নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেলাশেষে ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় আসলাম সামুর তীরে, রেখে যেতে চাই কিছু অবিস্মরণীয় কীর্তি । পারি না আর না পারি, চেষ্ঠার ত্রুটি রাখবো না, এই ওয়াদা করছি ।

মোশারফ হোসেন ০০৭

একজন শৌখিন লেখক আমি, আবার কবিও বলা যেতে পারে । যখন যা ভালো লাগে তাই লিখি ।

মোশারফ হোসেন ০০৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

▓▒▒▒▒ মিলান ও ছবির ভালোবাসার গল্প - যেন এক দীর্ঘ উপন্যাস ▒▒▒▒▓ (২য় পর্ব)

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:১৩

১ম পর্বের লিংকঃ মিলান ও ছবির ভালোবাসার গল্প - যেন এক দীর্ঘ উপন্যাস (১ম পর্ব)



১ম পর্বের পর থেকে -

২১.

বাইরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে । বৃষ্টির শব্দের একটা চিরাচরিত সুর আছে । অনেকক্ষণ ধরে কান পেতে শুনতে পারলেই কেবল সেটা শোনা যায় । কেমন জানি অদ্ভুত সেটা । ভালো মনটাকে খারাপ করে দেয় আবার খারাপ হওয়া মনটাকে ভালো করে দেয় । মিলান ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে । প্রায় বিশ মিনিট ধরে বৃষ্টির সেই অদ্ভুত সুর শুনছে সে । মাঝে মাঝে ব্যালকনির গ্রিলের ফাক দিয়ে হাত বের করে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ছুঁইয়ে দেবার চেষ্ঠা করে যাচ্ছে ।

অনেকেই বলে বৃষ্টির সময়টা অনেক রোমান্টিক । মিলানের কাছেও এই মুহূর্তটা অনেক রোমান্টিক মনে হচ্ছে । মনে হতেই মিলানের মনে হলো ছবিকে একটা ফোন তো দেওয়া যেতেই পারে । হাজার হলেও মিলানের রোমান্টিকতার ধারক তো এখন সেই মানুষটাই !! ভাবা মাত্রই পকেট থেকে মোবাইল বের করে ছবিকে ফোন দিলো মিলান । রিং হতে হতে একবার কেটে গেলো কিন্তু মেয়েটা ফোন ধরলোই না । মেয়েটার এরকম বদভ্যাস আছে । প্রচণ্ড কেয়ারলেস মাঝে মাঝে । মিলান কি যেন ভেবে আবার ফোন দিলো । বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর অবশেষে ফোন ধরলো ছবি ।

- আসসালামু আলাইকুম...

ছবিকে মিলান যতবারই ফোন দিয়েছে ততবারই ছবি ফোন ধরে এরকম মিষ্টি করে সালাম দিয়েছে, অবশ্য মন ভালো থাকলে । আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি । প্রথমবারে ছবির ফোন না ধরা কিংবা বেশ কয়েকদিন ধরে মেয়েটার সাথে দেখা না হওয়ার জন্য মিলানের মনে যে কষ্টটুকু ছিল, সেই কষ্টটুকু এই সালামের সাথেই গায়েব হয়ে গেলো । মিলান ফিক করে হেসে দিলো, অবশ্য খেয়াল রাখলো যাতে ফোনের অপর প্রান্তে ছবি হাসির শব্দটা শুনতে না পায় । বলা তো যায় না, ভেবেও বসতে পারে ওকে টিটকারি করা হচ্ছে ।

- ওয়ালাইকুম আসসালাম । কি খবর ? ভালো আছো ?
- সকালের দিকে প্রচণ্ড মাথাব্যাথা ছিল । এখন যদিও বেশ কমেছে, তবে ভালো আছি - এই কথাটা ঠিক বলা যায় না ।
- তা এখন কি অবস্থা ? মাথাব্যাথা আছে নাকি পুরোপুরি কমেছে ?
- না, এখনও আছে । এই ঘোড়ার ডিমের ব্যাথার কারণে কোন কিছু চিন্তা করতেও পারছি না ।
- কি চিন্তা ?
- কত কিছুর চিন্তা !! ও তুমি বুঝবে না ।

ছবির কথা শুনে মিলান এবার জোরেই হেসে দিলো । ছবি প্রথমে বুঝতে না পারলেও যখন বুঝলো তখন সেই হাসিতে মিলানের সাথে যোগ দিলো । কে যেন একবার বলেছিল হাসি প্রচণ্ড সংক্রামক । আসলেই ভুল বলেনি সে ।

২২.

অনেকক্ষণ ধরে রিং হওয়ার পরও অপরপ্রান্ত থেকে কোন সাড়া নেই । মিলান ফোনটা হাতে নিয়ে বেশ হতাশ হয়ে গেলো । হতাশা কাটানোর জন্যই কিনা সে আবারও ফোন করলো কিন্তু না, এবারও কোন সাড়া নেই । হ্যাঁ, মিলান ছবিকেই ফোন দিচ্ছে । এই ধরে ১০ম বারের মত । মেয়েটা একবারও ফোন রিসিভ করেনি । সময়ের পরাক্রমে তাদের সম্পর্ক কেমন জানি হয়ে গেছে !! ভালো লাগার সেই মেয়েটাকেই এখন বেশ অচেনা মনে হয়, মনে হয় মেয়েটার হাসি-কান্না-রাগ-দুঃখ সবকিছুই অচেনা । অথচ এমনটা তো মোটেও হওয়ার কথা ছিল না !!

