নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
তিন
বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে যাবার সময় ওরা তিনজন প্রায় কেউ কারো শরীর দেখতে পায় না, এমন জমাট অন্ধকার! ইট বিছানো রাস্তার দু-পাশের কয়েক একর জমি জুড়ে বাঁশঝাড়, দু-পাশের ঝাড়ের বাঁশ রাস্তার দিকে ঝুঁকে দো-চালা ঘরের মতো করে রেখেছে। এখানে দিনের বেলাতেই সূর্যের মুখ দেখা যায় না, রাতের বেলা চাঁদ চুইয়ে জ্যোৎস্না ঢোকার সাধ্য কী! বহুকাল আগে থেকেই নাকি এই বাঁশঝাড়ে ভূতের বসবাস, এই পথ দিয়ে যাবার সময় বহু লোক ভূতের ভয় পেয়েছে, ভূত অথবা ভূতের গোলাকার আলো দেখেছে; বহু মানুষকে ভূতে গায়েবও করেছে! ভয় পেয়ে কেউ কেউ এখানেই নাকি জ্ঞান হারিয়ে মারা গেছে, কারো লাশ খুঁজে পাওয়া যায় নি, কেউবা এখান থেকে কোনোক্রমে বেঁচে সজ্ঞানে বাড়ি ফিরে যেতে পারলেও পরে তার শরীর নাকি ক্রমশ পাটকাঠির মতো শুকিয়ে গেছে আর ভয়জনিত জ্বর কিংবা রোগে ভুগে মারা গেছে! সবই শোনা কথা, অতীতের গল্প আজও বয়স্ক মানুষের মুখে মুখে ফেরে, তারাও হয়ত শুনেছিল বয়স্ক দাদু-ঠাকুরমাদের মুখে, এভাবেই গল্পগুলো টিকে আছে বংশ পরম্পরায়। ওদের তিনজনের অবশ্য কোনো ভয় নেই, আদ্যনাথ বালা ওদের শরীর বন্ধ করে দিয়েছে, কোনো ভূত-প্রেতের বাপেরও নাকি সাধ্য নেই যে ওদের ওপর চড়াও হয় কিংবা ওদের শরীরে নখের স্পর্শও করে! চৈত্র মাসের শিবপূজাকে ওরা বলে দেইল পুজো, কেউ কেউ বলে চত্তির পুজো, এই পূজার ব্রতগুরু এবং বালা আদ্যনাথ সরকার, তার পারিবারিক পদবী ‘সরকার’ কাগজে-কলমে থাকলেও লোকমুখে তিনি আদ্যনাথ বালা নামেই পরিচিত। এখন অবশ্য তার শারীরিক শক্তি আগের মতো নেই, চালানের সময় পাঁচটা-ছয়টা শ্লোক বলেই হাঁফিয়ে ওঠেন; তবে তিনি যোগ্য বালা হিসেবে গড়ে তুলেছেন তার শিষ্য শিবু এবং গোবিন্দকে বছরের পর বছর তালিম দিয়ে, মূলত ওরা দুজনই এখন শ্লোক বলে চালান জমিয়ে রাখে, তবে পিছনে থেকে এখনো সমস্ত কিছু পরিচালনা করেন আদ্যনাথ। পঁচাত্তর বছরের আদ্যনাথের শিবপূজার প্রায় চল্লিশ বছরের গুরুগিরি এবং