নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
পরিবারের সঙ্গে কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই মতপার্থক্য নয় আমার, মতপার্থক্য আরো অনেক বিষয়ে। বীজগণিতের সূত্রের মতো আমাদের দেশে বিশ্বাসেরও কিছু সুত্র আছে, বিপুল সংখ্যক মানুষের সেই সূত্র মুখস্থ-আত্মস্থ; তাদের ধারণা এটাই নির্ভুল সূত্র এবং একমাত্র এই সূত্র দিয়েই জীবনের অংকের উত্তর সঠিকভাবে মেলানো সম্ভব, সহি মুসলমান হওয়া সম্ভব। হাজার যুক্তি-প্রমাণ দিয়েও তাদেরকে বোঝানো যায় না যে এই সূত্রের চেয়েও নির্ভুল সূত্র আছে! আমি বাদে আমাদের পরিবারের সকল সদস্যেরই এই সূত্র মুখস্থ এবং আত্মস্থ। আমাদের পরিবারে নতুন কোনো সদস্যের জন্ম হলে ছোট থেকেই বারবার শুনতে শুনতে সূত্রগুলো তাদের মগজে গেঁথে যায়, তারপর আত্মস্থ করে ফেলে। সূত্রগুলো হচ্ছে-
আওয়ামীলীগ+বামপন্থী বিরোধী= বিএনপি+জামায়াত প্রেমী
বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী=জিয়া প্রেমী
সর্বক্ষেত্রে ভারত বিদ্বেষী (গঠনমুলক সমালোচক নয়)=সর্বক্ষেত্রে পাকিস্থানপ্রেমী
অমুসলমান বিদ্বেষী=মুসলমানপ্রেমী
খুব ছোটবেলাতেই এই সূত্র আমার মুখস্থ হয়ে যায়, তারপর একসময় আমি নিজে নিজেই আত্মস্থ করে ফেলি। জীবনের আঠারোটি বছর আমি এই সূত্র মেনেই চলেছি। ভারত-পাকিস্থান ক্রিকেট ম্যাচ হলে মনে হতো নিজের দেশের বিরুদ্ধে খেলছে ভারত। আমি দু-বার মাঠে বসে ভারত-পাকিস্থান ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছি। পাকিস্থানের জার্সি-টুপি পরে, গালে পাকিস্থানের পতাকা এঁকে, গ্যালারীতে বসে পাকিস্থানের পতাকা উড়িয়েছি আর পাকিস্থান পাকিস্থান বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে মুখে ফেনা তুলেছি! পাকিস্থানী ক্রিকেটারদেরকে মনে হতো আপনজন, মনে হতো তারা তো আমাদের ভাই। আর ভারতীয় ক্রিকেটারদেরকে মনে হতো আমাদের পরম শত্রু। মনে হতো ওরা কারবালায় আমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, এ লড়াই মালাউনদের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহ’র লড়াই! তাই ভাইদেরকে আমরা উৎসাহ দিতাম আর ভারতীয় ক্রিকেটারদের দিতাম গালি। মালাউন, মালু, চাড়াল, হনু, রেন্ডিয়া ইত্যাদি বলে গালি দিয়ে ভীষণ আমোদ পেতাম; বাংলাদেশের ভারতীয় সমর্থকদের মনে করতাম ভারতীয় দালাল, তাদেরকে বলতাম, ‘রেন্ডিয়ার দালাল’! বাংলাদেশ-পাকিস্থান ম্যাচ হলেও বাল্যকালে চাচাকে দেখে পাকিস্থানকেই সমর্থন করতাম। পরের দিকে পড়েছিলাম দোটানায়, শেষ পর্যন্ত দুধভাত সমর্থক হয়ে গিয়েছিলাম, মনে হতো যে জেতে জিতুক; বাংলাদেশ জিতলেও উল্লাস করতাম না আবার হারলেও মন খারাপ করে বসে থাকতাম না! কেবল বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচেই দেশপ্রেম চাগাড় দিয়ে উঠতো, আর ভারত-পাকিস্থান ম্যাচে তো রক্ত টগবগ করে ফুটতো! তখন স্টেডিয়াম কিংবা টেলিভিশনের সামনে নয়, মনে হতো কারবালায় আছি!
তখন তো আমি বুঝিনি যে আমরা পাকিস্থানের পতাকা বাংলার মাটিতে আর উড়াবো না বলেই আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, ত্রিশ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, দুই লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। আর ভারতীয়রা? পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারাও তো ছিল আমাদের সহযোদ্ধা, সেই দুঃসময়ে এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়ে তারা খাইয়েছে-পরিয়েছে, তাদের সৈন্যরা জীবন দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য। অথচ কী কুৎসিৎ ভাষায় তাদেরকে আমি গালি দিয়েছি, শত্রু ভেবেছি! এসব করেছি শৈশবে শেখা ভুল সূত্রের ফলে।
এই সূত্রের কারণেই স্কুল-কলেজে যে অল্প ক’জন হিন্দু সহপাঠী ছিল তাদেরকে নানাভাবে নানাকথা বলে উত্যক্ত করেছি। ‘মালাউন’ শব্দটিকে সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়ে ‘মালু’ বলে ওদেরকে গালি দিয়েছি হরহামেশা। স্কুলে আমাদের হুজুর স্যার যখন ধর্ম ক্লাস নিতো, তখন হিন্দু সহপাঠীরাও ক্লাসে থাকতো। হুজুর স্যার প্রায়ই হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং ইহুদী ধর্মের সমালোচনা করতো; শুধু সমালোচনা করতো না, কথার ছুরি চালাতো। বিশেষ করে হিন্দুদের দেব-দেবী নিয়ে হুজুর স্যার মজার মজার কথা বললে আমরা খুব আনন্দ পেতাম আর আমাদের হিন্দু সহপাঠী তপন, সুকান্ত, অলক, মহাদেবের দিকে তাকাতাম। হুজুর স্যার বলতো, ‘হেন্দুরা শঙ্খ বাজায় ক্যান কও তো?’