মা কে বলে নিষেধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ছবি মেয়েটার মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখা গিয়েছে । আগে যেমন মিলানের সাথে দেখা না হলে যেমনটা অস্থির হতো, ফোন না পেলে কষ্ট পেতো, উল্টাপাল্টা চিন্তা করতো অথচ এখন সেই মেয়েটাকে মিলান প্রায় ২০ দিনের বেশি হয়ে গেছে দেখাই পায়নি । প্রতিদিন একই রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থেকেও না আবার ফোন করলেও সেই উদাসিন ভাব । যেন ইচ্ছা হলে ফোনটা ধরে আবার ইচ্ছা না হলে বারবার রিং বেজে একসময় মোবাইল থেমে যায় । মিলান মাঝে মাঝে খুব অধৈর্য্য হয়ে যায় । সদা হাসিখুশি ছেলেটা অনেক নীরব হয়ে যায় তখন । রুমের এক কোণে বসে নিজের কোন ভুল আছে কিনা, সেই ব্যাপারে ভাবা শুরু করে । তবে বেশিরভাগ সময়ই ধৈর্য্য ধরার চেষ্ঠা করে । সম্পর্কের দুই ধারেই যদি কাঁটাতার থাকে, তাহলে কি হয় !!

আচ্ছা, ছবি মেয়েটা কি জানে মিলান ছেলেটা এরকম কষ্ট পায়, মাঝে মাঝে অনেক কষ্টে চোখের পানি দমন করে, অনেক সময় শুন্য দৃষ্টিতে আবেগের আশ্রয় খোঁজে, প্রায় সময় বৃষ্টির দিনে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ? মিলানের মনে হয় ছবি এগুলোর কিছুই জানে না, জানতে চায়ও না । সত্যিই কি সম্পর্কগুলো এরকম কষ্টের হয়, ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয় ? এতকিছু মিলানের জানার কথা না । হাজার হলেও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই যে ।

জানালার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে ছবি । বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে । ছবির বাসার ঠিক সামনের রাস্তাটা বেশ ঢালু । একটু বৃষ্টি হলেই কাম সাড়া । গোড়ালি সমান পানি মুহূর্তের মধ্যেই হাঁটু পানিতে রূপান্তর হয়ে যায় । ছবির অবশ্য ছয়তলার উপরে থাকে । ছয়তলার বারান্দা দিয়ে নিচের মানুষগুলোর পানি মাড়িয়ে চলাচল করার দৃশ্যগুলো দেখছে ছবি । সহসা এমন দৃশ্যগুলো কোনভাবেই মজা দিতে পারে না কিন্তু ছবির কেন জানি বেশ মজা লাগছে । ইচ্ছা হচ্ছে সেই রাস্তায় যেয়ে এই গোড়ালি সমান পানিতে একটা দৌড় লাগাতে । মানুষজনের দৃষ্টি, মনোভাব, পানির কারণে জামা-কাপড়ের ভবিষ্যৎ অবস্থা এগুলোর কোনকিছুই মাথায় নেই তার ।

ভাবতে ভাবতেই একেবারে হঠাৎ করে জোরে বৃষ্টি শুরু হলো । যাকে ইংরেজিতে বলে "Cats and Dogs" অর্থাৎ মুষলধারে । বারান্দায় পানির ঝাপটা আসছে, জামা-কাপড় ভেজার আশংকায় ছবি বারান্দা থেকে রুমে চলে এলো । রুমে আসতেই বিছানায় পড়ে থাকা মোবাইলটার দিকে দৃষ্টি গেলো ছবির । হঠাৎ কি মনে হলো, মোবাইল অন করেই ১০টা মিসকল দেখতে পেলো সে । হ্যাঁ, মিলানই দিয়েছে । অন্য সময় হলে মনের মধ্যে কেমন জানি ভালো লাগা কাজ করার কথা কিন্তু এই মুহূর্তে ছবির মধ্যে কোন ভাবলেশ হলো না । মোবাইল আবার বিছানায় ফেলে দিয়ে ছবি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো । আর মনে মনে ভাবতে লাগলো, বৃষ্টির চেয়ে সুন্দর কিছু এখন আর আদৌ হতে পারে না ।

২৩.

- কার জন্য দাড়িয়ে এখানে ?

মিলান সেই রাস্তার মোড়ে এসে দাড়িয়েছে, যেখানে সে দাড়িয়ে ছবির অপেক্ষা করে । হঠাৎ করেই পিছন থেকে কে যেন প্রশ্নটা ছুড়ে বসলো । মিলান পিছন ঘুরে দেখতে পেলো তারই এক জুনিয়র পিছনে দাড়িয়ে আছে । হঠাৎ প্রশ্নটা শুনে মিলান ঘাবড়ে গেলেও, জুনিয়র ছোট ভাইকে দেখে পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে গেলো । মুখে হাসি এনেই জবাব দিলো,

- এমনিতেই, কারোর জন্য না । এমনিতেই হাঁটতে হাঁটতে এসে দাড়িয়েছি (যদিও পরিস্কার মিথ্যা কথা) । তারপর তোর কি খবর ? কোথায় যাচ্ছিলি নাকি ?
- হ্যাঁ, সামনের দিকে যাচ্ছিলাম ।
- ওহ, কোন কাজে ?
- হুম, টিউশনি আছে । তা আপনি যাবেন নাকি সামনের দিকে ?
- না, তুই যা, আমি আবার একটু ব্যাক করবো ।
- আচ্ছা ভাই, থাকেন তাইলে, আবার দেখা হবে ।
- হুম ।

জুনিয়র ছেলেটা চলে যেতেই মিলান যেন স্বস্তির নিশ্বাস নিলো । ছবির সাথে কিছুটা একান্ত সময় কাটাতে চায় সে । একটু পরই ছবি চলে এলো । ছবি কিছু বলার আগেই মিলান একটা রিকশা ডাক দিয়ে থামালো । রিকশা এসে থামতেই মিলান চড়ে বসলো, বসেই সে ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,

- ওঠো
- ওঠো মানে ? কোথায় যাবা ?
- আরে আগে ওঠোই না, দেখি কোথায় যাওয়া যায়...

