "ছিঃ! এইভাবে কাউকে চোর বলতে নেই।"

জাকির বলল, "আমি জানি ও চুরি করেছে।"

"কেন মনে হচ্ছে?"

জাকির আর কথা বলতে পারেনা। সে যদি 'পাট কাঠি' ডাকার কথা স্বীকার করে ফেলে, তাহলেতো তারই বিপদ। বিজ্ঞান টিচার প্রচন্ড রাগী একজন মহিলা। তিনি কখনও পরোয়া করেন না কারও মা স্কুলের বাংলা টিচার নাকি কারও মা ঘরের গৃহিনী। সপাং সপাং করে তাঁর বেত অপরাধীর পিঠে আছড়ে পরে।

মুহিব মনে মনে আশা করেছিল এই ধাক্কায় জাকির স্বীকার করবে। সে ঠিক করে রেখেছিল যদি জাকির স্বীকার করে এবং তাকে টিচাররা 'উপযুক্ত শাস্তি' দেন, তাহলেই কেবল সে তার পেন্সিল বক্স ফিরিয়ে দিবে। আর নাহলে পেন্সিল বক্স হারানোটাই তার শাস্তি।

টিচার বলেন, "তোমার কাছে কোন প্রমাণ আছে সে চুরি করেছে?"

জাকির মাথা নিচু করে বলে, "না টিচার।"

"তাহলে ওকে স্যরি বল! এখুনি!"

জাকির মিনমিনিয়ে স্যরি বলে।

"এখন সবাই যে যার বেঞ্চে গিয়ে বস। এটা ক্লাসরুম। কোন বাস স্টেশন না।"

ক্লাস চলার সময়ে জাকির এক ফাঁকে মুহিবকে ফিসফিসিয়ে বলে, "প্লিজ আমার পেন্সিলবক্সটা ফিরিয়ে দে। ওটা আমার খুব প্রিয়!"

কোন এক অদ্ভূত কারনে মুহিবের মনে ততক্ষণে এক অজানা আত্মবিশ্বাস এসে ভর করেছে। জাকিরের কথাটা শুনেই সে গলা চড়িয়ে বলল, "টিচার! জাকির আমাকে এখনও চোর বলছে!"

টিচার ধমক দিলেন, "এই জাকির! এসব কী শুরু করলে! এখুনি আবার তাকে স্যরি বল! এবং তুমি সামনের বেঞ্চে এসে বসো! এখুনি!"

মুহিব এইবারও ঠিক করেছিল, টিচার যদি জাকিরকে বেতের বাড়ি মারেন, তাহলেও সে তার পেন্সিল বক্স ফেরত দিয়ে দিবে। টিচার এইবারও তাকে হতাশ করলেন।

ছুটির ঘন্টা বাজার পর সবাই বাড়ির দিকে রউনা হলো। জাকির তার বড় ভাইয়ার সাথে হেঁটে বাড়ি ফিরে। তাদের বাড়ি মাত্রই বিশ মিনিট দূরে। মাঝ রাস্তায় গিয়ে সে হঠাৎ ভাইয়াকে বলে, "আহারে! পেন্সিল বক্সটা স্কুলে ফেলে এসেছি!"

ভাইয়া বললেন, "কালকে গেলেই পাবি।"

"যদি না পাই! আম্মু খুব মারবে! তুমি দাঁড়াও, আমি এক দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসছি।"

"দাঁড়া আমিও আসছি।"

ভাইয়া পিছন পিছন আসতে থাকেন। মুহিব দৌড়ে গিয়ে স্কুলের টয়লেটে গিয়ে হাজির হয়।

টয়লেটের ভেন্টিলেটরের খাঁজটাতে সে অত্যন্ত সাবধানে জাকিরের পেন্সিল বক্স লুকিয়ে রেখেছিল। নিচ থেকে খুব ভাল করে খেয়াল না করলে বুঝতে পারার কথাই নয় যে ওটা ওখানে আছে।

হাতড়ে হাতড়ে পেন্সিল বক্সটা নামিয়ে এনেই সে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল।

মনে মনে বলল, "তুমি যদি 'ফেলুদা' পড়ে থাক বাছাধন, তাহলে আমিও শার্লক হোমসের ভক্ত!"

জাকিরকে শাস্তি দেয়া হয়ে গেছে। এখন থেকে এই পেন্সিল বক্সটা তার।

পরিশিষ্ট: পরের ক্লাসেই মুহিব এই স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হয়। স্কুলের শেষ দিন পর্যন্ত জাকির আর কখনই মুহিবকে "পাটকাঠি" নামে ক্ষ্যাপায়নি। জীবনের একটা লম্বা সময় ধরে সে তার সাধের পেন্সিল বক্সটাকে মিস করেছে।

https://www.facebook.com/groups/canvasbd

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:২৩

নাজমুল হাসান মজুমদার বলেছেন: মজা পাইলাম গল্পে । আরও লেখার অপেক্ষায়

১১ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫২

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ! :)

২| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:০০

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: বাস্তবধর্মী একটা লেখা +++++++

ভালো থাকবেন ।

১১ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫৩

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.