হুজুর স্যার ‘হিন্দু’ শব্দের উচ্চারণ করতো ‘হেন্দু’। চার হিন্দু সহপাঠী বাদে আমরা সবাই সমস্বরে চিৎকার করতাম, ‘ক্যান হুজুর?’
‘মহাদেবের নাম শুনছো তোমরা?’
আমরা আমাদের সহপাঠী মহাদেবের দিকে আঙুল তুলে বলতাম, ‘হুজুর, অই যে মহাদেব।’
‘আরে এই মহাদেব না, হেন্দুগো দেবতা মহাদেব।’ বলে স্যার দাঁত বের করে হাসতো।
আমাদের মধ্যে যাদের গ্রামাঞ্চলে যাতায়াত ছিল, হিন্দুদের কিছু কিছু পূজা-পার্বণের সঙ্গে পরিচিত তারা ‘হ্যাঁ’ বলতাম; আর যাদের গ্রামের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক ছিল না, তারা ‘না’ বলতো।
হুজুর স্যার বলতো, ‘অই যে, হেন্দুরা যে কালীমূর্তি পূজা করে, বেশরমের মতো জিহ্বা বাইর কইরা খাঁড়াইয়া থাহে এক মহিলা, তার পায়ের নিচে বাঘের ছাল পইরা জটা মাথার যে লোকটা শুইয়া থাকে, তার নাম মহাদেব। মহাদেবের স্বভাব চরিত্র ভাল ছিল না, অসুরদের মা-বোনদের ওপর অত্যাচার চালাইতো। একবার সকল অসুর একত্র হইয়া মহাদেবরে দাবড়ানি দিছিল, দাবড় খাইয়া মহাদেব দৌড়াইতে দৌড়াইতে সমুদ্রে যাইয়া পালাইছিল শঙ্খের ভিতর। অসুররা অনেক খুঁজাখুঁজি কইরাও তারে আর পায় নাই। সে যাত্রায় রক্ষা পাইছিল মহাদেব, আর মহাদেবরে শঙ্খ রক্ষা করছিল বইলাই হেন্দুরা কৃতজ্ঞতাবশত পূজায় শঙ্খ বাজায়।’
আমরা এইসব বানোয়াট গল্প শুনে হাসতাম আর মহাদেব এবং অন্য হিন্দু সহপাঠীদের দিকে তাকাতাম। ওরা যতো বিপন্ন আর অসহায়বোধ করতো আমরা ততো বন্য আনন্দ পেতাম; আর মহাদেবকে তো ক্ষ্যাপাতাম-ই! তখন বুঝতে পারতাম না যে এতে ওদের বাল্য-কৈশোরের মন কতোটা ক্ষতবিক্ষত হতো।
আমাদের সহপাঠী সুকান্ত’র পদবী গঙ্গোপাধ্যায়। সুকান্ত’র নামের পদবী নিয়ে কৌতুক করে হুজুর স্যার একদিন বলেছিল, ‘তোগো হেন্দুগো যে কী সব নাম; মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়! মানে অইলো গিয়া কেউ মুখ খুইলা পাদ দেয়, কেউ মুখ বন্ধ কইরা পাদ দেয়, কেউ চট কইরা পাদ দেয়, আবার কেউ গন্ধ কইরা পাদ দেয়; হা হা হা…!’
হাসি সংক্রামিত হয়েছিল পুরো ক্লাস জুড়ে। লাল হয়ে উঠেছিল সুকান্ত’র মুখ, পুরো ক্লাস মাথা নিচু করে ছিল বাষ্পাকুল চোখে। অন্য হিন্দু সহপাঠীদের মুখেও হাসি ছিল না, ওরাও মাথা নিচু করে ছিল। ওদের ওই নিচু মাথা, বাষ্পাকুল চোখ, থমথমে মুখের অর্থ বোঝার মতো বয়স তখন আমাদের হলেও পারিবারিক শিক্ষা ছিল না বলে ব্যথিত হবার বদলে বুনো উল্লাসে ফেটে পড়তাম!
এরপর থেকে আমরা সুকান্তকে ক্ষ্যাপাতাম, ‘সুকান্ত তুই গন্ধ কইরা পাদ দিবি না কিন্তু, বন্ধ কইরা দিবি!’