মিলানের স্বভাব ছবির ভালোই জানা আছে । দেখা যায় মিলান ছবিকে পরিচিত জায়গাতেই নিয়ে যায় কিন্তু তার আগে একটু ভণিতা করবেই । তাই আর কিছু না বলে চুপচাপ ছবি রিকশা চড়ে বসলো । ছবি উঠতেই রিকশা চলা শুরু করলো । রিকশায় মিলান বকবক করেই গেলো, আর ছবি ? মিলান একবার বকবক শুরু করলে সে তো নীরব শ্রোতা ।

প্রায় আধাঘন্টা পর তারা গন্তব্যে পৌছলো । হ্যাঁ, আবার সেই নদীর পাড়ে । ছবি মনে মনে ভেবেই নিলো হয় এই জায়গাটা মিলানকে জাদু করেছে নয়তো মিলান ভালো করে আর কোন জায়গা চেনেই না । তবু সে মুখে কিছুই বললো না । কিভাবে যেন মিলান টের পেলো ছবি হয়তো গন্তব্য হিসেবে এই জায়গাটা আশা করেনি । ছবির অনুভূতি বুঝতে পেরে মিলান মুচকি একটা হাসি দিলো । অনেকদিনের জমানো পুরনো কথা বলতে গেলে তো পুরনো জায়গা ছাড়াও বিকল্প নেই, তাই না ??

২৪.

হাতে একটি ইটের টুকরা নিয়ে সামনের পানিতে ছুঁড়ে মারলো ছবি । শান্ত পানির মধ্যে সেই ইটের টুকরার কারণে একটু অশান্ত পরিবেশ তৈরি হলো । উপরের শান্ত আকাশের কোল ঘেঁষে পাখির দল উড়ে চলেছে নীড়ের পানে । ইদানিংকালে কালো মেঘমুক্ত আকাশ পাওয়াটা বেশ মুশকিল । আচমকা বৃষ্টি এসে সহসা অবাক করে দিচ্ছে প্রায়ই । না, আজকে বৃষ্টি নেই, হঠাৎ যে হতে পারে সেরকম ইঙ্গিতও নেই । মিলান বেশ খানিকক্ষণ ধরেই গুনগুন করে গান গেয়ে যাচ্ছে । ছবি প্রায় অনেকক্ষণ পরেই ইটের টুকরা আর পানি থেকে মনোযোগ সরিয়ে মিলানের দিকে মনোযোগ দিলো ।

মিলান আর ছবি বসে আছে সবুজ ঘাসের উপর । সামনেই বেশ বড় একটি পুকুর । জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, জনবসতি আশেপাশে আছে বেশ কিন্তু পাশ দিয়েই চলে যাওয়া রাস্তাটাতে কেউই নেই । ছোটখাট রাস্তা, সর্বসাকল্যে হয়তো রিকশা, সাইকেল আর বাইক চলে, গাড়ি চলে না । ভরদুপুরের এই সময়ে সেরকম কেউই নেই আশেপাশে । মিলান এই জায়গাটিতে অনেকবারই এসেছে কিন্তু ছবি আজকে প্রথমবার । নতুন জায়গার ব্যাপারে এমনিতেই সবার আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে, ছবিরও করছে । মিলানের জন্য অবশ্য এইটা মন খারাপ হয়ে গেলে ভালো করার জায়গা । আজকে ছবিকে সাথে নিয়ে এসে মনটাকে আরও ভালো করার অভিপ্রায় করছে সে ।

- কি ব্যাপার, চুপ কেন ?
- তুমি গান গাইছো, আমি শুনছি, সেই জন্যই...
- ওহ, আচ্ছা, কিছু একটা বলো...
- কি বলবো ?
- যা ইচ্ছা
- নাহ, তুমি বলো, আমি শুনি
- আমি তো বলতেই থাকি, আজকে তোমার কথা শুনবো । একেবারে শান্ত শ্রোতার মত মনোযোগ দিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনবো । যা ইচ্ছা বলো...
- উহু, না । আমি কিছুই বলবো না, তুমি বরং গান গাও । গুনগুন করে না, জোরে জোরে গাও...
- জোরে গাইবো !! তাহলেই সারছে, আশেপাশের কুকুর-বিড়াল ইত্যাদি যা কিছু আছে চিপায়-চাপায়, সব এখানে এসে ভিড় করবে । তুমি কি আসলে এটাই চাও ?

মিলানের কথা শুনে ছবি হেসে দিলো । এমনিতে প্রায় সময় গুনগুন করে গান গেতে থাকবে, এমনকি অনেকসময়ই নিজে থেকে জোরে গেয়েও শুনাবে কিন্তু একটু অনুরোধ করলেই এমনকিছুই শুনাবে মিলান । ছবি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, আর অনুরোধ করবে না মিলানকে, কিছু না বললে নিজে থেকেই শুনাবে । এভাবে বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকার পর প্রথমে মিলানই বললো,

- চলো উঠি
- চলে যাবা ?
- কেন, যেতে ইচ্ছা করছে না ?
- উহু্‌, না । জায়গাটা অনেক সুন্দর । আচ্ছা, ঠিক আছে চলো যাই, আরেকদিন আসবো নে...

