নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনন্দ-পঠন

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই

মেহেদী হাসান মঞ্জুর

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই।

মেহেদী হাসান মঞ্জুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

খাঁজকাটা বেলুনি

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:১৯





এখনো বেশ টুকটুকে বাঁকা কাস্তের মত চাঁদটি আকাশে থাকলেও নিয়ন বাতির ফ্যাকাশে আলোয় বাঁধা পেয়ে ওর নরম আলো ওদের গায়ে এসে স্নিগ্ধতা ছড়াতে ব্যার্থ হচ্ছে। বিশ-বাইশ বছরের একটি ঢ্যাঙ্গা ছেলে কালি-ঝুলি ভরা মুখ নিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে কেরোসিনের চুলায় মৃদু মৃদু চাপ দিয়ে একনাগারে পাম্প করে চলছে। আরেকজন বেটে ধরনের মোটা সোটা লোক ছোট একটি নড়বড়ে টেবিলের উপর ময়দা বেলতে বেলতে, পিছনের দিকে ভাজ পড়ে কালো হয়ে যাওয়া ঘাড় বেকিয়ে খেকিয়ে উঠে বলল- ঐ হাওয়ার পোলা জোরে জোরে পাম্প করতে পারসনা, ওহ হারাদিন ঘুম পাইড়াও তোর চোখের ঢুলুনি থামেনা, দেহসনা আগুন নিবা গেতাছে গা, দিমু নাকি বেলুনির কয়েক ঘা লাগাইয়া-তহন টের পাবি ঘুম কনে যায়। ঢ্যাঙ্গা ছেলেটার মনে পড়ে যায়, গত রাতে তার হাড় বের হয়ে যাওয়া শুকনো পিঠে বেলুনির আঘাতের কথা- পিঠটা যেন ব্যাথায় টনটন করে উঠে। ডান হাত দিয়ে পাম্প করছিল, আর বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে মাথার পিছনের দিকে চুলকাচ্ছিল- হঠাৎ খানিকটা ঝুঁকে পড়ে দু-হাত দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে খুব জোরে জোরে পাম্প করতে শুরু করে দেয়।

-আরে রোখ রোখ, অইছে অতো জোরে পাম্প করতে অইবোনা, তেলের ট্যাঙ্কি আবার ফাইটা যাবো- হ অহন ঠিক আছে; এই রকম কইরা দিতে থাক।

উস্কো-খোস্কো চুল, কাঁচের মার্বেলের মত স্বচ্ছ চোখের কচি একটা ছেলে খদ্দেরদের খালি হয়ে যাওয়া প্লেটে তেলে ভাঁজা গরম পরোটা তুলে দেয়, সাথে সাথে পাশাপাশি রাখা বোল থেকে সবজি আর মুগের ডাল চামচ দিয়ে ছোট প্লাস্টিকের বাটির মধ্যে তুলে ঘুনে ধরা বেঞ্চিটাতে পরোটার প্লেটের পাশে বেশ যত্নের সাথে রাখে। সারা রাত ভরে এই ওর কাজ- এই একই কাজ তাকে সবসময় করে যেতে হয়। এখন কাজে আর তেমন কোন ভুল-ত্রুটি হয়না, অনেকদিনের অভ্যাসে অনেকটা যেন রোবটের মত হয়ে গেছে। রোবটও মাঝে মাঝে বিকল হয়, ভুল কাজ দেয় কিন্তু ওদের ভুল হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর কোন কাজটা যে ঠিক আর কোনটা বেঠিক তাও যেন সবসময় ভালো বুঝতে পারেনা। ছেলেটার চোখে পিছনে শিকারী ছোটা ভয় পাওয়া হরিণের তস্ত্র চাহনি, কোথাও যেন একটুও এদিক-সেদিক না হতে পারে সেদিকে সদা-সতর্ক দৃষ্টি। কচি ছেলেটি খুব ভালো ভাবেই জানে, কাঠের যে খাঁজকাটা বেলুনিটি ময়দার চাকতির উপর মোটা হাতের পেষণে অবিরত ময়দার চাকতির উপর গড়িয়ে চলছে, এই মাত্র ঢ্যাঙ্গা ছেলেটির উপর গড়াতে গিয়েও কোনমতে ফসকে গেল; যেকোন সময় তার কচি পিঠেও গড়াতে পারে।