সুকান্ত’র বুকের রক্তক্ষরণ আমরা কখনোই টের পাইনি। হঠাৎ একদিন স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয় ও। পরে একদিন তপনের মুখে শুনি যে ও ভারতে চলে গেছে।
আসলে ওই সূত্রগুলো বর্জন করে অন্য সূত্র গ্রহণ করে জীবনের অংক কষা ভীষণ কঠিন, তবে চেষ্টা করলে একেবারে অসম্ভব নয়। ইন্টারমিডিয়েটে আমার একজন শিক্ষক ছিলেন, কবিরুল ইসলাম, আমরা তাকে ‘কবির স্যার’ বলে ডাকতাম। তিনি বয়সে তরুণ হলেও নানা বিষয়ে তার জ্ঞান এবং ব্যাপক পড়াশোনা ছিল। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি তিনি আমাদেরকে অন্যান্য বই পড়ার পরামর্শ দিতেন, অনেক বইয়ের নাম বলতেন। কবির স্যার ছিলেন উদার, অসাম্প্রদায়িক এবং সংস্কৃতমনা; ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে অনেক কথা বলতেন। তার বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন এবং ভারতপ্রেম দেখে অন্য অনেকের মতো আড়ালে আমিও তাকে আওয়ামীলীগ এবং ভারতের দালাল ভাবতাম, কিন্তু অন্যদের মতো স্যারকে আমি পুরোপুরি নাকচ করে দিতে পারতাম না তার সততা, স্পষ্টবাদিতা এবং চিন্তার প্রখরতার কারণে। অন্য অনেক স্যারদের চরিত্রে অনেক বৈপরীত্য থাকলেও তার কথা এবং কাজে কখনো অমিল দেখিনি, ফলে আমি তাকে উপেক্ষা করতে পারিনি। স্যারের কথা মন দিয়ে শুনতাম, তার কথা শুনেই নানা বিষয়ে আগ্রহ জন্মায় এবং সে-সব বিষয়ে কিছু কিছু পড়াশোনাও শুরু করি। তারপর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর ঊনিশে পা দিয়ে যখন বিভিন্ন বিষয়ে আরো বেশি বেশি পড়াশোনা শুরু করি, ইতিহাসটা জানা এবং বোঝার চেষ্টা করি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সন্ধান এবং নিজের বোধ দিয়ে তা বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করি, যুক্তির বিপরীত যুক্তিও মন দিয়ে শুনি, তখনই একটু একটু করে নিজের ভুলগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে বোধের আয়নায়। বুঝতে পারি যে- ভুল পরিবারে জন্ম নিয়ে ভুল শিক্ষায় বড় হয়েছি, এই ভুল শোধরাতে হবে আমাকেই। আঠারো বছরের আমজাদ উসামার ভুল শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সকল প্রকার সংকীর্ণ চিন্তার মৃত্যু ঘটিয়ে আমি নিজ হাতে তা সমাধিস্থ করেছি মানবতার উদার জমিনে। আমি হিন্দুধর্মের জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী নই, জন্মান্তরবাদের তত্ত্ব বৈদিক ব্রাহ্মণদের প্রতারণার একটি বুদ্ধিদীপ্ত পন্থামাত্র। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি একই দেহে মানুষের বারবার জন্ম হয়, চৈত্তিক জন্ম; আমারও তাই হয়েছে। এখন আমি উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ছাদের নিচ থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়েছি মানববাদের উদার আকাশের নিচে, মুসলিম উম্মাহ’র সংকীর্ণ শিক্ষার জাল কেটে বেরিয়ে বাইরে এসে নিয়েছি বিশ্ববীক্ষার পাঠ, জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ শিক্ষা ঝেড়ে ফেলে অনুভব করেছি আমি বিশ্ব নাগরিক, মহাবিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত! আমজাদ উসামা থেকে হয়ে উঠেছি নতুন মানুষ- সবুজ সমতল।
আমাকে ক্ষমা করুন কবির স্যার, আপনি যে জ্ঞানসুধা ঢেলেছিলেন আমার কৈশোরের চেতনায়, তাৎক্ষণিক আমি তার রসাস্বাদন করতে পারিনি। আপনার অর্পিত জ্ঞানসুধার বিপরীতে আমি আপনার অলক্ষ্যে আপনার দিকে ছুড়ে দিয়েছিলাম পচা কাদার মতো বাক্য! তবে সঙ্গে সঙ্গে না হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমি ভুল বুঝতে পেরেছিলাম। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, কেননা আপনিই আমার ভেতরে এই নতুন মানুষের বীজ বপন করেছিলেন, যে মানুষের শিকড় এখন বাংলাদেশে কিন্তু চেতনার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত সারা পৃথিবীতে, পৃথিবী ছাড়িয়ে অসীম মহাবিশ্বে। কবির স্যার, আপনার মতো শিক্ষকই পারেন সমাজকে বদলে দিতে।
একটি ধর্মান্ধ পরিবারের আঙিনা সবুজ সমতলের জন্য ভীষণ রুক্ষ, একটি ধর্মান্ধ দেশে সবুজ সমতলের পথটি ভীষণ অসমতল; তবু পথ চলছি। ধর্মান্ধতার ছাতার নিচ থেকে মানবতার উন্মুক্ত উদার আকাশের নিচে এসে দাঁড়িয়ে গ্রহণ করেছি নতুন চিন্তার নির্যাস, নতুন আদর্শ। এখন আর বুকে বয়ে বেড়াই না বিদ্বেষের সাইমুম, এখন বুকের ভেতর নদী, ঝর্ণা, জল, সমুদ্র, ফুল-ফল, পাখি, ঘাস-লতা, শিশির, মিষ্টি বাতাস, মেঘ এবং আরো কতো কিছুর বসবাস! অতীতের কু-শিক্ষা ভেতর থেকে ঝেড়ে ফেলেছি, তবু একটা ব্যাপারে নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না-সুকান্ত’র ভারতে চলে যাওয়া। বছর দুয়েক আগে তপনের কাছ থেকে জেনেছি, হুজুর স্যার সুকান্ত’র পদবী নিয়ে উপহাস করার পর ও নাকি কাঁদতে কাঁদতে তপনকে বলেছিল, ‘আমি আর এই দেশেই থাকবো না।’ আর তার কিছুদিন পরই সুকান্তরা সপরিবারে ভারতে চলে যায়।