ছবির আসলেই এখান থেকে বিদায় নিতে ইচ্ছে করছে না । আসলেই জায়গাটা অনেক সুন্দর, যে কারও মন ভালো করে দিতে বাধ্য । সেখান থেকে বেরিয়ে ফিরে আসার জন্য মিলান একটি রিকশা ডাকতেই ছবি বললো, সে রিকশায় না হেঁটে হেঁটে যাবে । কি আর করার অগত্যা মিলানকে ছবির এই আবদার মেনে নিতেই হলো । আসলেই আজকের বিকেলটা তাদের দুইজনের কাছেই অনেক স্মৃতির হয়ে থাকবে ।

২৫

- এই আছো

ভরদুপুরে ভাত ঘুম দেওয়ার সময়টাতে মেসেঞ্জারে ছবির নামের পাশে সবুজ চিহ্ন দেখতে পেয়ে ছবিকে নক দিলো মিলান,

- হুম, বলো
- জানো আজকে কি হয়েছে?
- কি ?
- আজকে তো সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি । একেবারে কুকুর বিড়ালের জোরসে লড়াই অবস্থায় নগরীর হাল তো কুপোকাত
- কুকুর বিড়ালের জোরসে লড়াই মানে?
- আরে ইংরেজিতে প্রবাদ আছে না? Cats & dogs অর্থাৎ মুষলধারে, সেটাকেই রূপক অর্থে মজা করে অনুবাদ করে বললাম
- আচ্ছা, বুঝলাম । তাতে কুপোকাত হলো কে? আর কিভাবে?
- কেন, তুমি জানো না নাকি? সারাদিন আজকে বাইরে বের হওনি?
- নাহ, আসলে সকাল থেকে মাথাটা এত ধরে আছে যে বিছানা থেকেই উঠতে পারছি না, ওদিকে আব্বু আম্মু গ্রামে গেছে, নিজেকেই রান্না বান্না করে খেতে হবে, তাই এখনও না খাওয়া অবস্থায় থেকে শরীর খারাপ লাগছে, তাই সবমিলিয়ে আজকে আর বের হওয়া হয়নি
- কি বলো !! এ তো সাংঘাতিক অবস্থা । আমি কি বাইরে থেকে কিছু কিনে নিয়ে আসবো ? আর ঘরে ঔষুধ আছে তো ?
- না, তোমাকে কিছু আনতে হবে না, ফ্রিজে ভাত আর ডাল আছে । কষ্ট করে ডিম ভাজি করে নিবো নে, একটু ভালো লাগলেই উঠে পড়বো । কিন্তু মনে হয় না, ঘরে কোন ঔষুধ আছে, তবু একবার আম্মুকে ফোন করে দেখি
- আচ্ছা, তাহলে তোমাকে আর বিরক্ত করবো না, তুমি রেস্ট নাও, পরে কথা বলছি আবার

এই বলে মেসেঞ্জার থেকে বেরিয়ে গেলো মিলান । ছবির এমন অসুস্থ অবস্থা আর সে কিনা বৃষ্টিস্নাত অবস্থা উপভোগ করছে । ছবির বাসা শহরের নিচু এলাকায় । সামান্য বৃষ্টি হলেই প্রায় হাঁটু সমান পানি উঠে যায় । মিলান কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো, ছবির জন্য এক প্যাকেট শুকনো পাউরুটি, এক পাতা প্যারাসিটামল আর এক ছোট ক্যাডবেরী চকলেটের প্যাকেট কিনে ছবিকে দিয়ে আসবে সে । কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে অনেকগুলো রিকশা ডেকেও ছবিদের এলাকায় যাওয়ার জন্য রাজী করাতে পারলো না সে । বাধ্য হয়েই এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি সাইকেল ম্যানেজ করলো সে । এক দোকান থেকে প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে প্যান্টটা কিছুটা হাঁটু সমান গুটিয়ে ছবির বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো মিলান ।

প্রায় ছবির বাসা পর্যন্ত পৌছাতে পৌছাতে অন্য দিনের তুলনায় বেশ সময় লেগে গেলো মিলানের । প্যান্টটা গুটানোর পরও পানি লেগে অনেকটা ভিজে গেছে প্যান্ট । ছবির বাসার কিছুটা সামনে থেকে সাইকেলে বসেই ছবিকে ফোন দিলো মিলান । ২/৩ বার কল দেওয়ার পর ছবি রিসিভ করলো,

- হ্যালো
- হ্যাঁ, ছবি, তুমি কি কিছুটা সুস্থ হইছো ?
- হ্যাঁ, আগের তুলনায় কিছুটা
- ঔষুধ পেলে?
- নাহ, বাসায় ঔষুধ নেই । আচ্ছা, তোমার চারপাশে কোলাহল মনে হচ্ছে, কোথায় তুমি ?
- তোমার বাসার সামনে
- মানে?
- হ্যাঁ, খাবার আর ঔষুধ এনেছি । হাতে হাতে যে দিবো, তুমি নিতে পারবা?
- পাগল নাকি তুমি? বাইরে এই অবস্থার মধ্যে তুমি... ? দরকার কি ছিল? আর আমার উঠার মত শক্তি এখনও হয়নি । আর তুমি খবরদ্র বাসার পাশেও এসো না কেউ দেখে ফেললে আমার ক্ষতি ।
- আচ্ছা, তোমার বাসায় আসবো না, ভয় নেই । তাহলে এগুলো কি করবো ?
- নিয়ে যাও, পরে একদিন দিও
- এবার তো তুমি পাগলের মত কথা বলছো, আচ্ছা আমি তোমার বাসার নিচের দোকানে রেখে যাচ্ছি, বলবো, এক বন্ধু এসে নিয়ে যাবে, একটু কষ্ট করে রেখে দিন
- আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি রেখেই চলে যাও, আমি নিচে নেমে এক সময় নিয়ে আসবো নে, আর তুমি জলদি করে বাসায় যেয়ে গোসল দাও গিয়ে । রাস্তার পানিতে কত ময়লা থাকে, আল্লাহ মালুম
- আচ্ছা, করবো নে, তুমি একটু কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে হাত মুখ ধোও, দেখবে ভালো লাগবে নে, আর আমি এগুলো সব রেখে যাচ্ছি

সম্পর্কে একে অপরের উপর মায়াটুকু থাকে বলেই আমরা একে অপরকে ভালবাসতে পারি। মিলান আর ছবির মধ্যেও এখন এই মায়াই কাজ করছে বেশি......

২৬

- আচ্ছা, তুমি রোজ রোজ বিকেল বেলাটাতে কোথায় হারিয়ে যাও বলো তো ?

