নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গোলাকার এক বৃত্তে পতিত মানব

মীর রবি

কবি ও সম্পাদক

মীর রবি › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও শিল্পী\' জীবন একটি পাঠ পর্যালোচনা

২৩ শে জুন, ২০১৭ দুপুর ১:১৭


বরেণ্য ভাষাবিদ ও গবেষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলেন-‘পল্লির ঘাটে মাঠে, পল্লির আলোবাতাসে, পল্লির প্রত্যেক পরতে পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে।’ আর লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক ড. দীনেশচন্দ্র সেন ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন- সাহিত্যের এক অমূল্য খনি পল্লিগাঁয়েই লুকিয়ে আছে। গ্রামাঞ্চলের এই অমূল্য সৃষ্টি সম্ভারের মাঝে একটি হচ্ছে লোকসংগীত বা লোকগীতি। পল্লির সাহিত্য-সংস্কৃতির অনকেটা জুড়েই এই লোকসংগীতের বাস। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে বিভিন্ন রকম লোকসংগীতের দেখা মেলে। এর মাঝে উত্তরাঞ্চলের, বিশেষত রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া এখন সারাদেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও বেশ সমাদরের সহিত জায়গা করে নিয়েছে। ফরিদুর রেজা সাগর পরিচালিত ‘উত্তরের সুর’ সিনেমায় লন্ডনের ক'জন গবেষক কর্তৃক ভাওয়াইয়া গান ও তার সুর সংগ্রহ করার কথা উল্লেখ পাই। তা ভাওয়াইয়ার কদরকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। ভাওয়াইয়া গবেষক, গীতিকার ও কবি সুশান্ত কুমার রায় তাঁর ‘লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও শিল্পী জীবন’ গবেষণা গ্রন্থে ভাওয়াইয়া ও ভাওয়াইয়া শিল্পীদের উপর বিস্তর আলোচনা করেছেন।

ভাওয়াইয়ার পরিচয়ে তিনি ‘ভাওয়াইয়া, গরু-গরুর গাড়ি ও বাঙালি সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন- ‘বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়া। লোকসংগীতের অমীয় সাগরে প্রাণবন্ত একটি ধারা ভাওয়াইয়া যা আজও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং ভারতের কোচবিহার, আসাম, জলপাইগুড়ি জেলার বৃহৎ এক জনগোষ্ঠীর অন্তরের গান। ভাব শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রেম-প্রীতি, প্রণয়-প্রকৃতি, ভক্তি, আবেগ, স্বভাব, ধরণ, মর্ম, চিন্তা প্রভৃতি। ভাব শব্দের সম্পৃক্ততা অর্থে ইয়া প্রত্যয় যুক্ত করে ভাব+ইয়া > ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি। অর্থাৎ ভাবের যে গান তা ভাওয়াইয়া। ’ ‘ভাওয়াইয়ার ভাষা ও সুরের কাঠামোয় উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিকতার (উপভাষা) প্রধান্য বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। রংপুর-দিনাজপুর, কোচবিহারের উপভাষার শব্দভান্ডার (Vocabulary) শব্দতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, উচ্চারণরীতির সঙ্গে এর কথার ও সুরের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক ।’ (লোকসংগীত ভাওয়াইয়ার আদি নিদর্শন / ভাওয়াইয়ার উপাদান অনুষঙ্গ ও লোকজ সংস্কৃতি) এই ভাবের গানের সঙ্গে গ্রামের মানুষের যে ভাব বা প্রেম, তা আজ শহুরে মানুষের মাঝে ভালবাসার জায়গা করে নিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, ভারতের কোচবিহার, জলপাইগুড়ির ভাওয়াইয়া আজ পরিবেশিত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া-নিউইয়র্ক-লন্ডনে।’ আজকের এই ভাওয়াইয়া দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন সারাবিশ্বে । এর পিছে আমাদের ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমদ্ এর অবদানকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেছেন- ‘লোকসংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মত লোকগীতিও আদিম ও প্রাচীন সমাজের ক্রমাগ্রাসর ধারা বা সারভাইবাল।’ ভাওয়াইয়া অনেক প্রাচীন এক লোকসংগীত।