বালাগিরির জীবনে আজ পর্যন্ত তার কোনো শিষ্য’র গায়ে নখের আঁচড়টিও দিতে পারে নি কোনো ভূত-প্রেত। চেষ্টা নাকি করেছে অনেকবার, তবে পারে নি, তার শক্তিশালী মন্ত্র আর খিস্তির কাছে হার মেনেছে! আগে চৈত্রমাস শুরু হলেই নাকি প্রেতাত্মারা আদ্যনাথের আশপাশে ঘুরঘুর করত, তার কোনো কোনো শিষ্য’র জীবন চাইত তারা, কিন্তু আদ্যনাথ দেন নি, শিষ্য অন্তপ্রাণ গুরু তিনি! একবার নাকি প্রেতাত্মারা একেবারে নাছোরবান্দার মতো তার আশপাশে ঘুর ঘুর করছিল কোনো একজন শিষ্য’র জীবন নেবার জন্য, কিছুতেই তারা আদ্যনাথকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না, প্রাণ একটা নিয়ে তবেই তারা যাবে, শেষে গভীর রাতে আদ্যনাথ একেবারে উলঙ্গ হয়ে কোমরের সুতোটিও ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ক্ষ্যাপা ষাঁড় যেমনি শিং দিয়ে মাটি খোঁড়ে, তেমনি দুইহাতে উঠোনের মাটি খুঁড়ে মন্ত্র পড়তে পড়তে আর প্রেতাত্মাদের চৌদ্দগুষ্ঠির নামে খিস্তি করতে করতে মাটি ছুড়েছিলেন শিবপূজার মণ্ডপ বা দেইলঘরের চারদিকে আর অন্ধকারে গাছপালার ভেতরে! তার মুখ নিশ্রিত মন্ত্র, খিস্তি আর হাতের নিক্ষিপ্ত মন্ত্রপুত মহা শক্তিশালী মাটির প্রভাবে টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নাকি প্রেতাত্মারা পালিয়েছিল! প্রেতাত্মারা পালানোর পর আদ্যনাথ অজ্ঞান হয়ে ছিলেন কয়েক ঘণ্টা, অনবরত মাথায় জল ঢেলে, জাঁতি দিয়ে দু-পাটি দাঁত ছাড়িয়ে তাকে সুস্থ করা হয়েছিল! সে-ও প্রায় বিশ বছর আগের কথা, সেই ঘটনার পর থেকেই নাকি প্রেতাত্মারা ভয়ে আদ্যনাথকে আর ঘাঁটায় না, তারা বুঝে গেছে যে আদ্যনাথের শক্তির কাছে তারা অপারগ! শিবপূজার বালাগিরি ছাড়াও আদ্যনাথ ওঝাগিরি করেন, কাউকে ভূতে ধরলে ঝাড়ফুক করে তার ঘাড় থেকে ভূত নামান, কারো ঘাড়ে কালী কিংবা শনি অথবা অন্য কোনো দেবতা ভড় করলে সেই দেবতার পূজার আয়োজন করে এবং তন্ত্র-মন্ত্রের গুণে উক্ত ব্যক্তির ঘাড় থেকে দেবতাকে পুনরায় স্বর্গে পাঠান, আবার কাউকে সাপে কামড়ালেও ঝাড়ফুক করে রোগীর শরীর থেকে বিষ নামান!