ছবির প্রশ্নটা শুনেও যেন না শোনার ভান করলো মিলান ।

- চলো ওদিকটাতে গিয়ে বসি ।

প্রতিদিনের মত আজকেও । ছবির করা এরকম শ খানেক প্রশ্ন আজকাল মিলান উত্তর না করেই পাশ কাটিয়ে দেয় । তাদের সম্পর্কটা খুব বেশি পানসে হয়ে গেছে ইদানিং । সেই ভরদুপুরের পাগলামি, রিকশায় করে হুটহাট হারিয়ে যাওয়া কিংবা ছবির সাথে দেখা করার জন্য মিলানের অস্থিরতা - সব আবেগগুলো কেন জানি আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে ।

ছবি মিলানের সাথে আরেকটু হেঁটে গিয়ে সামনের দিকে বসে । সূর্যটা আসি আসি করছে অনেকক্ষণ যাবৎ, অর্থাৎ দিনের প্রায় সন্ধ্যা সময় হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা সময়ের সবচেয়ে বড় যে সুবিধা সেটি হচ্ছে এই সময়টা দিন ও রাতের মধ্যে একটা সন্ধি তৈরি করে । এই সন্ধিই এই সন্ধ্যা সময়টাকে বেশ রোমান্টিক করে তোলে । কিন্তু প্রায় মাস খানেক পর দেখা করতে এসে ছবির মনে হচ্ছে মিলানের মধ্যে এই রোমান্টিকতার কোন লেশবিন্দু মাত্র নেই ।

- ছবি তোমাকে অনেকদিন একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হয় না ।

মিলানের কথা শুনে বুকটা ধ্বক করে ওঠে ছবির । তবে কি সে সবকিছুর শেষ চায় ? তবু সাহস করে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে ছবি বলে

- হ্যাঁ বলো কি বলবে
- আমার ভালোবাসার মানুষ হবে ?

মানে কি !! পাগল নাকি ছেলেটা ? এতদিন তাহলে দুইজন মিলে কি সময় নষ্ট করছিল নাকি ? ছবি তো ভালোবাসার মানুষ হয়েই আছে, নতুন করে আবার কিভাবে হবে ?

- মানে ?
- সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে শুরু করি চলো । খুব কষ্টে আছি । চাইলেও কেন জানি আপন ভেবে তোমাকে বলতে পারছি না । একটা অজানা দূরত্ব তৈরি হয়েছে তোমার আমার মাঝে । একটা দেয়াল ! অদৃশ্য !! চলো ভেঙ্গে ফেলি এই দেয়াল । দুইজন দুইজনার হয়ে যাই চিরদিনের জন্য । হবে তুমি এমন কেউ আমার ?

ছবি হ্যাঁ - না কিছু বলতে যাবে ওমনি স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো মিলানের । ধুর, কি মধুর স্বপ্নটা !! কিছুক্ষণ পর অজান্তেই বিরক্তি ভাবটা কেটে গেলো মিলানের আর মুখে সূক্ষ্ম একটি হাসি ফুটে উঠলো । আগামীকাল সকালেই ছবিকে স্বপ্নের কথা বলতে হবে, ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমিয়ে গেলো মিলান...

২৭

- কোথায় তুমি?
- এই তো প্রায় চলে এসেছি, ঘড়ি দেখতে থাকো, বড়জোর আমার আর ৩/৪ মিনিট লাগবে
- সত্যি তো ? গত ১০ মিনিট আগেও কিন্তু বলেছিলে আর মাত্র ৫ মিনিট লাগবে । আর ৪ মিনিটের মধ্যে তুমি এখানে না আসলে আমি কিন্তু সত্যি চলে যাবো...

এই বলেই ফোন রেখে দিলো ছবি । মিলান উপায় না দেখে রিকশাওয়ালা মামাকে বললো, "মামা, প্লিজ, তোমার সর্বশক্তি দিয়ে প্যাডেল দাও। খোদার কসম, পুষিয়ে দিবো ।" দেরী করার অভ্যাসটা মিলানের সেই ছোটকাল থেকেই । অথচ অনেক কষ্টে অনেক দিন পর ছবিকে সে রাজি করেছিল ঘুরতে যাবার জন্য । আর তার ছোটকালের অভ্যাসটা তাকে আজ বিপদে ফেলার উপক্রম করেছে ।

অবশেষে রিকশাওয়ালা মামার একান্ত প্রচেষ্টায় ঠিক ৬ মিনিটের মাথায় মিলান পৌছালো ছবির কাছে । ২ মিনিটের জন্য হলেও দেরি । রিকশা থেকে নামতে নামতে মিলান ছবির দিকে তাকিয়ে একটি শুকনো হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলেও ছবি মুখ ঘুরিয়ে নিলো । ছবির এভাবে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়াটা মিলানের কাছে অপ্রত্যাশিতই বটে । মিলান ঠিকি ওয়াদা অনুযায়ী রিকশাওয়ালা মামাকে খুশি করতে পারলো ।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, আশেপাশের বাতাসগুলো যেন যাত্রী সকলকে কেটে দিয়ে যাচ্ছে । যাত্রা তখনই বেশি উপভোগ্য হয় যখন পাশে বসে থাকে প্রিয়জন, আর তার সাথে গল্প করতে করতে সময়টুকু কখন কেটে যায়, টেরই পাওয়া যায় না । ওদিকে মিলানের প্রিয় মানুষটার মুখ ভার । তাই এই যাত্রায় উচ্ছ্বাস আছে কিন্তু উল্লাস নেই । মিলান আর ছবি বেশ অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ । একটু পর মিলান ছবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো –

- অনেক রাগ করেছো ?
- হুম ।
- রাগ কমবে না ?
- জানি না ।

মিলান ভেবে দেখলো ছবির রাগ কমানোর এখন একটাই উপায়, মেয়েটার হাতটা ধরা । আর হাত ধরে থাকা । মিলান আর কিছু না বলে ছবির দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো, উদ্দেশ্য ছবি নিজেই তার হাতটা বাড়িয়ে মিলানের হাতের উপর দেবে । কিন্তু অনেকক্ষণ হাত রেখেও ছবি তার হাতটা মিলানের হাতের উপর দিলো না ।

আসলেই তো সে অনেক রাগ করেছে । মিলান আবার বললো, ছবি যেন তার হাতটা মিলানের হাতের উপর দেয় । এরপর হাতটা বাড়িয়ে দিতেই এবার ছবি নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো । মাত্র ৩-৪ সেকেন্ড হাতটা রেখেই আমার হাত সরিয়ে নিলো । হ্যাঁ, মেয়েটার রাগ একটু একটু করে কমা শুরু হয়েছে ।

হাসি, কান্না, রাগ, মান অভিমান এই খুনসুটিগুলো একটি সম্পর্ককে গাঁঢ় করে, মিলান এটা জানে । তাই ছবির এই মান অভিমানের বিষয়গুলো তার ভালোই লাগে......

২৮

প্রায় দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে প্রায় ধরেই ফেললো মিলান । পিছন থেকেই বললো,

- এই মেয়ে, কি ব্যাপার, তখন ধরে ডেকেই যাচ্ছি, তাকাও না কেন ?

কিন্তু সামনের মেয়েটা পিছনে ফিরতেই আমার আক্কেলগুড়ুম । এটা তো ছবি না ।

- মেয়ে মানুষ দেখলেই এসব করতে ইচ্ছা করে !! আপনাদের মত বদ ছেলেদের জন্য আমরা মেয়েরা বোরকা পড়েও রাস্তায় হাঁটা-চলা করতে পারি না
- ইয়ে মানে...
- চুপ করুন, এত লাজ লজ্জা কম আপনার ? এখনও কথা বলে যাচ্ছেন !!
- না, মানে, শুনুন একবার...
- কি শুনবো, হ্যাঁ ? কি শুনাবেন আপনি ? এখন পাবলিকের সামনে বলছি বলে লজ্জা পাচ্ছেন ? তা আমাদের লজ্জার কথা মনে থাকে না, যখন আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করেন ?
- আরে কি যন্ত্রণা !! একটু বলার সুযোগ তো দিবেন নাকি ?
- মেয়ে মানুষ দেখলেই যেন গাঁয়ে সুরসুরি ওঠে !! একটু না চুলকালে যেমন সুরসুরি যায় না, ঠিক তেমনি মেয়েদের একটু উল্টাপাল্টা কিছু না বললে, কিছু না করলে এই ধরনের সুরসুরিও যায় না, তাই না ?
- চুপ করুন, তখন ধরেই উল্টাপাল্টা বকে যাচ্ছেন

মিলানের ঝাড়িতে সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটা এবার অবাক হয়ে গেলো । এ যেন চোরের মায়ের বড় গলা, তবু মিলান কি বলে এটা শুনার জন্য মেয়েটা চুপ করে শুনতে চাইলো,

- সব ছেলেরা খারাপ হয় না । ভালো খারাপের মিশেল সব জায়গায় থাকেই । আপনি পিছন থেকে হুবহু আমার পরিচিত একটি মেয়ের মত । তাই সে মনে করে আমি আপনাকে থামিয়েছি, তাছাড়া ঐ মেয়েটির এই রাস্তায় দাঁড়ানোর কথা ছিল । হয়তো সে আসেনি বলেই এমন কনফিউশন । আপনাকে দেখলে ভদ্র ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয় । ভদ্র জ্ঞান মাশাআল্লাহ্‌ কম নেই, কাউকে দেখেই তার সম্পর্কে নিজের মত করে ধারণা করে থেকে দয়া করে বিরত থাকবেন, প্লিজ । চলি, আল্লাহ্‌ হাফেজ ।

এই কথা বলেই মিলান হাঁটা দিলো, পিছন থেকে অপরিচিত মেয়েটি তাকিয়ে আছে কিনা এটা তার জানা নেই, হয়তো তাকিয়ে আছে আবার হয়তো পিছন ঘুরে হাঁটা দিয়েছে !! এত খেয়াল করার সময় নেই তার । ছবি মেয়েটা আজকেও আসবে বলে আসেনি, যত সমস্যা ওর জন্যই তো সৃষ্টি হলো । এতক্ষণ গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, ধীরে ধীরে বৃষ্টির গতি বাড়ছে । এই বৃষ্টিতে দাড়িয়ে থেকে কারও জন্য অপেক্ষা করাটা সহজ না । এই কঠিন কাজটি করবে কি করবে না কিছুক্ষণ ভেবে পাশে থাকা একটা চায়ের দোকানে ঢুকে গেলো মিলান । গরম এক কাপ লাল চায়ের ধোঁয়া উড়ানো আবেগটুকু তার ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করবে, এমনটাই মনে হচ্ছে মিলানের...

২৯

বাইরে সন্ধ্যা হয়ে হয়ে অবস্থা । এই সময়টাতে আকাশের দিকে খুব চোখ যায় । কেন জানি, সন্ধ্যার সময় আকাশটা চুম্বক হয়ে যায় । না চাইতেও দৃষ্টি আকাশের দিকে একবার যাবেই । এটা অবশ্য রহস্যময় । সন্ধ্যার সময়টার আরও বিশেষত্ব আছে । সময়টা বেশ পবিত্র, প্রায় প্রতিটি ধর্মের মানুষই এই সময় স্রষ্টাকে নিবিড়ভাবে স্মরন করতে ব্যস্ত হয় । তাছাড়া এই সময়টাতে ঘরের মধ্যে বন্দী থাকাটা বেশ কষ্টকর । মনে হয় চুম্বক আকাশটা তার ঐ চুম্বক বলে ঘর থেকে বাইরের দিকে টানে ।