লোকগীতি বা লোকসংগীত যাই বলি না কেন, প্রাচ্যের ভাষাতত্ত্ববিদ জর্জ আব্রাহাম গ্রীয়ারসনের মতে বাংলা ভাষার সাহিত্য-সংগীতের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ এর আগেও ভাওয়াইয়ার প্রচলন ছিল বলে প্রবন্ধকার তাঁর বইয়ে প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। চর্যাপদের আগে ভাওয়াইয়ার প্রচলন ছিল কিনা- এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও ভাওয়াইয়া যে সুপ্রাচীন লোকসংগীত তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন- ‘বাংলাদেশের অজস্র লোকগীতির মধ্যে চিরন্তনী স্বদেশের যে চিত্র পাই তা প্রীতি প্রেম ও করুণার রসে রঞ্জিত।’ এ ধারা থেকে তিনি লোকসংগীতকে সাতভাগে ভাগ করেছেন- (১) আঞ্চলিক গীতি (রিজিওনাল সং) যা অঞ্চল বিশেষ প্রচলিত। (২) ব্যবহারিক (ফাংশনাল সং) বিবাহ, উৎসব, অনুষ্ঠান, পালা, পার্বণ উপলক্ষে যা গীত হয়। (৩) হাসির গান (হিউমারাস সং) -হাসির বিষয়বস্তু নিয়ে যা রচিত। (৪) কর্ম সংগীত, শ্রম সংগীত (ওয়ার্ক সং) যা নানা কাজকর্ম, ছাদ পিটানো, ফসল বপন বা তোলা ইত্যাদি উপলক্ষে গীত হয়। (৫) প্রেমসংগীত (লাভ সং) নারী ও পুরুষের প্রেম ভালবাসা ও বিরহ সম্পর্কীয়। (৬) বারমাসী- যা অপেক্ষাকৃত লম্বা এবং নারীর বারো মাসের বিরহ র্বণনা যাতে গীত হয় এবং (৭) বিভিন্ন মরমীয় গীতি (স্পিরিচুয়াল সং) যাতে মানব মনের আকুতি ভক্তের আকুতি উৎসারিত হয় উদাস করা ও নিবেদিত ভাষার মাধ্যমে।’ সুশান্ত কুমার রায় তাঁর গ্রন্থে উৎপত্তিগত অর্থে ভাওয়াইয়াকে ভাবের (প্রেম, বিরহ) গান বলেছেন। কিন্তু তার গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধ পাঠে অনুধাবন করা যায় ভাওয়াইয়া শুধু ড. আশরাফ সিদ্দিকীর শ্রেণিবিন্যাসের লাভ সং বা রিজিওনাল সং-এ সীমাবদ্ধ থাকেনি। সুশান্ত কুমারের ‘ভাওয়াইয়া-গরু-গরুর গাড়ি ও বাঙালি সংস্কৃতি, লোক সংগীত ভাওয়াইয়ার আদি নির্দশন, ভাওয়াইয়ার উপাদান অনুষঙ্গ ও লোকজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী লোক সংগীত ভাওয়াইয়া ও লোকজ সংস্কৃতি, ভাওয়াইয়ার ঐতিহ্য ও নিসর্গতার নান্দনিকতা, রঙ্গপুরের ভাওয়াইয়া ও লোকজ সংস্কৃতি, লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও বাঙালির আত্মপরিচয়, সংগীত ও আমাদের সমাজ পরিমন্ডল’ এর প্রতিটি প্রবন্ধ পর্যালোচনা করে বলা যায়- ভাওয়াইয়া শুধু রিজিওনাল বা লাভ সং নয়। বিভিন্ন আলোচনায় লখেক পরোক্ষ প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়েছেন- লোকসংগীত ভাওয়াইয়া একাধারে রিজিওনাল, ওয়ার্ক, লাভ, ফাংশন্যল, হিউমারাস, অল-টাইমাল ও স্পিরিচুয়াল সং। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না- ভাওয়াইয়া গানে- ‘শ্রমজীবি মানুষের জীবন-জীবিকা, সমাজ, পরিবেশ, প্রকৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, উৎসব-পর্ব, আচার-আচরণ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, লাঞ্চনা, শ্রেণি-বৈষম্য ইত্যাদি বাঙময় হয়ে ফুটে উঠেছে শিল্পীর শৈল্পীক গুণে ভাওয়াইয়ার কথা ও সুরের মুর্ছনায়।’ (ঐতিহ্যবাহী লোক সংগীত ভাওয়াইয়া ও লোকজ সংস্কৃতি) লেখকের রেশ ধরেই আমরা বলতে পারি- সমাজের মানুষের দৈনন্দিন আচার-আচরণ, কাজ-কর্ম, পোষাক-পরিচ্ছদ, প্রচলিত লোক-কাহিনী, ধর্মীয় উৎসব, অনুষ্ঠার, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারনা, আবেগ-অনুভূতি, প্রেম-প্রকৃতি সব কিছুই সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ (ভাওয়াইয়ার ঐতিহ্য ও নিসর্গতার নান্দনিকতা) এই অবিচ্ছেদ্য অংশগুলো কোনোভাবেই ভাওয়াইয়া থেকে বাদ পড়েনি।

