![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সমকালীন চিন্তার সাথে কর্পোরেট ও সামাজিক জীবনের মিশ্রনে কমিউনিটি জার্নালিজম করা একজন মানুষ
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল, কিন্তু বাজারে একটিও দোকান খুলল না। যে বাজারে সকাল-সন্ধে হাজার মানুষের আসা যাওয়া, সেখানে এখন পাখি চরে বেড়াচ্ছে। পথে লোকজনেরও দেখা নেই। দেখলে মনে হবে যেন সব নাগরিক এক সঙ্গে শহরটা ছেড়েছে। বাস্তবও কিছুটা সেই রকম। অজানা মহামারির আতঙ্কে বহু মানুষই শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। যাঁরা পড়ে আছেন, তাঁরাও ভয়ের কারনে একঘরে হয়েছেন।
দৃশ্যটা কিন্তু ২০২০ সালের কোভিড-১৯ আক্রান্ত কোনও শহরের নয়। এটি ১৭২৯ সালের বৈশাখ মাসে মুঘল রাজধানী দিল্লির দৃশ্য। তার বিবরণ দিয়েছেন সমকালীন ইতিহাসবিদ সৈয়দ গোলাম হোসেন তাবতাবাই। আজকের দিনে বসে তাবতাবাইয়ের সেই বিবরণ পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। প্রায় তিনশো বছর আগের এই বর্ণনায় যেন হাল আমলের ছবি। তবে মুঘল আমলের এই বিবরণের সঙ্গে আজকের কোয়ারান্টাইন শহরগুলোর একটা বিশাল ফারাক রয়েছে। আর সেটা রাষ্ট্রের ভূমিকা সংক্রান্ত।
মুঘল কেন, ইংরেজ শাসন পত্তনের পরেও মহামারির সময় সরকারি ভাবে সারা শহর বা দেশ জুড়ে কোয়ারান্টাইন লাগু করার উদাহরণ বিরল। যাও বা দু-একটি উদাহরণ মেলে, তা হল দেশে নবাগত কোনও বিশেষ একটি দলকে কোয়ারান্টাইন করার দৃষ্টান্ত। গোটা শহর বা দেশকে কোয়ারান্টাইন করার নমুনা নয়। যেমন অটোমান সাম্রাজ্যে বার বার প্লেগ দেখা দেওয়ার ফলে অনেক সময় পশ্চিম এশিয়ার যাত্রীদের কিছু দিন কোয়ারান্টাইনে রাখা হত। ১৭৪৯ সালে উইলিয়াম প্লাইস্টেড নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী কলকাতা থেকে বসেরা, বাগদাদ ইত্যাদি হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কালে ফ্রান্সের মার্সেই শহরে কিছু দিন কোয়ারান্টাইনে থাকেন। সেই বৃত্তান্ত তিনি তাঁর যাত্রার আখ্যায়িকাটিতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
এরও পরবর্তী কালে ১৮০২ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় ফৌজ মিশরে নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে ভারতে ফিরল, আবারও পশ্চিম এশিয়ায় প্লেগ। ফলে তাঁদের কিছু দিন মুম্বইয়ের বাইরে কসাই দ্বীপ বা ‘বুচার্স আইল্যান্ড’-এ কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়েছিল।
এই ধারার পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে এই বাংলাদেশেই। ১৮১৭ সালে যশোর জেলায় দেখা দেয় এক নতুন ব্যাধি। আক্রান্ত ব্যক্তিরা হঠাৎ করে ঘন ঘন ভেদবমি ও মলত্যাগের মধ্যে দিয়ে অতি দ্রুত মৃত্যুমুখে পতিত হতেন। যদিও আমাদের এই বাংলাদেশে বহু কালই পেটের নানান রোগের সঙ্গে সুপরিচিত, ১৮১৭ সালের আগে সে সব রোগ কখনও এত মারাত্মক রূপে আবির্ভূত হয়নি। তাই এই নতুন ব্যাধির নতুন নাম রাখা হয় ‘এশিয়াটিক কলেরা’। যশোর থেকে প্রথমে কলকাতা, তার পর বাকি মহাদেশে এবং তারও পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়ানক এশিয়াটিক কলেরা।
কলেরা বা ওলাওঠার এই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার একটা স্পষ্ট কারণ ছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকটা ছিল বিশ্বায়নের প্রথম স্তর। বাষ্পচালিত জাহাজে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ হয়ে উঠেছিল অনেক সহজ ও দ্রুত। সেই সহজতা ও দ্রুততার সুবিধে নিয়েই নানা ইউরোপীয় দেশ অন্যান্য মহাদেশগুলোতে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছিল। এদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই ইংরেজ সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য বিস্তারের কারণ এবং ফল দুইই ছিল বাণিজ্য। কাঁচামাল সস্তায় কেনা ও তৈরি জিনিস বৃহত্তর বাজারে বিক্রি করা, এই দুটিই ছিল সাম্রাজ্যবাদের মূল মন্ত্র।
