![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেনিন জন্মের মধ্যদিয়ে সারাবিশ্বে মুক্তিকামী মানুষের যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল আজও তা ইতিহাসে বিস্ময়কর। একজন মানুষের জন্মের সঙ্গে সারা বিশ্বে পরিবর্তনের যে ঢেউ লাগে আজ তা ভাবতেই অবাক হতে হয়। লেনিনের নেতৃত্বের মধ্যদিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে মুক্তির ঢেউ খেলে যায় তা আজও ইতিহাস। শুধু জার সাম্রাজ্যের পতন নয়, এমন কি আমাদের ভারতবর্ষে পর্যন্ত তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে ছিল। খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত সোভিয়েতের পরিবর্তনে বিস্মিত হয়ে ছিলেন। ‘রাশিয়ার চিঠি’র মধ্যদিয়ে তিনি তা প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালে গিয়েছিলেন রাশিয়ায়। তখন দেশটি কমিউনিস্ট শাসিত। সেখানের আর্থ-সামাজিক উন্নতি তাকে মুগ্ধ করে। ফিরে এসে তিনি লিখেছিলেন ‘রাশিয়ার চিঠি’। কেন রাশিয়ার এই উন্নতি, তার জবাবে তিনি বলেছিলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই পিছিয়ে পড়া দেশটিকে বদলে দিয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্র থেকে কৃষক ও শ্রমিকদের শিক্ষাদানের বিপুল আয়োজন কবিগুরুকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি লিখেছেন, মাত্র কয়েক বছরে যেটা রাশিয়ায় সম্ভব হয়েছে, ভারতবর্ষে দেড়শ’ বছরেও তা অর্জন করা যায়নি। এ জন্য রুশ বিপ্লবের সংগঠকদের কৃতিত্ব দিয়েছেন তিনি।
১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর রাশিয়া যে সর্বজনীন শিক্ষার পথে অগ্রসর হয়েছে, তার প্রেরণা ছিল মার্কস ও এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার। এতে স্পষ্ট ভাষায় সর্বজনীন শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আজকে সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। অনেকের ধারণা লেনিনের মৃত্যুর পর থেকে ধীরে ধীরে ঘুন পোকা ঢুকতে থাকে সোভিয়েতের মূল কাঠামোতে। প্রেস্ত্রোইকা, গ্লাসনস্ত- কত দলিল দাঁড় করানো হয়েছিল, সে হিসেব নয় আজকে না-ই দিলাম। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনে যারা খুশিতে বগল বাজিয়েছিলেন আজ তারা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছেন, সাম্রাজ্যবাদের একচ্ছত্র চৌকিদারি। ভারসাম্যহীন বিশ্ব। সবখানে মার্কিনী আগ্রাসন। তাদের তাঁবেদারদের সংখ্যাও এখন কম নয়। এক সময় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে ভেঙে ফেলতে সা¤্রাজ্যবাদ যে তালেবানদের সৃষ্টি করেছিলেন, আজকের বাস্তবতায় তা ফ্রাংকেনস্টাইনের দৈত্যের মতো দেখা দিয়েছে। মার্কিনের তৈরি জঙ্গিবাদ আজ তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের মধ্যেও লেনিন-মার্কসবাদ রাজনীতির জন্য এক অপরিহার্য উপাদান। কোনো কারণেই এর প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে না। লেনিন যে সাংগঠনিক ক্ষমতা দিয়ে সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। সেই মহামতি লেনিনের ১৪৫তম জন্মদিনে জানাই- লাল সালাম।
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের জন্ম ১৮৭০ সালে ২২শে এপ্রিল জার শাসিত রাশিয়া-র সিমবির্স্ক শহরে। তাঁর আসল নামÑভøাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ। এ নামেই সবাই তাকে চিনতো। ভল্গা নদীর তীরবর্তী সিমবির্স্ক নামক ছোট শহরটি রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ১,৫০০ মাইল দুরত্বে অবস্থিত ছিল। ভøাদিমির ইলিচের পিতা ল্যা নিকোলয়েভিচ্ উলিয়ানভ পেশায় ছিলেন একজন বিদ্যালয় পরিদর্শক এবং গণতন্ত্রবাদের কট্টর সমর্থক। তাঁর মা মারিয়া আলেক্সান্ড্রভনা উলিয়ানভা ছিলেন এক প্রথিতযশা চিকিৎসকের বিদুষী কন্যা এবং একজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা। পিতামাতা-র বিচার বিবেচনা, লেনিন এবং তাঁর ভাইবোন দের মধ্যে গভীর ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। পারিবারিক এই শিক্ষা তাঁর সাংগঠনিক কাজের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে ছিল।
