নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
বারো
কোদাল কোপাতে কোপাতে হাঁফিয়ে ওঠে বিলাস, ঘামে ভিজে যায় ওর মাথার চুল-সারা শরীর, মাথার ঘাম কপাল বেয়ে নেমে আসে নাকের ডগায় আর ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ে মাটিতে। অমল শোয়া থেকে উঠে বসলেও পরিমল শুয়েই থাকে চোখ বুজে। হঠাৎ বাজারের দিক থেকে ওদের কানে ভেসে আসে হাজরা সরকারের গানের সুর-
‘আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে।।’
বিলাসের হাতের কোদাল থেমে যায়, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাম হাত কোমরে আর ডান হাত কোদালের হাতলে রেখে তাকায় বাজারের দিকে, চোখের পলক পড়ে না সহজে; অমলও ঘাড় ঘুরিয়ে বাজারের দিকে তাকায় নির্নিমিখ চোখে, আর মাটিতে শয়ান পরিমলের নিমীলিত চোখের পাতা খুলে যায়। বাজারের পাহাড়াদার পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন বছর বয়সী হাজরা সরকারের কণ্ঠ বেশ ভরাট আর শ্রুতিমধুর। তিনি একসময় পেশাদার যাত্রাশিল্পী ছিলেন, অনেক যাত্রাপালায় কখনো নায়ক কখনো পার্শ্ব-নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তখন নিয়মিত গানের চর্চা করতেন। বহু বছর আগে থেকেই শীতকালে জামালপুর বাজারে যাত্রা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো; যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ থেকে খ্যাতনামা সব যাত্রাদল বায়না করে আনা হতো; একটানা দশ-পনের রাত্রি পর্যন্ত চলত যাত্রাপালা। হাজরা সরকারের বাড়ি চন্দনা নদীর পশ্চিমপাড়ের জগনাদ্দী গ্রামে, ছেলেবেলা থেকেই বাবা-মা-জেঠিমাদের সঙ্গে যাত্রাপালা দেখতে আসতেন, আর ক্লাস এইট-নাইনে উঠে তো রীতিমতো যাত্রাপালার প্রেমে পড়ে যান। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি উঠে ভাঙা জানালা দিয়ে বেরিয়ে কখনো একা কখনো দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার পথ পায়ে হেঁটে যাত্রাপালা দেখতে আসতেন জামালপুর বাজারে, আবার ভোররাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে থাকতেই চুপিচুপি গিয়ে ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়তেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে, মেসে থেকে পড়তেন, তখন ফরিদপুর শহরে যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হলে একটা পালাও দেখা বাদ দিতেন না। কখনো কখনো শহরের বাইরের কোনো গ্রামে, এমনকি এগারো কিলোমিটার দূরে কানাইপুর কিংবা ত্রিশ কিলোমিলার দূরে মধুখালিতেও যাত্রা দেখতে যেতেন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর মেসের জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন, তারপর কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান। কিছুদিন পর বাড়িতে চিঠি লিখে জানান যে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, তিনি ভালো আছেন, যাত্রাদলে নাম লিখিয়েছেন, যাত্রাপালায় অভিনয় করতে চান। কোথায় কোনো যাত্রাদলে নাম লিখিয়েছেন, সে-সব কিছুই জানান নি চিঠিতে; কেননা তিনি জানতেন যে জানালে তার বাবা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবেন এবং সকলের সামনে তাকে পিটিয়ে যাত্রার ভূত মাথা থেকে তাড়িয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন।
বাড়ি ছাড়ার প্রায় বছর দুয়েক পর জামালপুর বাজারে তাদের দল পালা করতে আসে, এই দুই বছরে তিনি আর বাড়িমুখো হন নি বাবার হাতে প্রহারের ভয়ে, চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছিলেন। পরিচিত লোকজন যাত্রামঞ্চে হাজরা সরকারকে পার্শ্ব-নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখে বিস্ময় বনে যায়! আরে, হাজরা না? তাই তো! কী সুন্দর দেখতে হয়েছে হাজরা, কী বাহারি বাবরি চুল, ভরাট কণ্ঠে কী দারুণ সংলাপ বলার ধরণ, আর কী সাবলীল অভিনয়!