এলাকার সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে যে আদ্যনাথ বালার অলৌকিক ক্ষমতা আছে! প্রতি শনি এবং মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে নানাবিধ সমস্যা নিয়ে হিন্দু-মুসলমান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেক ভক্ত আসে আদ্যনাথের বাড়িতে। কেবল জিন-ভূতে ধরা কিংবা ঘাড়ে কালী-শনি ভড় করা মানুষ আসে তা নয়; কারো পেটের ব্যথা, কারো মাথা ব্যথা, কারো আলসার কিংবা অজানা কোনো রোগে ভুগে কারো শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে, কারো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না ইত্যাদি সংকট নিয়েও ভক্তরা আসে। এমনকি কোনো রোগীকে হয়ত ফরিদপুর কিংবা ঢাকার হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করানো হচ্ছে, রোগীর হয়ত অপারেশন হবে কী হচ্ছে, এদিকে তার বাড়ির লোকেরা আদ্যনাথের মন্দিরে গিয়ে রোগীর নামে মানসা করে আসে। আদ্যনাথ তার বাড়ির শিব মন্দিরে বসে মানুষের এইসব সমস্যার কথা শোনেন, ঝাড়-ফুঁক করেন, বাবা ভোলানাথের কাছে মানসা করতে বলেন। অনেকে পাঁঠা, মোরগ, ভোগ, নগদ অর্থ ইত্যাদি মানসা করে। বাবা ভোলানাথের কৃপায় হোক, কিংবা আদ্যনাথের ঝাড়-ফুঁকের গুণে হোক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসায় হোক অথবা আপনা-আপনিই হোক, মানুষের সমস্যার সমাধান হলে তারা আদ্যনাথের মন্দিরে এসে মানসা দিয়ে যায়। এই মানসার উপাদান এবং অর্থেই চলে আদ্যনাথের সংসার।
শহরে থেকে লেখাপড়া করা আজকালকার কোনো কোনো ছেলে-মেয়ে আদ্যনাথ বালার এইসব অলৌকিক ক্ষমতার কথা বিশ্বাস করে না; বিশেষ করে অমলদের পাড়ার সমরেশের ছেলে অয়ন, বছর চব্বিশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক, গ্রামে বিশেষ আসে না, কিন্তু যখন আসে তখন মানুষের মুখে আদ্যনাথের এইসব অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘ওসব আদ্যনাথ বালার ভড়ং, রুটি-রুজির ধান্ধা, আদতে ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেবতা বলেও কিছু নেই, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেবতা বা ভূত-প্রেত মানুষের মনোজাত ব্যাপার। যাদের ঘাড়ে কালী-শনি বা ভূত-প্রেত ভড় করে বলা হয়, তারা আসলে মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত, তাদেরকে ওঝা দিয়ে ঝাড়ফুঁক না করিয়ে, সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়ে সঠিক চিকিৎসা করানো উচিত।’
এমনকি এককালে বাঁশঝাড়ের পথে ভূত দেখা কিংবা ভূতের আলো দেখা অথবা ভূতের মানুষ গায়েব করার যে গল্প আজও এলাকার প্রবীণ মানুষদের মুখে মুখে ফেরে, তাও বিশ্বাস করে না অয়ন! সে ব্যাখ্যা দেয় যে ওসব ছিল ডাকাত কিংবা ঠগীদের কাজ, আগের দিনে বাংলা-বিহার অঞ্চলে অনেক ডাকাত কিংবা ঠগী ছিল, তারা দিনে বা রাতে বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত আর পথিক দেখলেই বেরিয়ে এসে পথিকদের হত্যা করে সর্বস্ব লুঠ করত। আগের দিনে নিশ্চয় ডাকাত কিংবা ঠগীরা রাতেরবেলা এই বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে থাকত, রাস্তা দিয়ে যাতায়াতরত পথচারীদের অস্তিত্ব টের পেলেই তারা বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে এসে পথচারীদের খুন করে তাদের জিনিসপত্র লুট করত, তারপর বাঁশঝাড়ে কিংবা কাছের কোনো জঙ্গলে পথচারীদের লাশ পুঁতে ফেলত কিংবা চন্দনা নদীতে ভাসিয়ে দিত, আর লোকে ভাবত ভূতে মানুষ মেরে ফেলেছে বা গায়েব করে ফেলেছে! হয়ত ডাকাতরা রাতের বেলা কখনো কখনো বাঁশঝাড়ের ভেতরে আলো জ্বালত, কোনো কোনো পথচারী সেই আলো দেখে দৌড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে লোকালয়ে গিয়ে প্রচার করত যে সে ভূতের আলো দেখেছে!
পুরোনো কালের ভূত কিংবা ভূতের আলো বিষয়ক কথিত অলৌকিক গল্পের এমন লৌকিক ব্যাখ্যাই দেয় অয়ন, দু-একজন তার কথা বিশ্বাস করলেও অধিকাংশ-ই করে না, তারা অতীতের অলৌকিক গল্পেই আস্থা রাখে। যারা আস্থা রাখে তারা আদ্যনাথের আরো কৃতিত্ব জাহির করতে বলে, ‘আদ্যনাথ বালা যে সাপে কাটা রুগী বাঁচায় তা তো মিথ্যে না, চোহির সামনে দ্যাহা, জাঁদরেল গুক্ষু সাপে কামড়াইচে, সেই রুগীও ঝাড়ফুঁক করে বাঁচাইচে উনি!’
