নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- সাত)

০৬ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:৫৫

পাঁচ

আমার বন্ধু ফরহাদ তখন ফুলার রোডের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোয়ার্টারে থাকত। ফরহাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক ছিল, পরবর্তীকালে দেশের রাজনীতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-রাজনীতির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ফরহাদ পদোন্নতি পেয়ে সহকারি অধ্যাপক হবার পর এক ছুটির দিনে সপরিবারে আমাকে এবং আরও কয়েকজন বন্ধুকে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ করেছিল ওর কোয়ার্টারে। সপরিবারে নিমন্ত্রণ করলেও আমি একাই গিয়েছিলাম, তপতীকে নিমন্ত্রণের কথা জানাইওনি। ঢাকা শহরে কোনো বন্ধু কিংবা সহকর্মী কোনো অনুষ্ঠানে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করলেও আমি একাই যেতাম নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে, তপতীকে জানাতাম না, যাবার সময় নিউমার্কেট থেকে উপহার কিনে নিতাম।

একবার তপতীর মাসতুতো বোনের বিয়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম মাগুরা। তুচ্ছ এক কারণে ঘরভর্তি লোকের সামনে তপতী আমায় ধমক দিয়েছিল। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গিয়েছিল। এরপর থেকে কী নিমন্ত্রণে কী বিনা নিমন্ত্রণে, ওর আত্মীয়-স্বজনবাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ছেড়ে দিই আমি। আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন বাড়িতেও ও যেত না। নিমন্ত্রণ থাকলে ওর আত্মীয়বাড়িতে ও যেত, আমার আত্মীয়বাড়িতে আমি যেতাম। এই যে ওর আত্মীয়বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিই, এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়। কিন্তু নিজের সম্মান বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। তপতী আচরণের মাধ্যমে ওর আত্মীয়দের বোঝাতে চাইতো যে আমি সর্বদা ওর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত! শুধু আত্মীয়বাড়িতেই নয়, ওর সঙ্গে আমি শপিংয়ে যাওয়াও কমিয়ে দিই একটা পর্যায়ে। মতের অমিল হলে দোকানদারদের সামনেই আমাকে ধমক দিত, যাচ্ছেতাই ব্যবহার করত। হুটহাট একটা অপ্রীতিকর কথা বলে দেওয়া ওর স্বভাব, সেটা আমার ক্ষেত্রেই হোক, কিংবা অন্য কেউ। আমার আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই ওকে এড়িয়ে চলত, কারণ তারা ওর কথায় আঘাত পেয়েছিল, মনঃখুন্ন হয়েছিল। আমি অনেকবার ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, কাউকে কিছু বলার আগে ভাবা উচিত সেই মানুষটি কষ্ট পাবে কি না, কিংবা সে অপমানিত বোধ করবে কি না। কোনো লাভ হয়নি তাতে। এছাড়াও ওর চলনে-বলনে বড়লোকি ভাব ছিল প্রকট, বড়লোকি জাহির করতে অজস্র মিথ্যে এবং অবাস্তব কথা বলত, লোকে ওর এসব মিথ্যে এবং অবাস্তব কথা বুঝতে পেরে আড়ালে হাসত, কিন্তু সেটা ও বুঝতে পারত না, বোঝাতে গেলে ঝগড়া করত আমার সঙ্গে। ওর এই সব আচরণে আমি ভীষণ বিব্রতবোধ করতাম। ফলে আমি কোনো বন্ধু বা সহকর্মীর বাসায় ওকে নিয়ে যাবার সাহস পেতাম না মানুষের সামনে বিব্রত-অপমানিত হবার আশঙ্কায়।
নিমন্ত্রণ খেয়ে আড্ডা-গল্প শেষে বিকেলে বাসায় ফিরছিলাম হেঁটে। ফুলার রোডের শেষ মাথার কাছাকাছি আসতেই একটা উচ্চস্বর কানে এলো, ‘স্যার....স্যার....।’

দেখি রাস্তার মাঝখান দিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে একটা মেয়ে। মুখটা দেখেই চেনা চেনা লাগলো, তারপর স্মৃতির দরজায় ঘা দিতেই দরজা খুলে গেল- জাহানারা! আগে খুব বেশি চিকন ছিল, এখন স্বাস্থ্য কিছুটা ভালো হয়েছে, গাল একটু ভরাট হলেও চিনতে অসুবিধা হলো না। জাহানারা আমার ছাত্রী, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ত। কিন্তু মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিল।