যৌবনে হাজরা সরকার সত্যিই খুব সুদর্শন ছিলেন, পাঁচ ফুট দশ-এগারো ইঞ্চি উচ্চতা, লালচে ফর্সা গায়ের রঙ, কিছুটা বাদামী রঙের ভাসা ভাসা চোখ, মাথা ভর্তি বাদামী আভাযুক্ত মসৃণ কালো চুল সামান্য বাতাসেই নেচে উঠত, আর অবসরে ফুটবল খেলার অভ্যাসের কারণে মেদহীন সুন্দর শারীরিক গড়ন ছিল তার। সরকার পরিবারের সকল পুরুষের শারীরিক গড়ন প্রায় একই রকম- সুঠাম এবং লম্বা, আশপাশের সাধারণ আর পাঁচটা বাঙালী পরিবারের চেয়ে তাদের শরীরের গড়ন এবং চেহারার ধাঁচ কিছুটা আলাদা। হাজরা সরকারের দাদুর বাবার নাম ছিল সাহেব সরকার, তখন ইংরেজদের শাসন চলছিল, গায়ের রঙ ইংরেজদের মতো ধবধবে ফর্সা ছিল বলেই হয়ত তার নাম রাখা হয়েছিল সাহেব সরকার। অতীতে যখন চন্দনা আরো প্রশস্ত এবং স্রোতস্বিনী ছিল, তখন চন্দনার বুকের ওপর দিয়ে যাত্রীবাহী নৌকা ছাড়াও অনেক বাণিজ্য নৌকা চলাচল করত। মধ্যযুগে ভারতবর্ষের নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী আরো অনেক অঞ্চলের মতোই পর্তুগীজ জলদস্যুদের উৎপাত ছিল এই অঞ্চলে- তারা বণিকদের বাণিজ্য নৌকা লুট করত, স্থানীয় নারী-পুরুষদের ধরে নিয়ে হাতের তালু ছিদ্র করে সরু বেত ঢুকিয়ে হালি গেঁথে জাহাজের পাটাতনের নিচে বন্দী করে রাখত, তারপর বন্দীদেরকে ওলন্দাজ এবং ফরাসী বণিকদের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত; আবার কখনো কখনো নারীদেরকে বাড়ি থেকে তুলে নিজেদের নৌকায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পর অতি ব্যবহৃত জীর্ণ জিনিসের মতো ফেলে দিত, কখনো নদী তীরবর্তী কোনো বাড়িতে ঢুকে নারীদেরকে জোরপূর্বক দলবদ্ধ ধর্ষণ করে চলে যেত। বাংলায় বার্মার মগ জলদস্যুদের উৎপাতও ছিল। স্থানীয় রাজারা তাদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী দিয়ে পর্তুগীজ এবং মগ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য থামানোর যথেষ্ট চেষ্টা করতেন। তারপরও বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে পর্তুগীজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেশি ছিল যে ওদেরকে শায়েস্তা করার জন্য কখনো কখনো কাউকে নেতৃত্ব দিয়ে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা হতো দিল্লী থেকে। সম্রাট শাহজাহান বাংলার হুগলী থেকে পর্তুগীজ জলদস্যুদের দমন করার জন্য বিশাল সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন কাশিম খানকে, কাশিম খানের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে পর্তুগীজ জলদস্যুরা হুগলী ছেড়ে পূর্ববঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলে চলে এসেছিল। এ অঞ্চলের মানুষ আগে থেকেই অতিষ্ট ছিল পর্তুগীজ এবং মগ জলদস্যুদের অত্যাচারে, হুগলী থেকে বিতাড়িত হয়ে পর্তুগীজ জলদস্যুরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবন আরো অতিষ্ট করে তুলেছিল। পরবর্তীতে সম্রাট আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে বাংলার সুবাদার করে পাঠিয়ে তাকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেন পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের দমন করার, তিনি শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গড়ে তোলেন এবং অনেকটা সফলও হন। মীর জুমলার পর বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন শায়েস্তা