অনেকদিন সুকান্ত’র কথা ভুলে ছিলাম, কিন্তু তপনের মুখে এই কথা শোনার পর থেকে বারবার সুকান্তকে মনে পড়ে। হুজুর স্যারের ক্লাসে সুকান্ত’র মাথা নিচু করে বসে থাকার দৃশ্যটি পাথরের মতো আঘাত করে বুকে। মনে হয় কেবল হুজুর স্যার নয়, আমার কারণেও সুকান্তরা ওদের পৈত্রিক ভিটেমাটি-দেশ ছেড়ে চলে গেছে, এর জন্য আমিও দায়ী। আজ কেবলই মনে হয় শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়ে মানুষকে কেন নিজের দেশ ছেড়ে আরেক যেতে হবে? সুকান্তদের পরিচয় এখন উদ্বাস্তু! অনেক বড় পৃথিবী, যার যখন খুশি যেখানে যাবে, যেখানে ইচ্ছে সেখানে ঘর বেঁধে থাকবে, সেটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ব্যাপার; পাসপোর্ট, ভিসা, কাঁটাতার এসব মানুষকে শোষণ এবং নির্যাতনের হাতিয়ার। আজ যারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে, বাংলাদেশ-পাকিস্থান থেকে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, এদের অধিকার আছে স্বেচ্ছায় পৃথিবীর যে কোনো ভূ-খণ্ডে গিয়ে বসবাস করার। কিন্তু জোর করে এদেরকে বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে, শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করে এদেরকে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। আর পৃথিবীর এই হাজার হাজার নির্যাতনকারীর অলিখিত তালিকায় একেবারে নিচের দিকে হলেও আমার নামটি আছে; শারীরিকভাবে না হোক মানসিকভাবে তো আমি সুকান্ত, তপন, অলক, মহাদেবকে নির্যাতন করেছি; এটা ভাবলেই আমি স্থির থাকতে পারি না, দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে! তপন, অলক আর মহাদেব বাংলাদেশেই আছে; তপন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, অলক রাজশাহী আর মহাদেব খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে; প্রথম বর্ষে ভর্তির কিছুদিন পর অলক আর মহাদেব যখন ঢাকায় আসে, তখন একদিন আমি ওদের তিনজনকে ডেকে ক্ষমা চেয়েছিলাম আমার অতীত কৃতকর্মের জন্য। আমাকে ক্ষমা চাইতে দেখে ওরা প্রথমে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, তারপর তপন বলে, ‘ক্ষমা চেয়ে কেন আমাদের বিব্রত করছিস? ক্ষমা চাইতে হবে না।’
আমি বলি, ‘ক্ষমা আমাকে চাইতেই হবে বন্ধু, আমি তো জানি যে আমি তোদেরকে কতো কষ্ট দিয়েছি।’
মহাদেব বলে, ‘জানিস, ছোটবেলা থেকেই আমরা ওসব কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত, এখনো শুনতে হয় কী ব্যক্তিজীবনে কী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমরা ধরেই নিয়েছি যে এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে জন্মানোর কারণে আমাদেরকে এইসব প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই যেতে হবে। ছোট থাকতে এসব কথা শুনে কষ্ট পেতাম, এখন এক কান দিয়ে শুনি আরেক কান দিয়ে বের করে দিই। তবু একটা কষ্ট আমাদের বুকে বাজে। আমাদের ব্যথাটা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ কখনোই সেভাবে অনুভব করতে পারে না, তুই যে এতোদিন পর পেরেছিস, এজন্য তোকে ধন্যবাদ।’
আমি মহাদেবের দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর চোখের ভেতর জল টলমল করছে। তপন আর অলকের দিকে তাকিয়েও একই চিত্র দেখতে পাই। তিনজনের চোখেই একই রকম জল, মুখে একই রকম অভিব্যক্তি; হয়তো তিনজনের বুকে একই রকম ব্যথা তাই! ওদের চোখের জল আমার চোখেও সংক্রামিত হয়, আমি ওদের তিনজনকে জাপটে ধ’রে কেঁদে ফেলি।
ওরা তিনজন আমাকে ক্ষমা করেছে, কিন্তু সুকান্ত’র কাছে আমি আজও ক্ষমা চাইতে পারিনি। ফেসবুকে সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় লিখে কতোবার সার্চ দিয়েছি, কতো সুকান্ত’র দেখা পেয়েছি, কিন্তু তাদের মধ্যে আমার বন্ধু সুকান্তকে খুঁজে পাইনি। তবে আমার বিশ্বাস ওর সঙ্গে আমার দেখা হবেই। যাবার আগে ও তপনকে বলেছিল যে ওরা উত্তর চব্বিশপরগণার দত্তপুকুরে চলে যাচ্ছে। আমি একদিন দত্তপুকুরে যাবই সুকান্তকে খুঁজতে, এ আমার আবেগের কথা নয়, আমি যাবই ওর কাছে ক্ষমা চাইতে; নইলে সারাজীবন যতোবার স্কুলের স্মৃতি ওর মনে পড়বে ততোবার অন্যদের মতো ও আমাকেও ঘৃণা করবে।
কোনো মানুষের বাল্য-কৈশোরের মানসিক বিকাশকালে তাকে ভুল সূত্র দ্বারা পরিচালিত করলে কিংবা যে কোনোভাবেই হোক তার মস্তিষ্কের উর্বর জমিনে ভুল বীজমন্ত্র প্রোথিত হলে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরের বিদ্বেষ ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হতে থাকে, এমনকি তার মানসিকতা বর্বরতা-হিংস্রতার পথেও ধাবিত হয়। কবির স্যারের মতো শিক্ষক পেয়েছিলাম বলেই হয়তো আমি রক্ষা পেয়েছি, আমার ভেতরে সাম্প্রদায়িকতা বা বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ শাখা-প্রশাখা মেলে বিস্তার লাভ করতে পারেনি। এর পিছনে কবির স্যারের যেমনি ভূমিকা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আমার নিজের দৃঢ় প্রচেষ্টাও। কবির স্যার আমাকে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সুবর্ণখনির পথ দেখিয়েছিলেন, আমি তার দেখানো পথ ধরে এগোতে এগোতে একসময় সন্ধান পেয়ে যাই সেই সুবর্ণখনির। আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে আমি সেই সুবর্ণখনির মূল্য সঠিকভাবে অনুধাবন করেছি বলেই দমন করতে পেরেছি বিদ্বেষের বিষবৃক্ষকে। উপলব্ধি করেছি যে মানুষের জীবনে পারিবারিক পরিবেশ এবং বন্ধুমহল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি হয়তো সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে নিজের এবং পরিবারের সঙ্গে লড়াই করে আমার মানসিক অন্ধত্ব দূর করেছি, কিন্তু সবার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
