![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মাথার মধ্যে যা আসে তা দমিয়ে রাখতে না পারার নামই আবর্জনা। আমি লিখি- কখনোই তা লেখা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করিনি। তবু লিখছি- স্বপ্ন ভাঙা এক আগন্তুক আমি।
শেষ পর্ব
চল্লিশ বেয়াল্লিশের মত বয়স হবে ভদ্রলোকের। পেশায় জেলার। মাথায় গোল মত টাক! শরীরের থেকে ভূরিটাই চোখে পড়ার মত। মাথার উপরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফ্যান ঘুরছে। হাতল ভাঙ্গা কাঠের একটা চেয়ারে ভদ্রলোক বসা। দেখতেই বুঝা যায়, ভদ্রলোক বেশ আয়েশের সাথে তাতে গা হেলিয়ে দিয়েছেন। সামনে পুরনো আমলের বড় মত কাঠের একটা টেবিল। তার উপরে কয়েকটা ফাইল। আগন্তুক যেই ভেতরে ঢুকতে যাবে অমনি জেলার সাহেব উচ্চস্বরে বলে উঠল, আসুন!আসুন। ইঙ্গিতে চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বলে। বসতেই হলুদ একটা খাম আগন্তুকের সামনে বাড়িয়ে দিলো।
কি এটা! প্রশ্ন করলে, ভদ্রলোক গড়গড় করে বলতে লাগলো, আপনার চিঠি।
কে পাঠিয়েছে?
একটু আগে পূর্ণতার মা এসে দিয়ে গেছে। ও নাকি মারা যাওয়ার আগে এটা লিখে গিয়েছিলো।
ও আচ্ছা! আর কিছু? মনে হলো ভদ্রলোক কিছু একটা বলতে চাইছেন। তাই আগন্তুক নিজে থেকে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবেন কি?
আমতা আমতা করে ভদ্রলোক বলতে লাগলো, না মানে... আপনাকে না বলেই ম্যাডামের চিঠিটা পড়ে ফেলেছি।
Its ok. কোন সমস্যা নাই। ফের আগন্তুকই বলে উঠলো, একটা উপকার করবেন...
কথা শেষ না করতেই জেলারই বলে উঠলো, এটা আপনি কি বললেন! উপকার করবো মানে! অপমান করলেন স্যার! কষ্ট পাইলাম বটে। আপনার উপকার করবো না সেটা কি হয়! আপনি শধু হুকুম করে দেখেন। জান কোরবানী করে দিবো।
কে বলবে এই লোকটা জেলার! আগন্তুক আগে যেমনটা ধারণা করেছিলো, এখন তার ষোলাআনা লক্ষনই দেখতে পাচ্ছে। লোকটাকে একটা প্রশ্ন করতে গেলে প্রশ্ন শেষ না হতেই গড় গড় করে একগাদি উত্তর দিয়ে দেয়। মাঝে একবার জিরিয়ে নিয়ে, স্যার সত্যি বলতে কি, আমি আপনার অনেক বড় একজন ভক্ত। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, গত তিন মাস ধরে আপনার অনেক সন্ধ্যান করেছি কিন্তু কেউই ঠিকানা দিতে পারেনি।এদিক দিয়ে বউও রাগ করে কথা বলে না। কি মছিবৎ দেখেন তো।
আর সন্ধ্যান করতে হবে না। এবার নিজেই এসে হাজির হয়েছি।
হ্যাঁ স্যার! সেটা আমার কপালই বটে। আপনি আমার শহরে থাকেন অথচ দেখেন কত জায়গায় খোঁজ করলাম। কেউ সন্ধ্যানটা পর্যন্ত দিতে পারলো না। একেই বলে নিয়তি।
ভালো না! ভালোই তো। মক্কেল নিজেই এসে হাজির।
স্যার এভাবে বলবেন না। মনে বড় ব্যথা পাই।
আগন্তক অনুতপ্ত হয়ে, আপনার মনে ব্যথা দেওয়ার জন্য দুঃখিত।
স্যার, আর লজ্জা দিবেন।
এই লোকের সাথে কথা না বাড়ানোই ভালো। তাই আগন্তুক নিজে থেকে চেপে গেলো। কিন্তু সে চাপলে কি হবে কপাল যদি না চাপে।
জেলার সাহেব আগের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলতে লাগলো, আপনার উপকার করবো না সেটা কি করে হয়! চিন্তা করবেন না। উকিল ধরেছি, জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য। আশা করি কালকের মধ্যেই জামিন হয়ে যাবে। তবে এটা ভাববেন না যে আপনাকে একেবারে ছেড়ে দিবো! বউয়ের আদেশ, এখান থেকে সোজা বাড়ি নিয়ে। গেলেই বুঝতে পারবেন আমরা দুজনই আপনার কেমন ভক্ত। স্যার, এ যাবত আপনি যে কয়টা বই বের করেছেন একটা ছাড়া বাকি সবগুলো আমার বাড়িতে আছে। জানেন কি না জানি না, রাত্রে ঘুম না আসলে আপনার বই খুলে বসি। পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। মজার ব্যপার কি জানেন স্যার! আমার ও (বউ) আপনার বইয়ের খুব ভক্ত। ও যখন ভার্সিটিতে পড়ত ঐ সময়ই আপনার কবিতা আমার বলে চালিয়ে দিতাম। শুনে অবাক হবেন এজন্য যে, আপনার কবিতা দিয়েই তমাকে পটাই।
আপনি না পুলিশ!