তখন অয়ন আবার আদ্যনাথ বালার সাপের বিষ নামানোর অলৌকিক ক্ষমতার লৌকিক ব্যাখ্যা দেয় এভাবে- ‘বাংলাদেশে আনুমানিক চুরানব্বই প্রজাতির সাপ আছে, এর মধ্যে ছাব্বিশ প্রজাতির সাপ বিষধর, বাকি আটষট্টি প্রজাতির সাপের বিষ নেই, নির্বিষ এই আটষট্টি প্রজাতির সাপ কামড়ালেও মানুষ মরে না, যদি না ভয়ে কারো হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যু হয়। বিষধর ছাব্বিশ প্রজাতি সাপের মধ্যে বারো প্রজাতি আবার সামুদ্রিক সাপ, সেগুলো কখনোই জনপদে আসে না। বাকি থাকলো চৌদ্দ প্রজাতির বিষধর সাপ, এদের মধ্যে তিন-চারটি সাপ দুর্লভ, এরা গভীর জঙ্গলে থাকে। মাত্র দশ-এগারো প্রজাতির বিষধর সাপের কাপড়ে সমতলের মানুষ মরে, আর আমাদের এই জনপদে দশ-এগারো প্রজাতির বিষধর সাপও হয়ত নেই, বড়জোর ছয়-সাত প্রজাতির থাকতে পারে, বেশি চোখে পড়ে গোখরো। গোখরো বা অন্য বিষধর সাপ কখনো কখনো শুকনো কামড় দেয়, এক্ষেত্রে বিষ প্রয়োগ করে না; এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে কিংবা নির্বিষ সাপে কামড়ালে ডাক্তারি চিকিৎসা ছাড়াও রোগী বেঁচে যায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ষাট হাজার মানুষ সাপের কামড় খায়, এর মধ্যে মারা যায় মাত্র ছয় হাজার মানুষ। বেঁচে যাওয়া চুয়ান্ন হাজার মানুষের বেশিরভাগকেই নির্বিষ সাপে কামড়ায়, আর কিছু সংখ্যক মানুষকে বিষধর সাপ শুকনো কামড় দেয়; কিন্তু এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে আদ্যনাথ বালা বা তার মতো ওঝারা ঝাড়ফুঁক করে রোগীকে বাঁচানোর কৃতিত্ব নেন আর লোকেও বিশ্বাস করে যে ওঝারা সাপে কাটা রোগী বাঁচাতে পারেন! আর যখন বিষধর সাপের বিষযুক্ত কামড় দেওয়া রোগীকে ঝাড়ফুঁক করে বাঁচাতে পারেন না তখন ওঝারা বলেন যে কু-মন্ত্র জানা কোনো দুষ্টুলোক ধাওয়া দিয়ে বিষ রোগীর মাথায় তুলে দিয়েছে, তাই রোগীকে বাঁচানো যায়নি! প্রকৃতপক্ষে বিষধর সাপ যদি কাউকে কামড়ায় আর বিষ প্রয়োগ করে, তখন সেই রোগীকে বাঁচাতে পারে শুধুমাত্র এন্টিভেনম ইনজেকশন, ১৮৯৫ সালে যা আবিষ্কার করেন ফরাসি চিকিৎসক আলবার্ট কেলমেট। সুতরাং সাপে কাটা রোগীকে বাঁচাতে হলে আদ্যনাথ বালা বা অন্য কোনো ওঝার কাছে নয়, দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।’
শুধু ভূত-প্রেত কিংবা ঝাড়ফুঁক নয়; এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অথবা মানুষ, জীবজন্তু এবং উদ্ভিদ সৃষ্টির এমন সব ব্যাখ্যা অয়ন দেয় যা শুনে আদিম ধর্মগ্রন্থ থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে জানা গ্রামের কারো কারো চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায় বিস্ময়ে আর গালে হাত দিয়ে ভাবে হতচ্ছাড়াটা বলে কী, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নাকি আদি পিতা ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন নি, কী সৃষ্টিছাড়া কথা! এতকাল ধরে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে অথবা ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা পণ্ডিত মানুষের মুখ থেকে বংশ পরম্পরায় তারা জেনে এসেছেন যে ব্রহ্মা প্রথমে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন এবং তারপর সৃষ্টি করেন মানুষ।
অথচ অয়ন বলে, ‘এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কোনো ব্রহ্মা কিংবা কোনো ঈশ্বর সৃষ্টি করেন নি, মহাবিস্ফোরণের ফলে আজ থেকে ১ হাজার ৩৭৫ কোটি বছর পূর্বে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়। আর আমাদের এই পৃথিবীর জন্ম হয় সূর্য থেকে, মাত্র ৪৫০ কোটি বছর পূর্বে। প্রথমে পৃথিবী জলন্ত গ্যাসের পুঞ্জ ছিল, তারপর বহু বছর ধরে তপ্ত পৃথিবীর অঙ্গের উপরিভাগ জুড়োয় আর প্রচণ্ড ভূমিকম্পে বারবার ওলট-পালট হয় পৃথিবীর বুক, পৃথিবী আরো শীতল হবার পর ঘন মেঘের মতো বাষ্পপুঞ্জ বৃষ্টিধারা হয়ে নেমে আসে ভূমিতে, অসমতল-রুক্ষ পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয় হ্রদ-নদী-সাগর।’
আর মানুষ, জীবজন্তু, উদ্ভিদের সৃষ্টি সম্পর্কে অয়ন যখন ডারউইনের বিবর্তনবাদের কথা বলে তখন তা শুনে কেউ কেউ হেসে গড়িয়ে পড়ে!
অয়ন বলে, ‘বহু বহু বছর ধরে পৃথিবীর বুকের অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, আয়রন, আয়োডিন, কার্বন, ক্লোরিন, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গেনিস, বোরোন ইত্যাদি অনেক রকম মৌলিক উপাদান মিলে তৈরি হয় প্রোটোপ্লাজম; সেই প্রোটোপ্লাজমের বিন্দু বা জীবকোষগুলিই আজকের পশু-পাখি, গাছপালা, পোকামাকড় এবং মানুষের পূর্বপুরুষ; জীবকোষগুলি একত্রিত হয়ে প্রথমে জন্ম হয় জলচর প্রাণির, তারপর অনাবৃষ্টির সঙ্গে জুঝতে জুঝতে জন্ম হয় উভচর প্রাণির, এরপর জন্ম হয় স্থলচর প্রাণির; অতঃপর কোটি কোটি বছর ধরে নানা ধরনের প্রাণির মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হতে হতে জন্ম নিয়েছে আজকের এই বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিক মানুষ।’
অয়নের এইসব কথা শুনে বয়োজ্যেষ্ঠ কোনো পবন কি বৃন্দাবন অণ্ডকোষের খুঁজলি নয়ত পেটের দাউদ চুলকাতে চুলকাতে বলেন, ‘দুই পাতা ল্যাহাপড়া শিহে জবর আমার চ্যাটের বালের শিক্ষিত অইচে! মানুষ আর ইঁন্দুর নাকি একই জিনিসে সৃষ্টি, চামচিকাও তাই! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! থুঃ... ওসব বালের বিজ্ঞান! ইঁন্দুর আর মানুষ নাকি জন্মসূত্রে আত্মীয়, হা হা হা!’ অথবা বয়স্ক কোনো শৈলবালা কি মণিমালা পাঠকাঠি ভেঙে উদোম পিঠ চুলকাতে চুলকাতে বলেন, ‘ল্যাহাপড়া শিহে জবর আমার শাইয়োর শিক্ষিত অইচে! জম্মে সারে বাপ-ঠাহুরদার কালের তে আমরা যা শুনে আসতেছি, তা অবিশ্বেস করে!’
আড়ালে গ্রামের কোনো কোনো শিক্ষিতজন অয়নকে উদ্দেশ্য করে উপহাস করে বলে, ‘ইঁদূরের দুসম্পর্কের ভাই!’
অনেকেই তাদের সন্তানকে অয়নের থেকে দূরে থাকতে বলে এই ভয়ে যে অয়নের দ্বারা যদি তাদের সন্তানের মনেও এইসব অবিশ্বাসের বীজ রোপিত হয়! তারা মনে করে যে লেখাপড়া শিখে সমরেশের ছেলেটি মানুষ না হয়ে হয়েছে কুলাঙ্গার!
পরিমল, অমল আর বিলাস বাঁশঝাড়ের নিচের অন্ধকারময় পথে হাঁটতে থাকে। উত্তরদিকে বাঁশঝাড় যেখানে শেষ, তার পরেই নতুন একটা বাড়ি হয়েছে; টিনের চালা আর বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া, মাটির ডোয়া। বাড়িতে তিনটি মাত্র প্রাণির বাস- ইয়াসিন, ওর মা আর যুবতী স্ত্রী। এদের ভূতের ভয় নেই নাকি, বুদ্ধি থাকলে ভূতের মুখের সামনে এমন জায়গায় কেউ বাড়ি করে! এদের দুঃসাহস আর বুদ্ধিহীনতার কথা বলাবলি করে এপথ দিয়ে যারা যাতায়াত করে তারা।
রাস্তার সাথে ইয়াসিনদের শোবার ঘর, ঘর থেকে কেউ একজন বের হয় হারিকেনের স্থান দখল করা বৈদ্যুতিক চার্জার লাইট হাতে নিয়ে, বারান্দা থেকে উঠোনে নামতেই বাঁশঝাড়ের অন্ধকার পথে চলা ওরা তিনজন বুঝতে পারে চার্জার লাইট হাতে নিয়ে যে বেরিয়েছে সে ইয়াসিনের যুবতী স্ত্রী, সাদা আলোর ঈষৎ আভা খেলা করছে তার মুখে। বাঁশঝাড়ের অন্ধকারের প্রান্তসীমায় ওরা তিনজন দাঁড়ায়, ইয়াসিনের স্ত্রী ছোট্ট উঠোন অতিক্রম করে রান্নাঘরের বারান্দার উত্তর কোনে চার্জার লাইটটা রেখে ঘরের পাশেই পরনের কাপড় কোমরে তুলে বসে পড়ে। বিলাস মুখে হাত চাপা দিয়ে হিস হিস করে নিচু স্বরে হাসে, অমল ওর গায়ে চিমটি কাটে। চার্জার লাইটের সাদা আলোর আভা ইয়াসিনের স্ত্রীর নগ্ন নিতম্বে ঢেউ খেলে। গতিশীল প্রসাবের ধারা স্যাঁতসেঁতে মাটির মধ্যে ফেনিয়ে উঠে ঝিঁঝির ডাকের মতো শব্দ করায় নির্জন রাতে খানিকটা দূর থেকেও শুনতে পায় ওরা। ওরা এখন সন্ন্যাসব্রত পালন করছে, তবু কেন যেন মনের ঘোড়ায় সংযমের লাগাম পরাতে পারে না, ইয়াসিনের স্ত্রীর দিকে তাকিয়েই থাকে, একটুও লজ্জাবোধ করে না, কেউ কাউকে ওদিকে তাকাতে নিষেধও করে না। ওরা সন্ন্যাসী, দিনভর উপোস থাকে, স্ত্রী-সঙ্গম থেকে বিরত আছে বিগত কিছুদিন, কিন্তু ইয়াসিনের স্ত্রীর নগ্ন নিতম্ব ওদের যৌন লালসায় কিছুটা যেন উস্কানি দেয়! কামলিপ্সু মোরগের ঘাড়ের মতো ফুলে ওঠে পরিমলের নেতিয়ে থাকা লিঙ্গ, অমল আর বিলাসের লিঙ্গও সাপুড়ের কাঠের বাক্সের মধ্যে থাকা গোখরোর মাথার মতো নড়েচড়ে ওঠে কাছা মারা ধুতির মধ্যে! হঠাৎ বাঁশঝাড়ে শালিকের ঝাঁক কিচির-মিচির করে ডেকে ওঠে।
