নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জন্মান্তর (উপন্যাস: পর্ব-দশ)

২৯ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:০০

স্নান শেষ হলে ছড়া থেকে উঠে এসে রৌদ্রজ্জ্বল একটা বড়ো পাথরের ওপর বসে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। তার চুল-দাড়ি বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে শরীরের নিচের দিকে, পাথর বেয়ে মাটিতে। এবার আমি তাকে খুব ভালভাবে দেখতে পাই, আড়াল থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাকে চিনতে চেষ্টা করি। ইনি কি হোমো ইরেকটাস, হোমো হাইডেলবারজেনসিস নাকি হোমো স্যাপিয়েন্স গোত্রের? মুখের বানরের আদলটা খুব একটা প্রকট নয়। আবার ফল খাওয়া, শরীর মার্জন করে স্নান করা, নিঃশব্দ হাসি, স্নান শেষে পাথরের ওপর বসে শরীর শুকোতে শুকোতে তার উদাসীন অথচ বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি; এসব দেখে আমার মনে হয় যে তিনি হোমো ইরেকটাস বা হোমো হাইডেলবারজেনসিস গোত্রের নন; হোমো ইরেকটাস এবং হাইডেলবারজেনসিসের বিবর্তিত উত্তরপুরুষ হোমো স্যাপিয়েন্স। আমি মৃদু পায়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে আছেন। মৃদু শব্দে দু-বার নাক টানেন, বোধহয় গন্ধ শুকে আমার অস্তিত্ব অনুভব করে চোখ খুলে মাথা নামিয়ে দৃষ্টি ছুড়ে দেন আমার দিকে। আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দ্রুত একবার দৃষ্টি বোলান, তারপর দৃষ্টি স্থির করেন আমার মুখে। আমি দৃষ্টি রাখি তার দৃষ্টিতে। বেশ কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে যায়, তিনি দৃষ্টি নামান না, আমিও না। তার দৃষ্টির ভেতরে আমি আমার অসংখ্য পূর্বপুরুষদের দেখতে পাই! তাদের একেকজনকে অতিক্রম করে এগোতে থাকে আমার দৃষ্টি, দৃষ্টি যতো এগোয় আমার সঙ্গে তাদের শারীরিক পরিবর্তন ততো প্রকট হয়ে ওঠে, তাদের মুখ অবিকল বানরের মতো, মানুষ থেকে ক্রমশ তারা বানর! আমার ভেতরটা আনন্দে নেচে ওঠে, ইনি আমার বহু প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষ, সে-ই হোমো স্যাপিয়েন্স গোত্রের! আনন্দে আমার ভেতরটা উদ্বেলিত, আমার চোখের পলক পড়ে। তিনি আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন আমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত। একবার নিজের শরীরের দিকে তাকান, পুনরায় আমার দিকে। আমি তার আরো কাছে গিয়ে বলি, ‘আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

তিনি কোনো কথা বলেন না। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের ঠোঁট দুটো নেড়ে কথা বলার ভঙ্গি করেন কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না মুখ থেকে।

আমি আবার বলি, ‘আমি আপনার উত্তরপুরুষ, কেমন আছেন আপনি?’

তিনি নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে নিজের দাড়িতে আঙুল বোলাতে থাকেন। বোধহয় আমার শ্মশ্রুমুণ্ডিত মুখমণ্ডল দেখে তিনি অবাক হন।

‘আপনি আমার পূর্বপুরুষ, আপনার বংশের সর্বশেষ প্রতিনিধি আমি।’

তিনি ধীরে ধীরে পাথর থেকে নেমে এসে আমাকে প্রদক্ষিণ করতে করতে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। আমিও পর্যবেক্ষণ করি আমাকে প্রদক্ষিণরত আমারই পূর্বপুরুষকে, যার শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত নেই! নগ্ন তিনি; আমি দৃষ্টি রাখি তার মুখে, বুকে, পেটে, পিঠে, নিতম্বে, ঊরুতে, পায়ের পাতায়, এমনকি কাঁচা-পাকা কেশাবৃত শিশ্নেও! কিন্তু কী আশ্চর্য, তাকে দেখে আমার একটুও লজ্জা লাগে না, তিনিও লজ্জিত বোধ করেন না! তাকে দেখে একবারও মনে হয় না যে আমার মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন বলে তিনি অশিক্ষিত; নগ্ন বলে মনে হয় না তিনি অসভ্য-অশালীন, তার নিন্মাঙ্গের কেশের ভেতর থেকে নেতিয়ে ঝুলে থাকা শিশ্নটাকে অশ্লীলতার ধ্বজা মনে হয় না আমার। বরং মনে হয় তিনি স্বাভাবিক, সত্য, সুন্দর!

আমি ভাবতে থাকি, আচ্ছা আমি যদি আমার বাবা কিংবা চাচাকে এরকম নগ্ন অবস্থায় দেখতাম তাহলে আমার কি মনে হতো? আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম, কয়েকটা দিন হয়তো তাদের সম্মুখে যেতে চাইতাম না, না চাইলেও মনের আয়নায় বারবার ভেসে উঠতো তাদের নগ্ন শরীর। মনে হতো কী অশ্লীল, কী অশালীন দৃশ্য! অথচ বাবা-চাচারই পূর্বপুরুষকে সম্পূর্ণ অনাবৃত অবস্থায় দেখেও আমার কিন্তু তেমন অনুভূতি হয় না! হয়তোবা সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অশ্লীলতা ঢুকে পড়েছে আমাদের মগজে, আমাদের চৈতন্যে ছড়িয়েছে অশ্লীলতাবোধ, আমাদের দৃশ্যমান লিঙ্গ কোমরের নিচে থাকলেও অদৃশ্য লিঙ্গ পাল তুলে ছুটছে মগজের কোষে কোষে। আমাদের মনন গ্রাস করেছে অস্বাভাবিক, অসত্য আর অসুন্দর তত্ত্বে; অথচ এই তত্ত্বকেই আমরা মেনে নিয়েছি স্বাভাবিক, সত্য আর সুন্দর বলে। কাল আমাদের গায়ে পরিয়ে দিয়েছে সুন্দর চাকচিক্য পোশাক, কিন্তু আমাদের অন্তর করেছে অসভ্য-অশালীন!

