নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- কুড়ি)

২৫ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:৪৯

১৪ ফেব্রুয়ারি কলেজে ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল কম। মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্ররা জমায়েত হয়ে সেখান থেকে যাওয়ার কথা সচিবালয় অভিমুখে। দেয়ালে দেয়ালে বড় বড় পোস্টার লাগিয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। কলেজে ছাত্রদের উপস্থিতি কম দেখে বুঝলাম যে তারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় গেছে।

স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরই শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও রেজাল্ট খারাপ হলেও যারা ৫০% শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সমর্থ, তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় ওই শিক্ষানীতিতে। দরিদ্র ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে ছাত্ররা এই শিক্ষানীতির প্রবল বিরোধিতা করে। এছাড়াও এসএসসি কোর্স ১২ বছর করার কথা বলা হয় নতুন শিক্ষানীতিতে। ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে মজিদ খানের এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলন করার বিষয়ে একমত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দি মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি এবং গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয়।

দুপুরের আগেই খবর পেলাম পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হয়ে উঠেছে রণক্ষেত্র। আমাদের কলেজের ছাত্ররা যারা বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেয়, তাদেরই কেউ কেউ ফিরে এসে খবর জানায়। দুশ্চিন্তায় পড়লাম জাহানারাকে নিয়ে, নিশ্চিত জানি যে সে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছে। আমাদের ছাত্রদের জন্যও দুশ্চিন্তা হলো। অস্থির লাগতে শুরু করল আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গিয়ে কি জাহানারার খোঁজ করব? কলেজ থেকে বেরিয়ে নীলক্ষেতের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের যে সংঘর্ষ হয়েছে তার প্রভাব পড়েছে আশপাশের সব এলাকাতেও। নীলক্ষেত মোড়ের কাছে যেতেই দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে দৌড়ে আসছে কিছু যুবক-যুবতী, দেখেই বুঝতে পারলাম যে ওরাও বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়েছিল। একজন যুবককে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিক্ষোভ মিছিলে গিয়েছিলে?’

ছেলেটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভাবল কে জানে, হয়ত আমি ওর জন্য নিরাপদ কি না সেটা ভাবল। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘কেন বলুন তো?’
বললাম, ‘আমি ঢাকা কলেজের শিক্ষক, আমার অনেক ছাত্র বিক্ষোভ মিছিলে গিয়েছে।’
ছেলেটা বলল, ‘স্যার আমিও ঢাকা কলেজের ছাত্র, আমিও বিক্ষোভ মিছিলে গিয়েছিলাম।’
‘ওদিকের কী খবর বলো তো?’
‘স্যার, আমরা ১০ টার দিকে বটতলা থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষা ভবনের দিকে যাচ্ছিলাম, শিশু একাডেমি আর কার্জন হলের মাঝখানের রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই শিক্ষাভবনের দিকে থাকা পুলিশ বিনা উস্কানিতে আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছে।’
‘কেউ কি মারা গেছে?’
‘তা বলতে পারব না। তবে অনেকের গায়েই গুলি রেগেছে। গুলিবিদ্ধ অনেক ছাত্রকে পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে, আবার আহত অনেককে ছাত্ররাই ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেছে। কেউ কেউ মনে হয় মারা গেছে স্যার।’
কেঁদে ফেলল ছেলেটা। আমার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করল। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, ‘কেঁদো না। কি নাম তোমার?’
‘সজল।’
‘হলে থাকো?’
‘হ্যাঁ, স্যার।’
‘যাও সজল, হলে চলে যাও। আজ আর হল থেকে বের হোয়ো না।’
‘আচ্ছা, স্যার।’

চলে গেল ছেলেটা। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। তখনও ওদিক থেকে ছাত্ররা দৌড়ে আসছে এদিকে। আমি আরো কয়েকজন ছাত্রের কাছে জিজ্ঞেস করেও একই রকম তথ্য পেলাম। পুলিশ গুলি চালানোর পর ছাত্র-ছাত্রীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। বিভিন্ন রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। কী করব কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কেবল জাহানারা-ই নয়, আমার কত প্রাক্তন ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আমার বর্তমান ছাত্ররাও অনেকে গেছে, যদি ওদের গায়ে গুলি লাগে! কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। আরো পরে যে-সব ছাত্ররা ওদিক থেকে এলো তাদের মুখেও একই কথা শুনতে পেলাম, পুলিশ নাকি খুব কাছ থেকে গুলি করেছে, কতজন মারা গেছে তার ঠিক নেই। বার বার নিজের ভেতরে প্রশ্ন জাগছিল জাহানারার কিছু হয়নি তো? সে ঠিকমতো হলে পৌঁছতে পেরেছে তো? একবার হলে পৌঁছতে পারলে আর কোনো চিন্তা নেই, পুলিশ আর কিছু করতে পারবে না। এইসব ভাবতে ভাবতেই বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।

সন্ধ্যায় গেলাম রোকেয়া হলে। হলের দারোয়ানকে বললাম, ‘আমার নাম অমি, ২০৬ নম্বর রুমে আমার কাজিন জাহানারা থাকে, ওকে একটু ডেকে দিন।’

দারোয়ান চলে গেলে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দারোয়ান এসে বলল, ‘সে রুমে নাই।’

জাহানারা রুমে নাই? তাহলে কোথায় গেল? পুলিশি আক্রমণের কারণে কোনো বন্ধুর বাড়িতে গেছে? নাকি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে? নাকি পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে গেছে?

ওখান থেকে গেলাম ঢাকা মেডিকেলে, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আহত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জাহানারাকে পেলাম না। আমি কি করব, কোথায় খুঁজব আমার জাহানারাকে? আমার তখন দিশেহারা অবস্থা! ভীষণ কান্না পেল, চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ঢাকা মেডিকেল থেকে বেরিয়ে শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে বসে নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগলাম। ঝাপসা চোখে শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, পাকিস্তানীরা আমাদেরকে মাতৃভাষা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল, আমরা বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের ভাষা রক্ষা করেছি। পাকিস্তানীরা আমাদের শোষণ করেছিল, নির্বিচারে নিরীহ মানুষদের মেরেছিল গুলি করে, আমরা বুকের রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। যাতে আর কেউ আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে না পারে, যাতে আর কেউ আমাদের শোষণ কিংবা আমাদের বুকে গুলি করতে না পারে। অথচ এখন আমাদের নিজের দেশেরই কিছু মানুষ পাকিস্তানীদের মতো নির্মম হয়ে উঠেছে, তারা নিজের দেশের ছাত্রদের বুকে গুলি চালাচ্ছে। এই দেশ, এই শাসক কি আমরা চেয়েছিলাম?

পরদিন সকালে প্রতিদিনের চেয়ে এক ঘণ্টা আগে বের হলাম বাসা থেকে, উদ্দেশ্য আগে রোকেয়া হলে গিয়ে জাহানারার খোঁজ নিব, তারপর যাব কলেজে। রিক্সায় বসে দু-চোখ বুজে আসতে চাইলো, জ্বলতে লাগল চোখ। প্রায় সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি, নানা রকম দুশ্চিন্তা ভর করেছে মাথায়। এইসব সংকটের সময়ে কি শুধু যতসব হাবিজাবি নেতিবাচক চিন্তা মাথায় ভর করে? রোকেয়া হলের গেটে নেমে দারোয়ান যাতে বিরক্ত না হয় তাই তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে জাহানারাকে ডেকে দিতে বললাম। দারোয়ান ফিরে এসে জানালো, ‘সে তো কাল রুমে ফেরে নাই।’

বললাম, ‘একটু কষ্ট করে ওর কোনো একজন রুমমেটকে ডেকে দিন।’

কিছুক্ষণ পর দারোয়ানের সঙ্গে একটা মেয়ে এলো। মেয়েটাকে দেখেই মনে হলো ওর নাম শাম্মী, চিকন, কালো, দেখতে সুশ্রী। জাহানারা ওর রুমমেটদের সম্পর্কে অনেক কথা বলেছে আমাকে, তা থেকেই আমার অনুমান। বললাম, ‘আমি অমি, জাহানারার কাজিন। আপনি তো ওর রুমমেট?’

‘হ্যাঁ, আমার নাম শাম্মী।’
‘কাল থেকে জাহানারার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ও কাল কখন রুম থেকে বেরিয়েছে?’
‘সকাল নয়টার দিকে।’
‘তারপর আর একবারও হলে আসেনি?’
‘না।’ দু-দিকে মাথা নাড়ল শাম্মী।
‘ও কি ওর কোনো বান্ধবীর বাসায় যেতে পারে? মানে, আগে কখনো তেমন কারো বাসায় গিয়েছে?’
‘না, ও তো রাত্রে কখনো বাইরে থাকে না। এটুকু জানি যে ও কাল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিক্ষোভ মিছিলে গিয়েছিল। পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে, অনেককে ধরেও নিয়ে গেছে। ওকেও ধরে নিয়ে গেছে কি না কে জানে! কিছুই বুঝতে পারছি না।’

আমার শরীর তখন কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল আমি পড়ে যাব যে-কোনো মুহূর্তে। বললাম, ‘ঠিক আছে শাম্মী, ধন্যবাদ আপনাকে, আমি বিকেলে আবার আসবো খোঁজ নিতে।’

শাম্মীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিক্সায় উঠলাম। বুকের মধ্যে ভাঙচুর করতে লাগল যেন। মনে হলো আবার আমি জাহানারার সঙ্গে দেখা হবার আগের বদ্ধ জীবনে ফিরে গেছি, আমার দক্ষিণের জানলাটা অকস্যাৎ বন্ধ হয়ে গেছে!

সেদিন সন্ধ্যায় আবার গেলাম রোকেয়া হলের গেটে, দারোয়ানকে দিয়ে শাম্মীকে ডাকালে সে জানালো যে জাহানারা রুমে ফেরেনি। এরপর প্রতিদিন-ই কলেজ থেকে ফেরার সময় আমি রোকেয়া হলের গেটে যেতাম জাহানারার খোঁজে, দারোয়ান রুমে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসে প্রতিদিন আমাকে একই কথা বলতেন, ‘সে তো ফেরে নাই।’

হাসপাতাল-থানা সব জায়গা আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, কিন্তু কোথাও জাহানারার কোনো খোঁজ পেলাম না। সরকারি হিসাবে ১৩৩১ জন ছাত্র-জনতাকে গ্রেফতার দেখানো হয়, তাদের মধ্যে জাহানারার নাম ছিল না। জয়নাল, জাফর, দীপালি, মোজাম্মেলসহ ১০ জন নিহতের নাম জানা গেলেও প্রকৃতপক্ষে কত জন নিহত হয়, তা অজানা। সেদিন বিক্ষোভ মিছিলে যেসব ছাত্রনেতা ছিলেন, তাদের কেউ কেউ বলেন সেদিন কমপক্ষে পঞ্চাশজন ছাত্র-জনতা পুলিশের হাতে খুন হন। সুতরাং একথা বলা যায় যে সেদিন আরও অনেকেই নিহত হন, তাদের লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে। তাদের কথা আর কোনাদিনই জানা যাবে না। কিন্তু আমি জানি তাদের মধ্যে আমার জাহানারাও একজন।

আমাদের আর কক্সবাজার যাওয়া হলো না, আমাকে একলা ঘরে বিবস্ত্র বসিয়ে ন্যূড ছবি আঁকার স্বপ্নও পূরণ হলো না জাহানারার। জাহানারাকে আমার সারপ্রাইজও দেওয়া হলো না যে তাকে আমি আলাদা বাসায় রাখতে চাই। আমাদের দুজনের আরও অনেক স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল!

১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের সময় রাজনৈতিককর্মী, সংস্কৃতিকর্মী এবং সচেতন সাধারণ মানুষ সবাই জেগে উঠেছিল স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে। মিছিল-স্লোগান, গান, কবিতায় মুখর হয়ে থাকত পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আমি কোনো রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিককর্মী ছিলাম না, কিন্তু একজন সচেতন সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রতিদিন বিকেলে যেতাম আন্দোলনে সংহতি জানাতে। রাজনৈতিককর্মী-সাংস্কৃতিককর্মীদের দেখে আমার মনে হতো, আহা, একটিবার যদি এদের মধ্যে দেখতে পেতাম জাহানারার মুখটি। অনেকটা জাহানারার মতো দেখতে, এমন মেয়ে দেখে বেশ কয়েকবার চমকেও গেছি আমি! কিন্তু পরক্ষণেই একটু ভালো করে দেখে সেই চমক আর থাকেনি, তাদের কেউ-ই জাহানারা নয়।

আরও রক্ত, আরও প্রাণের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়। আমি চেয়েছিলাম গুম-খুনের অপরাধে স্বৈরশাসক এরশাদের ফাঁসি কিংবা যাবতজীবন কারাদণ্ড হোক। তাই হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর মাত্র কয়েক বছর তাকে জেল খাটতে হয়, জেল থেকে বেরিয়ে দাঁত কেলিয়ে জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে রাজনীতিতে তিনি তার সরব উপস্থিতি জানান দেন। এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র হয়ে ওঠেন। পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে কখনো তার দলের প্রাপ্ত আসনের কারণে, আবার কখনো তাকে জোটে নিতে দড়ি টানাটানি করেছে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। কতটা নির্লজ্জ রাজনৈতিক নেতৃত্ব হলে এমনটা করতে পারে! এমনকি স্বৈরশাসক এরশাদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করা কিংবা বাংলা ক্যালেন্ডার সংশোধন করে পশ্চিমবঙ্গের পহেলা বৈশাখ থেকে বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ আলাদা করা এখনও বহাল আছে। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কোনো সরকারই এরশাদের এইসব সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডগুলো বাতিল করেনি। অর্থাৎ সব গণতান্ত্রিক সরকারই এরশাদের অসাম্প্রদায়িক-স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিয়েছে!

জয়নাল-দীপালিসহ সেদিনের নিহত শিক্ষার্থীদের কথা, আহত ও নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের কথা, রাষ্ট্র মনে রাখেনি, অধিকাংশ মানুষও মনে রাখেনি, আজকের বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ঘটা করে ভালোবাসা দিবস পালন করা হয়! না, না ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই, মানুষ ভালোবাসা দিবস পালন করতেই পারে। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস পালিত হলে আমাদের ভালোবাসায় কোনো কমতি হতো না নিশ্চয়!

১৪ ফেব্রুয়ারি আমি স্মরণ করি আমার মতো করে। জাহানারার আঁকা ওর নিজের একটি আত্মপ্রতিকৃতি আমি সংগ্রহ করেছিলাম শাম্মীর মাধ্যমে, যেটা ওর রুমে ছিল। আমার আলমারির ড্রয়ারে আত্মপ্রতিকৃতিটা রেখে চাবিটা লুকিয়ে রাখতাম। প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি ফুল কিনে গোপনে আমি আত্মপ্রতিকৃতিতে রাখতাম। তপতী মারা যাবার পর প্রতিকৃতিটা বাঁধাই করে দেয়ালে টাঙিয়েছিলাম, তারপর গোধুলিবাড়ি’তে আসার সময় সেটা সঙ্গে নিয়ে আসি, আমার ঘরের দেয়ালে টাঙাই। ফুলের মালা পরানো প্রতিকৃতি দেখে সবাই ভাবে আমার প্রয়াত স্ত্রীর প্রতিকৃতি!




(চলবে.......)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:১৯

রাজীব নুর বলেছেন: এরশাদ আসলেই বদলোক ছিলেন।
খালেদ জিয়া কি ভাল? না সেও ভালো না।

২৬ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:৩১

মিশু মিলন বলেছেন: খালেদা-এরশাদ দুজনের কেউ-ই ভালো মানুষ নয়। জানের মায়ায় এর চেয়ে বেশি কিছু কইলাম না!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.