শহরের ভেতরে রাস্তার পাশের খোলা দোকানটিতে এমন গভীর রাতে খদ্দের মাত্র দুইজন রিক্সাওয়ালা। তারা ঘুমকাতুরে চোখে বারবার তাদের রিক্সার দিকে ফিরে তাকাতে তাকাতে, ছোট বেঞ্চের উপর বসে, আলু ভাজি জুত মতো পরোটাতে মেখে নিয়ে বিশাল বড় হা করে মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে আয়েশ করে চিবুচ্ছে।

ঠিক এমনি সময়ে রাস্তার ওপাশের গলি থেকে ভো ভো শব্দে তুলে খুব দ্রুত গতিতে কালো রঙের চকচকে আনকোরা একটি জিপ ঠিক যেন ওদের ঘাড়ের কাছে এসে পড়লো। ওদের মনে হল এই আরেকটু হলেই চাকার নিচে পিষে যায় আর কি! হাতের সকল কাজ মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো, ওরা কাঠের পুতুলের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সকলেরই এক অবস্থা-মালিক-কর্মচারীর পার্থক্যটি হঠাৎ ঘুচে গিয়েছে যেন!

কালো গুহার ভেতর থেকে গুড়ি মারার মত করে- কালো পোশাক পড়া মাথায় কালো ফেটি বাঁধা কালো চশমা কপালে তোলা, দীর্ঘ মোটা কালো গোঁফ বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মোচড়াতে মোচড়াতে কুতকুতে হিংস্র চোখে তাকাতে তাকাতে চার জন নেমে এলো।

দেখতে পেয়ে বেচারী রিক্সাওয়ালা দুজনের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেছে। একে অপরের দিকে একবার মাত্র চাওয়ার সময় পেল। একজন কেবল পরোটা ছিড়ে আলু ভাজিতে মেখে মুখে তুলেতে লেগেছে- মুখটি তেমনি হা হয়ে আছে, পরোটা সমেত হাত পড়ে আছে প্লেটের উপর। পরোটার প্লেট হাতে নিয়ে তড়াক করে উঠে পাশেই রাখা ওদের রিক্সার আড়ালে লুকিয়ে অনেকটা যেন প্রানে বাঁচল।