এবার আমার পূর্বপুরুষ আমার মুখোমুখি দাঁড়ান, দুই হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেন আমার শ্মশ্রুমুণ্ডিত মুখমণ্ডল, চুল। হাত রাখেন আমার বুকে, বুকে মাথা ঠেকিয়ে কান পাতেন। তিনি কি আমাকে পরীক্ষা করে দেখছেন যে আমিই তার উত্তরপুরুষ কি-না? কী জানি! এরপর তিনি আমার হাত ধরেন, একটা একটা করে হাতের আঙুল টিপে দ্যাখেন। আমার ডান হাতটা রাখেন তার শ্মশ্রুময় গালে। তার গালে হাত রেখে আমি স্থির-স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি মুখের দিকে। কোনো কথা বলতে পারি না। আমি আবেগাপ্লুত, আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। হয়তোবা মনের আনন্দে-আবেগে, হঠাৎ-ই তিনি আমার হাত ছেড়ে ময়লা দাঁতগুলো বের করে নিঃশব্দে হাসতে হাসতে লাফাতে থাকেন। কেন? তিনি তার উত্তরপুরুষকে চিনতে পেরেছেন বলে! তারপর আচমকাই আবার দাঁড়িয়ে দৃষ্টি স্থির করেন আমার শরীরের পোশাকের দিকে; শার্ট, শার্টের পকেট, বোতাম, কলার, প্যান্ট, প্যান্টের পকেট ইত্যাদি হাত দিয়ে ধরে ধরে দ্যাখেন; অজান্তেই তিনি প্যান্টের চেইন ধরে টান দিলে প্রথমে একটুখানি খোলে, তারপর আরেকটু টান দিলে পুরোটাই খুলে যায়; এরপর বেশ কয়েকবার চেইন খোলেন আর লাগান। প্যান্টের চেইন ছেড়ে আমার পায়ের কাছে বসে আঙুলের ডগা দিয়ে জুতো টিপে টিপে দ্যাখেন; বিস্ময়ে বারবার নিজের পায়ের পাতায়-আঙুলে এবং আমার জুতোয় হাত বুলান। আবার উঠে দাঁড়িয়ে পুনরায় আমার গায়ে হাত বুলিয়ে, আঙুল দিয়ে শার্টের কাপড় ধরে দেখতে থাকেন। আমি বলি, ‘মানুষ এখন সভ্য হয়েছে; এখন মানুষ পোশাক পরে, স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষা অর্জন করে, পৃথিবীটা অনেক বদলে গেছে। আপনার পরবর্তী বংশধরদের আমাদের ভূ-খণ্ডে পৌঁছতে অনেককাল লেগেছিল।’

আমার কথা শুনে তার মুখের বিস্ময় আর আনন্দ উবে যায়, তিনি গম্ভীর হন। আমি আবার বলি, ‘আচ্ছা, আপনার নাম কী? ধর্ম কী? আমরা সভ্য মানুষেরা তো এখন সাড়ম্বরে অনেক রকম ধর্ম পালন করি, আপনারা কী সে-রকম কিছু পালন করেছেন?’

এবার আচমকা তার মুখাবয়বের ভাষা বদলে যায়; একটু আগে যে মুখে ছিল বিস্ময় আর আনন্দ, ক্ষণকাল পরেই সেখানে ফুটে ওঠে ক্ষুব্ধতা, দু-চোখের ভাবুক-স্নিগ্ধ দৃষ্টি হয়ে ওঠে ক্ষিপ্র! তিনি একবার আমার মুখের দিকে তাকান, তারপর ক্ষিপ্র হাতে আমার শার্ট ধরে টানেন। শার্টের প্রতি তার কৌতুহল দেখে আমি নির্বোধের মতো ভাবি তিনি বোধ হয় আমার শার্টটা পছন্দ করেছেন, হয়তো শার্টটা গায়ে দিতে চান। আমি শার্টটা গা থেকে খুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিই, ‘এটা শার্ট, আপনি রাখুন। রোদ এবং শীত থেকে জামা মানুষকে সুরক্ষা দেয়।’

আমার হাতে ধরা শার্টের দিকে তাকিয়ে তিনি আরও বেশি ক্ষুব্ধ হন আর তার দৃষ্টি হয়ে ওঠে আরো চঞ্চল! ক্ষিপ্র হাতে তিনি আমার হাত থেকে শার্টটা নিয়ে ছুড়ে ফেলেন মাটিতে। আমাকে অবাক করে তিনি দু-হাতে তার শিশ্ন উঁচিয়ে মূত্র বিসর্জন করেন শার্টের ওপর! তারপর মূত্রবিসর্জন শেষ হওয়ামাত্র তিনি দৌড় দেন অরণ্যের দিকে এবং নিমিষের মধ্যে মিলিয়ে যান অরণ্যের গাঢ় সবুজ শরীরে। বেশ কয়েক মুহূর্ত পর আমি অরণ্যের দিক থেকে দৃষ্টি গুটিয়ে আনি মূত্রস্নাত শার্টটার ওপর। শার্ট কোথায়, তিনি তো আমাদের তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা আর সভ্য মানুষের ধর্মের ওপর মূত্র বিসর্জন করে গেছেন!



মাগরিব এর আযানের কর্কশ সুর আমার ভাবুক মনের হলদে পাখিটাকে ফিরিয়ে আনে দাদার কবরে। সর্য ডুবে গেলেও এখনো চারিদিকে আদুরে আলোর পরশ। কবরস্থান এখন সুনসান, কোনো মানুষজন নেই। কবরস্থানের অফিসের লোকজনও হয়তো এখন ভেতরে ইফতারে ব্যস্ত। আমি শেষবারের মতো দাদার কবর স্পর্শ করে উঠে দাঁড়াই। দাদার কাছ থেকে বিদায় নিই, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হাঁটতে থাকি। এখানে বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকের কবর আছে। জীবদ্দশায় তাদের কাউকে কাউকে আমি দেখেছি, দু-একজনের সঙ্গে কথাও বলেছি। কবরস্থানে এলেই দাদার কবরে শ্রদ্ধা জানানোর পর আমি আমার পছন্দের কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের কবরে শ্রদ্ধা জানাই, তাদের সৃষ্টির অতলে ডুব দিয়ে কথা বলি তাদের সঙ্গে। আসলে জীবিত কবি-সাহিত্যিকদের চেয়ে মৃত কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অধিক দৃঢ়! তাদেরকে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি এই জন্য যে তারা অবিমৃশ্যকারী বা মিথ্যাবাদী নন; আর যেখানে অবিমৃশ্যকারিতা নেই, সাজানো মিথ্যার চাষ নেই, সেখানেই আমার সম্পর্ক দৃঢ় হয়। তা বলে মানুষ হিসেবে খুব নিকৃষ্ট, সাম্প্রদায়িক আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছিলেন; এমন কবি-সাহিত্যিকদের কবরেও আমি শ্রদ্ধা জানাই না।

আমি একজন উঠতি লেখক হলেও বিখ্যাত শিল্পী বা কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্য আজকাল এড়িয়ে চলি। কারণ এই যে তাদের সঙ্গে কিছুদিন মেলামেশার পরই তাদের স্বভাবের উৎকট দূর্গন্ধ আমার চিত্তকে আহত করে। দেখি যে তারা পারিবারে, ঘরোয়া আড্ডায়, সাহিত্যসভায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ পরে অবতীর্ণ হন। তাদের চরিত্রের বৈপরীত্য দেখে, তাদের দ্বিচারিতা দেখে আমি রীতিমতো হাঁ হয়ে যাই! আমি তাদের সৃষ্টির সঙ্গে মানুষটিকে কিছুতেই আর মেলাতে পারি না। অধিকাংশের ভেতরেই প্রভু হবার বিপুল বাসনা, বন্ধু হতে চায় না কেউ। অধিকাংশ-ই একে অন্যের কুৎসা করে আর তিন পেগ তরল আগুন পেটে পড়লেই কেউ কেউ অন্যকে গালিগালি করে, অন্যের সৃষ্টি খারিজ করে দিয়ে বোঝাতে চায় যে সে যা সৃষ্টি করেছে তাতে এরই মধ্যে তার অমরত্ব নিশ্চিত! এছাড়া নানা ধরনের প্রতারণা, অন্যের ক্ষতি করবার প্রবণতা, নারীলিপ্সা, অর্থলিপ্সা এসব তো আছেই!