খান, তাকেও একই নির্দেশ দেওয়া হয়। সুবাদার শায়েস্তা খান পদ্মা ও যমুনার সঙ্গমস্থলের নাওয়ারা মহলের দায়িত্ব দিয়ে পাঠান রাজপুত সেনা সংগ্রাম শাহকে, সংগ্রাম শাহ বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণে বানিবহ নামক স্থানে স্থায়ীভাবে বাস করলেও জামালপুর অঞ্চল ছিল তারই অধীনে, তিনিও পর্তুগীজ এবং মগ জলদস্যু দমনে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন, তার শাসনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ‘মথুরাপুরের দেউল’ কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। পরবর্তীতে এই অঞ্চল ভূষণার রাজা সীতারাম রায়ের অধীনে আসে, তিনিও পর্তুগীজ এবং মগ জলদস্যু দমনে ভীষণ কঠোর ছিলেন, বিভিন্ন নদীর চরে এবং তীরে তিনি সেনা-ছাউনী গড়ে তুলেছিলেন, সেনারা জলপথ পাহাড়ায় থাকত আর পর্তুগীজ এবং মগ জলদস্যু দেখতে পেলেই তাদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো। এত সতর্কতামুলক ব্যবস্থার পরও পর্তুগীজ এবং মগ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য থেমে থাকত না, সেনার চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের লুটতরাজ চলত, কখনো কখনো সেনার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। পরবর্তীতে বিট্রিশ রাজত্বের সময়ে ব্রিটিশরাও যাতায়াত করত চন্দনার বুকের ওপর দিয়ে, কর্মসূত্রে বসবাসও করত এই অঞ্চলে। সঙ্গত কারণেই কোনো কোনো বাঙালি রক্ত প্রবাহের সঙ্গে মিশে যায় পর্তুগীজ, মগ এবং ইংরেজ রক্ত প্রবাহ; ভূমিকন্যা কালো বাঙালী মায়ের পেটে জন্ম নেয়, ভূমিষ্ঠ হয়, আর আদরে-স্নেহে-যত্নে বেড়ে ওঠে গৌরবর্ণের অনেক সাহেব সরকার।
পরদিন লোকমুখে হাজরা সরকারের যাত্রাপালায় অভিনয় করার খবর শুনে তার বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যরা ছুটে আসে দেখা করার জন্য, মা আর ভাই-বোনেরা তাকে জাড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়, বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করে জলভরা চোখে চুপচাপ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এরপর যে ক’রাত্রি পালা হয়েছিল তার বাবা-মা আর ভাই-বোনেরা সবগুলো পালা-ই দেখেছিল। পরবর্তীকালে আরও অনেকবার জামালপুর বাজারে অভিনয় করতে এসেছেন হাজরা সরকার।
যাত্রাদলে ঢোকার পর হাজরা সরকারের লেখাপড়া আর এগোয় নি, কোনো চাকরির চেষ্টাও করেন নি, যাত্রাদলে অভিনয়ই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, যাত্রা-মৌসুমে শহর থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্তে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের বাজারে কিংবা মেলায় মেলায় ছুটে ছুটে যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। শুরুর দিকে বেতন কম হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই অভিনয়গুণে অধিকারীদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন, দল বদলে গোপালগঞ্জ থেকে আরো বেশি বেতনে চুক্তিবদ্ধ হন বাগেরহাটের একটি দলে। তখন যাত্রাশিল্পের অবস্থা এখনকার মতো এমন মুমূর্ষু ছিল না, জমজমাট ছিল যাত্রাশিল্প। কী গ্রাম আর কী শহর, সবখানেই একটা সাংস্কৃতিক আবহ ছিল; যাত্রা, পালাগান এসব ছিল লোকশিক্ষার মাধ্যম। দেশজুড়ে নানা ধরনের মেলা হতো, মেলা উপলক্ষে যাত্রা-সার্কাস-পুতুলনাচের