তা কি হয়েছে!
না। এমনিতেই! আসামির সাথে যেভাবে কথা বলছেন!
স্যার এভাবে বলতে পারলেন! মনে বড় ব্যথা পাইলাম।
সত্যি বলতে, জগতে অনেক ধরনের লোকের মধ্যে ওনিও একজন, যে কারণে অকারণে ব্যথা পায়।
অন্যদিকে আগন্তুকের লেখার প্রশংসা শুনতে শুনতে একগেয়েমি ধরে গেছে। তাই জেলার সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে, বলে উঠলো, বুঝতে পেরেছি। জামাল সাহেব, আর গভীরে যেতে হবে না। দয়া করে জানটা কোরবানী না করে, আপনি চিঠিটা আপনার কাছে দেখে দিন।
কেনো স্যার?
ওটা আমার লাগবে না।
কি বলছেন এসব! পূর্ণতা ম্যাডামের চিঠি আর আপনি বলছেন লাগবে না!
হ্যাঁ। আমি বলেছি যে ওটা আমার লাগবে না। আপনি বুঝতে পেরেছেন?
Ok. Sir, কিন্তু Sir একটা কথা জানতে পারি!
হুম! পারেন।
আপনি কি মেডামকে সত্যি সত্যি ভালোবাসতেন? প্রশ্ন শেষ করে জামাল জোয়াদ্দার কেমন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
আগন্তুক কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। তবে কি সত্যি সত্যি সে পূর্ণতাকে ভালোবাসত? না! তা কি করে হয়! ভালোবাসাতো কবিদের জন্য নয়। এটা সবাই জানে। এও জানে কবিরা ভালোবাসতে জানে না। জানে কেবল বঞ্চনা সহ্য করতে। হয়ত সেখান থেকেই কবিতার জন্ম। এ যেন শব্দহীন কোন প্রাণের নিথর অস্তিত্বের জানান দেওয়া। সে যা-ই হোক! এবার আগন্তুকের কথার আসি। যে কিনা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত থেকে নিজেকেই আড়াল করে গেছে। আজো হয়ত আড়াল করে যাবে। স্বপ্ন-সম্পর্ক সংশয়ে ভরা এক অন্য জীবন। যেখানে নিজের বলে কিছুই নাই।
কবির কথা আজ না হয় না-ই বললাম। আমরা পূর্ণতার প্রসঙ্গে আসি।
জামাল জোয়াদ্দারের হাতে রাখা হলুদ যে খামটা দেখতে পাচ্ছেন এটা পূর্ণতার লেখা চিঠি। অভিমানি এই মেয়েটা খামের বাম কর্নারে লাল কালি দিয়ে লিখে গিয়েছে......
ঘাসফড়িংয়ের ডানায় করে, আসবো উড়ে উড়ে,
মেঘ হয়ে ভাসবো আমি আসতে তোমার ঘরে।
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম- স্বপ্ন ভেঙে তাতে
কষ্ট না হয় বাড়িয়ে গেলাম তোমার অজান্তে।
__পূর্ণতা (এটুকু মোটা কালি দিয়ে লেখা)
এরপর ভেতরটা খুলে জামাল জোয়াদ্দার নিজেই পড়তে লাগলো...।
কোন সম্ভোদন ছাড়াই লিখলাম। জানি ভালো নেই, ভালো কি আমিও ছিলাম!সে থাক, আজ আর তোমাকে বলতে দিচ্ছি না। আজ শুধু আমিই বলবো।
‘কবি, সত্যি করে বলো, মানুষ কি মানুষকে ভুলে থাকতে পারে? কিংবা তুমি পারবে ভুলে থাকতে? আমি জানি তুমি তা পারবে না। তবে কেনো এমন করতে? উত্তর দাও! জানি উত্তর নেই। তবে এটুকু তো বলো, কতটা ভালোবাসলে ভালোবাসা শুদ্ধ হয়? কিংবা কতটা কষ্ট বুকে জমালে তাকে ভালোবাসা কয়?
