নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনন্দ-পঠন

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই

মেহেদী হাসান মঞ্জুর

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই।

মেহেদী হাসান মঞ্জুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছেড়িডা

২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৯



ছেড়িডা, প্রত্যেকদিন ভোর বেলা আমাদের সকলের ঘুম ভাঙ্গার আগে বিছানা ছাড়ে। বাথরুমে ঢুকে পড়ে চটজলদি সেরে নেয়, ঘুম থেকে উঠা পরবর্তী গাম্ভীর্য আঁকা মুখে দাঁড়ায় কিচেন বেসিনের সামনে; বাসন-কোসন, হাড়ি-পাতিলে একশ লেবুর শক্তিওয়ালা ডিস ক্লিনার মেখে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে। তারপর মেঝেতে পিঁড়ি পেতে বসে শুরু হয় তার ময়দা ডলা। চাকতির উপর রাখা ময়দার গুলতি, তার ঝুঁকে ঝুঁকে বেলনা চালানোয়, ছড়ানো গোলাকৃতি লাভ করে। খুন্তি হাতে উঠে দাঁড়ালে, গ্যাস চুল্লির উপরে রাখা তাওয়ার চতুর্পাশ দিয়ে বের হওয়া আগুনের অনবরত স্পান্দিত জিহ্বার আঁচে তার ফর্সা মুখমন্ডল ধীরে ধীরে বাতাসের ছোঁয়া লাগা কচুর ডাটির কষের মত লালচে হয়ে উঠে, এসময় তার চোখদুটোও যেন ঘামে ভিজে যায়।

উবু হয়ে ফ্রীজের সবচেয়ে নীচের তাক থেকে ঠান্ডা ম্যাড়ম্যাড়ে সবজি বের করে আনে; বটিতে কূটে, বাটিতে ধুয়ে রুটি সেঁকা তাওয়ার পাশের ফুটন্ত কড়াইতে তুলে দেয়, সবজিতে লেগে থাকা পানির ছোঁয়ায় গরম তেলের ছিটা এসে তার শরীরের কোথাও লাগলে গোসলের সময় ঠান্ডা পানির ছোঁয়া লাগা শিশুর মত পুরো শরীর ঝাঁকিয়ে উঠে। ময়দার গুড়া লেগে থাকা তাওয়াটি নামিয়ে আলাদা একটি তেলচিটচিটে তাওয়া বসায়, শক্ত টাইলসের উপর একটি নিখুঁত আঘাতে ডিমের খোলস চক্রাকারে ভেঙ্গে ভেতরের পদার্থ বাটিতে নিয়ে চা-চামচ দিয়ে অনবরত নেড়ে তরল করে ফেলে। ফালা ফালা করে কাটা মরিচ ও কুচিকুচি করা পেয়াজ মিশিয়ে তাওয়ার উপর ছেড়ে দেয়। অনেক দিন ধরে একই কাজ করতে করতে দক্ষ হয়ে উঠা হাতে খুন্তির নানা রকম উলট-পালটে একটুও বেশী পুড়ে না গিয়ে বালিশের মত ফোলা ফোলা হয়ে উঠে।

ইলেকট্রিক কেটলি থেকে আসে গরম পানির বলক উঠার শব্দ, পেয়ালার অভ্যন্তর থেকে উঠে চামচের খটখট শব্দ, রুমের দরজাগুলোতে হাতের আঘাতের শব্দ। বিছানার উপর হাই তোলা, আড়মোড়া ভাঙ্গা, কাছে গিয়ে কান পাতলে শোনা যাবে বাতাসের তোড়ে উষ্ণ তরল পানীয় টানার শব্দ।

সকালের নাস্তার সব আয়োজন শেষ হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই ডাইনিং টেবিলের উপর চেয়ারগুলোর সামনে আলাদা আলাদা করে সাজানো হয়ে যায়। নাস্তা খাওয়ার পালা শুরু হলে তাকে টেবিলের আশেপাশে অনবরত চক্কর খেতে হয়, একে এটা-ওকে ওটা এগিয়ে দাও, খাওয়া শেষে সকলে উঠে গেলে টেবিল পরিষ্কার করার কাজে হাত লাগায়, এটো থালা-বাটি নিয়ে রওনা দেয় বেসিনের দিকে।