উপরেল্লিখিত সূত্রগুলোর সঙ্গে কয়েক বছর আগে আরো দুটি নতুন সূত্র যোগ হয়েছে-
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধী-নাস্তিক ব্লগারদের বিচার প্রার্থী
গণজাগরণ মঞ্চ বিরোধী-হেফাজতে ইসলাম প্রেমী
আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিবাদ সমাবেশে গিয়েছি, এটা নিয়েও পরিবারের সঙ্গে আমাকে লড়াই করতে হয়েছে, এখনও করতে হয়। আমাদের পরিবারের কেউ-ই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চায় না। বলে, ‘এতোদিন পর এই বুড়ো মানুষগুলোকে শাস্তি দেবার কী দরকার! দেশে কতো অন্যায়-দুর্নীতি হচ্ছে তার তো বিচার হচ্ছে না, নবীজিকে নিয়ে নাস্তিক ব্লগাররা কতো খারাপ খারাপ কথা লিখছে তার তো বিচার করছে না সরকার। এটা একটা রাজনৈতিক চক্রান্ত।’
আমার দাদীর বড়ভাই একাত্তরে একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন, বাঙালি হলেও তিনি নাকি পারতপক্ষে বাংলায় কথা বলতেন না, অফিসে-বাড়িতে সব জায়গায় উর্দুতে কথা বলতেন। অন্যদেরকেও উর্দু ভাষায় কথা বলার পরামর্শ দিতেন। বাংলা ভাষাকে তিনি কাফের হিন্দুদের ভাষা মনে করে ঘৃণা করতেন! বিয়ে করেছিলেন পূর্ব-পাকিস্থানে কর্মরত একজন পশ্চিম পাকিস্থানী সরকারী কর্মকর্তার মেয়েকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিরলসভাবে পাকিস্থানের পক্ষে কাজ করেছেন; এমনকি নিরপরাধ মানুষ হত্যায় নেতৃত্বও দিয়েছেন। একাত্তরের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের বিজয় যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র তখন নিজের বিপদ আঁচ করতে পেরে তিনি তার পরিবার নিয়ে পালিয়ে পাকিস্থানে চলে যান। যাবার আগে নাকি বলে যান যে এই দেশের মুসলমানরা কাফের হয়ে গেছে, কাফেরদের এই নাপাক ভূমিতে তিনি আর কখনোই ফিরবেন না। ফেরেনওনি, আশি সালে করাচীর রাস্তায় এক বোমা বিস্ফোরণে মারা যান তিনি! তার স্ত্রী-সন্তান ওখানেই স্থায়ী হয়েছে। দাদীর ভাই মারা যাবার সংবাদটা জানানোর পর থেকে তারা আর বাংলাদেশে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমার দাদী তার ভাইকে এতো বছর বাদেও ভুলতে পারেননি, তার ভাইয়ের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলমান নাকি তিনি জীবনেও দেখেননি। ভাইয়ের কথা উঠলে আজও তিনি চোখের জল ফেলেন আর ভারতকে গালমন্দ করেন, শেখ মুজিব এবং ইন্দিরা গান্ধীর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন! দাদীর বিশ্বাস, ভারত অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর চক্রান্তেই পাকিস্থান থেকে ভাগ হয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। দেশটা যদি আজও পাকিস্থান থাকতো তাহলে তার ভাইকে করাচীর রাস্তায় অকালে প্রাণ হারাতে হতো না। যে ভাই গাছ থেকে আম-আমড়া পেড়ে আদর করে বোনকে খাইয়েছে, সেই ভাইয়ের কবরটাও তিনি দেখতে পেলেন না! এই নিয়ে দাদীর বড় আক্ষেপ; আরো একটি আক্ষেপ এই যে কতোকাল তিনি তার ভাইপুত-ভাইঝিদের মুখে ফুফু ডাকটাও শুনতে পান না, আজ তার সংসার ফুলে-ফেঁপে উঠলেও তাদেরকে নিজ হাতে রান্না করে ভাল কিছু খাওয়াতে পারেন না! ভাই বিষয়ে দাদীর সর্বশেষ আক্ষেপ হলো- একাত্তরের পরে করাচীতে জন্ম নেওয়া ভাইয়ের শেষ দুটো ছেলেমেয়ে কোনোদিন বাপ-দাদার ভিটেটাও দেখতে পায়নি আর তাদের চাঁদমুখ না দেখেই তাকে মরতে হবে!
যে কারণে আমাদের পরিবারের হিন্দু বিরোধীতা, বাংলাদেশ বিরোধীতা, ভারত বিরোধীতা, আওয়ামীলীগ বিরোধীতা কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতার শিকড় চেতনার খুব গভীরে প্রোথিত। যেদিন জামায়াতে ইসলামীর নেতা-একাত্তরের কুখ্যাত খুনি রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় হয়, সেদিন সংবাদ দেখার সময় চাচা রিমোর্ট ছুড়ে মারেন টেলিভিশনের পর্দায়। রিমোর্টটা ভেঙে চুরমার হয়, টেলিভিশনের পর্দায় চিড় ধরে। চাচা সাঈদীর ওয়াজের খুব ভক্ত, তাই সংবাদটা শুনে তিনি সহ্য করতে না পেরে অমন কাণ্ড করেন। পরে যখন আদালত আপিলের রায়ে ফাঁসির বদলে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়, তখন তিনি খানিকটা স্বস্তি বোধ করেন।