তবে এই সময়টা শহরবাসীদের জন্য অত্যন্ত বিরক্তিকর । সারাদিনের খাঁটাখাটনির পর একটু আরাম করতে গেলে একঘেয়েমিতা চলে আসে এই সময় । যতই কাজ থেকে বিরত থাকুক না কেন মানুষ, কাজ ছাড়া মানুষ ঠিকই বিরক্ত বোধ করতে থাকে । গ্রামবাসীদের জন্য অবশ্য এই সন্ধ্যার সময়টা বেশ উপভোগ্য । গ্রামের ছেলে-মেয়েরা বিকেলের খেলাধুলা করে এসে সন্ধ্যার পর ঠিকই পড়তে বসে আর গ্রামের গৃহবধূরা সারাদিন বাড়িতে একা থেকে পেটের মধ্যে জমানো সব গল্পগুলো উগড়ে দেয় বাড়ি ফিরে আসা স্বামীর কাছে । গ্রামের বুড়ো-বুড়িও কিন্তু এক্ষেত্রে কম যায় না । পানের অভ্যাস থাকা মুরুব্বিরা এই সময় পান নিয়ে বসে নয়তো বাড়ির পাশের চায়ের দোকানে ধোঁয়াটে চায়ের কাপে তাদের জম্পেশ আড্ডা জমে । তবে এই ক্ষেত্রে আড্ডায় শরীক হয় শুধুই বুড়োগুলো । গৃহবধূরা যেমন সারাদিন পর সন্ধ্যার পর স্বামীকে কাছে পায়, ঠিক তেমনি বুড়িগুলো সারা দিনের পর এই সন্ধ্যার দিকেই বুড়োগুলো থেকে একটু ছাড়া পায় ।

সন্ধ্যার সময়টা তাহলে আমার জন্য কেমন ? এক কথায় বললে বলতে হয় একাকী, একঘেয়েমি আর নিরিবিলি এলোমেলো চিন্তা মনের দ্বারপ্রান্তে ঘোরাঘুরি করার সময় । আমার দিনের সময়টাই বেশি পছন্দ । জানি, বেশিরভাগ মানুষই এটা শুনে হাসবে কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা এমনই । আমার কাছে মনে হয় দিনের বেলাতে পুরোপুরি কর্মউদ্দীপনা থাকে, শক্তি থাকে, আরও থাকে স্পৃহা । রাতের বেলা আমি সেই চিরচেনা নির্জীব ।

মিলানের কথাগুলো বেশ মনোযোগ দিয়েই শুনছিল ছবি । সন্ধ্যা বিষয়ক মিলানের এই চিন্তা-ভাবনাগুলো বেশ অদ্ভুত বটেই । এতক্ষণ চুপ থাকার পর হঠাৎ মিলানকে ছবি জিজ্ঞাসা করলো -

- হঠাৎ এত কঠিন কঠিন কথা বলছো কেন আজকে?
- কই কথাগুলো তো কঠিন না, ইদানিং খুব জীবনমুখী চিন্তা করছি
- আচ্ছা, যা বললে তার কিছুটা আমি বুঝতে পেরেছি । তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাই, সন্ধ্যার সময়টাতে তো সকলেরই স্বরূপ একই রকম । তুমি কি নিজেকে ব্যতিক্রম কিছু ভাবো ?
- বিষয়টা আসলে তা না । আমি ভেবেছিলাম আমার জীবনে আমি ইচ্ছা করলে যে কোন সময়ের স্বরূপ নির্ধারণ করতে পারবো কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে আমরা সবাই কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছি । আমাকে এই পরিবর্তনটুকুই নির্জীব বানিয়ে দিচ্ছে ।
- কিছুটা বুঝলাম । তোমার মধ্যে হঠাৎ এই কবি কবি ভাব দেখে সত্যি অবাক লাগছে । কবিতা লেখা শুরু করলে নাকি?
- তোমার তাই মনে হয় ? হা হা হা । চলো, অনেকক্ষণ তো বকবক করলাম এবার উঠি ।
- হ্যাঁ, চলো উঠি ।
- খেয়াল করেছো, যখন এখানে এসেছিলাম তখন হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন লোক ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে লোকসংখ্যা তো বেড়েই চলছে ?
- মনে হয় সন্ধ্যা হয়েছে তাই...

ছবি এই কথা বলা মাত্রই মিলান আর ছবি একসাথে হেসে উঠলো...

৩০

- হ্যালো
- হ্যাঁ, বলো
- কি করো ?
- রেডি হচ্ছি
- রেডি হচ্ছ মানে !! কিসের জন্য রেডি হচ্ছ ?
- বাইরে যাবো
- বাইরের যাওয়ার জন্যই রেডি হতে হয়, সে তো আমিও জানি, ঘড়িতে যে ইতিমধ্যেই সাড়ে আটটা বাজে খেয়াল আছে? বাইরে কেন যাবা এত রাতে ?
- মামার শরীরটা খুব খারাপ, দেখতে যাবো
- ওহ আচ্ছা, খুব বেশি খারাপ ?
- সেটা তো না দেখে বলতে পারবো না
- ওহ অ্যান্টি কিংবা আংকেল সাথে যাচ্ছে ?
- আব্বু - আম্মু আগেই চলে গেছে, আমি টিউশনিতে গিয়েছিলাম । আমাকে যাওয়ার সময় জানায়নি । এখন বাড়ি এসে শুনলাম । ফোন দিতেই আব্বু - আম্মু যেতে মানা করলো কিন্তু আমাকে যেতেই হবে
- তাহলে বান্ধবী কাউকে নিয়ে যাও
- না, একা যাচ্ছি
- কি বলো !! পাগল নাকি ? এই রাতে একা একটা মেয়ে হয়ে......
- তো কি করবো, কাউকেই তো যাওয়ার মত পাচ্ছি না অথচ আমাকে যেতেই হবে
- আচ্ছা, কোথায় তুমি এখন ?
- দিলারা মোড়
- দিলারা মোড় থেকে কোন দিক মামাবাড়ি ?
- সরপুঁটি খামার বাড়ি