রান্না ঘরের মেঝেতে পিড়ি পেতে খেতে বসে একাএকা, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠার পর থেকে একের পর এক যে খাবারগুলো সে নিজ হাতে তৈরী করল, সেগুলোর সামান্য কিছু মুখেপুরার ইচ্ছাটাও যেন অনেকদিনের অনাহারে মরে গেছে। তাকে, তার জন্য আলাদা করে দেওয়া থালায়, গত রাতের বেঁচে যাওয়া বাসি ভাত-তরকারি বেড়ে বসতে হয়।

খাওয়া শেষ করেই আবার তাকে দৌড়াতে হয় রুমগুলোর উদ্দেশ্যে। লম্বা লম্বা রশির সাহায্যে চারকোনায় আটকে থাকা মশারির বাঁধন খুলে ভাঁজ করে ওয়ারড্রবে ঢোকানো, কুঁচকে যাওয়া বিছানার চাদর উঠিয়ে, নারকেলের সলা দিয়ে তোষক ঝেড়ে, পরিপাটি করে আবার বিছানো, সারা রাত ভরে মাথার ভারে মাঝখানে গর্ত হয়ে যাওয়া বালিশগুলোর চতুর্পাশ চেপে অনাহারী বাচ্চাদের ক্রিমিওয়ালা পেটের মত ফুলিয়ে একটির পর একটি সাজিয়ে রাখা, বিছানার উপর এলোমেলো পড়ে থাকা কাঁথা-কম্বল ভাঁজ করা। একেক সময় একেক জন বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সুনির্দিষ্ট রুমে ঢুকে বিছানায় ছেড়ে যাওয়া কাপড়গুলোকে আলনায় সাজিয়ে রাখার কাজটিও অবধারিতভাবে তার ঘাড়েই চাপে।

খোলা ট্যাব হতে একটানা ছড়ছড় শব্দে পতিত হয়ে আধাভর্তি বালতিতে টুপ টুপ কয়েক ফোঁটা ফ্লোর ক্লিনার, কনুই পর্যন্ত চুবানো হাত ভেতরে তোলপাড় তুললে বালতির খালি অংশটুকু সাদা ফেনায় ভরে উঠে। তারপর ফেনা উঠা পানিতে ভেজানো ন্যাকড়া দুহাতে মুচড়িয়ে অতিরিক্ত পানি ফেলে দিয়ে শুরু হয় মেঝে মোছার কাজ। মাথাটা কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে ও নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে বসে প্রসারিত হাত বার কয়েক উপবৃত্তাকারে ঘুরিয়ে খানিকটা পিছনে সরে আসে(দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন শিল্পীর নিবিষ্টতায় মেঝেতে আলপনা আঁকছে), আরেক হাত দিয়ে বালতিটাকে মেঝে ঘষটে নিজের সাথে টেনে নেয়। ন্যাকড়া হাতে চার হাত-পায়ে পশুর মত ভর করে খাট, টেবিলের নীচে ঢুকে উপবৃত্তাকারে হাত ঘুরাতে ঘুরাতে পিছনে সরে আসার কালে হঠাৎ বেখেয়ালে তার চিকন মাঝা মোটা কাঠের তক্তার সাথে ধাক্কা লাগলে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মাঝায় হাত দিয়ে বসে পড়ার কালে মাথাটাও ঠুকে যায় খাটের মাচার সাথে। এভাবে চলতে চলতে ক্রমান্বয়ে তার হাত, ন্যাকড়া ও বালতির পানি যতবেশী নোংরা হয় সমানুপাতে পুরো ফ্ল্যাটের মেঝের প্রতি ইঞ্চি জায়গা ততবেশী ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠে। বাথরুমে প্রবেশ করে ন্যাকড়া, হাত ও ঘিনঘিনে অনুভূতিতে ভরে উঠা মুখ ভালো করে ধুয়ে ফেলে, এরপর আবার কিচেনে প্রবেশ করে আমার জন্য সকালের নাস্তা তৈরী করতে বসে যায়।