চাচা শুরুতে আইএস এর ব্যাপারে দারুণ উৎসাহী ছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন যে একমাত্র আইএস-ই পারবে সারা পৃথিবীর মানুষকে ইসলামী কওমের ছাতার নিচে এনে সত্যিকারের দার-উল-ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে। এমন স্বপ্ন তিনি আগেও দেখেছিলেন তালেবান আর আল-কায়েদাকে নিয়ে। লাদেন বাহিনী যখন আমেরিকার টুইনটাওয়ারে হামলা চালায় তখন আমি বেশ ছোট হলেও চাচার সেই বুনো উল্লাসের কথা আমার আজও মনে আছে। আফগানিস্থানে তালেবানরা যখন বড় বড় বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙছিল তখনও চাচাকে উৎফুল্ল দেখেছি। কিন্তু তালেবান আর কায়েদায় চাচার স্বপ্নভঙ্গ হয় তারা আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে না পারায়। তাই চাচা সর্বশেষ স্বপ্ন বোনেন আইএসকে ঘিরে। কিন্তু যখন শোনেন যে আইএস কাবা শরীফেও আক্রমণ করতে চায়, তারা হজ কিংবা ঈদের জামায়াত বন্ধ করতে চায়, তখন চাচার সেই উৎসাহের মহীরুহে যেন বাজ পড়ে! চাচা হয়ে যান আইএস বিরোধী এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে আইএস ইসলামের শত্রু ইসরাইলের সৃষ্টি, ইসলাম ধ্বংস করাই আইএসের একমাত্র উদ্দেশ্য, এটা ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের চক্রান্ত! তার বিশ্বাস পরে সংক্রামিত হয়েছে বাবার মধ্যেও। তবে বাবা চাচার চেয়ে খানিকটা উদারপন্থী। এই যে আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা হয়, গলা কেটে হত্যা করা হয়, তাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া হয়, বাবা এসবের পক্ষে নন। বাবা চান সংখ্যালঘুরা থাকুক ওদের মতো, ওরা তো আমাদের পায়ের নিচেই আছে, খুনোখুনি করার তো কোনো দরকার নেই। যদিও বাবার সাম্প্রতিক ধারণা অনির্বাচিত আওয়ামীলীগ সরকার এখন ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাদের বিশ্বাসভাজন সংখ্যালঘুদেরকে বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে, প্রশাসনসহ সব সেক্টরে বড় বড় পোস্টে হিন্দুদের চাকরি দিচ্ছে। কিছুদিন আগে ড্রয়িংরুমে বসে বাবা আর চাচা এসব নিয়েই আলাপ করছিলেন। রান্নাঘরে নিজের জন্য চা বানাতে বানাতে আমি তাদের কথা শুনছিলাম। এক পর্যায়ে সদ্য বানানো ধোঁয়া ওঠা চায়ের মগটা ডাইনিং টেবিলে রেখে ঢুকে পড়ি তাদের কথার মধ্যে, ‘জামায়ত-বিএনপি ক্ষতায় থাকাকালীন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হিন্দুদের চাকরি দেয়নি। ইন্টারভিউ বোর্ডকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হতো হিন্দুদের নিয়োগ না দেবার জন্য। আওয়ামীলীগ সরকার সেই নীতি গ্রহণ করছে না, এজন্য আওয়ামীলীগের ধন্যবাদ প্রাপ্য।’
‘অল্প কিছু নিয়োগ দিলে বিষয়টা মানা যেতো, তাই ব’লে প্রশাসনের বড় পোস্টে এতো হিন্দু কমকর্তা!’ বাবা বলেন।
চাচা ফোঁস করে ওঠেন, ‘ইন্ডিয়ার ইশারায় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামীলীগ এসব করছে। গোপালগঞ্জ থেকে সব নমো-চাঁড়ালগুলোকে ধরে এনে চেয়ারে বসিয়েছে।’
আমি চাচার চোখে চোখ রাখি, ‘চাচা, আমাদের পূর্ব পুরুষও যে নমো-চাঁড়াল ছিল না, নিশ্চয় এই বিষয়ে আপনি নিশ্চিত নন; বরং ইতিহাস বলে সেই সম্ভাবনাই বেশি। তাই এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করলে নিজেদের গায়েই থুথু ছিটানো হয়। আর আওয়ামীলীগ হিন্দুদের বড় বড় পোস্টে নিয়োগ দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করছে। জামায়াতের টাকা খেয়ে মুসলমানদের দেশের সঙ্গে বেঈমানী করার সম্ভাবনা প্রবল, কিন্তু হিন্দুদের সেই সম্ভবনা নেই বললেই চলে।’
চাচা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র শিবির করতেন, এখন রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও জামায়াতে ইসলামীর কট্টর সমর্থক এবং চাকরি করেন ইসলামী ব্যাংকে। সবসময় নিজের যুক্তিতে অটল থাকলেও সেদিন আর এ বিষয়ে কথা বাড়াননি।
চাচা ক্লাস এইট পর্যন্ত গ্রামে লেখাপড়া করেছেন, তারপরই পুরো পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন দাদা। ঢাকায় নিয়ে এলেও প্রতি ঈদেই গ্রামে যেতেন ঈদ করতে। ছেলেবেলায় আমি, আমার দুই আপু আর ফুফাতো ভাই-বোনেরা চাচার কাছে তার ছেলেবেলার ঈদের গল্প শুনতে চাইলে চাচা তাদের ছেলেবেলার আনন্দ-উৎসবের অনেক গল্পের মধ্যে একটি গল্প বলতে যেমনি পুলকবোধ করতেন, তেমনি আমরাও মজা পেয়ে হাসতে হাসতে কেউ তার গায়ে কেউবা সোফায় গড়িয়ে পড়তাম! চাচার মুখে শোনা সেই অতি মজার গল্পটা হচ্ছে- কোরবানী ঈদের সকালে গরু কোরবানীর পর চাচা এবং তার বন্ধুরা গরুর হাড় আর নাড়ি লুকিয়ে রেখে দিতেন। তারপর রাত্রিবেলা সেই হাড় আর নাড়ি নিয়ে যেতেন হিন্দুপাড়ায়, হিন্দুপাড়ার যে-সব ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা বা অন্য কোনো কারণে তাদের বিরোধ থাকতো সেইসব ছেলেদের বাড়ির উঠোন-বারান্দায় গরুর হাড় আর নাড়ি রেখে আসতেন, গাছের ডালে গিঁট দিয়ে ঝুলিয়ে কিংবা টিউবয়েলের গায়ে নাড়ি পেঁচিয়ে রাখতেন।
গল্পটা চাচা এমন রসিয়ে রসিয়ে বলতেন যে মনে হতো আমরা চোখের সামনে সেই মজার দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি! দাদার মুখে নবীজীর মক্কা বিজয়ের গল্প শুনে যে আনন্দ পেতাম, তার চেয়েও বেশি আনন্দ পেতাম চাচার মুখে এই গল্পটা শুনে!