কাছে এসে বলল, ‘কেমন আছেন স্যার?’
প্রশ্নটি আমার জন্য ভীষণ বিব্রতকর, অথচ প্রায় প্রতিদিনই আমাকে এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো এবং হাসিমুখে মিথ্যে বলতে হতো। দাম্পত্য জীবন অসুখী হলে ভালো থাকা যায় না। তবু বরাবরের মতোই বললাম, ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘আছি স্যার, চলে যাচ্ছে জীবন।’
‘চলে যাচ্ছে কেন! তোমাদেরই তো ভালো থাকার বয়স।’
‘মেয়ে হয়ে জন্মেছি স্যার, তাও আবার দরিদ্র পরিবারে, চাইলেই কী আর ভালো থাকা যায়!’
কী বলবো ওকে, সত্যিই তো, আমাদের দেশের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের পক্ষে ভালো থাকাটা একটু বেশি-ই কঠিন!
বললাম, ‘তুমি কি ঢাকাতেই থাকো?’
‘হ্যাঁ স্যার। স্যার, আপনি এখন কোথায় থাকেন?’
‘আমিও এখন ঢাকাতেই থাকি। বদলি হয়ে এসেছি ঢাকা কলেজে। শুনেছিলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি তো লেখাপড়ায় খারাপ ছিলে না। বিয়ের পরও তো লেখাপড়া করা যেত, কত মেয়ে বিয়ের পর লেখাপড়া করছে।’

একটুক্ষণ চুপ করে রইল জাহানারা, তারপর বলল, ‘স্যার, বিয়ের পর আমাকে পড়ানোর কথা থাকলেও এক পর্যায়ে আমার বর এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে সংসারের কাজে মন দিতে বলে, আমি প্রতিবাদ করলে তারা আমার বই-খাতা পুড়িয়ে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। আমি মেনে নিতে পারিনি, প্রতিবাদ করলে আমার বর আর শাশুড়ি মারধর করত। আমি কনসিভ করেছিলাম, একদিন আমার বর আর শাশুড়ি মিলে এমন মারধর করে যে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, আমার গর্ভের সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায় স্যার। হাসপাতাল থেকে আমি আর শ্বশুরবাড়ি যাইনি, বাবার বাড়ি ফিরে এসে ডিভোর্স দিয়েছি বরকে। একটা বছর আমার নষ্ট হলেও পরের বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করি, আপনি তখন বদলি হয়ে গেছেন। স্যার, আপনাদের দোয়ায় এখন আমি চারুকলার অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি।’

আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম জাহানারার দিকে। ওর জীবনযুদ্ধের কথা শুনে আমার চোখ ভিজে উঠল। এই বাংলাদেশের কত মেয়েকে যে ওর মতো একইরকম সমস্যায় পড়তে হয় তার ঠিক নেই। কিন্তু সবাই ওর মতো লড়াই করে ফিরে আসতে পারে না। বেশিরভাগ মেয়ের জীবনই নষ্ট হয়ে যায়। ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, ‘তোমার জন্য আমি গর্বিত-আনন্দিত জাহানারা। তোমাকে আমার উপদেশ দেবার কিছু নেই, তুমি নিজেই এমন এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছ যে তোমার গল্প তোমার মতো সংকটে পড়া অনেক মেয়েকে লড়াইয়ের সাহস যোগাবে। আমি শুধু এটুকু বলব, তুমি যখন যে সমস্যায় পড়বে সোজা আমার বাসায় কিংবা ঢাকা কলেজে চলে আসবে। তোমার লড়াইয়ে আমি তোমার পাশে আছি। মনে থাকবে?’

ওর চোখ ছলছল করে উঠল। ঘাড় নেড়ে বলল, ‘জ্বি স্যার।’

আমার বাসার ঠিকানাটা বললাম ওকে। বললাম বটে, কিন্তু আমি জানি যে সত্যি সত্যি জাহানারা যদি আমার বাসায় যায়, তাহলে ও বাসা থেকে বের হওয়া মাত্র তপতীর জেরার মখে পড়তে হবে আমাকে। হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিয়েও যে মুক্তি মিলবে তা নয়। পরে যখন কোনো কারণে আমার ওপর ওর রাগ হবে, আর সেই রাগ যদি কোনো কারণে ঝগড়ায় গড়ায় তাহলে আমাকে আর জাহানারাকে নিয়ে কুৎসিত কথা বলবে। একবার আমি আর তপতী নিউমার্কেট থেকে রিক্সায় আসার পথে ইডেন কলেজের সামনের ফুটপাতে বসা একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তপতী সেটা লক্ষ্য করেছিল। একটু মনোমালিন্য হলেই তপতী সেই প্রসঙ্গ তুলে আমাকে খোঁটা দিত।

তপতী দিলে দেবে খোঁটা, জাহানারার মতো যোদ্ধা মেয়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য শুনবো না হয় কিছু কটু বাক্য!
আমার ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, ব্যাথাতুর জীবনে অনেকদিন পর আনন্দের বন্যা বইয়ে দিল জাহানারা। সত্যি সত্যি আমি অনেক অনুপ্রেরণা পেলাম আমারই ছাত্রীর জীবনের গল্প শুনে।



ঢাকায় জাহানারার সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার যেদিন দেখা হয়, সেই দিনটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে পালা বদলের দিন। দিনটিতে ঢাকার পরিবেশ ছিল অন্য দিনের চেয়ে একটু আলাদা, কিছুটা থমথমে। আমার ডায়েরির পাতায় লেখা আছে সেই দিনের কথা-
৩০ শে মে, ১৯৮১

আজ শনিবার। প্রতিদিনের মতোই ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য সেরে স্নান করে বের হলাম। তারপর বেডরুম থেকে রেডিওটা হাতে নিয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে চেয়ারে বসলাম। রেডিওটা চালু করতেই পল্লীগীতি গান শুরু হলো। কাজের মেয়েটি নাস্তা দিলে হাত ধুয়ে এসে নাস্তা খেতে আরম্ভ করলাম। একটু পরই খবর শুরু হলো, শিরোনাম শুনে ক্ষণিকের জন্য আমার খাওয়া থেমে গেল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খুন হয়েছেন! আমি আবার রুটি চিবোতে শুরু করলাম। বিস্তারিত সংবাদে জানতে পারলাম- ভোররাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল আর্মি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে গুলি করে হত্যা করেছে। খবরটা শুনে আমি দুঃখও পেলাম না, আনন্দিতও হলাম না, যেন এমন একটি ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়! আমার এমন স্বাভাবিক থাকার কারণ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সংস্কৃতি এবং জিয়াউর রহমানের কর্ম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সময় থেকেই সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খল-উশৃঙ্খল, মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যা করেছে সেনারা, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সেনাবাহিনীতে একের পর এক ক্যু হয়েছে, কখনো খন্দকার মোশতাক আহমাদ-আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে পুতুল রাষ্ট্রপতি বানিয়ে ক্ষমতার চাবিকাঠি নিজেদের হাতে রেখেছে, আবার কখনো নিজেরাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে। ফলে ক্ষমতালিপ্সু-অশান্ত-রক্তপিপাসু সেনাবাহিনীর মধ্যে যে-কোনো কিছুই ঘটতে পারে এমন ধারণা আমার ছিল। তাছাড়া আমি সেনাবাহিনীর দেশ চালানোর পক্ষে নই, আমি চাই দেশ চালাবেন রাজনীতিকরা, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার। সেনাবাহিনীর দেশ চালানো পাকিস্তানী মডেল। আমরা যুদ্ধ করে অনেক রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের সেনাবাহিনীর বিরাট অংশটি লালন করছে পাকিস্তানী আদর্শ! বঙ্গবন্ধু এবং চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের হত্যাকাণ্ড-ই তার বড় প্রমাণ। আমার ধারণা বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতার হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের হাত থাকলেও থাকতে পারে, থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা জিয়া বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতার খুনিদের বিচার করার পরিবর্তে বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়েছেন, খুনিদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সামাজিক মর্যাদা দিয়েছেন। এর অর্থ এই যে এতবড় নৃশংস হত্যাকাণ্ডতে তিনি অপরাধ হিসেবে দ্যাখেননি, বরং খুনিদেরকে উপঢৌকন দিয়েছেন। এছাড়াও ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির জয়পুরহাট শাখার চেয়ারম্যান রাজাকার আব্দুল আলীমকে রেলমন্ত্রী করেছেন জিয়া। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকার শর্ষিণার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে ১৯৮০ সালে জনসেবার জন্য স্বাধীনতা পদক দিয়েছেন। এমনিভাবে জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী এবং বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার খুনিদেরকে রাজনীতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

সঙ্গত কারণেই জিয়াউর রহমানের মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেনি। আমি শুধু ভাবছি- এই দেশটার কী হবে? বাংলাদেশের বুকে পাথরের মতো চেপে থাকা সেনাশাসনের কি কখনো ইতি ঘটবে না? রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেও আমরা কি প্রকৃত স্বাধীনতার সুখ থেকে বঞ্চিত থাকব?

খাওয়া শেষ হলে খবরের কাগজখানা নিয়ে সোফায় বসলাম। ভোররাতে জিয়া খুন হওয়ায় খবরের কাগজে সেই সংবাদ নেই। এরপর অমিয়কে স্কুলে দিয়ে আমি কলেজে চলে গেলাম। কলেজে যাবার সময় লক্ষ্য করলাম, রাস্তাঘাটে অন্যদিনের চেয়ে ভিড় একটু কম। কিছুটা থমথমে ভাব। রাস্তার চায়ের দোকানে, পথ চলতি মানুষের মধ্যে কেবলই জিয়ার খুন হবার বিষয়ে আলোচনা। কলেজেও সহকর্মীদের মধ্যে একই আলোচনা। আমার সহকর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই জিয়ার ভক্ত। যারা জিয়ার ভক্ত, এরা সাংঘাতিক রকমের মুজিববিরোধী। এদের ভাষায় শেখ মুজিব ভারতের দালাল ছিল, আওয়ামী লীগও ভারতের দালাল। বলা বাহুল্য যে এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল। আমি এদের সঙ্গে কখনো রাজনৈতিক আলোচনা করি না। আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এদের কেউ কেউ আড়ালে আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে, আমাকেও আওয়ামী লীগ এবং ভারতের দালাল মনে করে।

অন্যদিনের চেয়ে ছাত্রদের উপস্থিতি কম ছিল আজ। ছুটির পর আমি ভাবলাম রিক্সা নিয়ে টিএসসির দিকে একটা চক্কর দিয়ে আসি, দেখে আসি ওদিকের পরিস্থিতি কী? টিএসসিতে নেমে একটা চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম। চায়ের দোকানে আমি ছাড়াও আরো কয়েকজন ছিল, তারা জিয়ার খুন হবার বিষয়ে গল্প করছিল। আমি তাদের গল্পে কান পেতে চায়ে চুমুক দিতে লাগলাম। সবার মধ্যেই উত্তেজনা আর কৌতুহল- এখন কী হবে? তাদের আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনার প্রসঙ্গও উঠলো। ছয় বছর বিদেশে নির্বাসিত থাকার পর মাত্রই কিছুদিন আগে, ১৭ মে তিনি দেশে ফিরেছেন।

হঠাৎ আমার দৃষ্টিতে পড়ল চারুকলার দিক থেকে জাহানারা হেঁটে আসছে, ওর পাশে পাশে হাঁটছে একটা ছেলে, হাত ধরে জাহানারাকে থামানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু জাহানারা ঝাড়ি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে। ছেলেটা কি জাহানারার পরিচিত কেউ? নইলে অপরিচিত কেউ হাত ধরবে কেন? হতে পারে ছেলেটির সঙ্গে ওর সম্পর্ক আছে, মান-অভিমান হয়েছে। আমি যখন এইসব ভাবছি তখন ছেলেটি জাহানারার পথ রোধ করে দাঁড়ালো, জাহানারা বাঁয়ে সরে গিয়ে এগোনোর চেষ্টা করলো। যাব না ভেবেও আবার মনে হলো- আমার যাওয়া উচিত যেহেতু জাহানারা ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। হতে পারে ছেলেটি জোর করে জাহানারার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে চায়। চায়ের দাম দিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম, দূরত্ব যখন আর পনের-বিশ গজ তখন জাহানারার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হতেই ও উচ্চস্বরে বলল, ‘স্যার.....।’

ওর ডাকের মধ্যে সাহায্য চাওয়ার আকুতি ছিল। ছেলেটি ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখামাত্রই জাহানারাকে কিছু একটা বলে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলে শাহবাগের দিকে। আমি জাহানারার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ও তখন কাঁদছিল। ছেলেটা কেন ওকে বিরক্ত করছিল জানতে চাইলে চোখের জল মুছে জাহানারা জানাল যে ছেলেটা ওর প্রাক্তন বর। ছেলেটা তার অতীতের অপরাধ স্বীকার করে জাহানারার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, জাহানারাকে আবার বিয়ে করে সংসার করতে চায়। কিন্তু জাহানারা আর পুরোনো সম্পর্কে ফিরে যেতে রাজি নয়। ছেলেটা এর আগেও একদিন এসেছিল, সেদিনও জাহানারা ওকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর আজকে ওকে ভয় দেখিয়ে গেছে যে জাহানারা যদি তাকে আবার বিয়ে করে সংসার না করে তাহলে এসিড মেরে ওর মুখ ঝলসে দেবে!

আমি আর জাহানারা সড়কদ্বীপে এসে বসলাম। জাহানারা নিজের জীবনের অনেক কথা খুলে বলল আমাকে, যা কখনো ওর কোনো সহপাঠীকেও বলতে পারেনি, শুনে আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। আমাদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, সন্ধ্যার আগে আমি ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরলাম।


অমিতাভ রায়
আজিমপুর, ঢাকা




(চলবে.....)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:৪৮

রাজীব নুর বলেছেন: তপতী চরিত্র টা খুব সুন্দর।

০৬ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:৫৬

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ০৭ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: আমার ইচ্ছা আছে,'গোধূলিবাড়ি' বই আকারে প্রকাশ হওয়ার পর আমি, এই বই নিয়ে একটা রিভিউ লিখব।

০৭ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:২৬

মিশু মিলন বলেছেন: শুনে খুব খুশি হলাম। অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.