![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
★-★
আমি গরু নিয়ে গেলাম, মাঠে। মাকে শুনিয়ে জোরে করে বললাম কথাটা। মা কি কাজে যেন ব্যাস্ত ছিল। আমার কথা শুনে কাজ ফেলে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে আসলো, এসে বললো, যাইস না বাবা? সকালে না খেয়ে যাইস না? পান্তা ভাত খাবি না। আমি তোর বুবুর বাড়ি থেকে কড়কড়া ভাত এনে দিচ্ছি।
- তোর ভাত তুই খা। আমি খাবো না বলছি, খাবো না। গরু ছেড়ে দিয়েছি চলে গেলাম।
আর কিছু না শোনার ভান করে চলে আসলাম। সকালে আমি পান্তা ভাত গুড় ছাড়া খেতে পারি না। গুড় শেষ হয়ে গেছে তো পান্তা ভাত করার কি দরকার ছিলো।
বাড়ির দক্ষিণ পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা আছে, সেই রাস্তা ধরে কিছুটা পশ্চিমে গেলে একটা খাড়ি। খাড়ির ঐপারে মাঠ। এখানে গ্রামের সকল ছেলে-মেয়ে গরু, ছাগল নিয়ে আসে। এখন আমাদের স্কুল জৈষ্ঠ্যমাসের আঠার দিন ছুটি। শুধু আমাদের গ্রামের না, আশেপাশের আরো দু-চার গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও আসে।
আমি গরু নিয়ে খাড়ি পার হয়ে উঠতেই দেখলাম, আমার চাচাতো ভাই রাজু চলে এসেছে। সে কার সাথে যেন বসে কথা বলছে, এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে না৷ কারন সে আড়ানির নিচে বসে আছে। আমাদের এইদিকার জমিগুলো অনেক উঁচু-নিচু ঠিক যেন, সিঁড়ির মত বেয়ে চলে গেছে নিচে আবার নিচ থেকে উপরে উঠেছে। উত্তর বঙ্গ বলে কথা।
রাজু বড়ই মিশুক ছেলে, এখানে যতগুলো মেয়েরা আসে সবার সাথে ওর ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে খুব তাড়াতাড়ি। সে নিজেও জানে না, কে তার, সে কার। তাই সব ছেলেরা তাকে বিশ্ব প্রেমিক বলে ডাকে। যদিও সবাই বিশ্ব প্রেমিক কাকে বলে জানেনা।
আমি কাছে আসতে দেখলাম, শিখার সাথে বসে আছে। শিখা আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। সে রোজ ছাগল নিয়ে আসে। আজ সেও আগে চলে আসছে।
তারা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলো, আমাকে দেখে শিখা থতমত খেয়ে বললো, কেমন আছেন ভাইয়া?
-কেমন আছি, রোজ একি প্রশ্ন করিস, তোর বিরক্ত লাগে না? আর আড়ানির নিচে কি কথা বলিস ফাঁকা যায়গাই থাকতে পারিস না।
-তুমি এইরকম কেন? তার কারনেই তো তোমার সাথে কেউ কথা বলে না। তোমার চাচাতো ভাইকে দেখো তো, ও তো তোমার কত ছোট। তারপরও ওর সাথে সবাই কথা বলে৷ আর তুমি একা ঘাপটি মেরে গিয়ে আলাদা বসে থাকো।
-তো তোর কি? যত্তসব ফালতু মেয়ে একটা। যা সবার সাথে ঘুরে বেড়া, ইচ্ছে হলে স্বামী করে নিস সবাইকে। আমার সাথে লাগতে আসবি না।
দেখি এবার সে চুপ হয়ে গেছে, আর কোন কথা বলছে না।
আমি চলে আসলাম আম গাছের কাছে, মন খারাপ থাকলে এখানে আমি বেশি থাকি। আর মন ভালো থাকলে গরুগুলোর পিছু পিছু ঘুরে বেড়াই। তাদেরকে সুন্দর করে খাওয়ায়। আমাদের মোট চারটা গরু, দুইটা লাল, একটা মাটি রঙ্গা, একটা কালো।