রশিদ খানের বাগেশ্রী শেষ হতেই মেঝের সাথে চেয়ারের পায়ার ঘর্ষণের শব্দ শুনতে পাই। বোধ সেহেরি খাওয়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠছে সবাই। অল্পক্ষণ পরই মসজিদের মাইক আবার হেঁকে ওঠে, ‘সম্মানিত রোজাদার ভাই ও বোনেরা, সেহেরি খাওয়ার সময় শেষ হয়েছে, সেহেরি খাওয়ার সময় শেষ হয়েছে, সেহেরি খাওয়ার সময় শেষ হয়েছে।’
ঘুম আসছে না বলে মোবাইলে ইয়োগা মিউজিক ছেড়ে ফেসবুকে ঢুকি। উহ! সেহেরি খাওয়ার ছবিতে ফেসবুকের ওয়াল সয়লাব, বাহারি খাবারের সঙ্গে সেলফি! বাস্তব জগতের সঙ্গে ভার্চুয়াল জগতের নির্যাতনও শুরু হলো! রমজান মাসে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত এবং অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান সকাল-সন্ধ্যায় সেহেরি এবং ইফতারের সময় সাজগোজ করে বাসার কিংবা ইফতার পার্টির নানা পদের খাবারসহ, নিজের, বন্ধুদের এবং পরিবারের লোকজনের ছবি তোলে আর মাসব্যাপী ফেসবুক-টুইটারে পোস্ট করে। ছবির সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ক্যাপশন জুড়ে দেয়; যেমন- ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে আরও একটি রোজা পার করলাম’, ‘বন্ধুর বাসায় ইফতার পার্টিতে’, ‘শূটিংয়ে ইফতার পার্টিতে’, মদিনা সাংস্কৃতিক জোটের ইফতার পার্টিতে আমরা কজন’, বখতিয়ার গ্রুপ অফ কোম্পানীর ইফতার পার্টিতে আমি, ‘আবাবিল থিয়েটারের ইফতার পার্টি’, ‘দুলদুল নৃত্য গোষ্ঠীর ইফতার পার্টি শেষে আমরা’ ইত্যাদি! গত কয়েক বছর ধরে চালু হয়েছে সেহেরির নতুন সংস্করণ-সেহেরি পার্টি। অনেকেই ইফতারের পর বন্ধু-বান্ধবের বাসায় যায়, সারারাত আড্ডা দেয়, তারপর ভোরবেলা উদযাপন করে সেহেরি পার্টি। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে কোনো কোনো রেস্টুরেন্ট; তারা সেহেরির খাবারের আয়োজন করে আর মানুষ বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে মাঝরাতে ঝলমলে পোশাক পরে, ভারী মেকআপ নিয়ে পিকনিক মুডে যোগ দেয় সেহেরি পার্টিতে। আজ প্রথম রোজা বলে সেহেরি পার্টির কোনো ছবি ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি না, প্রথম সেহেরি হয়তো সবাই পরিবারের সাথেই খেতে চায়; তবে দু-চার দিনের মধ্যেই সেহেরি পার্টির ছবি রোশনাই ছড়াবে ফেসবুকে, আর ইফতার পার্টি তো আছেই! মাত্র কয়েক বছর যাবৎ চালু হয়েছে সেহেরি পার্টি, অথচ এরই মধ্যে নাকি এটা সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে! আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে মূল সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এই সব ভুঁইফোঁড় অপসংস্কৃতি!
ব্যক্তিগতভাবে আমি কেবল সেহেরি বা ইফতারি নয়, ফেসবুক-টুইটারে যে কোনো খাবারের ছবি প্রদর্শন করা ভীষণ অপছন্দ করি; এটা আমার কাছে অসভ্যতা মনে হয়। আমার টাকা আছে, আমি বাসায় কিংবা কোনো ভাল রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভাল খাবার খেতেই পারি, কিন্তু তা মানুষকে দেখাতে হবে কেন! আমি কী খাব সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, দশজনের সামনে জাহির করার বিষয় নয়, যেখানে আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ দু-বেলা দু-মুঠো ভাতই খেতে পায় না! আমার সমাজের কোনো পড়শি হয়তো ভাল খেতে পায় না, আমি কি তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাব যে দ্যাখো আমি ভাল ভাল খাবার খাচ্ছি? ফেসবুকও তো একটি সমাজ, ভার্চুয়াল সমাজ। কিন্তু হায় এই স্বাভাবিক শিক্ষা-সহবতটুকু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের নেই, অথচ এরা ধার্মিক!