জানি উত্তর আসবে না। তারপরেও বলি, যখন আমি থাকবো না, তখন ঘাসফড়িংয়ের গল্প কাকে শুনাবে? কে তোমার কবিতাগুলোয় প্রাণ এনে দিবে? আর দখিন দিক থেকে ঝড়ো হাওয়া বইলে তখন কে তোমার অলকাণন্দা গাছটি আগলে রাখবে? তোমার পোষা ডাহুক ছানাটিকে আদর করে কে খাইয়ে দিবে? অনেক প্রশ্ন! জানি উত্তর দিতে পারবে না। তবে কি ধরে নিবো, সেদিনের মত আজো নিজেকে লুকাচ্ছো? কিন্তু কেনো? কাঁদতে ভয় পাও? নাকি আমি যা ভেবেছি তা-ই সত্যি?
তুমিই তো বলেছো ‘ভালোবাসা মানুষকে হয় অন্ধ করে না হয় মহান। তবে উত্তর দাও না কেন? যে অন্তরে তোমার দহন! কি করে পারলে সে ক্ষত-বিক্ষত অন্তরটাকে নিজের অজান্তে শেষ করে দিতে!
কবি, আমিতো জানতাম কবিরা ঝড় শব্দের ভাষা বুঝে। নাকি আমার ধারণাটাকে মিথ্যে করতে একের পর এক তোমার এ নিষ্টুর অভিনয়!সে যা-ই হোক! এখন আমার কথা বলি। ভালোবাসা কি আগে জানতাম না। তোমাকে দেখার পর তা বুঝতে পেরেছি। ‘ভালোবাসতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অন্ধের মত ভালোবেসে গেছি। তুমি নিজেও তা বুঝতে পেরছো। জানি না কি অদৃশ্য কারণে তা প্রত্যাখ্যান করেছো। হয়তো সে ভালোবাসায় খুঁত ছিলো। তবু তো ভালোবেসিছি। সেখানে তোমার নিরব প্রত্যাখ্যান আমাকে না ফেরার দেশে যাত্রী করতে বাধ্য করেছে।
ভেবো না তুমি মুক্তি পেয়েছো! যদি তাই ভাবো তবে তা ভুল ছিলো। তাকাও! এই দেখো আমি আছি।এইতো তোমার পাশেই। তোমার সব অগুছালো কবিতা হয়ে।
অপূর্ণ জীবনে তোমার আগমন ছিলো পূর্ণতা নামের স্বার্থকতা। হয়ত তার জন্যই অবহেলা, অবজ্ঞা আর নিরব প্রত্যাখ্যান। অবশেষে আমাকে না ফেরার ......
চিঠির শেষ প্রান্তে আসতেই জেলার জামাল জোয়াদ্দার হু-হু করে কেঁদে ওঠলেন।কি আশ্চর্য! জেলারের চোখে অশ্রু! লোকটি কি মনে করে অশ্রু গড়াচ্ছে জানি না। অশ্রু ঝরালে মন হালকা হয়। সে জন্য হয়ত কাঁদছে। ভালো। যত পারে কেঁদে মনটা হালকা করে নিক। তাতে আগন্তুকের কি! সে-ই বা কেনো কাঁদবো! কার জন্য কাঁদবে! আগন্তুক তো সেদিন থেকে কাঁদতে ভুলে গেছে, যেদিন প্রথম কষ্টের সাথে ঘর করতে শিখে। আর কাঁদবে না বলেই তো রাতজাগা পাখিদের সাথে জড়ো হয় কবিতা পাড়ায়। এমনটা ভাবতে ভাবতে চোখের নিচে হাত রাখতে অনেকটা চমকে উঠে, একি! এ যে অশ্রু! কখন থেকে জানি জমতে শুরু করেছিলো। জেলার সাহেব দেখে ফেলার আগেই আগন্তুক তা মুছেতে গেলে জেলার সাহেব হাতটা ধরে ফেললেন। মুছবেন না! আপনারা কবিরা তো কখনো অশ্রু ঝরান না। তাহলে আপনি ঝরাবেন কেনো?
কই ঝরালাম! জেলার সাহেব আপনি হয়ত কোথাও ভুল দেখছেন।
জেলার সাহেব ভুল দেখেছে কিনা আমরা জানি না। তবে এটাও বুঝতে পেরেছি, গল্পের নায়ক আগন্তুক কিছু একটা লুকানোর জন্য নিজের সাথে মিথ্যে বলছে। তার জন্যই চোখ অন্যদিকে ঘুরাতে চেষ্টা করলো। জামাল জোয়াদ্দারের পেছনের দিকের ভাঙ্গা জানালায় চোখ পড়লো। সেখান দিয়ে বাইরের আকাশটা সামান্য দেখা যাচ্ছিলো। ওটুকু দিয়ে চোখ রাখতে কেমন জানি মনে হলো পুরো আকাশটাই মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। একি! সাদা মেঘগুলো কেমন ভারী হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কে জানে কতদিন ধরে আকাশটা কাঁদেনি। আগন্তুক কি মনে করে জামাল জোয়াদ্দারকে বলে ওঠে, জানালাটা খুলে দিন। অনেকদিন হয় বৃষ্টির গান শুনি না। আজ বৃষ্টির গান শুনবো।
©somewhere in net ltd.