নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনন্দ-পঠন

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই

মেহেদী হাসান মঞ্জুর

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই।

মেহেদী হাসান মঞ্জুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

যদি আমি সময় ভ্রমণের সুযোগ পাই, তাহলে আমি বার বার করে যাব হেনা দাসের শোক-মিছিলের সেই দিনটিতে!

২২ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:০০



২০০৯ সালের জুলাই মাসে যখন কমরেড হেনা দাস মৃত্যুবরণ করে, তখন আমি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একজন কর্মী। মৃত্যুর খবর শোনা মাত্র, আমরা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা দেই- মরদেহ দেখতে। মরদেহটি সেখানে দিন সাতেকের জন্য রেফ্রিজারেশনে রাখা হবে কারন তার নিকট-আত্মীয়দের মধ্যে কেউ কেউ দেশের বাইরে থাকে, তারা মরদেহটি শেষবারের মত দেখতে আসবে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। হাসপাতালে পৌঁছেই দেখি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কিছু নেতা-কর্মী মরদেহটিকে চক্রাকারে ঘিরে আছে, যতটুকু মনে পড়ে তারা তখন সম্ভবত সমবেত স্বরে ইন্টারন্যাশনাল(সমাজতান্ত্রিক ভাবসঙ্গীত) গাইছিল। ভিড়ের ভেতর দিয়ে আমি হেনা দাসের মরদেহের মুখমন্ডলের দিকে তাকানোর সাথে সাথেই ভয়ানকভাবে চমকে উঠি। আমি আমার জীবনে কখনো এরকম অদ্ভুত কিছু দেখিনি। শুধুমাত্র শরীরটাই অনড়, তাছাড়া তার মধ্যকার সবকিছুই সম্পূর্ণরূপে জীবন্ত একজন সংগ্রামী মানুষের মতই মনে হচ্ছিল। আসলে সে ছিল শারীরিকভাবে মৃত, মানসিক বা চেতনাগত ভাবে মোটেই নয়। আমি যদি আত্মায় বিশ্বাসী হতাম, তাহলে হয়ত বলতামঃ তার আত্মাটি এখনও শরীরের ভেতরে, শধুমাত্র আকস্মিকভাবে তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে। তার চেতনা, রাজনৈতিক আদর্শ, শ্রমজীবী শ্রেণি ও নিপীড়িত মানুষের জন্য জীবনব্যাপী সংগ্রাম এবং আমাদের সমাজে বিদ্যমান অন্যায়-অবিচার, সকল ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং প্রজ্ঞা ও অন্যান্য নানা ধরনের অনুভূতির চিহ্ন তার মুখমন্ডলের মধ্যে ঘন হয়ে ছেয়ে আছে।



তার নিকট-আত্মীয়েরা দেশে ফিরলে শোক-মিছিলের দিন ধার্য্য করা হল। যথারীতি আমরা ছাত্র ইউনিয়নের প্রায় সকল নেতা-কর্মীরা শোক-মিছিলে যোগ দেই। আমি আমার জীবনে যতগুলো শোক মিছিলে যোগ দিয়েছি, এটা ছিল সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী দীর্ঘ( যেমন পথের দূরত্ব হিসেবে ঠিক তেমনিভাবে মিছিলের আকার হিসেবেও)। মনে পড়ে, ঐ দিনটিতে ভীষণরকম তাপদাহ ছিল। কিছু রাস্তা পায়ে হেঁটে, কিছু রাস্তা বাসে চড়ে আমরা সেদিন ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে যাই। আমাদেরকে নানা জায়গায় থামতে হচ্ছিল কারন বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন ঘেমে-নেয়ে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় জমাতে থাকে বা সমবেতভাবে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করে। এই ধরনের ঘটনায় আমি বেশ বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। ভাবছিলাম, লোকজন কেন এমন একজনকে নিয়ে এত মাতামাতি শুরু করেছে যে মূলত আমাদের লোক, তাদের কি খেয়েদেয়ে আর কোন কাজ নেই, শুধু শুধু আমাদের যাত্রা পথে বিঘ্ন ঘটাছে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই নারায়নগঞ্জ পৌঁছে যেতাম! তবে, পরবর্তী সময়ে অন্যদের কাছে হেনা দাসের সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনে এর উত্তর পেয়েছি, কেন এত এত লোক সেদিন তার কাছে এসেছিল, কেন তারা কেঁদেছিল হৃদয় থেকে! হেনা দাস শুধুমাত্র আমাদেরই লোক ছিল না, নিশ্চিতভাবেই তাদেরও লোক ছিল, যাদের জন্য তার জীবনব্যাপী সংগ্রাম যা এমনকি মরণও থামিয়ে দিতে ভয়ানকভাবে ব্যার্থ হয়েছে। মৃত্যুর কারনে তার শরীর অনড় হয়ে পড়ে থাকলেও, মুখের মধ্যে এখনও লেগে আছে সেই যুদ্ধংদেহী ভাব। সেই মানুষটাকে কি তারা তাদের হৃদয়-মন মথিত শ্রদ্ধা জানাতে আসবে না!