এইসব নানাবিধ কারণে তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা কিছুতেই অটুট রাখতে পারি না, আর তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাও আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে আমি সকল সঙ্গ ত্যাগ করে একলা চলার নীতি গ্রহণ করেছি। আর এই উপলব্ধি আমার হয়েছে যে বিখ্যাতজনদের বেশি ঘনিষ্ঠ হতে নেই, তাতে পিঠ চাপড়ানি জুটলেও নিজের প্রতিভা নষ্ট হবার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। বুঝেছি যে অন্য অনেক কর্মের মতো সৃজনশীল কর্মও একটা দক্ষতা; একজন ব্যক্তি নিজেকে ঘষামাজা করতে করতে একটা পর্যায়ে গিয়ে হয়তো সৃজনশীলতায় দক্ষ হয়ে ওঠেন, তিনি দারুণ কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু তিনি দারুণ কিছু সৃষ্টি করছেন মানেই যে তিনি নিজের ভেতরের বিশ্বাস থেকে করছেন বা ব্যক্তি মানুষটির সততাই যে তার সৃষ্টিতে প্রতিফলিত হচ্ছে, এমনটা ভাবা মানে বোকার স্বর্গে বাস করা, আমি অনেকদিন ওই বোকাস্বর্গে বাস করেছি! আসলে সবই ওই দক্ষতা, একজন পকেটমার যেমন চেষ্টা করতে করতে দক্ষ হয়ে ওঠে, সৃজনশীল মানুষও তাই। দক্ষ হলেই যে তার ভেতরে সততা থাকবে, তিনি একজন সৎ মানুষ হবেন তা নয়; তার সৃষ্টির সততা, ভালমানুষিতা, মিষ্টবচন, মহানুভবতা ইত্যাদি আরোপিতও হতে পারে। দক্ষতা অর্জন করলে সৃষ্টিতে নানান গুণের শীলিত বিন্যাস সম্ভব। এসব বুঝতে আমার বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছে। আর বোঝার পরেই বিখ্যাত ব্যক্তির সাহচার্য পাবার মোহ আমার কেটে গেছে। মনে হয়েছে যে বিখ্যাত ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে থেকে কেবল তার সৃষ্টির রস আস্বাদন করাই উত্তম, কাছে গেলেই বিপদ বাড়ে, বাড়ে মানসিক পীড়ন। তার সৃষ্টির প্রতিও বিতৃষ্ণা জন্মায়। অবশ্য সবাই যে এই রকম তা নয়, সংখ্যায় খুব কম হলেও কেউ কেউ আছেন ব্যতিক্রম; যাদের মুখের ওপর আলাদা মুখোশ নেই; দূর থেকে আমি তাদেরকে শ্রদ্ধা জানাই!

মাস ছয়েক আগে একজন কবি পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তখন। সেই সূত্রে তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সমাজভাবনা অনেক বিষয়েই আমি অবগত। মুসলমানের সন্তান হলেও তিনি নামাজ পড়েন না, রোজা রাখেন না, সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন না। ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় মোল্লাদের গালাগাল করতেন, কোরানকে আখ্যা দিতেন পাগলা মুহাম্মদের প্রলাপ বলে, মুহাম্মদকে বলতেন জঙ্গিবাদের জনক, আড্ডার মাঝখানে বা কবিতা পড়ার সময় আযান শুরু হলে বিরক্ত হয়ে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে মুয়াজ্জিনকে গালি দিতেন। অথচ সেই তিনি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে এই কথাগুলো লিখেছিলেন-‘ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে না। একটি স্বার্থান্বেষী মহল পবিত্র কোরানের ভুল ব্যাখ্যা করে দেশে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাচ্ছে।’

আমি রীতিমতো থ হয়ে গিয়েছিলাম তার লেখা পড়ে! কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় তার বাসায় ব্যক্তিগত আড্ডায় আমি কোরান হাদিসের কয়েকটি আয়াত তার সামনে তুলে ধরি-

‘অতএব যখন তোমরা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে মোকাবিলা কর তখন তাদের ঘাড়ে-গর্দানে আঘাত করো। শেষ যখন তোমরা ওদেরকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করবে তখন ওদেরকে শক্ত করে বাঁধবে। তারপর তোমরা ইচ্ছে করলে ওদেরকে মুক্ত করে দিতে পারো বা মুক্তিপণ নিয়েও ছেড়ে দিতে পারো। যতোক্ষণ না ওরা অস্ত্র সংবরণ করে, তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এ-ই বিধান। এজন্য যে আল্লাহ ইচ্ছা করলে ওদেরকে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি চান তোমাদের এককে অপরকে দিয়ে পরীক্ষা করতে। যারা আল্লাহ’র পথে নিহত হয় তিনি কখনই তাদের কাজ নষ্ট হতে দেন না।’ (আল কোরান, সুরা মুহাম্মদ, আয়াত-৪)।

‘স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাদের ওপর প্রত্যাদেশ করেন, “আমি তোমাদের সাথে আছি, সুতরাং বিশ্বাসীদেরকে সাহস দাও।” যারা অবিশ্বাস করে আমি তাদের হৃদয়ে ভয় ঢুকিয়ে দেব। সুতরাং তোমরা তাদের ঘাড়ে ও সারা অঙ্গে আঘাত করো।’ (আল কোরান, সুরা আনফাল, আয়াত-১২)।

‘তোমরা তাদেরকে হত্যা করোনি, আল্লাহ তাদেরকে মেরেছিলেন, আর তুমি যখন (কাঁকর) ছুড়েছিলে তখন তুমি ছোড়োনি, আল্লাহ-ই তা ছুড়েছিলেন; তার তা ছিল অবিশ্বাসীদেরকে ভাল পুরস্কার দেওয়ার জন্য। নিশ্চয় আল্লাহ সব শোনেন, সব দেখেন।’ (আল কোরান, সুরা আনফাল, আয়াত-১৭)।

‘যারা আমার উদ্দেশে জিহাদ করে আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করবো। আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাকেন।’ (আল কোরান, সুরা আনকাবুত, আয়াত-৬৯)।

হাদিস থেকেও উল্লেখ করেছিলাম মুহাম্মদের উক্তি- ‘আমি বাদ্য-যন্ত্র ও মুর্তি ধ্বংস করার জন্যে প্রেরিত হয়েছি।’

তারপর তাকে প্রশ্ন করি, ‘আমি জানি এই আয়াতগুলোসহ কোরান-হাদিসের আরো অনেক ধ্বংসাত্মক উক্তি সম্পর্কে আপনি অবগত, ধর্ম সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত বিশ্বাসও আমি জানি, সব জেনেও আপনি অমন একটি স্ববিরোধী প্রবন্ধ কেন লিখলেন?’