দল বায়না করে আনা হতো। মেলার বাইরেও শুধুমাত্র যাত্রা-উৎসবের আয়োজন করা হতো, ফলে যাত্রাশিল্পীদের ভালো রোজগার হতো তখন, শুধুমাত্র যাত্রায় অভিনয় করেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ স্বচ্ছলভাবে জীবনযাপন করতে পারতেন শিল্পীরা। যাত্রা মৌসুমে হাজরা সরকার বাড়িতে যাবারও সময় পেতেন না। একসময় হাজরা সরকার বিয়ে করেন, তিন মেয়ের বাবা হন। গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা এবং যশোরের বিভিন্ন যাত্রা দলে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তিনি অভিনয় করেছেন। যখন যে শহরের দলে চুক্তিবদ্ধ হতেন, তখন সেই শহরেই বাসা ভাড়া করে পরিবার নিয়ে থাকতেন, যাত্রা-মৌসুম শেষ হলে পরিবার নিয়ে মাঝে মাঝে বাড়িতে বেড়াতে আসতেন।
সময়ের আবর্তে যাত্রাশিল্প নানামুখী সংকটের মুখোমুখি হয়, অতিরিক্ত দর্শক টানার লোভে কোনো কোনো নায়েকপার্টি দর্শককে যাত্রাভিনয় দেখানোর চেয়ে নাচ দেখানোর প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে, দর্শককে নাচ দেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে মাইকে এবং দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে প্রচারণা চালানো শুরু হয়, কোথাও কোথাও শালীনতার মাত্রা ছাড়ানো নাচ-গানের প্রচলন হয়, আর স্বল্প জনপ্রিয় তৃতীয় সারির যাত্রাদলের অধিকারীরাও বায়নার লোভে নায়েক পার্টির চাহিদা পূরণ করতে চড়া দাম দিয়ে দলে তুখোর নৃত্যশিল্পী অন্তর্ভুক্ত করতে আরম্ভ করে। ফলে একটা সময়ে যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে যাত্রাপালা দেখত, তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। অন্যদিকে আগে থেকেই যে মুসলমান মৌলবাদী গোষ্ঠী যাত্রাশিল্প তথা বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্য নানা ধরনের অপপ্রচার-অপচেষ্টা চালাচ্ছিল, তারা আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। দেশের রাজধানী থেকে আরম্ভ করে একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে বিষফোঁড়ার মতো গড়ে ওঠা মাদ্রাসা থেকে পাস করা শিল্প-সংস্কৃতি-সভ্যতা বিদ্বেষী ধর্মান্ধ আলেম-ওলামারা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে। জুম্মার নামাজের দিন মসজিদের ইমাম খুতবার বয়ানে, মাওলানারা ওয়াজ মাহফিলের বয়ানে, এমনকি তারা হাটে-বাজারে এবং মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবহমানকালের বাংলার সংস্কৃতি- মেলা, যাত্রা, পুতুলনাচ, নাচ-গান প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিষোদগার করে পরকালে দোজখের ভয় আর জান্নাতের লোভ দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে থাকে। জামায়াতী এবং মৌলবাদী নারীরা তালিমের মাধ্যমে সাধারণ ধর্মভীরু নারীদেরকে বোঝায় যে মেলা, যাত্রা, নাচ-গান হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি; এসব ইসলামে হারাম, এসব করলে দোজখে যেতে হবে। ধর্মভীরু মানুষ মৌলবাদীদের এসব প্রচারণা বিশ্বাস করে বাঙালির আবহমানকালের তথা তাদের পিতৃপুরুষের নান্দনিক শিল্প-সংস্কৃতিকে হারাম এবং শিরক জ্ঞান করে দূরে সরে যেতে থাকে।
যাত্রাশিল্প বন্ধ করার জন্য এইসব ইসলামী মৌলবাদী মাওলানারা সরকার এবং প্রশাসনকে হুঁশিহারি দিতে থাকে। তাছাড়া ইসলামী সশস্ত্র জঙ্গিরাও যাত্রা অনুষ্ঠানে হামলা চালানোর হুমকি দিতে থাকে, কোথাও কোথাও হামলা চালায়ও। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার গঠন করার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে যাত্রা নিষিদ্ধ করে। পরবর্তী সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও সেই নিষেধাজ্ঞার কালো ছায়া আর কাটে না, কিছু কিছু জায়গায় যাত্রা অনুষ্ঠিত হলেও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বিরাজ করে বিভিন্ন জায়গায়। সরকার কিংবা প্রশাসন ইসলামী মৌলবাদীদের চটাতে চায় না, এরই মধ্যে মৌলবাদের আলখাল্লায় ঢুকে পড়া বিভ্রান্ত মানুষদের ভোট হারাতে চায় না, বিপুল সংখ্যক মৌলবাদী-ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেয়ে স্বল্প সংখ্যক সংস্কৃতিকর্মীদের কার্যক্রম বন্ধ বা সীমিত রাখাই সহজ এবং ভোটের মাঠে তা যথেষ্ঠ লাভজনক, ফলে নিরাপত্তার অজুহাতে সরকারের গোপন নির্দেশে কিংবা নীরবতায় প্রশাসন একের পর এক যাত্রা অনুষ্ঠানের আবেদন বাতিল করতে থাকে। আর এর প্রভাব পড়তে থাকে যাত্রাদল এবং শিল্পীদের ওপর, দলগুলির বায়না কমতে থাকে, দলের রোজগার এবং শিল্পীদের মজুরি কমতে থাকে। ক্রমশ মালিকদের পক্ষে দল চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে, কম শিল্পী অন্তর্ভূক্ত করে জোড়া-তালি দিয়ে দল চালাতে থাকেন তারা, অনেক দল ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে বন্ধও হয়ে যায়। শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়েন, জীবিকার জন্য ভিন্ন পেশা খুঁজতে থাকেন, যারা একসময় যাত্রাশিল্পকে ভালোবেসে এই পথে এসেছিলেন, তারা অভিনয়-গান-বাদ্যযন্ত্র বাজানো ব্যতিত অন্য কোনো কাজে তেমন দক্ষ নন, অনেকের লেখাপড়া জানা থাকলেও বয়সের কারণে এবং দক্ষতার অভাবে সম্মানজনক যাত্রাশিল্পীর পেশা ছেড়ে তারা সামান্য বেতনে খুবই সাধারণ কাজে যোগ দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। সেই অনেকের মধ্যেই একজন হাজরা সরকার, এখন আর তার যাত্রাপালায় অভিনয়-জীবনের সেই সুদিন নেই, যাত্রাশিল্পীর সম্মান নেই। একটা সময় ছিল যখন তিনি যাত্রাপালায় অভিনয়ের জন্য জামালপুর বাজারে আসতেন কিংবা অভিনয় ছাড়াও যখন বাড়িতে বেড়াতে এসে বাজারে আসতেন, তখন মানুষ তাকে ঘিরে ধরত। বাজারের অনেক ব্যবসায়ী তাকে খাতির করত, তার মুখ থেকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর নানা ধরনের অভিজ্ঞতার গল্প শুনত, চা-নাস্তা খাওয়াত। শিল্পী জীবনের কী নির্মম পরিহাস, আজ সেই সব ব্যবসায়ীরা দূরে থাক, তাদের দোকানের সামান্য বেতনভুক্ত কর্মচারীরাও এখন হাজরা সরকারকে পাত্তা দেয় না! এখন হাজরা সরকারের মাথায় বাদামী আভাযুক্ত কালো বাবরি চুলের পরিবর্তে কাঁচা-পাকা কদমছাট চুল, শ্মশ্রুমুণ্ডিত চকচকে ফর্সা ভরাট গালের পরিবর্তে তামাটে চুপসানো গাল, তার সেই সুস্বাস্থ্য এখন পুরোনো জমিদার বাড়ির বিলীয়মান ইটের ভাঙা দেয়ালের মতোই জীর্ণ! কত রাত শরীরে রাজকীয় পোশাক পরে রাজপুত্রের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন, অথচ আজ সেই হাজরা সরকারের গায়ে নেভি-ব্লু রঙের ঘামের-ময়লার গন্ধময় পাহাড়াদারের ইউনিফর্ম! একদিন যাকে চা-নাস্তা করিয়ে অনেকে নিজেকে ধন্য মনে করত, আজ তাকেই একটা সস্তা সিগারেট চেয়ে খেতে হয় শিবু মিস্ত্রীর কাছ থেকে! হাজরা সরকারের সব গেছে, বিলুপ্ত জমিদারীর ধ্বংসপ্রায় প্রাচীন প্রাসাদের শিখরের স্যাঁতাপড়া সিংহের মতো এখনো আছে তার কণ্ঠের সুর-