কালো পোশাক পরিহিত চারজন, চারদিক শ্যোন দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে, ইতিমধ্যে রিক্সাওয়ালাদের খালি করা বেঞ্চটিতে বসতে বসতে পরোটা আর ডিম ভাজির অর্ডার দিল। অর্ডার দিল নাকি হুঙ্কার ছাড়লো দোকানের মালিক-কর্মচারী কেউ ভালো বুঝে উঠতে পারলো না। ভয়ে গোবেচারাদের শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। এদিকে আবার গোলানো ময়দা গেছে ফুরিয়ে। ওরা অনেকটা ধরা পড়ে যাওয়া ছিঁচকে চোরের মত কাঁপতে কাঁপতে নিজেদের কাজ শুরু করে দিল। অত্যাধিক ভয়ের কারনে এসব কাজে পেকে যাওয়া হাতেও বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি হতে লাগলো। ময়দা গুলতে গিয়ে মালিকটি পানি বেশী দিয়ে ফেলছে-আবার পরিমান মত ময়দা মিশাতে গিয়ে অনেকটা বেশী হয়ে যাচ্ছে। ঢ্যাঙ্গা ছেলেটি এমন জোরে পাম্প করা শুরু করেছে যে, কালো হয়ে যাওয়া লোহার বিশাল তাওয়াটির পাশ দিয়ে আগুনের শিখা উপরে উঠে যাচ্ছে। ঢ্যাঙ্গা কর্মচারীটি এবং মোটা সোটা মালিকটি নিজেদের মধ্যে সামান্য একটি মুহূর্তের জন্য একে অপরের দিকে তাকালো। সেই মুহূর্তে মোটা লোকটি যেন আর মালিক নয়, ঢ্যাঙ্গা ছেলেটিও নয় আর কর্মচারী, হুঙ্করারের শব্দ তাদের যেন কাছাকাছি এনে ফেলেছে। কচি ছেলেটি এই মুহূর্তে তার ঠিক কি কাজ করা উচিত ভালো বুঝতে না পেরে দাউদাউ করে জ্বলে উঠা আগুনের শিখার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বাঘের মত শক্তিশালী মালিকটি যেখানে ভয় পেয়ে ভুলভাল কাজ করতে শুরু করেছে –তাহলে এই কালো পোশাক পড়া লোকগুলো না জানি কত শক্তিমান। প্রাচীন যুগের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মুখ দিয়ে আগুন বের করার ক্ষমতা সম্পন্ন বিশাল বিশাল জানোয়ারগুলো যেন নতুন রুপে উঠে এসেছে। ডাইনোসরদের আগুন বের হত মুখ দিয়ে আর এদের বের হয় লোহার নলের ভেতর দিয়ে। ওরে বাবা- এই বুঝি ক্রস ফায়ারে ফেলে দিল! খাওয়ার পূর্বে এধরনের ঘটনা ঘটাবেনা নইলে ওরা মাগনা পেট পূজা করবে কিভাবে কিন্তু খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গেলে কি হবে তা আগাম বলার উপায় নেই। দেখা গেলো, এই তোর ডিম ভাজার মধ্যে মরা মাছি কেন- তাই বলে ঠুস করে গুলী করে দিল!

চারজন কেবল আমেজ করে গরম গরম তেলে ভেজে পরোটা, ডিমের মামলেট, আলু ভাজি খাওয়া শুরু করেছে, অমনি একটা ভাঙ্গা-চোরা জীপ গাড়ির ঘড়-ঘড় শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। হালকা বাতাসে ভর করে ভেসে এলো পুলিশের মেঘনাদ, কানের পর্দা বুঝি আর আস্ত থাকেনা; ফেটে চৌচিড় হয়ে যায়। দাঁত খিচোচ্ছে, হাত-পা ছুড়ছে, মাথা ঝাকাচ্ছে, লাফাচ্ছে, আর কত কিছু যে বলে যাচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ঐ শুয়রের বাচ্চা, বাইঞ্চোত, মাদারচোত, খানকির পোলা, তোদেরকে না কইছি এইহানে আর পরোটা ভাজবিনা। পিটিয়ে তোদের হাড় গুড়ো করে ফেলবো, টেংরী কেটে হাতে ধরিয়ে দেবো। আমাদের কথা শুনসনা, তোদের এতবড় আস্পর্ধা, ঠিক মত বখরা দেসনা, ঘন্টা দুই আগে উঠাইয়া দিয়া গেলাম এর মধ্যে আবার পরোটা ভাজতে শুরু করছস।

ইতিমধ্যে আধমরা হয়ে যাওয়া লোকগুলোর প্রান বায়ু গলার কাছে এসে ঠেকেছে। পুলিশের বাজান, কালা ফারুকদের আজরাইল, যমের শিরোমনি, সরকারের পোষা নেকড়ে, ক্রস ফায়ার নাটকের দুর্দান্ত অভিনেতা, সর্বশক্তিমানদের সাক্ষাত সামনে রেখেও সামান্য পুলিশের হুঙ্কারে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে- ঢ্যাঙ্গা ছেলেটি হঠাৎ যেন শূন্যে মিলিয়ে গেলো, মোটাসোটা মালিকটি বিশাল ভুড়ি নিয়ে ভালো দৌড়াতে পারেনা; কোনমতে ময়দা গোলানোর টেবিলের তলায় ঢুকে পড়লো। আর কচি ছেলেটি চোখে সর্ষে ফুল দেখতে দেখতে টাল খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো, অত্যাধিক ভয়ে দূর্বল শরীরে চেতনা হারানো ছেলেটির দিকে কেউ ফিরে তাকানোরও অবসর পেল না। মালিকের শক্ত হাতে ধরা খাঁজকাটা বেলুনির পাড় খেয়ে খেয়ে এমনিতেই তার মন সবসময় ভয়ে কুকড়ে থাকে। পুলিশের মোটা লাঠি তার পিঠে পড়লে এবার আর সে আস্ত থাকবেনা! তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সেবারে যখন শত শত পুলিশ গিয়েছিল বস্তি ভেঙ্গে দিতে, যেই একজন পুলিশ লাঠির খোঁচায় তাদের নড়বড়ে ঘরটি ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করছে- তখন এতো কিছু বোঝার ক্ষমতা তার হয়নি- অমনি বুক টান টান করে এগিয়ে এসে বলে, কত কষ্ট কইরা আমার মায় বাপে কতজায়গায় ঘুইরা শেষমেষ এইহানে আইয়া ঘর তুলছে, কথা নাই বার্তা নাই আইয়াই ঘর ভাঙ্গতে শুরু করছে- ওহ কইলেই অইল, ঘর বানাইতে বুঝি কষ্ট অয়না- আর ঘর ভাইঙ্গা দিলে আমরা তাইলে থাকমু কোনহানে। হরেন ইনথিকা, আমাগো ঘর আমি ভাঙ্গবার দিমুনা। ওই বিচ্ছু, তর এত বড় সাহস আমার সাথে তর্ক করস- অ্যাঁ, কি টাসটাস কথা আবার- ঘর ভাঙ্গবার দিমুনা, তগো ঘর সবার আগে ভাঙ্গমু, দেহি তোর কোন বাপে ফিরাইতে আহে, ভাইঙ্গা একবারে তুষ বানাইয়া হালামু। দাড়া তরে আগে শায়েস্তা কইরা লই, এই বলে তারে এমন পিটুনি দিয়েছিল যে, সারা শরীরে জ্বর এসে গিয়েছিল; পনের দিন হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে থেকে অবশেষে চোখ মেলতে পেরেছে।



পুলিশগুলো প্রচন্ড চিৎকার করতে করতে পরোটার দোকানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু তাদের এই চিৎকার চেঁচামেচি বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে পারলো না। চোখে কি ভিটামিন এ এর অভাব পড়েছে নাকি-সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা দেখায়। কই প্রত্যেকদিন সকালে বাজার থেকে কত ধরনের শাকসবজি নিয়ে আসে। কত দিন হাফ দাম দেয় আর কত দিন পরে দেবো বলে গট গট করে হেটে রওনা দেয়। বউ ভালো করে তেল দিয়ে ভেজে দিলেই তো গরম ভাতের সাথে খেয়ে থানায় চলে আসে। তাহলে কি এর মধ্যেই চোখে চালশে লেগে গেলো নাকি! না হলে চোখে সবকিছু এমন অস্পষ্ট দেখাচ্ছে কেন? চোখের সামনের মূর্তিগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। হায় ভগবান- এ যে সাক্ষাত কালা পাহাড়। এরা আবার এখানে আসলো কখন, কি জ্বালা। এখন কি হবে- বড় বেয়াদবী হয়ে গেলো যে। এ যাত্রা কোনমতে রক্ষা পেলে বেঁচে যাই- এর পরে খুব সাবধানে চারদিক দেখে শুনে কথাবার্তা বলতে হবে। কি যে হয় আজকে আল্লাই জানে। আগে তো মাথা থেকে টুপিটা খুলে ফেলি, তারপর দেখা যাক কি হয়।



পুলিশগুলোর টুপি হীন মাথা বুকের মধ্যে অনেকটা যেন সেঁধিয়ে আছে। দলনেতা টাইপের বয়স্ক একজন পুলিশ জোড় হাতে সামনের দিকে এগিয়ে এসে কাঁপতে কাঁপতে বলল- স্যার, স্যার, স্যার, স্যার------আপনারা এখানে স্যার বুঝতে পারিনি, আপনারা এই সময়ে এখানে থাকবেন তা কল্পনায়ও আসেনি। আপনাদের সামনে বড় কথা বলে ফেলেছি, ভুল হয়ে গেছে স্যার। বয়স তো আপনাদের দোয়ায় কম হলনা- চোখে ভালো দেখতে পাইনা স্যার, আপনাদের ঠাহর করে উঠতে পারিনি, এবারের মত মাফ করে দ্যান। কালো পোশাক পরা চারজন, পুলিশগুলোর দিকে ভালো করে চেয়েও দেখলো না- ভাবে সাবে মনে হচ্ছে কোন কথা এদের কানেই যায়নি। দলনেতাটি এবার একটু কেশে নিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে বলল-আমি না হয় চোখে ভালো দেখতে পাইনা, তোরাও কি চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি এই জোয়ান বয়সেই। দেখে আমাকে কেন আগে সাবধান করলিনা যে, এখানে স্যারেরা বসে পরোটা খাচ্ছে। তোদের কালকেই খাগড়াছড়ির জঙ্গলে পাঠিয়ে দেবো-ঢাকা শহরে অনেক থেকেছো আর থাকতে অইবোনা। নিয়ন বাতির ঝাপসা আলো স্যার- আমরাও ঠিকমত ঠাহর করে উঠতে পারিনি স্যার। এবারের মত মাপ করে দেন, কনষ্টেবলগুলো সমস্বরে মিনমিন করে উঠলো। অ্যাঁ, আমি মাফ করার কে, স্যারেরা মাফ করলেই কেবল ঢাকা শহরে থাকতে পারবি। কালো পোশাকের ভেতর থেকে জলদ গম্ভীর আওয়াজ উঠলো- থাক আর বাজে বকতে হবেনা, দোকানের লোকগুলো কে কোথায় পালালো তাই আগে খুঁজে বার কর, তারপর চোখের সামনে থেকে বিদেয় হও। সামনের জন এবার একটু নিশ্চিন্ত হল, কথা বলেছে যেহেতু তার মানে স্যারদের রাগ একটু ভাটা পড়েছে। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছেড়ে গেলো- শরীরের হালকা ভাবটি কিছুটা যেন ফিরে আসলো।

-এই তোরা লুকোলি কোথায়, তাড়াতাড়ি বের হয়ে আয়- দেখ দেখি কি কান্ড, আমাদের দেখে আবার ভয়ের কি আছে, আমরা তো তোদের সেবক। তোদের সেবা করাই তো আমাদের কাজ। স্যারদের মনে হয় ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে- ভালো করে পরোটা ভাজবি, বুঝলি-চিন্তা করিসনা মোটা বকশিস পাবি।

তালপাতার মত একজন কনষ্টেবল কচি ছেলেটির চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো। কচি ছেলেটি আস্তে করে চোখ মেলে, একেবারে মুখের সামনে খাকি পোশাক পড়া একজন পুলিশ দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠলো কিন্তু পরক্ষনেই বুঝতে পারলো এর চোখের চাহনিটা যেন কেমন করুন। ছেলেটার মনে একধরনের দয়ার ভাব উদ্রেক হল। এই মুহূর্তে ওরা দুজন ঠিক কোথায় যেন মিলে গেল- যেখানে একে অপরকে সহজে আলাদা করা যায়না। আরেকজন কনষ্টেবল পা ধরে টেনে টেবিলের নিচ থেকে মালিকটিকে উদ্ধার করলো। আহ কি লজ্জার কথা, তাড়াহুড়া করতে গিয়ে কোথায় যেন টান লেগে লুঙ্গির গিটটা কখন যে খুলে গেছে! মালিকটি লুঙ্গিতে গিট দিতে দিতে অধোমুখে দাঁড়িয়ে রইল। আগুনের আঁচ লাগা তামাটে হয়ে যাওয়া মোটা চমড়ার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পুলিশগুলো অনেকক্ষণ ধরে আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গীতে ডাকাডাকির পর ঢ্যাঙ্গা ছেলেটা বাম হাত দিয়ে মাথার পিছনের দিকটা চুলকাতে চুলকাতে কোথা থেকে এসে যেন হাজির হল।