যশোর তখন নীল চাষের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। আর সেই ব্যবসায় আকৃষ্ট হয়ে নানা দিক থেকে বহু মানুষ তখন যশোরবাসী হচ্ছেন। এই ব্যবসার সুবিধের জন্যই ইংরেজ সরকার নতুন সড়ক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। আর সেই সড়ক নির্মাণের কাজে লাগানো হয় বিভিন্ন জেল থেকে নিয়ে আসা কয়েদিদের। এই সড়ক তৈরিতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যেই প্রথম দেখা দিল ভয়ানক কলেরা। আর এই বাণিজ্যিক পথ ধরেই তা ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে। সাম্রাজ্য আর বাণিজ্যের যৌথ ভাবে তৈরি জাল যেমন পৃথিবীটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে থাকে, সেই জাল বেয়েই আবার কলেরার মতো ভয়ানক ব্যাধি দ্রুতগতিতে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
১৮১৭ থেকে ১৮২১ পর্যন্ত বারে বারে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে থাকেন কলেরায়। আজকের বিজ্ঞানীরা এই সময়টিকে ‘প্রথম কলেরা প্যানডেমিক’ নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। তবে এই বিষয়ে একটি বড় ঐতি হাসিক ধাঁধা হল যে, এই মারাত্মক এবং বিধ্বংসী ব্যাধির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজ সরকার কেন কোন কোয়ারান্টাইনের উদ্যেগ নেননি। ঔপনিবেশিক বাংলাকে কোয়ারান্টাইন করে দিলে তো তাদের নিজের দেশ রক্ষা পেয়ে যেত। কিন্তু ইংরেজরা তা করলেন না। বরং চিরাচরিত, প্রাক-ঔপনিবেশিক রীতি অনুযায়ী তাঁরা চেষ্টা করলেন আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসার সুযোগের মাধ্যমে কিছুটা সুবিধেও দিতে। প্রধান সড়কগুলির ধারে ধারে স্থাপিত হল কয়েকটি চিকিৎসাকেন্দ্র। গ্রামাঞ্চলে অস্থায়ী ভাবে কয়েকজন চিকিৎসকও নিযুক্ত করা হল। কিন্তু কোয়ারান্টাইন নিয়ে কোন সামাজিক বা রাষ্ট্রিয় উদ্যেগ দাবি তখনও ওঠেনি।
কোয়ারান্টাইন নিয়ে সেই দাবি উঠল মাত্র ১০ বছর পরে, ১৮৩০-৩১ এ, যখন ‘দ্বিতীয় কলেরা প্যানডেমিক’ শুরু হল। এবং আশ্চর্যের বিষয়, তা মেনেও নেওয়া হল। ইউরোপে এবং পরবর্তী কালে আমেরিকায় একাধিক দেশ, এবং দেশের মধ্যে অনেক শহর, গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত নিজের নিজের চৌহদ্দির মধ্যে কোয়ারান্টাইন জারি করতে থাকল। মহামারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের চিরাচরিত কার্যপ্রণালীতে হঠাৎই এসে গেল আমূল পরিবর্তন। যেখানে এত কাল মহামারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র কেবল কিছুটা দান-খয়রাত করে আর কিছুটা প্রার্থনা করে আর্ত নাগরিকদের প্রতি তাদের দায়িত্ব মেটাত, এবার সেই রাষ্ট্র হয়ে উঠল অনেক বেশি সক্রিয়। কোয়ারান্টাইনের মাধ্যমে মহামারিকে প্রতিহত করতে সামাজিক জীবনের আনাচে-কানাচে ঢুকে পড়তে সচেষ্ট হল সে।
কেন রাষ্ট্রের ভূমিকাতে এই পরিবর্তন এল? এমন তো নয় যে এর আগে কখনও মহামারি ঘটেনি বা রাষ্ট্রকে তার মোকাবিলা করতে হয়নি। তবে কেন অবশেষে উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে এসেই রাষ্ট্রের চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড বদলে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের দেখতে হবে রাষ্ট্রশক্তির ভিত্তিটি কী ভাবে আঠেরো শতকের শেষার্ধ থেকে পরিবর্তিত হতে থাকে। ওই সময় পর্যন্ত যে কোনও রাষ্ট্রের ক্ষমতা স্থাপিত ছিল মূলত প্রাণহরণের অধিকারের উপর। লোকে রাজাকে শ্রদ্ধা করত, মেনে চলত, কর্জ দিত, কারণ এ সব না করলে রাজা গর্দান নিতেন। সেই অধিকার তাঁর ছিল এবং সেই অধিকার প্রয়োগের জন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হত না। মানুষের প্রাণপাত করার মধ্যে দিয়েই রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের কর্ণধার— অর্থাৎ রাজা— ক্ষমতায় বজায় থাকতেন।