তখন তার চার পেগ চলছে, আমার প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর তিনি গড়গড় করে এই বিষয়ে যে দীর্ঘ বয়ান আমাকে শোনান তার সারসংক্ষেপ এইরকম- ‘প্রবন্ধটা আমি নিজের ইচ্ছায় লিখিনি। ওটা ছিল একটা ফরমায়েশি কাজ। পত্রিকা থেকে জঙ্গিবাদের বিপক্ষে এই ধরনের একটা প্রবন্ধ আমাকে লিখতে বলা হয়েছিল, কেননা ওরা জানে যে পাঠকের ওপর আমার বেশ প্রভাব আছে। ওদের প্রস্তাবে আমি না করতে পারিনি; কারণ, ওরাই আমাকে প্রমোট করে বড়ো কবি বানিয়েছে। যে পাঁচ-দশজন মানুষ আজ আমাকে চেনে-জানে বা সম্মান করে, যে সকল প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন আমাকে সম্মাননা দেয়; তা ওদের জন্য। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা সংবাদপত্রে আমি ধর্ম বিষয়ক লেখালেখি থেকে বিরত থাকলেও এবার ওদের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে পারিনি। ধর্ম সম্পর্কে সত্য কথা শোনার মতো সুশিক্ষিত এবং সহনশীল নয় আমাদের সমাজ। আমাদের সমাজ মিথ এবং মিথ্যায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, বংশ পরম্পরায় মস্তিষ্কে বহন করে চলেছে কু-সংস্কার। প্রগতি এবং সত্যের জন্য আমাদের সমাজ এখনো তৈরি হয়নি। ফলে, ধর্মটাকে পুঁজি করে বাণিজ্য করে নিচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যমের লোকজন। আর তার বলি হচ্ছে কারা জানো? আমরা, আমার মতো কিছু প্রগতিশীল মানুষ; গণমাধ্যম যাদেরকে আখ্যা দিয়েছে বুদ্ধিজীবি, সমাজের মানুষও আমাদের সেভাবেই চেনে। যেহেতু আমাদের ভেতরেও অদম্য নেশা ও আশা থাকে জনপ্রিয় হওয়ার, গণ্যমান্য বুদ্ধিজীবির কাতারে পৌঁছনোর, ঘন ঘন পত্রিকায় লেখা ছাপানো আর মানুষের প্রশংসা পাবার, টেলিভিশন-সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার প্রদানের, সভা-সমিতির চেয়ার অলংকৃত করার; ফলে ওরা আমাদের এই দূর্বল জায়গাটাকে ব্যবহার করে ওদের ব্যবসায়িক স্বার্থে, কারণ ওদের টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্রের জন্য আসল হোক বা নকল হোক বুদ্ধিজীবি তৈরি করা প্রয়োজন। রাজনীতিবিদদেরও বুদ্ধিজীবি প্রয়োজন তাদের সভাসমিতির ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি এবং দল ও ব্যক্তির গুণগান করানোর জন্য। এজন্য ওরা আমাদের সামনে লোভের জাল বিছায়, আর আমরা সহজেই তাতে জড়িয়ে পড়ি। একবার জালে জড়িয়ে গেলে আর বের হবার উপায় থাকে না। তুমি বের হতে চাইলেও লোভ তোমাকে বের হতে দেবে না। যার ফলে সমস্ত সত্য নিজের মধ্যে গোপন করে একটা দুধভাত টাইপের বুদ্ধিজীবির ভেগ ধরে থাকতে হয়। তবে এখন এটাই সিস্টেম হয়ে দাঁড়িয়েছে বুঝলে, সমাজ তো চিরকাল একই রীতিনীতি আর মূল্যবোধ নিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না; আজ যা আমরা অনৈতিক বলে ভাবছি, কাল হয়তো তাই-ই নৈতিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবে; পেয়েছেও তাই। পুঁজিবাদের এই ঘোর দৌড়ের দিনে সবকিছু দ্রুত ভেঙেচুরে যাচ্ছে; অন্যায়, অনৈতিকতার ওপরে পুঁজিবাদের জৌলুসের রঙ পড়ে তা শুদ্ধ হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা জেনেশুনে পাপ করে গায়ে-মাথায় গঙ্গাজল কিংবা গোলাপজল ছিটিয়ে পাপ মোচনের মতো আর কী! পুঁজিবাদের জৌলুস হচ্ছে আধুনিক যুগের নতুন ধরনের গঙ্গাজল বা গোলাপজল, অন্যায়কেও ন্যায় হিসেবে মানুষের চেতনায় ঢুকিয়ে তা প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারে! ফলে এই সিস্টেমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলাটাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ।’

জানতে চাই, ‘আত্মগ্লানি হয় না? নিজেকে ঠকানোর জন্য নিজের ওপর ঘৃণা হয় না?’

হো হো করে হেসে তিনি বলেন, ‘ধুর! কীসের আত্মগ্লানি, কীসের ঘৃণা! অর্থ-জনপ্রিয়তা এমন এক মাদক যা একবার তুমি পান করলে ভুলে যাবে সব নীতি-নৈতিকতা! আর বললাম তো পুঁজিবাদের গোলাপজলের কারণে এটাই এখন প্রতিষ্ঠিত নব্য মূল্যবোধ। হ্যাঁ, আগে মাঝে মাঝে খানিকটা আত্মগ্লানি হতো, কিন্তু এখন আর হয় না। কেন হবে? অর্থ পাচ্ছি, আমি যা-ই লিখছি পাঠক গোগ্রাসে গিলছে। আমার বাপ-দাদা কোনোদিন বিজনেস ক্লাস বাসেই চড়েনি, তাদের ঘরের ছেলে হয়ে আমি সরকারি-বেসরকারি ট্যুরে বিমানে চড়ে সারা বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছি, নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর সাহিত্যসভায় যোগ দিচ্ছি। এসব পেতে হলে তোমাকে কলমে লাগাম পরাতেই হবে। তুমি শাসকের বিরুদ্ধে লিখতে পারবে না, ধর্মের বিরুদ্ধেও না। এখন আমি ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের বিরুদ্ধে লিখলে পাঠক হারাবো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাখ লাখ পাঠক আমাকে ধিক্কার দেবে, গণমাধ্যম আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সরকার আমাকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন কাউকে বসাবে আমার জায়গায়, আমি অচ্ছুত হয়ে পড়বো, আমার গর্দানের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরবে চাপতিবাজরা। কেন জেনে বুঝে এই আত্মহত্যা আমি করবো? আমার দুটো সন্তান আছে, স্ত্রী আছে; ওরা ভেসে যাবে। তাই আপোস করে বেঁচে থাকা। আর কে না আপোস করছে বলো? এককালের বাঘা বাঘা সব মার্ক্সবাদীরা এখন এমন ভেগ ধরেছে যে তাদেরকে আর চিনতেই পারি না, মনে হয় এরা কোনোকালেও মার্ক্সবাদী ছিল না, জন্মলগ্ন থেকেই এরা কট্টর ডানপন্থী! সমাজ এখন দ্রুত পরিবর্তনশীল, তুমি যদি এই পরিবর্তনটা ধরতে না পারো তবে তুমি বোকা, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না; তুমি ব্যর্থ হবে। শোনো কিছু করতে হলে মিডিয়ার সাপোর্ট তোমার লাগবেই, মিডিয়া যাকে প্রমোট করে আমজনতা তাকে নিয়েই হইচই করে, তার বই কেনার জন্য বইমেলায় স্টলের সামনে পাঠকেরা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে; লেখার গুণ নয়, কে বড়ো লেখক আর কে মাঝারি লেখক তা নির্ধারণ করে মিডিয়া। সবাই এখন স্রোতের একদিকে ভেসে চলেছে বুঝলে, যে এই স্রোতে গা না ভাসাবে সে নির্বোধ! সে সুবিমলমিশ্র; সুবিমলমিশ্র জীবনে কিচ্ছু পায়নি, না অর্থ না জনপ্রিয়তা। স্বীকার করছি যে তিনি অসম্ভব ভাল লেখেন, আমি তাকে শ্রদ্ধাও করি; কিন্তু আমাদের মতো দু-চারজন লেখক-কবি ছাড়া তাকে কে চেনে বলো?’

