![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সম্প্রতি অক্সফোর্ডের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিশ্বে যেসব দেশ দারিদ্র্য বিমোচনে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে, সেগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ, নেপাল ও রুয়ান্ডা। এমনকি বাংলাদেশ ও নেপাল দারিদ্র্য বিমোচনে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকেও অনেক পেছনে ফেলেছে। অক্সফোর্ড প্রভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (ওপিএইচআই) পরিচালক সাবিনা আলকার পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ভারত যেখানে ফিবছর দারিদ্র্যের হার ১ দশমিক ২ শতাংশ কমিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ ৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং নেপাল ৪ দশমিক ১ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছে।
এ কারণেই অক্সফোর্ডের গবেষণায় দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ, নেপাল ও রুয়ান্ডাকে স্টার পারফরমার বা তারকা কুশীলব বলে অভিহিত করা হয়েছে।
কয়েক দিন আগে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিবেদনে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। মানব উন্নয়নে বর্তমানে ১৮১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬, গত বছর যা ছিল ১৪৭।
ভারতের নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রায়ই বাংলাদেশের অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁর মতে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে।
কেবল মানবসম্পদ উন্নয়ন নয়, অধুনা বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন, প্রবাসী-আয়, রপ্তানি আয়, দুর্যোগ মোকাবিলাসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি খাতে বিরাট সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ শুধু পরিশ্রমী নয়, উদ্যমীও।
গত সোমবার ১৮ দলীয় জোট আহূত ৩৬ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিন প্রথম আলোর অর্থ ও বাণিজ্য পাতায় পাঁচটি ইতিবাচক খবর ছিল যথাক্রমে: ‘দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ব্যাংকের অর্থায়ন বাড়ছে’, ‘চট্টগ্রাম বাণিজ্য মেলায় জমজমাট বিকিকিনি’, ‘সাত মাসে পণ্য আমদানি ব্যয় কিছুটা কমেছে’, ‘শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে’ এবং ‘মংলা ইপিজেডে দেশীয় ক্রোকারিজ কারখানা হচ্ছে’।
অর্থাৎ, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত হচ্ছে, মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা মনে করেন বাংলাদেশ শিগগিরই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ক্লাবের সদস্য হতে যাচ্ছে। বর্তমানে চীন, ভারত, মোজাম্বিক, উগান্ডা ও কম্বোডিয়া এই ক্লাবের সদস্য।
এটি এক বাংলাদেশের চিত্র। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। অগ্রসরমাণ বাংলাদেশ। আলোকিত বাংলাদেশ। বিশ্বকে তাক লাগানো বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের নির্মাতা সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষ। এই বাংলাদেশের নির্মাতা গ্রামের কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, খুদে ও মাঝারি খামারি। এই বাংলাদেশের নির্মাতা কারখানার শ্রমিক, ছোট-বড় শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী; এমনকি আজিজ মার্কেটের তরুণ বাটিক ও বুটিক বিক্রেতারাও এর বাইরে নন। এই বাংলাদেশের নির্মাতা তৈরি পোশাকশিল্পের ৩০ লাখ নারী শ্রমিক এবং বিদেশে কর্মরত ৬০ লাখ মানুষ, যাঁরা কেবল নিজের জন্য গায়ের রক্ত পানি করেন না। যত দূরেই থাকুন না কেন, তাঁদের হূদয়ে সদা জাগরূক থাকে বাংলাদেশ। পশ্চিমা গণমাধ্যম পূর্বের ব্যাপারে যত কৃপণই হোক না কেন, তারাও বাংলাদেশের এই সাফল্যের কথা না বলে পারছে না।
ইংরেজ নদীবিশেষজ্ঞ স্যার উইলিয়াম ১৯২৮ সালের এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিলজুড়ে ছড়ানো প্রাচীন সেচব্যবস্থা এ দেশের মানুষের সামাজিক উদ্যোগের ফসল। বন্যা মোকাবিলায় বাঁধ নির্মাণ ও কাটা, সেচের খাল-নালা দেখভাল করা, সড়ক-বিদ্যালয় নির্মাণের মতো বহু সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে মানুষ একযোগে কাজ করত এবং এসবের ওপর তাদের হক প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সামাজিক পুঁজির বরাতে অনেক অসুবিধার মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েছে, টিকে থেকেছে।
যশোরে ভবদহ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছিল ওয়াপদার ভুলে। কিন্তু এর সমাধান হয় স্থানীয় মানুষদের আন্দোলন ও উদ্ভাবনার ফলে। জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন যখন সমুদ্রের তলে জমি ডুবে যাওয়ার কথা, তখন দক্ষিণাঞ্চলে চাষিদের বুদ্ধিতে সমুদ্রের তল থেকে ভূমি জাগানো সম্ভব হচ্ছে।
এই সামাজিক শক্তির খবর না জানার জন্যই হয়তো ২০০৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তো ‘দ্য পাজল অব বাংলাদেশ’ নামে একটা প্রতিবেদন ছাপে। এর সারমর্ম হলো, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন নেই, নেই সুশাসন, নেই সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব, নেই দূরদর্শী ও জনমুখী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের ছায়াসঙ্গী। তার পরও গত দেড় দশকে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপর ধরে রেখেছে। ২০০৬-০৭ সালে জিডিপি সাড়ে ৬-এর ঘরেও উঠেছিল। মানে না হলেও পরিমাণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ভারতকে ছাপিয়ে গেছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় নারী-পুরুষ বৈষম্য কমানোয় ভারত থেকে এগিয়ে। পাঁচ রকম কারণে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ভারত বা চীনসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের থেকে কম। দারিদ্র্য প্রতিবছর ১ শতাংশ করে হলেও কমছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আত্মবিশ্বাসী করার মতো। জিডিপিতে বিদেশি সাহায্যের ভাগ ৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। দুর্নীতি আর লুটপাট কিছুখানি কমলে এটুকুও দরকার হতো না।
কীভাবে এই গতিশীলতা সম্ভব হচ্ছে, তা সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে একটা ধাঁধা। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন ‘দি বাংলাদেশ প্যারাডক্স’। তাঁদের বিস্ময়ের কারণ এ দেশের সাধারণ মানুষ—আসলে কৃষির মানুষ, মাটির মানুষ যাঁরা। তাঁরা গরিব কিন্তু সৎ, অনাহারী, লুঙি-শাড়ি পরা এবং আধুনিকতাবাদীরা এঁদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলতে ভালোবাসেন। এই মানুষেরাই দুই হাত আর মাটির ওপর বিশ্বাস রেখে প্রতিবছর খাদ্য উৎপাদন ৩ শতাংশ করে বাড়িয়ে যাচ্ছেন। এই বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছাপিয়ে যাওয়ায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। অথচ একদিকে সার-বিদ্যুৎ-পানি-বীজ-ঋণের জন্য মনুষ্যশক্তির সঙ্গে, অন্যদিকে বন্যা-খরা-মড়কের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে কী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই-ই না কৃষক নামের এই প্রজাতিকে লড়তে হয়! যাঁকে চিরকাল মাটির ওপর উবু হয়ে কাজ করে যেতে দেখি, যিনি প্রায়শই ফসলের ন্যায্য দাম পান না, ঋণের সুদ যাঁর পিছু ছাড়ে না, সেই মানুষটির মতো জীবনীশক্তি কার আছে? তাঁদের কল্যাণেই হাজার বছর বয়সী অন্নাভাব কাটাবার সামর্থ্য বাংলাদেশের দোরগোড়ায়।
২০০৫-এর বন্যার পরে আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ করে প্রবৃদ্ধি ৫-এর ঘরেই থেকেছে। ওই বছরই কোটার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া আর চীনা প্রতিযোগিতার মুখে তৈরি পোশাকশিল্প যায় যায় রব উঠেছিল। কিন্তু যায়নি, বরং আরও বেড়েছে। চলতি বৈশ্বিক মন্দার তোড়ে কত হাতি-ঘোড়া তলিয়ে গেল, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো জল মেপে পথ পাড়ি দিচ্ছে। আইলা-সিডর দক্ষিণাঞ্চলের মাজা ভেঙে দিলেও মনের জোর ভাঙেনি। সরকার দায়সারা। বিদেশিরা ভুলে গেছে। প্রকৃতি বিরূপ, তবু খোলা সমুদ্রের সামনে লাশ আর ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষ ঠিকই উঠে দাঁড়িয়েছে, অমানুষিক কষ্টের মধ্যেও আবার চালাচ্ছে জীবন চালিয়ে যাওয়ার লড়াই। তরুণদের অসংখ্য স্বাধীন উদ্যোগ অর্থনৈতিক সামর্থ্যও বাড়াচ্ছে। অর্থমন্ত্রী জানাচ্ছেন ২০০৮-০৯ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, এ বছরে তা উঠেছে ৬-এর ওপরে।
রাজনীতিতেও দেখা যাবে যে সাধারণ মানুষ ক্ষমতার কামড়াকামড়ি চায় না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। কানসাট, ফুলবাড়ী, শনির আখড়া ও আড়িয়ল বিলে জনমানুষের প্রতিবাদ অন্যায় ও দুর্নীতি ঠেকিয়েছে। সন্ত্রাস ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা সামাজিক আন্দোলনও নাগরিক শক্তির নড়াচড়ার প্রমাণ। প্রশ্ন হচ্ছে, বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি কত কাল এই সামাজিক শক্তিকে উপেক্ষা করে চলতে পারবে? যদি পারেও, তাতে কি দেশের ভালো হবে?
আমাদের সাফল্যগুলো সেসব সামাজিক ক্ষেত্রের, যেখানে রাজনীতিবিদেরা খুব বেশি বাধা হননি। যতই ধাঁধা লাগুক, যতই স্ববিরোধী মনে হোক, দেশটা চলছে সাধারণ মানুষের উদ্যোগ আর জীবনীশক্তির কল্যাণে। এই সামাজিক জীবনীশক্তিই বাংলাদেশের আশাবাদী হওয়ার প্রধান রসদ। বাংলাদেশ নামক ধাঁধার সত্যিকার উত্তর।
©somewhere in net ltd.