আঠেরো শতকের শেষ দিক থেকে শিল্প বিপ্লবের চাপে রাষ্ট্রশক্তির এই ভিত নড়ে যায়। মানুষ— বিশেষত নতুন ভাবে প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ী এবং সদ্যোজাত মধ্যবিত্ত শ্রেণি— রাজার প্রাণহরণের নিরঙ্কুশ অধিকার আর মেনে নিতে চাইলেন না। ফ্রান্সে এই নতুন বুর্জোয়া গোষ্ঠী স্বয়ং রাজারই গর্দান নিয়ে বসলেন। তাঁদেরই দাবির চোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বিপ্লবীরা রাজশক্তিকে সম্পূর্ণ নাকচ করে নতুন গণরাষ্ট্র সৃষ্টি করলেন। এই সব যুগান্তকারী ঘটনার মধ্যে দিয়েই তৈরি হয় নতুন এক ধরনের রাষ্ট্রশক্তি। এই নতুন রাষ্ট্রশক্তি নিজেকে প্রাণহরকের চাইতে বরং এবার জীবনের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিপন্ন করল। দাবি করল, রাজ্য শাসনের অধিকার জন্মাবে মানুষের প্রাণ নিয়ে নয়, বরং নাগরিকদের জীবন রক্ষা এবং প্রতিপালন করার মধ্যে দিয়ে।
১৮৩০-এর পরেই এই ধারণা দ্রুত পাল্টাতে থাকে এই অঞ্চলের চিকিৎসা ভাবনা। তত দিনে সংবাদপত্রের প্রচার বহুল হয়েছে, সাম্রাজ্যের কারণে দূরদূরান্তের দেশগুলির মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। সেই সুবাদে ইউরোপের সংবাদপত্রগুলোর দৈনিক খবর থেকে এটুকু প্রমাণ হয়ে যায় যে বাংলা থেকে ধীরে ধীরে কলেরা বিশ্বময় ছড়াচ্ছে পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজে চেপে,। এ থেকেই উঠে আসতে থাকে সংক্রমণের ধারণা, সেই ধারণার দ্বারাই লালিত হয় কোয়ারান্টাইন করার যৌক্তিকতা। এই সময় থেকে ধীরে ধীরে আধুনিক জনস্বাস্থ্যের ধারণাও গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৩০-এর পরে কলেরার আতঙ্কে ত্রস্ত ইউরোপীয় রাজ্যগুলো একে একে কোয়ারান্টাইন জারি করতে থাকে।
প্রাক-আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর সীমান্ত প্রায়শই ছিল অরক্ষিত। প্রধান নদীপথ বা স্থলপথে টোল আদায়কারী কয়েকটা চৌকি ছাড়া তেমন কোনও পাহারারও ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু কোয়ারান্টাইন সফল করতে, সীমান্তে বসল নতুন পাহারা। দেশের মধ্যেও নতুন সমস্ত আইনকানুন জারি হল। মানুষের সামাজিক জীবনে রাষ্ট্র উঁকি মারা শুরু করল। ডাক্তার, প্রতিবেশী, আত্মীয় ইত্যাদির উপর রাষ্ট্রকে খবর দেওয়ার নতুন দায়িত্ব বর্তাল। আর্তের চিকিৎসা কিংবা মৃতের সৎকার এত দিন ছিল আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কর্তব্য, এ বার তার সঙ্গে যুক্ত হল রাষ্ট্রকে সূচিত করার দায়িত্ব।
সুত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা অবলম্বনে
২| ১০ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৩:৩৬
রাজীব নুর বলেছেন: 'ছুটি' শব্দটার সাথে আমাদের এতো 'রাষ্ট্রীয় প্রেম' করোনা না এলে জানতামই না! সারাবিশ্বে তাহলে লকডাউন, জনতার কারফিউ, জরুরী ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-অফিস বন্ধ ঘোষণা -এই ডিসকোর্স বা বয়ানগুলো ব্যবহার করছে কেন?
৩| ১১ ই এপ্রিল, ২০২০ ভোর ৪:০২
শের শায়রী বলেছেন: দারুন পোষ্ট।
©somewhere in net ltd.
১|
১০ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:৩৮
নেওয়াজ আলি বলেছেন: করনো এখন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে