![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২য় পর্ব
বিকেল বেলা আবার মাঠে গেলাম। এখনো সবাই মাঠে চলে এসেছে, আমি সবার পরে আসলাম। দেখি সবাই মিলে খেলতেছে, ‘সেন্ডেল চুর’ খেলা মেহেগুণী গাছের লম্বা লম্বা পাতা দিয়ে। আমি তাদের খেলার একটু পাশে এসে বসলাম এখনো আবার একটু মন খারাপ। বাবার সাথে আজ আবার কথা কাটাকাটি হয়েছে। আমার বাবার সাথে আমার কোন কথারই বনিবনা পড়ে না। তাই ভাবতেছি কি করা যায়। বাড়িতে থাকার কোন ইচ্ছেই নাই আর আমার।
ঐ দিকে থেকে অনেকে বলতেছে, ভাইয়া এইদিকে আসো তুমি খেললে একজন খেলতে পারবে। আমি তাদের কথায় তেমন কান দিলাম না। একটু পরে শিখা আমার কাছে আসলো। সে সেন্ডেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে বিপক্ষের হাতে তাই এখন তার বিরতি।
শিখা পাশে এসে বললো,- ‘ভাইয়া এখনো তোমার মন খারাপ না কি আবার?’ দুপুরে আবার খাওনি না কি?
-হ্যাঁ মন খারাপ একটু, তবে খেয়ে এসেছি। বাবার সাথে আজ আবার কথা কাটাকাটি হয়েছে। ঐ বাড়িতে থাকতে আমার আর একদম ইচ্ছে করছে না। কখন যে কোথায় চলে যাবো নিজেও জানি না। তবে তোকে খুব মনে পড়বে।
-সত্যি? আমাকে মনে পড়বে তোমার? আমি তো দেখতে সুন্দর না। তাছাড়া আমাকে তো তোমার শত্রু ভাবো।
- শত্রু কখনো ভাবিনি। তবে সবার সাথে তুই হেঁসে হেঁসে কথা বলিস তার জন্য তোকে অপছন্দ আমার। কিন্তু এখন বুঝেছি তুই সত্যি কারের খাঁটি মানুষ। আর তুই সুন্দর না কে বলেছে, তুই জানিস, “গাছে ফুটে থাকা কদম ফুল, জবা ফুল কত সুন্দর? তার চেয়ে তুই বেশি সুন্দর।” কারন সৃষ্টির সেরা হলো মানুষ, তোর মত মানুষ। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে নিজ হাতে সুন্দর করে তৈরি করেছেন, আর কাও কে না। তিনি জানেন কাকে কীভাবে সৃষ্টি করলে সে সুন্দর হবে। তাই তিনি তো তোকে এইভাবে সৃষ্টি করেছেন৷ মনে রাখিস, পৃথিবীতে যত কিছু সুন্দর আছে, সবার চেয়ে সুন্দর হলো মানুষ। তারচেয়ে বেশি সুন্দর তোর মত মানুষ যার এতো সুন্দর একটি উদার মন আছে।
- আজ তোমার কাছে সুন্দরের উদাহরণ শুনে মনে হচ্ছে তুমি সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। তাই তোমাকে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
- কী কথা বল?
- না, এখন না, কাল বলবো।
- আচ্ছা বলিস। এখন সন্ধ্যা নেমে আসছে, তারাতারি বাড়ি চল। মেয়ে মানুষদের সন্ধ্যা লগ্নে বাড়ির বাহিরে থাকা ঠিক না, জ্বীনে ধরে।
-তুুমি তো আছো। রাজু, সজিব, বাচ্চু, সাকিল সবাই তো আছে, তাহলে আমার ভয় কিসের?
- সব সময় অন্যের উপর ভরসা করা ঠিক নয়। এতে নিজেকে পস্তাতে হয় অনেক, কষ্টও পেতে হয় অনেক। মনে কর তুই কারো জন্য অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে আছিস কিন্তু সে আসলো না। তখন কেমন লাগবে তোর?
- কেমন লাগবে আবার? তাকে তো পরে পাবো তখন শায়েস্তা করে নিবো।
কথা বলতে বলতে সকলে মিলে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
রাতে মা পটল রান্না করেছে ঝোল করে। এটা আমার একদম পছন্দ না৷ মাকে তাই বললাম,- এইগুলো তরকারি মানুষ খায়। কি যা তা রান্না করেছিস? আমাদের গ্রামের অধিকাংশ ছেলে-মেয়েরাই মা কে তুই করে বলে।
পাশে বাবা বসে ছিলো, আমার কথা শুনে তিনি বললেন,- পটল খাবিনা, বেগুন খাবিনা, আলু খাবি না, পন্তা খাবি না গুড় ছাড়া। তো কি খাবি? জমিদারের ব্যাটা হয়েছিস। নিজে ইনকাম করে কিনে কিনে খাবি।
আমি কোন কথা বললাম না। শুধু মনে মনে বলছি, রাতটা পার হোক কোন মতে।
পরেরদিন সকালবেলা আবার গরু নিয়ে মাঠে গেলাম। যেতে ভাবছি কিছু একটা করতে হবে। হঠাৎ পিছন থেকে শিখা ডাক দিলো, সুজন ভাইয়া আজ তুমি আগে চলে আসলে। বলতেই কাছে চলে আসলো এসে, এই নাও আমাদের গাছের খেজুর। খুব মিষ্টি। অনেক গুলো দিলো আমাকে, আমি তা লুঙ্গির একমাথায় গুঁজে নিলাম। আর অবাক হলাম, আজ সে আমাকে নাম ধরে ডাকলো, আর এই প্রথম আমাকে কিছু দিলো। আমি তো তাকে ওড়না দিতে চেয়ে এখনো দিতেই পারলাম না।
আমি বললাম,- আজ তোকে বেশি খুশি মনে হচ্ছে? এতো খুশি হওয়া ভালো নয়, পরে দুঃখ পেতে হয়। আমার তো তাই হয়, আমি যেদিন সকালে বেশি খুশি থাকি, বিকালে সেদিন মন খারাপ হয়ে যায়। আবার যেদিন সকালে মন খারাপ থাকে সেদিন বিকালে মন অনেক ভালো থাকে।
- ও তাই। তুমি সব সময় আমাকে শিক্ষকদের মত কথা বলো, দুলাল স্যারের মত। আচ্ছা, এখন তোমার মন ভালো না খারাপ?
- এখন একটু খারাপ, তবে তোকে দেখে ভালো হলো। আচ্ছা রাজুরা এখনো আজ আসেনি কেন?
একটু পরে সবাই আসলো। শিখা তাদের সাথে খেলতে চলে গেলো। তারা খেলতে খেলতে কে যেন মজা করে ঢিল ছুড়ে, তা গিয়ে শিখার হাতে লাগে। সাথে সাথে সে মাটিতে বসে পড়ে, সকলে তাকে ঘিরে ফেলে। আমি দূর থেকে বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে। দ্রুত সেখানে গেলাম গিয়ে দেখলাম, শিখার হাতের সিনার একটু নিচে কালশিরি পড়ে গেছে৷ সে ফর্সা মেয়ে হলে লাল হয়ে যেত।
আমি তা দেখে খাড়ি থেকে গামছাটা ভিজিয়ে এনে তার ঐখানে বেঁধে দিলাম।
সে আর খেললো না, দুপুর হয়ে গেছে তাই সে ছাগল নিয়ে বাড়িতে আসতে লাগলো। আমিও তার সাথে সাথে আসলাম। হঠাৎ আমার মনে পড়লো গতকাল সে যেন কি বলতে চেয়েছিলো। বললাম,- কি রে কাল যে তুই আমাকে কি যেন বলতে চেয়েছিলি। এখন বল?
- না এখন বলতে পারবো না। সন্ধেবেলা তুমি আমাদের কামরাঙ্গা গাছের কাছে এসো।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
আমি বাড়ি এসে গরু বাধার সময় শুনতে পেলাম বাবা বাড়ির ভিতরে চিল্লাচিল্লি করছে। সকালে আমি ভাত নিয়ে যায়নি মাঠে বাবার কাছে তার জন্য মায়ের সাথে রাগারাগি করছে। আমি কিছু বললাম না। চুপ থাকলাম।
গোসল করতে গিয়ে দেখলাম শিখার দেওয়া খেজুর, তখন কয়টা খেয়েছিলাম আর এখনো লুঙ্গীতে জড়া আছে কয়েকটা।
ভাত খেয়ে কাপড়ের ব্যাগে করে দুইটা লুঙ্গী, তিনটা সাট ভরে নিলাম। সাথে শিখার দেওয়া খেজুরগুলো, আর শফিকের দেওয়া ফোন নাম্বার। শফিকের বোনেরা ঢাকাতে থাকে কোন এক গ্রামেন্টসে। শফিককে বলে তার বোন-দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলে রেখেছিলাম, সেখানেই চলে যাবো। এই বাড়িতে থাকা আর সম্ভব নয়। বিকালবেলা সবাই কাজে চলে গেলে, মায়ের রাখা পাঁচশত টাকা নিয়ে নিলাম। ভালো করে দেখে আসলাম মা চাচিদের সাথে গল্পে ব্যাস্ত আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। এই সুজোগেই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গ্রামের পিছন সাইড দিয়ে আসলাম যাতে কেউ না দেখতে পাই। তারপর রাস্তায় উঠে গাড়িতে করে সোজা তানোর এসে নামলাম। সেখান থেকে রাজশাহীর গাড়ীতে উঠলাম।
রাশাহীতে এসে নেমে, সিরোইলে এলাম এখানে ঢাকার বাসের কাউন্টার। জীবনের প্রথম বাস কাউন্টারে এসে নতুন অভিজ্ঞতা হলো। একানকার বেশিরভাগ লোকগুলো চিটার বাটপার। কাউন্টারের কাছে আমি যেতেই পারিনি তাতেই শুধু আমার ব্যাগ ধরে টানাটানি করছে একেকজন। মনে হচ্ছে আমি তাদের পরিচিত কেউ। একজন তো ধমক দিয়ে বললো, ‘এই ব্যাটা ঢাকা তো যাবি তো এতো অভিনয় করছিস কেন? চল আমাদের বাসে চল।’
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম দুই একটা পুলিশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমিও এক ঝাড়ি নিয়ে বললাম, তোদের বাসে কি ফ্রি নিয়ে যাবি? বেশি রকম করলে না ঐ যে পুলিশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, চিল্লাতে শুরু করবো। আমার এমন কথা শুনে তারা সরে গেলো। তারা মনে করেছে আমি কোন টোকাই-টুকাই। শফিক আমাকে আগে থেকে বলে রাখছিলো কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটবি। লোকাল বাসের টিকিট কাটলে ২০০-২৫০ টাকা নেবে। আমি ২২০ টাকা দিয়ে শিশির পরিবহনের একটা টিকিট কাটলাম।
বাস ছাড়লো সন্ধে ছ'টায়। এই প্রথম অনেক দূরের বাসে উঠেছি তাই মনের ভিতর কেমন জানি করতে শুরু করলো। গা টা ঘেমে যাচ্ছে, তাই গামছা বের করার জন্য ব্যাগে হাত দিলাম। তখন মনে পড়লো গামছা তো শিখাকে দিয়েছিলাম। তাকে একটা লাল ওড়না কিনে দিতে চেয়েছিলাম আর আমার লাল গামছাটাই দিয়ে চলে এসেছি আজ। কি ভাগ্যের খেলা। ব্যাগে রাখা খেজুরগুলো আমার হাতে পড়লো। সেগুলো বের করে খেতে গিয়ে মনে পড়লো, শিখা আমাকে কি যেন বলতে চেয়েছিলো। সে নিশ্চয় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু খবর নেওয়ার তো কোন উপায়ও নেই। গ্রামে সবে মাত্র ফোন এসেছে, শুধু দুইটা একটা সাদেকুল ভাইয়ের কাছে, একটা মাইনুল কাকার কাছে, দুটো ফোনই সিটিসেল। দুই টাকা মিনিট নেয় কথা বলতে।
মনে হচ্ছে শিখা এখন আমার কথা ভাবতেছে, যার জন্য মনে একটা টান অনুভব করতেছি।
©somewhere in net ltd.