নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
সায়েম ক্লাস এইটের সমাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষা দিতে বসেছে। প্রশ্ন পেয়েই তাঁর মাথা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। "সমাজ কি? সংজ্ঞা সহ উদাহরণ দাও।" মার্কস ১০!
গতকাল রাতে একটানা একঘেয়ে সুরে সে "সমাজের" সংজ্ঞা মুখস্ত করেছিল। এখন কিছুতেই মনে পড়ছে না। তার স্মৃতি শক্তি তাকে এইভাবে ধোঁকা দিল! মা বলেন দুধ খেলে স্মৃতি শক্তি বাড়ে। সে বিস্বাদ দুধ মুখেই তুলতে পারেনা। এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর কোনদিন গ্লাসের দুধ কাজের ছেলেটিকে লুকিয়ে লুকিয়ে খাইয়ে দিবে না।
সে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে সিদ্ধান্ত নেয় বানিয়ে বানিয়েই লিখবে। বানিয়ে লেখার জন্য সে নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগলো।
বাবা মা প্রায়ই বলেন, আমাদের দেশের সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের সবসময়েই গর্ব করা উচিৎ। সায়েম মনে করার চেষ্টা করছে, তাঁরা "সমাজ" "সংস্কৃতি" বলতে ঠিক কী বুঝান।
তার কয়েকটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।
মিলন আঙ্কেলের বাসায় এক ডিনারের দাওয়াতে একটি আন্টির সাথে বাবার পরিচয় হয়েছিল। বাবারই এক বন্ধুর (জলিল আঙ্কেল) ঘনিষ্ট বান্ধবী তিনি। আন্টিটি গুণবতী এ নিয়ে কোনই সন্দেহ নেই। যেমন দেখতে রূপসী, তেমনি তাঁর আচার ব্যবহার। তাঁর সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেই বুঝা গেল তিনি ভীষণ স্মার্ট! এই ধরনের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে যে কেউ পছন্দ করবে। সায়েম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, বড় হয়ে সে এই আন্টির মতই কাউকে বিয়ে করবে।
পরে অন্য এক পার্টিতে বাবা জলিল আঙ্কেলের সাথে সেই আন্টিকে নিয়ে কথা বলতে গেলেন, "জানিস? সেদিন আমার সাথে নিশার (কাল্পনিক নাম) পরিচয় হয়েছিল।"
"হ্যা দেখেছি। খুব ঢলে ঢলে কথা বলছিলি। তুই কী জানিস এই মেয়ে ডিভোর্সী?"
এই এক ঘটনা থেকেই সায়েমের মনে কয়েকটি প্রশ্ন জেগে উঠলো।
ডিভোর্স নিয়ে কী আন্টি বিরাট কোন অপরাধ করে ফেলেছে? বাংলাদেশের সংবিধানেতো ডিভোর্স নেয়া কোন অপরাধ নয়। ইসলামী শরিয়া আইনেও নয়। আমাদের নবীজিরই (সঃ) যেখানে প্রায় সব স্ত্রীই ছিলেন ডিভোর্সী অথবা বিধবা। তাহলে কেন এটাকে এত বড় করে দেখা হয়? তবে এটাই কী বাংলাদেশী সংস্কৃতি?
সায়েমের জন্ম বিদেশে। এখনও বছরের তিন চার মাস তাদের বিদেশেই কাটে। সে শুধুমাত্র বাংলাদেশী "সমাজ" ছাড়া আর কাউকে এই বিষয় নিয়ে এত আলোচনা করতে দেখেনি। একজনের সাথে বিয়ে হয়েছিল, তার সাথে মতের মিল হয়নি বলেই বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তবে এটিই জীবনের শেষ নয়। অন্যান্য দেশে একে ফু দিয়ে উড়াবারও যোগ্য মনে করে না। আমরা বাঙালিরাই যা ফালাফালি করি। আমাদের অনেক আজাইরা সময়!
আর জলিল আঙ্কেল যদি ডিভোর্সী হবার "অপরাধে" কাউকে দোষী জ্ঞান করেই থাকেন এবং অন্যের সামনেও তাঁর বদনাম করে থাকেন, তবে তিনি নিজেই বা কেন তাঁর সাথে এত ঘনিষ্টভাবে মেশেন? তাঁর সাথে আঙ্কেলের কথাবার্তা শুনলেতো বেচারী বুঝতেও পারবে না তিনি তাঁর পিঠে ছুরি চালান! এই হিপোক্রেসীও কী বাঙালি সংস্কৃতির অংশ? এই নিয়েও আমাদের গর্ব করা উচিৎ?
যখন রোকেয়া আন্টি জানতে পারলেন যে নিশা আন্টির ডিভোর্স হয়েছে, তখন তিনি খুব দুঃখী গলায় জানতে চান, "তোমার খবর শুনলাম। খবরটা শোনার পর আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনাই। এতই খারাপ লেগেছিল, জানো! আচ্ছা, ঘটনা কী হয়েছিল বলতো! আমাকে বলতে পারো, আমি কাউকে বলবো না।"
এবং নিশা আন্টিও বোকার মতন সব কথা বলে দেন।
পুরো "সমাজে" রটে যেতে এক দিনও সময় লাগেনি। এবং বলাই বাহুল্য, বাড়তি মশলা যোগ হয়েই।
"আমি আগেই বলেছিলাম, এই মেয়ে সংসারী মেয়ে না। আপনিইতো বিশ্বাস করেননি। এত ফাস্ট মেয়েরে বাবা! ফেসবুকের ছবি দেখেন নাই? যে সমস্ত ড্রেস পড়ে, কোন ভদ্র ঘরের মেয়ে এমন ড্রেস পড়তে পারে? আপনিই বলেন? ছিঃ!"