প্রাকৃতিক কার্য শেষ হলে ইয়াসিনের স্ত্রী পুনরায় রান্নাঘরের বারান্দা থেকে চার্জার লাইটটা হাতে নিয়ে এক চিলতে উঠোন পেরিয়ে শোবার ঘরের বারান্দায় ওঠে, অল্পক্ষণ পরই দরজা বন্ধ করার শব্দ হয়। ওরা তিনজন আবার পা বাড়ায়। ঘর অতিক্রম করে যাবার সময় ইয়াসিনের মায়ের কণ্ঠ ওদের কানে আসে, ঘরের উত্তর দিকের অন্ধকার কামরা থেকে ইয়াসিনের মা বলে, ‘ও বউমা....।’
পাশের কামরা থেকে ইয়াসিনের স্ত্রী সাড়া দেয়, ‘কী?’
‘ইয়াসিন আইচে?’
‘না।’
‘ছাওয়ালডা এত রাত অব্দি কী করে! এই যে পই পই করে কই দিন-সহালে বাড়ি ফিরিস, শোনে না।’
‘আজ হাটের দিন, মনে অয় দূরি কোনোখানে খ্যাপ মারবার গেছে, আপনি ঘুমান।’
আর কোনো কথা শোনা যায় না, দক্ষিণের কামরার আলো নিভে যায়।ওরা তিনজন আবার কিছু পথ দৌড়ে অতিক্রম করে। একটা পাড়ার কাছে এসে অমল বলে, ‘এই পরি থাম, এহন আর দৌড়নে যাবিনে, পা’র শব্দ শুনলি কেউ আবার চোর বলে চিক্কের দিবার পারে!’
দৌড় থামিয়ে তিনজনই আবার হাঁটতে শুরু করে। গাছপালা বেষ্টিত অন্ধকারাচ্ছন্ন গৃহস্থবাড়িগুলোর কোথাও কোনো আলো দেখা যায় না, মানুষের কোনো সাড়াশব্দ নেই, কেবল আনাচে-কানাচে চিকার চিঁ চিঁ আর ঝোপে-ঝাড়ে ঝিঁঝির ডাক। একটা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ওদের কানে ভেসে আসে হঠাৎ গেয়ে ওঠা গানের সুর-
‘ও কী ও... কলঙ্কিনী রাধা
কদম ডালে বসিয়া আছে কানু হারামজাদা
মাই তুই জলে না যাইও।
মাই তুই জলে না যাইও....’
(চলবে.....)
২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:৫৪
মিশু মিলন বলেছেন: অনেকেই আঞ্চলিক শব্দকে অশুদ্ধ বলে গণ্য করে, যা দুঃখজনক। ধন্যবাদ।
২| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:৫০
নেওয়াজ আলি বলেছেন: এক রাশ মুগ্ধতা ।
২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৮
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
৩| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:২৩
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: ঝরঝরে লেখনি!
টেনে নিয়ে গেল... আগ্রহটা জিইয়ে রেখে
+++
২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৪
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:৩৩
রাজীব নুর বলেছেন: আঞ্চলিক শব্দ গুলো আমাকে পীড়া দেয়। কারন আমি ঢাকায় থাকি।