মিলান মনে মনে এক চোট ভেবে নিলো । মিলান যেখানে আছে এখন সেটা পল্টি রোড । পল্টি রোড থেকে দিলারা মোড় হেঁটে গেলে বিশ মিনিটের মত লাগবে, অটো রিকশায় লাগবে দশ মিনিট । সরপুঁটি খামার বাড়ি যেতে হলে অবশ্যই পল্টি রোড ছুঁয়েই যেতে হবে । এখান থেকে সরপুঁটি খামার বাড়ি ঘণ্টা খানেকের পথ । ছবিকে কিছুতেই একা ছাড়বে না মিলান । কেউ সাথে না গেলে মিলান যাবে, ছবি না করলেও শুনবো না ।

- হ্যালো আমি পল্টি রোডের মাথায় দাঁড়াচ্ছি, তুমি কি অটো রিকশায় উঠছো ?
- হ্যাঁ, আমি দিলারা মোড় ছাড়ালাম মাত্র । আচ্ছা তুমি পল্টি রোডের মাথায় দাঁড়াও । আমার মোবাইলে কিন্তু টাকা নেই । তাড়াহুড়ার মধ্যে টাকা ভরার সময় পাইনি ।
- আচ্ছা , সমস্যা নেই । আমি দাড়িয়ে আছি । আসো

প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট দাড়িয়ে থেকে মেয়েটার খোঁজ না পেয়ে হঠাৎ ফোন দিতেই সে জানালো সে পল্টি রোড ছাড়িয়ে মাহেন্দ্রো স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়েছে । মিলানকে যেতে না করে দিলো, পরিচিত কে যেন দেখে ফেলেছে । মিলান এর ব্যাপারটা ছবির কাছে এখনও গোপনীয় খুব । তাই মিলানকে দেখলে ঝামেলা হতে পারে, হয়তো বাড়িতে ফোন দিয়ে জানাতে পারে । মিলান আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিলো, তার এত কিছু শুনার ইচ্ছা নেই । মেয়েটাকে কিছুতেই একা ছাড়বে না সে ।

ফোন রেখেই দৌড় লাগালো মিলান, প্রায় এক দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মাহেন্দ্রো স্ট্যান্ড পৌছালো সে । মাহেন্দ্রো একজনের জন্য আটকে আছে, নয়তো ছেড়ে দিতো । মিলান আর সাত-পাঁচ কিছু না ভেবে উঠে পড়লো । ছবি মিলানকে খেয়াল করেছে, অবাক হয়েছে প্রচুর কিন্তু মিলান বা ছবি কেউই একজন আরেকজনের সাথে কথা বললো না । মাহেন্দ্রো ছেড়ে দিলো মিলান উঠার পরপরই ।

তীব্র বাতাসে তার এলোমেলো চুলগুলা উড়তো, যদি সেই অবাধ্য চুলগুলো আবৃত না থাকতো । নীরব যাত্রার শেষ হয়ে গেলো দ্রুতই । ছবি মেয়েটিও কেমন অদ্ভুত । নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে মাহেন্দ্রোর ভাড়া মিটিয়েই গায়েব হয়ে গেলো চোখের পলকে । মিলান তখনই আর নামতে পারলো না মাহেন্দ্রো থেকে । হয়তো মাহেন্দ্রো থেকে তৎক্ষণাৎ নেমে গেলে মেয়েটির সমস্যা হতো । ছবি মেয়েটি নেমে যেতেই বাকী যাত্রী সহ মাহেন্দ্রো আবারও ছেড়ে দিলো । আরও কিলোমিটার চারেক যাবে এটি । মিলান হাসছে, ভাবছে জীবনে তো কত জার্নি বাই বাস কিংবা জার্নি বাই ট্রেন রচনা লিখলাম । এ যাত্রায় জার্নি বাই মাহেন্দ্রো লিখলে মন্দ হয় না । হাহাহাহা

(চলবে)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:১৫

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: "প্রেমের মরা জলে ডুবেনা"

- মিলান প্রেমের গলা জলে ডুবে আছে তা বুঝা যাচেছ তবে ছবি কি মিলানকে নিয়ে খেলছে না আসলেই ভালবাসে তা বুঝা যাচেছনা।

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৪২

মোশারফ হোসেন ০০৭ বলেছেন: আরেকটি বিষয় হতে পারে, লেখাটা মিলানের দৃষ্টি থেকে লেখা, যেখানে ছবি পাশাপাশি একটি সাপোর্টিং চরিত্র

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য :|

২| ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:১৩

ফয়সাল রকি বলেছেন: এতোদিন পরে দ্বিতীয় পর্ব!!! B:-)

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৪৩

মোশারফ হোসেন ০০৭ বলেছেন: এক্ষেত্রে সত্যিই আমি অপরাধী, জীবনের নানানমুখী ব্যস্ততায় এই দুইটি চরিত্রের প্রেম কাহিনীর দিকে খেয়াল করার সময় বের করতে পারিনি ।

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য :|

৩| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৫২

রাজীব নুর বলেছেন: অনেক বড় লেখা। পড়ছি তো পড়ছি। শেষ আর হয় না।
মিলান আমার ভাগ্নির নাম।

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৪৬

মোশারফ হোসেন ০০৭ বলেছেন: মজার ব্যাপার কি জানেন, প্রায় ৪ বছর আগে যখন এই লেখার ১ম পর্ব দিয়েছিলাম, সেই লেখার কমেন্টবক্সেও আপনার একইরকম একটি কমেন্ট আছে । সেখানে ২০ খণ্ড দিয়েছিলাম, নিজেও পরে বুঝেছিলাম বড় হয়ে গেছে, তাই ২য় পর্বে ১০ খণ্ড দিয়েছি । তাও যদি বড় হয়, তাহলে দুঃখিত আর কিছু করতে পারছি না

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য :|

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.