সায়েমের মনে প্রশ্ন জাগে, এইটাও কী আমাদের সংস্কৃতি যা নিয়ে আমাদের গর্ব করা উচিৎ? যদি না হয়ে থাকে, তবে আমাদের সমাজের নব্বই ভাগেরও বেশি মানুষের এই স্বভাব আছে কেন?
একদিন ছোট কাকুও ফোন করেছিলেন নিশা আন্টিকে। সে ব্যাট খুঁজতে কাকুর ঘরে গিয়েছিল, কাকু বুঝতে পারেননি। কাকুর কানে সমস্যাতো, ফোনের স্পিকারে অনেক জোরে কথা শোনা যায়।
"তোমার খবরটা জানার পর আমার খুব খারাপ লেগেছে বুঝলে? আমি তোমার পক্ষেই আছি। যদি কখনও কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে আমি মাত্র একটা ফোন কল দূরে।"
"থ্যাংক ইউ ভাইয়া।"
"না না, থ্যাংকস দিতে হবে না। আর ইয়ে, মানে ভাইয়া বলো না। আমাকে তোমার বন্ধু মনে করো।....."
এইটা এমনিতেই মনে পড়লো। বিশ্বের সব সমাজের সব পুরুষেরাই এমন। এইটি পুরুষ সমাজের সংস্কৃতি, যা নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই।
সমাজের সংজ্ঞা কিছুতেই মনে না পড়ায় সায়েম আরেকটা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলো।
তাদের পাশের বাসার নিম্মি আপুকে তার স্বামী পিটিয়ে আইসিইউতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ কেস নিতে এসেছিল, কিন্তু নিম্মি আপুর মা বাবা কেস ফাইল করতে রাজি হয়নি। মেয়ে "যদি" বেঁচে ফিরে আসে, তবে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার স্বামীর বাড়ি ফেরত পাঠানো হবে। মেয়ের সংসার ভেঙ্গে গেলে সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে?
সায়েমের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। সে সমাজের সংজ্ঞা খুঁজে পেতে শুরু করেছে। তবে তার আগে মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে।
যেই সমাজের কারনে কারও মেয়েকে সারাজীবন জানোয়ারের হাতে মার খেয়ে থাকতে হয়, কোথাও কোথাও ক্ষেত্র বিশেষে মেয়েকে আত্মহত্যাও করতে হয়, সেই সমাজকে নিয়ে গর্ব করার কথা আমাদের শেখানো হয়?
নিম্মি আপুর আব্বা মারা গেলে তাঁর জন্য দুই ফোঁটা "আন্তরিক" অশ্রুজল কে ফেলবে? সমাজ, না নিম্মি আপু? কারও বাবা বিপদে পড়লে কে নিঃস্বার্থভাবে তাঁর পাশে থাকবে? সমাজ, না তাঁর মেয়ে? তাহলে বাবা মারা কেন নিজেদের মেয়েকে ফেলে সমাজকে সুখী করতে ব্যস্ত? এইটাই আমাদের সংস্কৃতি? একে নিয়েই গর্ব করতে হবে?
সায়েম উদাহরণ পেয়ে গেছে। সে আগে সংজ্ঞা লিখতে শুরু করলো।
"সমাজ" হচ্ছে সেই মানবগোষ্ঠী যারা কারও মেয়ের বিয়ের দাওয়াত পেয়ে নিজের জ্ঞাতি গুষ্ঠীসহ খেতে চলে আসে, এক টাকা দিয়ে সাহায্য না করলেও আয়োজনে একটু এদিক ওদিক হলে বদনাম করতে এতটুকু ছাড় দেয় না; কনের বিয়ের সাজে একটু এদিক ওদিক হলে আড়ালে গিয়ে বলে, "বাজে মেকাপ! একদম ভাল দেখাচ্ছে না" - এবং সেই বধূ যদি ভবিষ্যতে স্বামীর হাতে মার খায়, তবে এরাই উল্টো মেয়েকে বুঝাতে আসে, "সহ্য করে নাও মা। সংসারে টুকি টাকি এমন হয়েই থাকে।"
লেখা শেষে সে ভুরু কুঁচকে ভাবে, উত্তর কী সঠিক হয়েছে? ম্যাডাম দশের মধ্যে কত দিবেন?
১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:২৮
মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: জাযাকাল্লাহ!
©somewhere in net ltd.
১| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৭:০৬
নূসরাত তানজীন লুবনা বলেছেন: সর্বপ্রথম ভান্ডারে নিলাম দেন কমেন্ট
অতি অসাধারন
আমাদের দেশের সমাজের বেশিরভাগ মানুষের কাজ ছিদ্রান্বেষণ
এবং এর প্রচার প্রসার
জাযাকাল্লাহ
ভালো থাকুন