নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
বারো
একটা মজার ব্যাপার কী জানেন, গোধূলিবাড়ি’তে আমরা যারা আছি, তাদের অধিকাংশেরই কোনো না কোনো বিষয়ে আগ্রহ এবং বিশেষ দক্ষতা আছে। এই যেমন ধরুন বেনুদির বিশেষ দক্ষতা সঙ্গীতে, গান শুনিয়ে তিনি গোধূলিবাড়ি’র সবাইকে আনন্দে রাখেন। ক্যাপ্টেন হারুন ভাইয়ের দক্ষতা শরীরচর্চায়, শরীর সুস্থ রাখতে তিনি সবাইকে নিয়মিত শরীরচর্চা করার পরামর্শ দেন এবং শরীরচর্চার নানান কৌশল শেখান। আয়েশা বেগমের আগ্রহ রান্নায়, গোধূলিবাড়ি’তে রান্নার জন্য লোক রাখা থাকলেও তিনি মাঝে মাঝে নানা পদ রান্না করেন। রাবেয়া খাতুনের দক্ষতা কাঁথা সেলাইয়ে, নিপুণ হাতে কাঁথার জমিনে নান্দনিক সব নকশা ফুটিয়ে তোলেন তিনি। সালমা বেগম, বিনয় গোস্বামী আর পরিবার পরিকল্পনার প্রাক্তন কর্মী ডলি আক্তারের ঝোঁক শাক-শবজি চাষে। লক্ষ্মী খাতুন ভীষণ সুস্বাদু আচার বানাতে পারেন। মিনতি দাস খুব সুন্দর আলপনা আঁকতে পারেন। পহেলা বৈশাখ, লক্ষ্মীপূজা, পৌষ সঙক্রান্তিতে গোধূলিবাড়ির বারান্দা সেজে ওঠে তার আঁকা আলপনায়। আমার আগ্রহ গাছপালা বিষয়ে, নানান রকম গাছপালা লাগানো এবং পরিচর্যা করা আমার নেশা। এরকম প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী। এসব করে আমাদের সময় যেমনি কাটে, তেমনি মনও ভালো থাকে।
আর একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি সবার মধ্যে, এখানে আমরা যারা আছি তারা প্রত্যেকেই একটা সময় পরিবারের কর্তা বা কত্রী ছিলাম; কেউ মধ্যবিত্ত, কেউ নিন্ম মধ্যবিত্ত, আবার কেউবা নিন্মবিত্ত পরিবারের। কিন্তু প্রত্যেকেই এসেছি ভেতরে একটা হাহাকার নিয়ে, হারানোর হাহাকার। তাই আসবার সময় প্রত্যেকে প্রত্যেকের অহংবোধ ফেলে এসেছি। কে মধ্যবিত্ত, কে নিন্ম মধ্যবিত্ত, কে নিন্মবিত্ত, আর কে কেরানি, কে পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন, সে-সব ভুলে এখানে একসূত্রে এসে মিলেছি একেবারে সাধারণ মানুষ হিসেবে। তাইতো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বেনুদি একই ঘরে থাকেন সরকারি হাসপাতালের চতুর্থশ্রেণির একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মী সুফিয়া বেগমের সঙ্গে। একজন অসুস্থ হলে আরেকজন সেবা করেন। আসলে আমরা সারা জীবন নাই-নাই, চাই-চাই করে নিজেকে নিঙড়ে রক্ত জল করেছি সংসারের জন্য। তারপর সেই সংসারের কাছ থেকে পোড় খেয়ে পুড়ে খাঁটি হয়ে এখানে এসেছি সবাই। তাই এখানে কোনো নাই-নাই, চাই-চাই নেই। এখানে বিলিয়ে দিতে পারাতেই যেন সবার আনন্দ, একজন আরেকজনের জন্য কিছু করতে পারাতেই যেন সুখ!
এরই মধ্যে আমার ঘরে একজন সঙ্গী পেলাম। পরান বাউল। আমার বয়সীই হবে। একটা চোখ অন্ধ। দোতারা বাজিয়ে হাট-বাজারে গান করে বেড়াতো। বাঁধনের চোখে পড়েছে, ধরে নিয়ে এসেছে। খুব ভালো গান গায়। গলায় ভাব আর সুর মাখামাখি। পরানকে আমার পাশের কক্ষে থাকতে দিচ্ছিল। আমি-ই পরানকে আমার কক্ষে থাকতে অনুরোধ করলাম। প্রথম দিন থেকেই তার সাথে আমার ভাব জমে গেল বেশ। কয়েক দিনেই আপনি’র ব্যবধান ঘুচিয়ে দু-জন দু-জনকে তুমি সম্বোধন করতে শুরু করলাম, হয়ে উঠলাম দু-জন দু-জনের হৃদয়ের কাছের মানুষ, বন্ধু। পরানের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই, কখনোই স্কুলে যায়নি। কিন্তু কী গভীর তার জীবনবোধ, কী সুক্ষ্ম তার দৃষ্টিভঙ্গি! আমি মুগ্ধ হয়ে পরানের কথা শুনতাম। একটি মুসলমান পরিবারে পরানের জন্ম, ছেলেবেলায় ওদের গ্রামে যে-সব বাউলেরা একতারা-দোতারা বাজিয়ে গান গাইতে যেতেন, তাদের দেখে আর তাদের গান শুনেই বাউল দর্শনের প্রতি ওর আগ্রহ জন্মায়। একটু বড় হওয়ার পর একজন বাউলের শিষ্যত্বগ্রহণ করে। সেই থেকে বাউল সাধনায় কেটেছে ওর জীবন। বিয়ে, স্ত্রী, সন্তান, সংসার, এসবের মোহ কখনো ওকে বশ করতে পারেনি। বাউল হয়ে বহু কটুক্তি, অপমান, এমনকি শারীরিক নিপীড়নের শিকার পর্যন্ত হতে হয়েছে। সুন্নী ইসলামপন্থি মৌলবাদীরা বহুবার তাকে বাউলজীবন ত্যাগ করে শরিয়তী জীবনযাপন করার জন্য চাপ দিয়েছে, মারধর করে দু-বার তার মাথা কামিয়ে তওবা করিয়েছে যে সে আর গান গাইবে না। মারের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে তওবা করলেও পরে আবার হাতে তুলে নিয়েছে দোতারা। এত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও কেন বাউলজীবন ত্যাগ করেনি জানতে চাইলে সে বলত, ‘সাঁই যারে পথ দেখায়, সে যদি একবার নিগূঢ় তত্ত্বে ডুবে যায়, তাইলে সে কী আর ভিন্ন পথে যাইতে পারে! অপমান-লাঞ্ছনা সহ্য করছি, মারধর খাইছি, কিন্তু এই পথ থেইকা ফিরতে পারি নাই। একবার এই পথে পা বাড়াইলে আর ফেরা যায় না।’
বাউল তত্ত্ব সম্পর্কে আগে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কখনও কোনো বাউলের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়নি। দূর থেকে বাউলদের দেখতাম, তাদের গান শুনতাম, ভালো লাগত। যখন কোথাও শরীয়তী মৌলবাদীদের দ্বারা কোনো বাউলের আক্রান্ত হবার খবর পড়তাম পত্রিকার পাতায়, তখন খারাপ লাগত। পরান বাউলকে কাছে পেয়ে, ওর কথাবার্তা শুনে, ওর জীবনাচার প্রত্যক্ষ করে, আমি বাউলতত্ত্ব সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর কাছ থেকে বাউল সাধনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতাম। পরানের কথাসমুদ্রে ডুবে আমার মনে হতো- পৃথিবীর পাঠশালা থেকে সে যা শিখেছে, তার কাছে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তুচ্ছ! পরান হলো প্রকৃতি, আর আমি অনেকটা যান্ত্রিক! অথচ আমাদের সমাজের চোখে পরান বাউল অশিক্ষিত, মেধাহীন, কম মর্যাদার একজন মানুষ; আর আমি শিক্ষিত, মেধাবী এবং মর্যাদাশীল একজন মানুষ! শিক্ষা, মেধা এবং মর্যাদার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মানদণ্ডের এই ছক ভেঙে এখন আমাদের বেরিয়ে আসা ভীষণ দরকার। একজন মানুষ দোতারা এবং আরও কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে, গান গাইতে পারে, জানে বাউল দর্শনের গূঢ়তত্ত্ব। এই মানুষটি কি শিক্ষাহীন, মেধাহীন, কম মর্যাদার হতে পারে? আমি গাদা গাদা বই মুখস্ত করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে কলেজের শিক্ষক হয়েছিলাম, সেই মুখস্ত বিদ্যাই আবার আমার ছাত্রদের পড়াতাম। এর মধ্যে কোনো সৃজনশীলতা ছিল না, নিজস্ব উদ্ভাবন ছিল না। কিন্তু পরান বাউল একজন সৃজনশীল এবং তাত্ত্বিক মানুষ। প্রকৃত মেধাবী তো পরান বাউল, আমি নই। বাউলদের জীবন ও দর্শন নিয়ে পিএইচডি অর্জন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষিত, মেধাবী এবং মযার্দাশীল হিসেবে পরিচিতি পেলে, বাউলরা কেন নয়?
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ছক ভাঙা এখন সময়ের দাবী। একজন মানুষ পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক কারণে হয়ত স্কুল-কলেজে লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি, কিন্তু জীবনের কোনো এক পর্যায়ে সে নিজেকে কোনো বিষয়ে দক্ষ বা যোগ্য হিসেবে গড়ে তুললেও, শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সনদ না থাকার কারণে সেই যোগ্য মানুষটি তার যোগ্য কাজটি পায় না। এটা সেই মানুষটির প্রতি অন্যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সনদ ছাড়াই, শুধুমাত্র দক্ষতার ভিত্তিতে প্রার্থীকে চাকরি প্রদানের রীতি শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও এই রীতি চালু করা উচিত। তাহলে অনেক দক্ষ মানুষ বসে না থেকে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই রীতি চালু করে।
যাইহোক, আমার নিজেকে পরানের কাছে অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ মনে হতো। কখনও কখনও এটাও মনে হতো যে শিক্ষক না হয়ে বাউল হলেই বুঝি ভালো হতো, জীবনটা আনন্দেই কাটত। একটি নিরানন্দ জীবন কাটানোর অবসাদ হয়ত থাকত না মনে।
প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই হয়ত একজন ঘুমন্ত বাউল বাস করে, কারো ভেতরের সেই বাউল হয়ত সম্পূর্ণভাবে জেগে ওঠে, কারো ভেতরের বাউল হয়ত আধো ঘুম আধো জাগরণে থাকে, আর কারো ভেতরের বাউল হয়ত কখনো জাগেই না মহৎ প্রাণের সংস্পর্শ না পাওয়ায় কিংবা মহৎ দর্শন গ্রহণ না করায়। কিন্তু মহৎ প্রাণের সংস্পর্শ পেলে, মহৎ দর্শন গ্রহণ করলে প্রত্যেকের ভেতরের ঘুমন্ত বাউল-ই হয়ত জেগে উঠতে পারে। একারণেই হয়ত বাউল শাহ আবদুল করিম বলেছেন- ‘একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে।’
যদি সত্যি সত্যিই কোনোদিন মহৎ প্রাণের সংস্পর্শ পেয়ে কিংবা মহৎ দর্শন গ্রহণ করে সব মানুষের ভেতরের ঘুমন্ত বাউল জেগে ওঠে, সে-দিন সত্যিই পৃথিবীটা সুন্দর হবে।
পরান বাউল যেমনি একজন গভীর চিন্তার মানুষ, তেমনি সাঙ্ঘাতিক রসিকও। সে আসার পর গোধূলিবাড়ি যেন আলাদা মাত্রা পেলো। গানের আসরে যখন বেনুদি আর পরান বাউল গান গাইতো, তখন অদ্ভুত এক সুরের মায়া তৈরি হতো। কোন এক অচেনা জগতে যেন আমি হারিয়ে যেতাম। মনে হতো আরও আগে কেন এই জীবনের স্বাদ পেলাম না!
(চলবে.....)
২০ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:৫৮
মিশু মিলন বলেছেন: নিজের কিছু বিশ্বাস, কিছু স্বপ্ন, চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি, চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছি। কতটা সফল হয়েছি জানি না। অনেক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২০ শে আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৪:৫২
রাজীব নুর বলেছেন: আমি খেয়াল করে দেখলাম আপনি আপনার এই ধারাবাহিকে অনেক গুলো বিষয় এনেছেন। এবং সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। লেখাটা বেশ উপভোগ্য হয়েছে।
সুন্দর ঝরঝরে লেখা। পড়ে আরাম পাচ্ছি।