গ্লাসে আরেক পেগ ঢালতে ঢালতে তিনি বলেন, ‘তোমার এখন বয়স কম, তাই নীতি-নৈতিকতা বিষয়ে তুমি অটল। কিন্তু যখন তুমি বিয়ে করবে, সংসার-সন্তান হবে তখন বুঝবে যে আমাদের মতো দেশে এইসব নীতি-নৈতিকতা ফালতু আবেগ ছাড়া কিছুই নয়। তখন স্ত্রী-সন্তানের কথা ভেবে জীবন-জীবিকার তাগিদে তুমিও আপোস করবে। তুমি আমার কাছের মানুষ তাই তোমাকে আগে থেকেই আমি পথ বাতলে দিচ্ছি। অযথা ধর্মের বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে লিখে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরো না। ধর্ম কিংবা রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। সৈয়দ শামসুল হককে দেখ, রাজনীতি গুলে খেয়েছেন, তার স্ট্র্যাট্রেজি’র কাছে ঝানু রাজনীতিকও হার মানতে বাধ্য! শাসকের সঙ্গে বিটে বিটে পায়ে পা মিলিয়ে পথ চলেছেন, আবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক সময়ে পুরনো শাসকের হাত ছেড়ে নতুন শাসকের হাত ধরতেও তার তাল ভঙ্গ হয়নি; পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহকে নায়ক বানিয়ে কবিতা লিখেছেন আবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও লিখেছেন! পাকিস্তান আমলে লিখেছেন জিহাদী কবিতা, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং পাকিস্তানের সমর্থনে লেখালেখি করেছেন, শুধু তাই-ই নয় যে পঞ্চান্নজন দালাল বুদ্ধিজীবি পাকিস্থানের পক্ষে এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই তালিকার পঞ্চাশ নম্বরে তার নাম ছিল এবং তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন।’

আমি কিছুটা অবিশ্বাসের চোখে তাকাই, সৈয়দ শামসুল হকের বিবৃতিতে স্বাক্ষর করার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সেটা বুঝতে পেরে তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে? ভাবছো যে লোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এতো এতো গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখেছে সে কেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করবে? চাঁদ-তারা ছেড়ে লাল-সবুজে মাথা গলিয়ে দেশপ্রেমে গদগদ ওসব মুক্তিযুদ্ধের গান-কবিতা-উপন্যাস লিখেছেন স্বাধীনতার পরে, পরিস্থিতি বুঝে দু-চারটা হয়তোবা মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকেও লিখে থাকতে পারেন। আমার কথা বিশ্বাস না হয় তুমি ড. আহমদ শরীফ, কাজী নূর-উজ্জামান আর শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ বইটি প’ড়ে দেখো।’

গ্লাসে চুমুক দিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হাসেন তিনি, তারপর আবার বলেন, ‘পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি জলপাই রঙ ধারণ করেন। মেজর জিয়ার আমলে গুলশানে একটি বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন, স্বৈরাচার এরশাদ তার বাড়িটি পুনঃনির্মাণ করে দিয়েছিলেন। সাহিত্যাঙ্গনে এমন কথাও শোনা যায় যে এরশাদের নামে বেরোনো কবিতাগুলো যারা লিখে দিতেন, সৈয়দ শামসুল হক তাদেরই একজন। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, আমরা সাংস্কৃতিক কর্মীরা তখন মাঠে নেমে প্রতিবাদ করছি গান-কবিতা-নাটকের মাধ্যমে; আর সৈয়দ শামসুল হক তখন এরশাদের তৈরি করে দেওয়া বাড়িতে সুখনিদ্রা দিচ্ছেন। আবার নব্বই পরবর্তীতে স্বাধীনতার পক্ষের মূল স্রোতে ঢুকে পড়েছেন সুড়সুড় করে, এখন তিনি আওয়ামীলীগের সভাকবি! কাল এই দেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেই খেলাফতের নায়ককে নিয়েও বীররসে পরিপূর্ণ কবিতা লিখবেন এবং তাদের দলে ভিড়ে যাবেন, পাকিস্তান আমলের মতো আবারো জিহাদি কবিতা লিখবেন; এটাও এক ধরনের স্মার্টনেস! এই দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে আধিপত্য ধরে রাখতে হলে এটা খুব প্রয়োজন। বুদ্ধিমান মানুষেরা সময়ের নার্ভটা সঠিক সময়ে ধরতে জানেন বুঝলে, তাই তারা সফল হন। দ্যাখো, এতোবার আদর্শ বদলানোর পরও প্রধান প্রধান পত্রিকাগুলো তাকেই বেশি ফোকাস করে, সরকার তাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়, জনপ্রিয় কবি-সাহিত্যিকেরা তাকে মাথায় তুলে রাখে। বাঙালী আত্মভোলা এক জাতি বুঝলে, তুমি আজ কী করছো কাল কেউ তা মনে রাখবে না। বুদ্ধিমানেরা এটা জানে বলেই তারা সময়-সুবিধা মতো আদর্শ বদলায়। তুমিও ওইসব জোলো এথিকস বাতাসে ভাসিয়ে দাও নইলে কিচ্ছুটি পাবে না জীবনে, শেষ বয়সে অনুতপ্ত হয়ে নিজের আঙুল নিজে কামড়াবে; কিন্তু তখন হয়তো কিচ্ছু করার থাকবে না। এসব পরামর্শ আমি কাউকেই দিই না, কিন্তু তুমি আমার খুব কাছের মানুষ, লাইক মাই ইয়াঙ্গার্ ব্রাদার, তোমাকে ভালবাসি-স্নেহ করি তাই তোমাকে বলছি। জীবনে বেঁচে থাকতে যদি তুমি কিছু না পাও, মরার পর মানুষ তোমার সৃষ্টি নিয়ে মাথায় করে নাচলো না দৌড়লো তাতে তোমার কিচ্ছু আসে-যায় না!’