একজন নায়িকা সেহেরির সেলফি তুলে পোস্ট দিয়েছে, সঙ্গে ক্যাপশন-‘সবগুলো রোজা রাখবো ইনশাল্লাহ, আপনারাও রোজা রাখুন’। ভোরবেলাতেও তার মুখে হালকা মেকআপ, ঠোঁটে লিপস্টিক, প্লাক করা চিকন ভ্রু, খোলা চুল বেশ কায়দা করে আঁচড়ানো। যদিও ইসলামে মুখে রঙ মাখা, ভ্রু চাঁছা, পরপুরুষকে চুল দেখানো হারাম! নায়িকা আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নেই, আমার ফ্রেন্ড লিস্টের একজন ধার্মিক পোস্টটা শেয়ার দিয়েছে। পেশায় অভিনয়শিল্পী, সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পরপুরুষের সঙ্গে অভিনয় করে, স্বল্পবসন পরে পরপুরুষের কণ্ঠলগ্ন হয়ে রোমশ বক্ষে নিজের স্ফীত স্তন ঠেকিয়ে মুখে যৌন আবেদন ফুটিয়ে নৃত্য-গীত করে, যা সম্পূর্ণ ইসলামী শরিয়া বিরোধী কাজ; অথচ সুযোগে সেও মানুষকে রোজা রাখার পরামর্শ দেয় আর মানুষও গদগদ হয়ে তার পোস্টে লাইক-কমেন্ট করে তাকে প্রশংসার বন্যায় ভাসায় এবং শেয়ার করে! অথচ এখনই কেউ মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ অথবা যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলের স্টিল ফটোগ্রাফির ওপর হাদিস থেকে ক্যাপশন লিখুক-‘পানি যে-রূপ জমিনে ঘাস উৎপন্ন করে গান-বাজনা তদ্রুপ অন্তরে মুনাফেকী পয়দা করে’ অথবা লিখুক-‘গান-বাজনা শ্রবণ করা, গান-বাজনার মজলিশে বসা, বাদ্য-যন্ত্র বাজানো, নর্তন-কুর্দ্দন করা সবই হারাম, যে ব্যক্তি এগুলোকে হালাল মনে করবে সে ব্যক্তি কাফির’; লিখে পোস্ট দিক ফেসবুকে, এখন যারা নায়িকার ছবিতে লাইক-কমেন্ট করেছে তাদের অনেকেই নেকি হাসিলের জন্য রাজ্জাক কিংবা সাঈদীর ছবিতে লাইক-কমেন্ট করে সহি মুসলমানিত্ব ঝালাই করে নেবে! এই দ্বিচারিতা অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানের চরিত্রে প্রকট।
রমজান মাস এলেই এদেশের অধিকাংশ মুসলমানের ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য প্রকট হয়ে ওঠে এবং তা রীতিমতো বিরক্তির পর্যায়ে চলে যায়। দেশের কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সংগীতশিল্পী, চিত্রকর, নারী নেত্রী, খেলোয়াড়, সরকারি-বেসরকারী কর্মজীবি নারী-পুরুষ, রাজনীতিক, ঘুষখোর পুলিশ-র্যাব-মিলিটারি, মুদি দোকানদার, রিক্সাওয়ালা, মদ্যপ, মিথ্যাবাদী, প্রতারক, মজুতদার, ধর্ষক ইত্যাদিসহ কে নেই এই দলে! আর এখন এদের ধর্মপরায়ণতা জাহির করার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক-টুইটার। যে কোনোদিন কোরান-হাদিস পড়েনি, সারাবছর বেশরিয়তী কাজকর্মে লিপ্ত থাকে, পুরো রমজানে দুটো-তিনটে রোজা রাখে কী না রাখে, এই ফেসবুকের যুগে সেও সেহেরি, ইফতার, ঈদের জামায়তে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে তার সহি মুসলমানিত্ব জাহির করে সমাজের মানুষের কাছে! আর কোরবানী ঈদে তো আরো এক ধাপ এগিয়ে, গরু-ছাগলের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুক-টুইটারে পোস্ট করার হিড়িক পড়ে যায়! নানান ভঙ্গিমার বাহারি সে-সব ছবি; কেউ গরু-ছাগলের পিঠে হাত বুলাচ্ছে, কেউ ঘাস কিংবা খড় খাওয়াচ্ছে ইত্যাদি। দেখে মনে হয় যেন, আহা, পশুর প্রতি এদের কতো প্রেম! অথচ ঈদের দিন সকালবেলার বাতাসটা ভারী হয়ে ওঠে পশুর পীড়িত আর্তনাদে, অবলা পশুর রক্তে ভেসে যায় অলি-গলি। আর ধার্মিকেরা সেই রক্তমাখা বীভৎস ছবি পুনরায় পোস্ট করে ফেসবুক-টুইটারে।
সেলফি তুলে এবেলা-ওবেলা ফেসবুক-টুইটারে পোস্ট করা মুমিন মুসলমানের একটা বড় অংশ জানেও না যে ছবি আঁকা-ছবি তোলা ইসলামে হারাম, আবার অনেকে জেনেও অমান্য করে। অনেক ধার্মিক চিত্রকরকেও ফেসবুক-টুইটারে তার ধর্মপরাণতার বিজ্ঞাপন দিতে দেখা যায়। অথচ হাদিসে বলা আছে- ‘(কিয়ামতের দিন) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি বানায়।” [সহীহ বুখারী, নবম খণ্ড, হাদিস নং ৫৫২৬-ইফা]
আরো বলা আছে- ‘হাশরের দিন সর্বাধিক আজাবে আক্রান্ত হবে তারাই, যারা কোনো প্রাণির ছবি তোলে অথবা আঁকে।’ (সহীহ বুখারী : ৫/২২২২)
আসলে ইসলাম এতোটাই অকার্যকর, অবৈজ্ঞানিক এবং অশৈল্পিক ধর্ম যে কোরান-হাদিসের কথা মেনে জীবনযাপন করা অসম্ভব, কোরান-হাদিস অনুসরণ করে জীবন-যাপন করতে গেলে হয় মরুভূমিতে ঘর বেঁধে থাকতে হবে নয়তো বনে বাস করতে হবে। এটা বুঝেই আধুনিক কালের মাওলানা কিংবা মুফতিরা কোরান-হাদিসের কোনো কোনো আয়াতের নতুন ব্যাখ্যা এবং ফতোয়া দেয়। যেমন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান আল্লামা মুফতি আবুল কাসেম নোমানী ফতোয়া দিয়েছেন, ‘পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরির মতো একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ইসলামে ছবি তোলা হারাম।’
তারপরও মুমিন মুসলমানদেরকে আমরা এই হারাম কাজটি হরহামেশা-ই করতে দেখি! ‘নাস্তিক ব্লগাররা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখালেখি করে’ ‘মুক্তমনারা ইসলামকে অবমাননা করে’; এসব বলতে বলতে মুমিন মুসলমানরা মুখে ফেনা তুলে ফেলে, অথচ যাপিত জীবনে প্রতিদিন-প্রতিমুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ইসলাম অবমাননা করে এইসব মুমিন মুসলমানরাই! বস্তুত আজকের দিনে হয়তো কিছু কিছু জঙ্গি ব্যতিত কেউ-ই প্রকৃত মুসলমান নয়। এমনকি ইমাম-খতিব-মওলানারাও নয়, কেননা এদেরকেও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে আপোস করে চলতে হয়।
(চলবে…..)
০৬ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৮:৪৯
মিশু মিলন বলেছেন: হ্যাঁ পর্বগুলো বেশ বড় বড়।
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৮:৪২
রাজীব নুর বলেছেন: বিশাল পোষ্ট।