-স্যারদের পরোটা দেবার আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিস। আহা-আহা-দেখি দেখি-তোর হাতে তো বেজায় ময়লা দেখছি। কচি ছেলের ছোট-নরম হাতটি পুলিশের দলনেতাটি নিজের দিকে টেনে আনতে আনতে বলে, তোদের কতবার বলেছি সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকবি। নোংরা হাত দিয়ে ভাজি-পরোটা দিলে লোকজনের অসুখ-বিসুখ করবে। কচি ছেলেটি এই প্রথমবারের মত এমন মোলায়েম সুরের কথা খাকি পোশাক পড়া কোন লোকের মুখে শুনতে পেল। কচি ছেলেটি মাথায় আলতো করে একটা চাটি দিয়ে, এজন্যেইতো তোদের দোকান বসাতে দিতে চাইনা, যা ভালো ভাবে কাজ কর। ছেলেটির বাবা ঠিক যেমন করে বলে, সেই একই ভঙ্গী।

এবার কালো পোশাক পরিহিত চারজনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিকে বিনম্র দৃষ্টিতে মাটির তাকিয়ে খাবি খেতে খেতে বললো, ভালো কইরা খাওয়া-দাওয়া করেন স্যার, আপনাদের আর বিরক্ত করবোনা স্যার। কিছু মনে রাইখেন না স্যার, মাফ কইরা দিয়েন স্যার। আপনারা কত বড় স্যার- ঠুস ঠাস গুলি কইরা হাসতে হাসতে যখন তখন কত পাবলিক মাইরা ফালান তার কি কোন ঠিক আছে। আর আমরা ঠিকমতো কইষা দুইটা পিটুনিও লাগাইতে পারিনা-ফাজিল পাবলিক উল্টা আমাগো মারতে আসে। পাবলিক ভালোই বোঝে-হাতের বন্দুক জং ধরা, ওতে গুলি নাই, তাই আমাগো একটুও ভয় পায়না। পিছনদিকে ইশারা করে-আর অগোরে হাতে ঠনঠনা বেতের লাঠি। আপনাগো সাথে আমাগো তুলনা! আপনাদের দুই আঙ্গুলের একটা চাপেই পুটি মাছের মত মইরা যামু। আসি স্যার, ভালো থাইকেন স্যার, সালাম স্যার।



পুলিশগুলো কেমন যেন একধরনের মিন মিন শব্দের মৃদু কোলাহল তুলে জীপে গিয়ে উঠলো। মনে হল ভাঙ্গাচোরা জীপটি সামনে একটা দশাসই কালো রঙের নতুন জীপ দেখে ভয় পেয়ে কেমন যেন জড়সড় হয়ে ছিল। জীপটিও যেন এখান থেকে কোনমতে চলে যেতে পারলে বেঁচে যায়। ভাঙ্গাচোরা জীপটি দশাসই চকচকে জীপটির শ্রবনসীমার বাইরে গিয়ে আবার ঘড়-ঘড় আওয়াজ তুলে। কালো পোশাক পরিহিত চারজনের দৃষ্টি সীমানার বাইরে গিয়ে আবার আগের রূপ ফিরে পেল পুলিশ। দূর থেকেই আবার হাঁক দেয়- ঐ শুয়োরের বাচ্চারা আমাগো বখরা না দিয়াই আবার চা-সিগারেটের দোকান বহাইছস। খাড়া আইতাছি---





মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.