‘হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে
আমি দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে;
কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।।’
হাজরা সরকারের কণ্ঠের গান ক্ষণিকের জন্য যেন স্তব্ধ করে দেয় অমল, পরিমল আর বিলাসকে; ওরা কথা খুঁজে পায় না! অন্ধকারে নিজেদের অবয়বের দিকে তাকায়, পুনরায় তাকায় বাজারের দিকে, যে-দিক থেকে গানের সুর ভেসে আসে। ওরা অবশ্য তিন রাস্তার মোড়ের দোকানের আড়ালে থাকায় হাজরা সরকারকে দেখতে পায় না। গান শুনে ওদের তিনজনের প্রায় একই ধরনের অনুভূতি হয়, একই স্মৃতি চাগাড় দিয়ে ওঠে, হাজরা সরকারের মুখ নিশ্রিত প্রতিটি শব্দ যেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওদের ব্যথা জাগিয়ে তোলে-
‘লাগি সেই হৃদয় শশী, সদা প্রাণ হয় উদাসী,
পেলে মন হতো খুশি, দিবা-নিশি দেখিতাম নয়ন ভরে
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে, নিভাই কেমন করে-
মরি হায় হায়, হায় রে-
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
(ওরে) দেখনা তোরা হৃদয় চিরে
কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।।’
হাজরা সরকারের গান থেমে যায়; কিন্তু ওদের হৃদয়ে অবিরাম বেজে চলে গানের সুর, সে সুর হাজরা সরকারের নয়, ওদের হৃদয় তোলপাড় করা কিশোরী- আশালতার। ওদের কৈশোরে এক ফাল্গুনের শেষ বিকেলে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গগন হরকরার এই গানটি গেয়েছিল আশালতা আর দর্শকের আসনে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল ওরা তিনজন, শুনতে শুনতে কৈশোরের অথৈ আবেগে ভেসে গিয়েছিল। আজ এতকাল পরে হাজরা সরকারের কণ্ঠে সেই গান শুনে তিন তরুণ যেন আবার ফিরে যায় কৈশোরে আর ওদের হৃদমঞ্চে দাঁড়িয়ে অবিরাম গাইতে থাকে কিশোরী আশালতা!
(চলবে....)
০৬ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৫৬
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
২| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ১২:৫০
রাজীব নুর বলেছেন: আসলে যাত্রাশিল্প বন্ধ হওয়ার প্রধান কারন- মানুষ যাত্রা দেখে না। টিভিতে এত এত চ্যানেল। তাই মানুষ যাত্রা দেখে না। তাছাড়া গত দশো বছরে যাত্রার মান খুব কমেছে। অশ্লীতায় ভরা।
০৬ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১০:০৬
মিশু মিলন বলেছেন: আমার কাছে মনে হয় কারণটা ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক। বিএনপি-জামায়াত যাত্রা নিষিদ্ধ করছিল তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে সংস্কৃতির শিকড় থেকে উন্মুল করার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে। অশ্লীলতা একটা অজুহাত মাত্র। তৃতীয় শ্রেণির কিছু যাত্রাদল অশ্লীল নাচ-গান শুরু করেছিল, তাদেরকে সতর্ক করা যেত। তা না করে যাত্রা নিষিদ্ধ করে তারা। প্রথম শ্রেণির যে দলগুলো প্রকৃতপক্ষে যাত্রা শিল্পের চর্চা করতো, তাদেরকেও নিষিদ্ধ করা হয়। এটা তাদের পরিকল্পনার অংশ ছিল।
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ১২:০৪
নেওয়াজ আলি বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন