![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গোলাপি রঙের সূতাটা নিয়ে আয় তো মা বলে আপন মনে সাদা স্যালোয়ারটা সেলাই করতে থাকে রাবেয়া।
এর পর গোলাপি ব্লাউজটা সেলাই করতে হবে।পাশের বাড়ির তমিজের বউ গত তিন দিন থেকে সেলাই করতে বলছে ব্লাউজটা,আজ নাকি তারা কোন আত্নীয়ের বাসায় বেড়াতে যাবে। মেয়ে জবাব দেয় কই মা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না তো। জানালার কাছে কাঠের পাঠাতনের উপর নীল রঙের বয়ামটার ভিতরে দেখতে বলে আবারও সেলাইয়ে মন দেয় রাবেয়া। কট.....কট.....কট.....কট.....কট...........শব্দে সেলাই করতে থাকে সে। এই সেলাইয়ের শব্দটার সাথে কি রকম যেন একটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছে রাবেয়ার।আর তা হবেই বা না কেন ,এই সেলাই মেশিনটার মাধ্যমে সে যে পরিবারটা চালায়। আর বাড়তি হাস-মুরগি আছে। মাঝে মধ্যে এক হালি ডিম বেঁছেও ছেলে মেয়েদের খাতা-কলম কিনে দেয় রাবেয়া। বড় মেয়েটা ক্লাস সেভেনে পড়ে আর ছেলে দু’টির একটি ক্লাস ফোর এবং ক্লাস টু তে পড়ে। ছেলে মেয়ে তিনজনকে নিয়েই রাবেয়ার সংসার। আলোর একটা চাচা সরকারি চাকুরীজীবী আর দাদা অবসর প্রাপ্ত দারোগা হলে কি হবে তারা তো আর তাদের খোঁজ- খবর নেয় না বললেই চলে। গত শীতে তারা কত কষ্টেই না দিন অতিবাহিত করল। কই তারা তো ছোট ছেলে রাতুল কিংবা মেজ সন্তান রাব্বি’র জন্য একটা কান ঢাকা টুপি বা একজোড়া মোজাও তো কিনে দেয় নি। যেদিন তারা ভাল রাঁধে সেদিন গুনে গুনে চার টুকরা মাছ/মাংস আর একটু সবজি ছোট ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দেয়। ছেলে মেয়ে তিনটাকে একটু বলেও না যে ওদের সাথে বসে একটু খাক। ছোট ছেলেটা আগে খাওয়ার সময় ওদের ওখানে যেত,এখন সেও আর তেমন যায় না। অবুজ সাত বছরের ছেলেটাও যেন বুজতে শিখেছে। প্রতিবার ঈদের সময় গভীর রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে রাবেয়া। এই কান্নার মাঝেও মনে হয় তার একটা আনন্দ আছে। স্বামীকে স্মরণ করেই তার এই কান্না। সব ছেলে মেয়েদের বাবা তাদের ছেলে মেয়েদের কোলে –কাঁধে করে ঈদের নামাজ পড়তে যায়। নিজের ছেলে মেয়েদের এই শূন্যতা দেখে বুকের ভিতর কান্না চাপা রাখতে পারে না রাবেয়া। ছেলে মেয়েরা মায়ের কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে কই কিছু না বলে চোখের জল মুছে ফেলে রাবেয়া। সন্তানদেরও বোঝার বাকি থাকে না যে বাবাকে স্মরণ করেই মায়ের এই কান্না। রাবেয়া এমনিতেই পাতলা গড়নের,তার উপর সেলাই মেশিনটাকে সময় দিতে দিতে চিররোগী বনে গেছে। বিয়ের সময়কার ছবিটা দেখলে মনের গহিনে লুকায়িত কান্না যেন আর বেড়ে যায়। স্বামী’র শোক সে কোনমতেই ভুলতে পারে না। এই তো সেদিন উলিপুর থেকে বউ সাজিয়ে তাকে নিয়ে আসল অনন্তপুরে। স্বামী,দীপু চাকুরীজীবী ছিল না এতে তার কোন আক্ষেপ ছিল না। দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারতো, একই ছাদের নিচে ঘুমোতে পারত এতেই ছিল তার অনন্ত সুখ। অনন্তপুরে এসে অনন্ত সুখের দেখা যেন মিলে ছিল রাবেয়ার। বিয়ের বছর দেড়েক পর প্রথম সন্তান আলো’র জন্ম দেয় রাবেয়া। প্রথম সন্তান মেয়ে হলেও যতন করে মেয়ের নাম রাখে আলো। এই মেয়েটাই যেন এক ফালি চাঁদের ন্যায় আলোকিত করে রাখে বাড়িঘর। স্বামী অন্যের ক্ষেতে কাজ করে । যেদিন আয় বেশি হয় সেদিন তারা ভালোটাই খায়। সেদিন পোয়া খানেক মাংস কিংবা একটা পাংগাস মাছ কিনে বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাড়িতে ফেরে দীপু। সেদিন বাবা –মার কাছে বাটিখানেক তরকারী নিয়ে পাঠিয়ে দেয় ছোট ছেলেটাকে। এই অভাব আত্তির মাঝে বাবা-মাকে সামান্য কিছু দিতে পারলে নিজেকে কৃতজ্ঞ মনে হয় দীপুর। এরপর একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় রাবেয়া। পুত্র সন্তানের মুখ দেখে দীপুর সুখের সীমা থাকে না। পুত্র সন্তানকে উপার্জনের হাতিয়ারই মনে করে সে। রাবেয়া খেয়াল করে যে পরিবারের ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। তারপরও স্বামীকে দোষারোপ করতে পারে না সে। কারণ সে ভাবে তার স্বামী তো আর পাশের বাড়ির মোক্তারের ন্যায় হাত-পা গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকে না। দিন ভাল থাকলে বিকেল শেষে মজুরির টাকাটা হাতে পায় দীপু। তাই দিয়েই পরিবারের তেল-নুন থেকে স্ত্রী- সন্তানের পরনের কাপড়। কাপড়ের দোকানদারের কাছে কিছু টাকা বাকিও পড়েছে তার। ঠিক সময়ে পরিশোধ করতে না পারায় অনেক কথা শুনতে হয় তাকে। দোকানদার দীপু গরীব বলে কোন অনুগ্রহ করে না বরং খরচ বাকিতে হওয়ায় আরও দুই-দশ টাকা বেশি করে লিখে হিসেবের খাতায়। এ বিষয়টা দীপু ভাল করেই জানে। ক’টা টাকা বেশি নিলেও এই অভাবের দিনে সে তো তার পরিবেরের সবার পরনের কাপড় সরবরাহ করছে,তাই এ বিষয়টাকে সে সহজভাবে মেনে নেয়। কারণ মেনে না নেয়া ছাড়া তার কোন আর উপায় নেই। কুঁড়ে ঘরে থাকলেও ছেলে মেয়েকে দু’কলম পড়ানোর স্বপ্ন দেখে দীপু–রাবেয়া। তারা ভাবে যে পড়ালেখা না জানলে সমাজের শোষক শ্রেণীর হাত থেকে বাঁচার কোন পথ নেই। বর্ষা আসলেই ভোগান্তির শেষ থাকে না দীপু-রাবেয়ার। দিনে কাজ না জুটলে তারা খাবে কি ! রাবেয়া বৃষ্টির দিনে একটি পুরাতন কাপড়ের বস্তা থেকে কিছু ক্ষুদ বের করে। এগুলো সে ধান কাটার মৌসুমে আলতাফ হাজী’র বাড়িতে কাজ করার সুবাদে পেয়েছিল। এই বর্ষায় ক্ষুধটুকুই ওদের একমাত্র ভরসা। কোরমা পোলাউ তারা কোন্দিন চোখেই দেখেনি। রাবেয়া ক্ষুধের সাথে হলুদ, লবন, মরিচ দিয়ে তরকারির খরচটা বাঁচার চেষ্টা করে। রাবেয়ার ছেলে মেয়ে এই খুদভাতটাকে পোলাউ হিসেবে জানে। তাইতো বৃষ্টির দিন আসলে পোলাউ খাওয়ার বায়না ধরে তার ছেলে মেয়ে। এবার তৃতীয় সন্তানের জন্ম দেয় রাবেয়া। এবারও ছেলে হল। দীপু-রাবেয়া উভয়েই খুশি। মুখ বাড়লে যে আহারেরও বেশি প্রয়োজন হয় পুত্র সন্তানের সুখে সে কথা যেন তারা ভুলেই গেছে। আজ সাত দিন যাবত শরীরে কেমন যেন বল পাচ্ছে না দীপু। থেকে থেকে শরীরটা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করে ওঠে। খাবারের প্রতি আগের মত আর লোভ নেই। যে দীপু মাঝারি বোলটাতে ভাত পুরে নিয়ে ভর্তা ভাতেই সাবাড় করে দিত ,তার খাবারের প্রতি এই অরুচি দেখে রাবেয়া অত্যন্ত চিন্তত। গত মৌসুমে আলতাফ হাজী’র পাট ক্ষেত থেকে আনা শাক একটু শুকিয়ে রেখেছিল সে। দুপুরে সেই শুক্তানি রান্না করে দীপুকে খেতে দেয় এই ভেবে যে,এটা খেলে খাবারে রুচি আসবে দীপুর। আজ তিন দিন আর কাজই করতে পারছে না দীপু। পাড়া-পড়শি’র কথা মত দীপুকে কবিরাজ সোলাইমানে’র কাছে নিয়ে যায় রাবেয়া। চোখ,জিহ্বা দেখার পর কবিরাজ বলে যে দীপুর জন্ডিস হয়েছে। কবিরাজ অভয়বাণী দেয় যে কয়েকদিন ঝাড়ফুঁক করলে ঠিক হয়ে যাবে। ১৭দিন পর্যন্ত ঝাড়ার পরও বিন্দুমাত্র সুস্থতার লক্ষণ নেই দীপুর। এদিকে ঘরে খাবারও নেই। আলো ওর নানাবাড়ি থেকে যে সেরপাচেক চাল নিয়ে এসেছিল তাও শেষ। দিপু এতই অসুস্থ যে তাকে আর কবিরাজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দীপু আর বিছানা থেকে উঠতেই পারছে না। সারা শরিরে পানি জমে গেছে। গত দু’দিন থেকে প্রসাব-পায়খানাও হচ্ছে না। শরিরটা ক্রমান্বয়ে ফুলে উঠছে। থেকে থেকে সন্তানের মুখগুলো দেখতে চাচ্ছে দীপু। দুপুরের পর থেকে অবস্থা আরও খারাপ। মুখ দিয়ে গোল্লার মত ফেপনা ছাড়ছে অনবরত। চিরচেনা মুখগুলোও চিনতে পারছে না সে। আসরের আগে আগে দীপু চলে গেল দূরে কোথাও যেখানে এই পার্থিব অভাব-অনটন,স্ত্রী-সন্তান কিছুই নেই। স্বামী মারা যাওয়ার বছরখানেক হল একটি এনজিও’র সহায়তায় রাবেয়া একটি সেলাই মেশিন পেয়েছে। আলো গোলাপি রঙের সূতাটা নিয়ে আসলে সে ব্লাউজটা সেলাই করতে শুরু করে।
২| ২৭ শে মে, ২০১৪ সকাল ১১:৫৪
মিনুল বলেছেন: ধন্যবাদ .....কান্ডারি ভাই
৩| ০৩ রা জুন, ২০১৪ সকাল ১১:১৭
স্নিগ্ধ শোভন বলেছেন:
সুন্দর !!!
শুভকামনা।
০৩ রা জুন, ২০১৪ দুপুর ২:০৫
মিনুল বলেছেন: অজস্র ধন্যবাদ ভাই।ভালো থাকবেন।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে মে, ২০১৪ সকাল ১১:৩৪
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
মন ছুঁয়ে যাওয়া একটা লেখা পড়লাম ভাই। শুভ কামনা রইল।