১৮৮৬ সালে ভ্লাদিমির ইলিচ-এর পিতৃ বিয়োগের পর তাঁর মায়ের উপর সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব এসে পরে। ১৮৮৭ সালে লেনিন কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। তবে ছাত্রাবস্থায় শিক্ষার্থীদের বিপ্লবী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বহিস্কার করে। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে তিনি সামারা যান এবং স্থানীয় মার্ক্সবাদীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৮৯১ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন, এবং সামারাতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ চলে আসেন এবং তাঁর সাংগঠনিক কাজের দ্বারা সেখানকার মার্ক্সবাদীদের অবিসংবাদী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এখানেই ক্রুপস্কায়া-র সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ক্রুপস্কায়া শ্রমিক এবং কৃষকদের মধ্যে সাম্যবাদ এবং বিপ্লবী আদর্শের প্রচারে ব্রতী ছিলেন। ১৮৯৫ সালে লেনিন কারারুদ্ধ হন এবং ১৮৯৭ এ তাঁকে পূর্ব সাইবেরিয়ার এক নির্জন স্থানে নির্বাসিত করা হয়। কিছুদিনের মধ্যে ক্রুপস্কায়াকেও সেখানে নির্বাসিত করা হয়। পরবর্তীকালে তাঁরা বিবাহ সম্পন্ন করেন। নির্বাসনে থাকাকালীন সময়ে লেনিন ৩০টি পুস্তক রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’, যা মার্ক্সবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করে রাশিয়ার অর্থনীতি সম্বন্ধে বিচার বিশ্লেষণ করেছিল। এই সময়েই তিনি রাশিয়ার শোষিত শ্রমিক এবং সর্বহারা গোষ্ঠীকে নিয়ে একটি দল গঠনে উদ্যোগী হন।
১৯০০ সালে নির্বাসন থেকে মুক্তিলাভ করে একটি সংবাদপত্র (বিপ্লবী প্রচারপত্র) প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে লেনিন পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহর গুলিতে (মিউনিখ ১৯০০-০২, লন্ডন ১৯০২-০৩, জেনেভা ১৯০৩-০৫ ) সফর করেন। এই সময় তিনি জুলিয়াস মার্টয়-এর সাথে মিলিত হয়ে দেশের বাইরে থেকেই ‘ইস্ক্রা’ (স্ফুলিঙ্গ) নামক একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এর সাথে সাথে তিনি সর্বহারা শ্রেণী, তাদের অধিকার প্রভৃতি নিয়ে কিছু পত্র-পত্রিকা ও পুস্তক রচনা করেন। সেই সময় জার শাসিত রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া মার্ক্সবাদীরা তাঁকে সহায়তা এই কাজে করেছিলেন। রাশিয়ান স্যোশাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি গঠনের সময় ভøাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। সাইবেরিয়ার লেনা নদীর নামানুসারে তিনি নিজের নাম রাখেন লেনিন। লেনিন তাঁর বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ লিখেছিলেন ১৯১৭ সালের এপ্রিলে। সুইৎজারল্যাণ্ডের নির্বাসন থেকে ৩ তারিখে পেত্রোগ্রাদে ফিরে এসে তিনি ৭ তারিখে লিখেছিলেন মোট ১০টি টীকার একটি থিসিস। তিনি তাঁর দল অল রাশান সৌশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির গৃহীত রাজনৈতিক লাইনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এপ্রিল থিসিসে।
তার দু’মাস আগে সামন্তবাদী জারতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ফেব্রæয়ারি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর অন্তরবর্তীকালীন পুঁজিবাদী কেরনস্কি সরকার ভূ-সামন্তদের জমিদারী বাজেয়াপ্ত করা, রাষ্ট্র থেকে চার্চকে পৃথক করা, ইত্যাদি কর্মসূচি ঘোষণা করলে মার্কসবাদী বিপ্লবীরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক কর্মসম্পাদনের জন্য সে সরকারকে সমর্থন করে।
লেনিন তাঁর এপ্রিল থিসিস তাঁর দলের বলশেভিক ও মেনশেভিক দুই গ্রুপের বৈঠকেই পাঠ করে এই যুক্তি তুলে ধরেন যে, বুর্জোয়াদের প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে তাদের সমর্থন করার অর্থ হবে সর্বহারা শ্রেণীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। তাই বিপ্লবীদের কাজ হচ্ছে, শ্রমিকদের সোভিয়েত বা পঞ্চায়েতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তোলা; পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন ভেঙ্গে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর আইন শৃক্সখলা, প্রতিরক্ষা ও প্রশাসন গড়ে তোলা; এবং শিল্প-কারখানায় শ্রমিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সমস্ত জমিতে দরিদ্র কৃষকদের দখল নেয়া।
আমরা জানি, লেনিনের উপস্থাপনার ১০দিন পর স্ট্যালিন লেনিনের পক্ষে এসেছিলেন এবং একে-একে বলশিভেকদের প্রায় সবাই। পরবর্তীতে লেনিনের এপ্রিল থিসিসের ভিত্তিতেই রাশিয়াতে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিলো। তাই, সর্বহারা বিপ্লবের ইতিহাসে লেনিনের এপ্রিল থিসিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের মুক্তিকামী সব দেশের গণমানুষের লড়াই এখনো অব্যাহত। এ লড়াই চলবে মুক্তি না পাওয়া অবধি। লড়াই সংগ্রাম যতদিন থাকবে ততদিন কমরেড লেনিন থাকবেন বিশ্বের প্রতি ঘরে সংগ্রামের উজ্জ্বল প্রেরণা হয়ে।
©somewhere in net ltd.