‘লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও শিল্পী জীবন’ গবেষণা গ্রন্থে সুশান্ত কুমার রায় একটি অধ্যায়ে ভাওয়াইয়া গান ও অপর অধ্যায়ে ভাওয়াইয়া শিল্পীদের জীবন কর্ম তুলে ধরেছেন। যে সব সুর ও শব্দ এবং কণ্ঠ শ্রমিকরা ঐতিহ্যবাহী এই সংগীতকে কণ্ঠে তুলে ধরে ভাওয়াইয়াকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন, তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ক'জনের জীবন ও কর্মের কথা ঠাঁই পেয়েছে তার গবেষণা গ্রন্থে। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমদ্, গীতিকার-সুরকার ও শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায়, ভাওয়াইয়া গবেষক-সংগ্রাহক-সংগীত ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা জামান আব্বাসী, শিল্পী ফেরদৌসী রহমান, ভাওয়াইয়া যুবরাজ কছিম উদ্দিন, সিরাজ উদ্দিন, নুরুল ইসলাম জাহিদ, ভাওয়াইয়া গীতিকার ও শিল্পী রবীন্দ্রনাথ মিশ্র, দোতরার জাদুকর দোতরা বাদক নমর উদ্দিন, নন্দিত শিল্পী বেগম সুরাইয়া বেলী, লোকসংগীত শিল্পী সুভাষ চন্দ্র রায়, শিল্পী- অনন্ত কুমার দেব, ভূপতি ভূষণ বর্মা, নির্মল কুমার দে, বিশ্বনাথ মোহন্ত, রণজিৎ কুমার রায়, কে.এম. শাহানুর রহমান, শিল্পী ভবতরণ এবং বিষাদ চন্দ্র বর্মনের ভাওয়াইয়া কেন্দ্রিক জীবন ও কর্মের কথা গ্রন্থটিতে সাবলীল ভাষায় উঠে এসেছে । সুশান্ত কুমার রায় এর- ‘লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও শিল্পী জীবন’ গবেষণা গ্রন্থটি ভাওয়াইয়ার গবেষণার কাজে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ভাওয়াইয়া শিল্পীর দুর্লভ কিছু ছবি সংযোজন বইটিকে আরো আকর্ষণীয় ও সমৃদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে ।
....................................

লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও শিল্পী জীবন- সুশান্ত কুমার রায়
প্রকাশক : সরোজ দেব, শব্দ প্রকাশনা
প্রচ্ছদ : কিংশুক ভট্টাচার্য, মূল্য : ২৫০ টাকা




মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.