এমনিতে আজ অনেক মন খারাপ, সকালে ভাত খাইনি। তার উপর এই মেয়েটা, বড়ই অসহ্য।
বয়সে আমার দেড় বছরের বড়, তারপরও আমাকে তুমি করে বলে, আর আমি তাকে তুই করে বলি। এই অভ্যাস ছোট বেলা থেকে কেমন করে জানি হয়ে গেছে। দেখতে একটু শ্যামলা, তবু মাঠে এসে সকলের সাথে মিশবে, ভিন্ন গ্রামের ছেলেদের সাথেও কথা বলবে। তার জন্য তাকে আমার আরো বেশি অসহ্য লাগে।
একটু পরে দেখি রাজু আসলো আমার কাছে। এসে বলছে, ঐভাবে ওকে তুমি কথা বলেছো, ও এখন কানতেছে না।
-কান্দুক! ওকে কি আমার সাথে কথা বলতে বলেছি। এমনি তে আজ আমি সকালে ভাত খাইনি। পান্তা ভাত করছে, কিন্তু গুড় ফুরাইয়া গেছে তার জন্য। তার উপর ও কি বলছে, কেমন আছো। রোজ একি কথা। কেমন আছো? এইটা কোন কথা হলো? যদি বলতো ভাত খেয়ে এসেছো? তাহলেও হতো।
- তুমি আসার আগে। সে তোমার কথায় বলছিলো।
-কি বলছিলো?
-বলছিলো,- তুমি মাঠে এসে কারো সাথে মিশো না। কোন ছেলেদের সাথে মিশো না আর মেয়েদের সাথে তো দুরের কথা। সবার থেকে আলাদা থাকো তার জন্য সে তোমাকে পছন্দ করে, কিন্তু তুমি অনেক রাগিত তাই কিছু বলতে পারে না।
-কি? এসব বলেছে? আর ও যে সবার সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলে বেড়াই। তার জন্য ওকে কে পছন্দ করবে শুনি। এসব মেয়েরা কখনো ভালো হয়? যারা পাড়া গাবানির মত ঘুরে বেড়াই।
হঠাৎ আমার চোখ পড়লো আমার ধামড়াটার উপরে, সে পটলের জমির ভিতরে ঢুকে গেছে। রাজুকে আর কোন কথা না বলে, গাছ থেকে লাফ দিয়ে পটলের জমির কাছে চলে গেলাম। তারপর দামড়াটাকে ইচ্ছা মত পেটাতে পেটাতে নিয়ে আসলাম।
আজ পচন্ড রোদের তাপ উঠেছে। আমার মাথা, গা কেমন যেন অবস হয়ে আসছে। এর আগেও একবার যখন সকালবেলা না খেয়ে স্কুলে গিয়েছিলাম, তখন একটু বেলা বাড়ার সাথে সাথে আমি বমি করতে শুরু করেছিলাম৷ আজও সেইরকম হচ্ছে।
কোন রকমে আম গাছটার কাছে আসলাম আবার, এসে পেট ধরে বসে পড়লাম।
রাজু বলতে লাগলো, কি হয়েছে? গরু এ শিং মারলো না কি?
-আরে না, সকালে ভাত খাইনি তার জন্য এমন হচ্ছে।
-আচ্ছা তুমি ভালো হয়ে বসো, আমি পানি নিয়ে আসি। শিখা বোতলে করে পানি নিয়ে এসেছে।
এখানে অনেকদুর পর্যন্ত কোন পানি খাওয়ার ব্যাবস্থা নাই তাই অনেকে বোতলে করে পানি নিয়ে আসে বাড়ি থেকে। আর কেউ না নিয়ে আসলে তো শিখা নিয়ে আসবেই, ওর না কি আবার ঘন ঘন তৃষ্ণা পায়। কিন্তু সে সামন্য করে পানি খাবে তাতেই আবার তার তৃষ্ণা মিটে যায়, আজব মেয়ে একটা।
রাজু শিখার কাছে যেতেই দেখি শিখা পানির বোতল নিয়ে দৌড়ে এইদিকে আসছে। মেয়েটার মনটা বড়ই দিলদরিয়া, গ্রামের অধিকাংশ মেয়েরা এইরকম। এই মাঠে সবার বিপদে ওই ছুটে যায় সবার আগে। কিন্ত এইটা আমার ভালো লাগে না। ও সবার কাছে ছুটে যাবে কেন, গ্রামের ছেলেরা হলে আলাদা কথা। তা নাহলে ভিন গ্রামের ছেলেদের কাছে যাবে কেন। সে কি নার্সের চাকরি নিয়েছে?