ছড়িয়ে যাওয়া গোলাকার ময়দার পাতলা পর্দার উপর হাতের তেলো দিয়ে এমন মোলায়েমভাবে তেল মাখে যেন বিছানায় শুয়ে থাকা নিজের পেটের শিশু সন্তানের গায়ে মাখছে, পরপর কয়েকটি ভাঁজে বেশ পুরু ও চারকোনা করে তোলে, প্রত্যেকটি ভাঁজে ভাঁজে তেল মাখা, একটুও যেন বেঁকে না যায় এমন সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে বেলনা চেপে চারকোনা ছড়িয়ে দেয়। প্রত্যেকবার কামড় লাগানোর সময় ভাঁজে ভাঁজে তার তেলময় সরু সরু আঙ্গুলের স্পর্শ টের পাওয়া যায়।

বেশ বেলা হয়ে গেলে চায়ের কাপ হাতে সে আমার রুমের দরজায় আঘাত হানে, বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা না খোলা পর্যন্ত দরাম দরাম শব্দে ঘা পড়তে থাকে। অধিকাংশ সময়েই- যেই মাত্র ঘুমটি সবচেয়ে নীচু তলায় অবস্থান নিয়েছে অমনি তার ঢোল পিটানো শুরু হয়। গেয়ো ক্ষেত একটা, আমাদের শহুরে সভ্য মানুষদের সকাল বেলাকার মিষ্টি আমেজের ঘুমের কি বুঝবে! যাহোক, দু-হাতের মুঠিতে চোখ ডলতে ডলতে দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়েই ঘুমের হ্যাঁচকা টানে চলে আবার চলে আসতে হয় বিছানার উপর। ছেড়িডা, টিপয়ের উপর চায়ের কাপ রেখে পাশের টেবিলের উপর থেকে ভাতের থালা, তরকারীর বাটি নিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়।

এতক্ষণ ধরে যে ছেড়িডার প্রাত্যহিক সকালবেলার কাজের ফিরিস্তি বর্ণিত হল সে আমার গ্রাম সম্পর্কে চাচাতো বোন লাগে। ছোটবেলা থেকেই- মাঝখানে বছর চারেকের বিরতি- সে আমাদের বাসায় আছে। মাঝের সময়টুকুতে সে জামাইর ঘর করেছে, কঙ্কালসার দেহে ঢোলের মত পেট ফুলিয়ে পরপর জন্ম দিয়েছে দুইটি সন্তানের। জামাইর বাড়িতে সে কেমন ছিল, কেন তাকে ছাড়া করে দেওয়া হল- এসব ব্যাপার কিছুই আমরা জানিনা, জিজ্ঞেস করিনি কোন দিন, প্রয়োজন বোধ করিনি কখনো; তাকে পেয়েই আমরা খুশিতে ডগমগ।

একবার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে, জামাইর ঘরকরাকালীন সময়ে, তার সাথে দেখা হয়েছিলঃ প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে শরীরের কাঠামোটা অনেকটাই ভেঙ্গে গেছে, গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারও এক তাকানোতে তার রক্তস্বল্পতা বুঝে ফেলবে, চোখ দুটো কোটরের ভেতরে এমনভাবে রাখা যেন কাদার মাঝে ঘোলাটে মার্বেল ঢুকে আছে, চুলগুলো গ্রীষ্মের রোদে শুকানো খড়ের মত, ময়লা জমে-রোদে পুড়ে, শীতে কুঁচকে শরীরের চামড়া বিশুষ্ক মলিন, বছর দেড়েকের- চোখ ভর্তি পিচুটি ও সারা গায়ে ধুলো মাখা- একটা ছেলে আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে, আর মাস ছয়েকের- সমস্ত শরীর খোসপাঁচড়ায় ভরা– একজনকে বেঁকে যাওয়া মাঝার সাথে বাহুর চাপে এমনভাবে ধরা ও ছেড়িডার মুখের ভাবটি এমন মনে হয় যেন ফেলে দিতে পারলেই বাঁচে; লজ্জা-শরমের বালাই না রেখেই ঢিলা ব্লাউজের একপাশ গুটিয়ে উপরের দিকে উঠানো, কোলের ছেলেটির মত দুধেল স্তনটিও মাটিতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার মত নীচের দিকে ঝুঁকে আছে। তবে জামাইর কাছ থেকে ছাড়া হয়ে আমাদের বাসায় চলে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই সে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, গায়ে লাগে নতুন মাংশ, চোখ দুটো জলের উপর কাঠের টুকরার মত ভেসে উঠে, বহুজাতিক কোম্পানীর তৈরী সাবানের বিজ্ঞাপন দেওয়া নারীর মত তার শরীরের চামড়া পেলব হয়, ধানের কচি পাতার মত সজীব হয়ে উঠা শ্যাম্পু করা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে উড়তে থাকে ফুরফুর করে।