আমি আর তাকে কিছু বলিনি। কারণ আমি জানি তিনি যা করছেন সচেতনভাবে জেনে-বুঝেই করছেন। অর্থ, ক্ষমতা আর জনপ্রিয়তার মাদক পান করেছেন তিনি, আমৃত্যু এই নেশা থাকবে। নষ্ট আর বিপথগামী সমাজের অধিকাংশ মানুষ মুখ বুজে সকল অন্যায় মেনে নিয়ে সত্যের পথ থেকে সরে আসে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ভয়ে, একা হবার ভয়ে; কিন্তু এই নষ্ট-ভ্রষ্ট, বিপথগামী আর ক্রমাগত পতোনোন্মুখ সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্য ও ন্যায় আঁকড়ে ধরে একা হবার যে কী অপার আনন্দ, কী যে মুক্তির স্বাধীনতা ও সুখ, মাথা বন্ধক দেওয়া এইসব জ্ঞানপাপীরা তা জানে না!

আমি একজন কবির কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মুহূর্ত খানেক দাঁড়াই, তারপর আবার হাঁটতে শুরু করি। এই কবি ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন, ব্যক্তিজীবনে নিয়ম মেনে ধর্মকর্ম পালন না করলেও তিনি ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং কিছুটা ইসলাম বাতিক তার ছিল। তার কবিতায় বারবার উঠে এসেছে প্রেম এবং কাম; অথচ ইসলামে এসবের অনুমোদন নেই। ইসলাম কেবল সেই কবিতাকেই অনুমোদন করে যা কোরান-হাদিসের মূল্যমান, মূল্যবোধ এবং ইসলামী ভাবাদর্শ অনুসরণ করে লেখা। মুহাম্মদ কবি লবীদের কবিতা পছন্দ করতেন, কবি লবীদের কবিতার প্রশংসা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আরবের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে সত্য কবিতাটি রচনা করেছে লবীদ- জেনে রাখো আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুই বাতিল।’

যদিও কবি লবীদ এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন তথাকথিত জাহেলী যুগে এবং তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে।

একবার মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা মদিনা থেকে আশি মাইল দূরের আরজ নামক এক পল্লীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একজন কবি এসে তাদেরকে কবিতা শোনাতে থাকেন, কবিতা শুনে মুহাম্মদ তার অনুসারীদের বলেন, ‘এই শয়তানটাকে আটক করো। কবিতা দিয়ে পেট ভরার চেয়ে পুঁজ দিয়ে ভরা ভাল, যে পুঁজ তার যকৃতে পচন ধরায়।’

বর্তমান কালের কোনো কোনো আলেমের মতে, সেই কবির কবিতা অশ্লীল ছিল, তাই মুহাম্মদ তাকে শয়তান আখ্যা দিয়ে আটক করতে বলেছিলেন। কবিতা চর্চা করা মুবাহ যদি তা ইসলামী আদর্শে লেখা হয়। আবার অনেক আলেমের মতে, কবিতা চর্চা করা মাকরূহ।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে ধরনের সাহিত্যের চর্চা হয়, বলা বাহুল্য যে তার অধিকাংশই ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করে নয়; বস্তুত ইসলামে শিল্প-সাহিত্য চর্চার পথ রুদ্ধ। তারপরও ইসলামের ছায়াতলে থেকেই এদেশের বহু মানুষ শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করেছেন এবং এখনো করছেন। গত আড়াই দশক ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ। নানা ধর্মের নানা পেশার মানুষ তার বই কিনেছেন, পাঠ করেছেন এবং এখনো করছেন। মাদ্রাসার হুজুর থেকে শুরু করে ইংলিশ মিডিয়ামের ইয়ো ইয়ো ছাত্রটিও তার পাঠক। আমি অনেক মুসলিম বাসার বুকশেলফে দেখেছি কোরান শরীফ, সহি মুসলিম শরীফ, বোখারী শরীফ, এ ধরনের কয়েকখানা ধর্মীয় বইয়ের পাশে হুমায়ুন আহমেদের হিমু কিংবা মিসির আলী সিরিজের কয়েকখানা বই; এর বাইরে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষার কয়েকখানা পুরোনো পাঠ্যবই, ইন্টার্নি রিপোর্ট, দু-একখানা ডায়েরি; সারা বুকশেলফে এর বাইরে আর কোনো বই নেই; শেলফের শূন্যস্থান পূরণ করা হয়েছে দু-একটা ট্রফি কিংবা ক্রেস্ট, মগ-প্লেট, করো ছোটবেলার একখানা বাঁধানো ছবি ইত্যাদি দিয়ে। এই ধরনের বুকশেলফ বর্তমান মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের আভিজাত্য এবং মূল্যবোধের প্রতীক! বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানের কাছে এখন কোরান-হাদিসের পরেই হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের স্থান! হুমায়ুন আহমেদ ধার্মিক ছিলেন, ঈদগায় ঈদের নামাজ পড়ার পর ছেলে কোলে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে তার কুশল বিনিময়ের ছবি ফলাও করে ছাপা হয়েছিল পত্রিকার পাতায়। একবার একটি সাক্ষাৎকারে তিনি লেখক তসলিমা নাসরিনকে খোঁচা দিয়ে যা বলেছিলেন তার বক্তব্য মোটামুটি এরকম, ‘আমাদের দেশের একজন সাহিত্যিক পশ্চিমাদের কাছে জনপ্রিয় হবার জন্য আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে।’

এমন একজন ধার্মিক সাহিত্যিক তার সাহিত্যে যে ধরনের গল্প বলেছেন এবং যেভাবে যৌনতা এনেছেন তা কোনোভাবেই ইসলাম সম্মত নয়। কোরান-হাদিসে এ ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির অনুমোদন নেই। সম্ভবত তার সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হিমু; সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং মজার ব্যাপার হলো একজন ধার্মিক মানুষ হয়েও তিনি হিমুর গায়ে পরিয়ে দিয়েছেন হারাম পোশাক হলুদ পাঞ্জাবি, মুসলমান পুরুষের জন্য হলুদ পোশাক পরা হারাম! হারাম পোশাক পরেও হিমু তার সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র, মাদ্রাসার হুজুর থেকে শুরু করে কোটি কোটি ধর্মান্ধ মুসলমান তার বই কিনে পড়েছে এবং বুকশেলফে কোরান-হাদিসের পাশে কিংবা কাছাকাছি রেখেছে; আর তিনিও তার এই হারাম সৃষ্টির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেছেন এবং তা দিয়ে হারাম মদ্যপান ও আরামে তার ধর্মপ্রাণ জীবন যাপন করেছেন!