তারা কাছে আসতে আসতে আমি বমন করে ফেলেছি।
শিখা পাশে বসে তার ওড়নাটা দিয়ে প্রথমে মুখ মুছে দিলো। তারপরে পানি ঢালতে লাগলো।
একটু আগেও যে মেয়েটা আমার কড়া কথার জন্যে না কি কিছুক্ষণ আগে কাঁদলো। আর সে এখন আসছে আমাকে বাঁচাতে। একটু পানির জন্যই কিন্তু মানুষ মারা যায়।
আমি বললাম,- আমি বাড়ি চলে যাবো। আমার গরুগুলো...
বলতেই শিখা বললো, “গরু রাজু নিয়ে যাবেনি। আমি তোমাকে এখন বাড়ি নিয়ে যায়।”
-না যেতে হবে না আমি একা যেতে পারবো। বলে, আমি চলতে লাগলাম বাড়ির দিকে।
বাড়ি আসতেই মা বললো, কি হয়েছে? চলে আসলি এখুনি? গরু কই? মাথা কেন ভেজা?
- সকালে ভাত খেয়ে যায়নি তার জন্য বমি করছি। গরু রাজু নিয়ে আসবে।
-তোকে তো বললাম, সকালে না খেয়ে যাস না। গুরুজনদের কথা শুনবি না। দেখ গুরুজনদের কথা না শোনার ফল কি রকম। আমি তো তোর দাদির বাড়ি থেকে ভাত এনে দিতেই চাইলাম।
এখন আমি তেমন তেজ দেখাতে পারছি না। শরীরে তেমন শক্তি নাই। নইলে আবার খেতাম না এসব কটুকথার জন্য।
ভাত খেলাম। খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
১২ টার দিকে রাজু গরু নিয়ে এসে দিলো। আমি শুনতে পেলাম, কিন্তু উঠলাম না। তার একটু পরে দেখি শিখা মায়ের সাথে কথা বলছে। একটু কথা বুঝতে পারলাম, ‘আমরাই তো ভাইয়ার মাথায় পানি ঢেলে ভালো করলাম, তা না হলে কি জে হতো।’
আমার মা বাহিরে কাজ করছিলো, শিখা আমার ঘরে আসলো। এসে বললো, এখন কেমন আছো? আবার সেই প্রশ্ন, কিন্তু এখন রাগ হলো না।
-এখন ভালো। তবে তোর কাছে আমি এখন অনেক ঋণী হয়ে গেলাম।
-এমন কথা বলছো কেন? আমি হলে তুমি করতে না?
-না করতাম না। আমি কি তোর মত এতো বড় মনের মানুষ না কি? তুই মেয়েও, আবার মানুষও।
-তুমি চুপ থাকো! ঘুমাও! আমি গেলাম।
-এই শোনে যা, তোর ওড়নাটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তোকে একটা ওড়না কিনে দেব। লাল ওড়না। আমাদের লাল দামড়াটার মত রংয়ের। ঐটা দিয়ে আবার যাকে তাকে মুখ মুছাবি না।
সে দরজার পাশে থেমে গিয়েছিলো। আমার কথা শুনে আবার বললো, তোমার ইচ্ছা। আমি এবার সত্যি গেলাম।
১ম পর্ব
©somewhere in net ltd.