কোলের সন্তানদের ফেলে আসতে হওয়ায় আমার পরিবারের লোকজন উপরে উপরে তাকে বেশ খানিকটা সমবেদনা জানালেও ভেতরে ভেতরে বেজায় খুশি হয়। গরীব ঘরের মেয়েরা গার্মেন্টস কারখানার দিকে পথ ধরাতে বাসা-বাড়ির কাজের জন্য মেয়ে জোগাড় করা বড়ই দুষ্কর আজকাল। আর তার মত একেবারে ঘরে তৈরী, সকল রকম কাজ জানা, বিশ্বাসী ছেড়িই বা কোথায় পাওয়া যায়! আর ছেড়িডাও আমাদের সাথে থাকতেই যেন বেশী ভালো বোধ করে। নিজের পেটের সন্তানদের কথা তার মুখ থেকে বের হয় না তেমন একটা। একবার জিজ্ঞেস করলে, সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে জানিয়েছিল, অরা নাকি এহন আর তারে চিনবারই পারব না, বড়ডায় চিনলেও চিনবার পারে, এসময় তার মুখে অনিশ্চয়তার ছায়া গাঢ় হয়ে উঠে। জামাইর ব্যাপারে বলে, অর কাছে আর কয় দিন থাকলে সে নাকি গোরস্থানে চইল্যা যাইত।

ছেড়িডা, একদিন মাসোহারা দাবী করে বসলে ভূতের শব্দ শোনার মত চমকে উঠেছিল সবাই। এখানেই তো ভালো খায়, ভালো থাকে, ভালো পড়ে, কোন ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হয় না, কারো প্রতি কোন দায়-দায়িত্ব নেই, বাপ-মায়ের খরচ তো অর ভাইয়েরাই চালাবে, সন্তান দুজন তো তাদের বাপের কাছেই থাকে। কোন প্রয়োজনে তবে ছেড়িডার টাকা লাগবে? এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেতে হয়রান হয় সকলে, যুতসই কোন সমাধান খুঁজে পায় না। তবে এও ভাবে, দিনকাল যা পড়েছে, এখন কি আর কেউ আগের মত পেটে-ভাতে কাজ করবে! এরপর থেকে কিছু কিছু মাসোহারা সে পায়, তবে আমাদের সকলের চোখে কেমন যেন একটু পর হয়ে যায়। টাকা নিচ্ছে কাজ করছে, অর সাথে আবার সম্পর্ক কিসের! তবে কেউ তার সাথে তেমন একটা দুর্ব্যাবহার করে না, বাসার কাউকে কোনদিন তার গায়ে হাত তুলতে দেখিনি আজ পর্যন্ত।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৫

ক্ষতিগ্রস্থ বলেছেন: শব্দচয়ন, চিত্রকল্প, প্লট অসাধারণ। খুব ভাল লাগল। ++++

২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৩

মেহেদী হাসান মঞ্জুর বলেছেন: গল্পটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম এবং উৎসাহী বোধ করছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত।

২| ২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৮:০৭

ফারদীন নিশ্চিন্ত বলেছেন: ভাল লাগল। আহারে ছেড়িডা।

২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৮:১৪

মেহেদী হাসান মঞ্জুর বলেছেন: ধন্যবাদ, ফারদীন নিশ্চিন্ত।

৩| ২১ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৯:১৬

আজীব ০০৭ বলেছেন: +++

২১ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৮:৫৬

মেহেদী হাসান মঞ্জুর বলেছেন: ধন্যবাদ, আজীব০০৭।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.