বিচিত্র ধরনের জ্ঞানপাপীর বাস আমাদের এই বাংলাদেশে, জ্ঞানপাপীদের স্বর্গরাজ্যও বলা যায়! এদেশে ইসলামবিরোধী অনেক কাজ করেও পার পাওয়া যায়, মুসলমানদের মন জয় করা যায় যদি না ইসলাম সম্পর্কে কেউ সঠিক সত্য কথাটি না বলে। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক সত্য তথ্য ও ইতিহাস সামনে নিয়ে এলেই তার সমূহ বিপদ; স্ব-নামে লিখলে হয় তাকে জেল খাটতে হয়, নয়তো চাপতির কোপে ঘাড় থেকে মাথাটা নেমে যায়; অথবা স্বাধীনভাবে বাঁচতে হলে তাকে দেশত্যাগ করতে হয়।

পৃথিবীর কোনো ইসলামী রাষ্ট্রেই মুক্তচিন্তক বা ইসলামের সমালোচকের কোনো স্বাধীনতা নেই; জেল, নির্বাসন কিংবা মৃত্যুই তার ভবিতব্য। মুক্তচিন্তার মূলোৎপাটনের এই বীজমন্ত্র প্রোথিত করেছিলেন স্বয়ং মুহাম্মদ মদিনার ইহুদি বানু আমর ইবনে আউফ গোত্রের একশো বিশ বছর বয়সী কবি আবু আফাকের রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। মুহাম্মদ এবং তার শিষ্যরা আল-হারিথ বিন সুয়া’দ বিন সামিত নামের এক ব্যক্তিকে খুন করেছিলেন। এই খুনের প্রতিবাদে কবি আবু আফাক একটি কবিতা লেখেন, প্রতিবাদী কবিতা লিখে তিনি মানুষকে জাগাতে চেয়েছিলেন। কবি আবু আফাকের কবিতা যাতে মানুষকে প্রভাবিত করতে না পারে, সে-জন্যই মুহাম্মদ তাকে খুন জন্য ঘাতক নিযুক্ত করেছিলেন। একটা মানুষ কতোটা নৃশংস এবং উৎপীড়ক হলে একশো বিশ বছরের একজন বৃদ্ধ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা লিখে মানুষকে জাগানোর চেষ্টা করতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

শাওয়াল মাসের গরমের রাত, বার্ধক্যপীড়িত কবি ঘরের সামনের আঙিনায় ঘুমিয়ে ছিলেন। হয়তো সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল, অথবা ছিল না; হয়তো আঙিনার পাশে একটা পোয়াতি খেঁজুরগাছ ছিল, অথবা ছিল না। কবি হয়তোবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন কিংবা নিমীলিত চোখে করছিলেন বিগত দিনের স্মৃতিচারণা অথবা অপলক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে সাজাচ্ছিলেন নতুন কোনো কবিতার পংক্তি। আর তখনই মুহাম্মদের শিষ্য ঘাতক সালিম বিন উমায়েরের ধারালো তরবারি গেঁথে যায় কবির বুকে, কলিজা আর পিঠ ফুঁড়ে বেরোয় রক্তমাখা তরবারির মাথা! অসম্পূর্ণ-ই থেকে যায় কবির স্বপ্ন কিংবা স্মৃতিচারণা অথবা পংক্তিমালা!

মুহাম্মদ একইভাবে তার শিষ্য উমায়ের বিন আদি আল খাতমিকে নিযুক্ত করেছিলেন পাঁচ সন্তানের জননী মদিনার কবি আসমা বিনতে মারোয়ানের কলম স্তব্ধ করার জন্য। আসমা ছিলেন বানু উমাইয়া গোত্রের কিন্তু তিনি বিয়ে করেছিলেন বানু খাতমা গোত্রের ইয়াজিদ বিন জায়েদকে। কবি আবু আফাককে হত্যার পর তিনি ইসলাম ধর্ম, মুহাম্মদ এবং তার শিষ্যদের সমালোচনা করেছিলেন, লিখেছিলেন প্রতিবাদী এবং মানুষের ঘুম ভাঙানিয়া এক অসীম সাহসী কবিতা। এক অদম্য সাহসী কবি, হত্যভাগ্য জননী; রাতেরবেলা পাঁচ সন্তানকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন, কনিষ্ঠ সন্তানকে বুকের দুধ পান করাচ্ছিলেন। সেই অবস্থায় তাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে যায় ঘাতক উমায়ের বিন আদি। আকর্ষিক স্তনবৃন্তচ্যুত দুধপানরত সন্তানটি নিশ্চয় কেঁদে উঠেছিল তখন, কিন্তু সে কান্না শুনেও ঘাতক উমায়ের বিন আদি’র হৃদয় আর্দ্র হয়নি, তরবারির আঘাতে সে আসমার বুক-পিঠ এফোঁড়-ওফোঁড় করে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। আসমাকে হত্যার পর ঘাতক উমায়ের বিন আদি সংবাদ নিয়ে ভোরবেলা ছুটে গিয়েছিল মুহাম্মদের কাছে, মুহাম্মদ তাকে সঙ্গে নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি ঘাতক উমায়ের বিন আদিকে ‘বসির’ অর্থাৎ চক্ষুষ্মান উপাধি দেন।

বানু নাভান গোত্রের কাব বিন আল-আশরাফও মুহাম্মদের বদরযুদ্ধ, হত্যা, লুণ্ঠনের সমালোচনা করে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। এরপর তিনি এক মুসলমান নারীকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন, যা ইসলামের জন্য অপমানজনক মনে করেছিলেন মুহাম্মদ। মুহাম্মদের নির্দেশে তার কয়েকজন শিষ্য বন্ধুত্বের ছলনার মাধ্যমে কাব বিন আল-আশরাফকে হত্যা করেছিল। সে-রাত ছিল জ্যোৎস্নাপ্লাবিত, আল-আশরাফ তার নববিবাহিত পত্নীকে নিয়ে শুয়েছিলেন। তারই পালিত ভাই এবং মুহাম্মদের শিষ্য সিলকান বিন সালাম বিন ওয়াকাশ তাকে মাঝরাতে ডেকেছিল, স্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি বাইরে গিয়েছিলেন। সিলকান ছলনা করে তাকে অন্যত্র নিয়ে যায় এবং অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে তাকে হত্যা করে। তারপর তারা আল-আশরাফের ছিন্ন মস্তক ফজরের ওয়াক্তে নিয়ে যায় মসজিদে, মুহাম্মদ তখন নামাজের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, নামাজ আদায় না করেই তিনি বাইরে আসেন, রক্তাক্ত কাটা মস্তকের ওপর থুথু নিক্ষেপ করে শিষ্যদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

সেই থেকে গত চৌদ্দ’শ বছরে আরবভূমিসহ বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিমদের দ্বারা নির্যাতিত, নির্বাসিত এবং নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছে অসংখ্য কবি, মুক্তচিন্তক, সমালোচক। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিতা লেখার অপরাধে ১৯৭৪ সালে প্রথম নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন কবি দাউদ হায়দারকে। এরপর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯৪ সালে নির্বাসিত হয়েছেন তসলিমা নাসরিন। আর মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে গত সাত-আট বছরে অনেকে ইসলামী জঙ্গিদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, অনেকে জেল খেটেছেন এবং এখনো জেল খাটছেন, অনেকে আত্মগোপনে আছেন, আর তরুণ মুক্তমনা লেখকদের কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন এবং এখনো জমাচ্ছেন। অথচ কী আশ্চর্য, এই দেশের অধিকাংশ শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক এই হত্যা, নির্যাতন এবং নির্বাসনের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ; তারা ব্যস্ত শাসকের স্তুতিতে! ইমলামী জঙ্গিরা যে দেশে দাপিয়ে বেড়ায়, লেখকের রক্তে যে দেশের রাজপথ ভেসে যায়, সেই দেশেরই শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ নিয়ে গঠিত নাগরিক কমিটি ‘উন্নয়ন ও সুশাসনের জননী’ আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা প্রদানের আয়োজন করে, আর সেই তথাকথিত নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে উত্তর প্রজন্মের লেখকের রক্তের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে শেখ হাসিনাকে ‘দেশরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে তার হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন আরেক লেখক সৈয়দ শামসুল হক!

আমি এবার আমার কাঙ্ক্ষিত কবির কবরের সামনে এসে ব্যাগ থেকে ফুলের পাপড়ি নিয়ে কবরের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকি ক্রমশ ঘনায়মাণ ছায়া ছায়া অন্ধকারে। স্মৃতিতে জলবিম্বের মতো ভেসে ওঠে কবির কবিতার কিছু পংক্তি। আমি প্রথমে যে কবির কবরের সামনে দাঁড়াই তিনি ধার্মিক ছিলেন আর এখন যে কবির কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি তিনি নাস্তিক ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মৃত্যুর পর দু-জনের মৃতদেহই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে প্রথমে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য শহীদ মিনারে রাখা হয়, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জানাযা শেষে এখানে কবর দেওয়া হয়। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী প্রথমটি বেশরিয়তী কর্ম এবং পরেরটি শরিয়তী কর্ম; কিন্তু দু-জনের ক্ষেত্রেই এই বিপরীতধর্মী দুটি কর্ম পর পর সম্পাদন করা হয়। ধার্মিকের কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করে যেমনি ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হয়, তেমনি নাস্তিক কবির লাশের জানাযা পড়ানোয় তার বিশ্বাসকে অবমূল্যায়ন করা হয়। আজকাল বিজ্ঞ-অজ্ঞ সকলেই মুখে ফ্যানা তুলে ফেলছে একটা কথা বলতে বলতে যে নাস্তিক ব্লগাররা ইসলামের অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে, তারা ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করছে। কিন্তু কোরান-হাদিসের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যে মৃতের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় এটা কি ইসলাম ধর্মের অবমাননা নয়? এতে কি মুমিন বান্দাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে না? আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ হাজারো মানুষ মৃতের কবরে বা মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়; শহীদ মিনারে, স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে; নিঃসন্দেহে এসব শরিয়ত বিরোধী কাজ, অনৈসলামিক কাজ। এরা একদিকে বলছে নাস্তিক ব্লগাররা ইসলাম অবমাননা করছে, আবার অন্যদিকে নিজেরাই ইসলাম অবমাননার অনুষ্ঠানে সাড়ম্বরে যোগ দিচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের ধর্ম- ইসলাম। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকেরা রাষ্ট্রের শরীরে বোরকা পরিয়ে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের পাহাড়-সমতলের মাটির প্রতিটি কণাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে চেয়েছে; গাছপালা, নদী-নালা-খাল-বিল, জীবজন্তু, পশুপখি, জল-বাতাস, বঙ্গোপসাগরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। অথচ কী আশ্চর্য এরাই আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে অনৈসলামিক আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং বিধর্মী কাফেরদের সাথে তাতে অংশ নিয়ে প্রতিনিয়ত মুহাম্মদের সহি ইসলামের অবমাননা করে!

একদিকে রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের বিরাট অংশ এইসব ইসলাম বিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত, তারা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে নিজেদের সুবিধামতো নতুন এক জগাখিচুরি ধরনের অলিখিত শরিয়তের জন্ম দিয়েছে এবং তা পালন করছে; অন্যদিকে জুম্মার খুতবায় কিংবা ওয়াজ মাহফিলে এইসব বেশরিয়তী কাজকর্মের বিরুদ্ধে উস্কানিমুলক বক্তব্য দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করছে মাওলানারা। মাওলানাদের উস্কানিমুলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারকগণ অবগত, কিন্তু এর বিরুদ্ধে তারা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না, কারণ তারা জানেন যে মাওলানারা যেটা বলছেন সেটাই প্রকৃত ইসলাম।

আজকাল কবরে কিংবা শ্মশানে এলেই আমার মনে হয় নাস্তিকদের জন্য আলাদা সমাধিক্ষেত্র প্রয়োজন। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী একজন মানুষ সকল প্রকার ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সারাজীবন মুক্তচিন্তা করে, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই করে, ধর্মান্ধতার শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তির কথা বলে, সাম্প্রদায়িকতার কথা না বলে মানবতার কথা বলে, একটি মাত্র গোষ্ঠীর উন্নতির কথা না বলে সমগ্র মানবজাতির উন্নতির কথা বলে। এমন একজন মানুষের মৃত্যুর পর কোনো ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে তার দেহের শেষকৃত্য করা মানে তার সারাজীবনের বিশ্বাস, তার চিন্তা, তার সততা, তার মূল্যবোধ, তার জীবনদর্শন ও আদর্শকে তীব্রভাবে অপমান করা। একজন নাস্তিক জীবদ্দশায় তার মরনোত্তর দেহ দান করে যেতে পারেন, কিন্তু কারো কারো তো এই আশাও থাকতে পারে যে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন মাটিতে। কিন্তু যেহেতু নাস্তিকদের জন্য কোনো আলাদা সমাধিক্ষেত্র নেই, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি মৃত্যু পরবর্তী তার দেহের করণীয় বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দিয়ে যান না অথবা দিলেও তার পরিবারের লোকেরা সমাজের কথা বিবেচনা করে ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে একজন ধার্মিকের দেহের মতোই তার দেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে এবং পরবর্তীতে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতাও করে সকল ধর্মীয় রীতি মেনে। এটা একজন মৃত নাস্তিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নয়, তাকে ভীষণভাবে অসম্মান করা।

সঙ্গত কারণেই নাস্তিকদের জন্য আলাদা সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করা এখন সময়ের দাবি। উন্নত বিশ্বের কোনো কোনো দেশে তা সম্ভব হলেও আমাদের মতো ইসলামিক রাষ্ট্রে তা কল্পনাতীত। বর্তমানে কোটি কোটি ধার্মিকের ভিড়ে এই চাওয়া পূরণ হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আজ না হোক, বিজ্ঞানের আলো আরো বিস্তৃত হলে, মানুষ আরও সুশিক্ষিত এবং সভ্য হলে আগামীর কোনো এক শতাব্দীতে আমাদের এই ভূ-খণ্ডে নাস্তিকদের জন্য আলাদা সমাধিক্ষেত্র গড়ে উঠবেই।

(চলবে....)


মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১১:২৮

রাজীব নুর বলেছেন: জন্মান্তর পড়ছি। লেখা ভালো লাগছে।

৩০ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৩:১৬

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.