অবশেষে, আমরা সকলে দীর্ঘযাত্রায় ভয়ানক ক্লান্ত হয়ে নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছাই। নারায়ণগঞ্জের কমিউনিস্ট পার্টির অফিস ছিল শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে। পার্টি অফিসে এসে পৌঁছানোর সাথেই সাথেই আমরা অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি, নদীর ঠান্ডা পানির ছোঁয়া পেয়ে আমাদের শরীর-মন জুড়োয়। এরপর নারায়ণগঞ্জ পার্টি অফিসের পক্ষ থেকে আমাদের সকলকে একটি করে লাঞ্চ বক্স দেয়া হয়, শোকের কথা সম্পূর্ণভাবে বিস্মৃত হয়ে প্রাণভরে খেয়ে নেই, কারন আমরা সকলেই তখন ভয়ানক ক্ষুধার্ত ছিলাম।



এরপর শুরু হল শোকমিছিলের দ্বিতীয় ধাপ, এ-পর্যায়ে আমাদের সাথে যোগ দিল নারায়ণগঞ্জের পার্টি কমরেড, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মী এবং সমাজের সর্বস্তরের লোকজন। মিছিলটি শশ্মানঘাটের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। শীতলক্ষ্যা নদীতে গোসল করে এবং পেটের ক্ষুধা মিটিয়ে আমরা যারা ঢাকা থেকে এসেছিলাম তারা সকলে বেশ আরামই বোধ করছিলাম। আমি মিছিলের সাথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ করে, দুইটি মেয়ের দিকে আমার চোখ পড়ে, যারা পাশাপাশি থেকে হাঁটছিল। প্রথম দেখাতেই আমি তাদের মধ্যকার একজনের প্রেমে পড়ে যাই(শোক মানুষকে প্রেমে পড়া থেকে নিবৃত্ত করেনা বরঞ্চ ধাবিত করে)। মেয়েদুটি দেখতে এমনিতেই বেশ সুন্দর, বিকেল বেলার পড়ন্ত আলো এবং শোকের ছায়া বাঁকাভাবে তাদের মুখের উপর পড়ে তাদের সৌন্দর্যের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। এই প্রথম বারের মত বুঝতে পারি, এমনকি শোকও মানুষের সৌন্দর্যের উপর তুলির আরেকটি পোছ দিতে পারে! যাহোক, এই ব্যাপার কথা বলা এখানেই বন্ধ করি কারন আমি এখানে প্রেমের গল্প ফাঁদতে বসিনি এবং এ-ব্যাপারে আমার আর কিছু বলারও নেই, কারন পরবর্তীতে সময়ে আজও পর্যন্ত ঐ মেয়েদুটিকে আর একটিবারের জন্যও দেখিনি, এবং এমনকি মেয়েদুটির মুখচ্ছবিও এখন আর স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি না।



শশ্মানঘাটে পৌঁছানোর পর, হেনাদাসের মরদেহ জ্বালানীকাঠ দিয়ে তৈরী মঞ্চের উপর রাখা হল। সেখানে প্রাশ্চাত্য ঢঙে কালো পোশাকে সজ্জিত একজন বা দুইজন নারীর দেখা পেলাম, তাদের চোখে অশ্রু টলমল করছিল। আমার কাছে তাদেরকে হেনা দাসের নিকট-আত্মীয় বলেই মনে হল, সম্ভবত তারা হেনা দাসের মেয়ে, দেশের বাইরে থাকে। তাদের মুখে সংগ্রামের কোন চিহ্ন ছড়িয়ে ছিলনা বরঞ্চ তা ছিল খুবই পেলব। ছুঁয়ে না দেখে এমনকি বেশ দূর থেকেই আমি খুব সহজেই তা অনুধাবন করতে পারছিলাম। উত্তরাধিকার স্বরূপ তারা তাদের মায়ের কাছ থেকে মানসিক সম্পত্তির ছিটেফোঁটাও পায়নি- এমনটিই মনে হল আমার। কেন জানি, তাদের প্রতি আমার বেশ করুণা বোধ হতে থাকে সেইসময়!



যাহোক, যখন জ্বালনী কাঠে প্রথমবার আগুন দেয়া হল, আমরা তখন মরদেহকে ঘিরে একে-অপরের হাত ধরে বৃত্তাকারে দাঁড়ালাম। প্রথমে, আমরা গাইলাম ইন্টারন্যাশনাল(সমাজতন্ত্রের ভাবসঙ্গীত) তারপর শুরু হল রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া। (হে, আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, এ-জীবন পূর্ণ করো, এ-জীবন পূর্ণ করো--) এই লাইনটি যখন সকলে সমবেত ভাবে গাচ্ছিলাম তখন আমার যে অনুভূতিটা হল তা অনেকটা এরকমঃ মিছিলের মধ্যে দেখা সেই সুঠাম মেয়ে দুটি দুই দিক হতে আগুনের পরশমনি হতে করে নিয়ে এসে আমার প্রাণে ছোঁয়াচ্ছে, যেমনভাবে এক মোমবাতির আগুন থেকে অন্য মোমবাতিগুলোতে আগুন জ্বালানো হয়। (আমার এ দেহখানি তুলে ধর, তোমারও দেবালয়ের প্রদীপ গড়, নিশিদিন আলোক শিখা জ্বলুক গানে--) এই লাইনটি চলাকালীন সময়ে আমার বোধ হলঃ অদৃশ্য কেউ একজন আমার শরীরটাকে উপরের দিকে তুলে ধরছে, এ সময়ে আমার শরীরটা যেন একটা পালকের মত প্রায় ওজন শূন্য হয়ে উঠে এবং মৃদুমন্দ বাতাসে তা এমনভাবে উড়ে বেড়াতে শুরু করে যেন সেখানকার মধ্যাকর্ষণ শক্তি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এবং আমার হৃদয়ের মধ্যিখানে বেদনার মত কোন একটা কিছু অবিরাম জ্বলতে থাকে। ঠিক এই সময়ে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, কিভাবে জ্বালানী কাঠ থেকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠা আগুনের শিখা তার সকল উষ্ণতা নিয়ে মরদেহটিকে বারে বারে একটু একটু করে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সেই সময়কার অনুভূতি পুরোপুরি বর্ণনা করা আমার সাধ্যের বাইরে। শুধুমাত্র এটুকু বলতে পারি, যদি আমি সময় ভ্রমণ করার সুযোগ পাই, তাহলে বার বার করে ফিরে যাব হেনা দাসের শোক-মিছিলের সেই দিনটিতে!



মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৪৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, ভাই মেহেদী হাসান।

২২ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:২০

মেহেদী হাসান মঞ্জুর বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ- আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.