![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শপথ নেয়া নতুন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। গত ৬ তারিখ সরকারের ৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। সম্মুখে মেয়াদ আছে এক বছরেরও কিছুটা কম। সুতরাং সরকারের জন্য সময়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিরোধী দলের জন্যও। ৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে গণমাধ্যমগুলোতে মতামত জরিপ ও উপস্থাপনের বেশ কিছু উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকা বড় ধরনের নেতিবাচক শিরোনাম করেছে, কোনো কোনোটি ভারসাম্য রক্ষার নীতি অনুসরণ করেছে। অর্জন ও ব্যর্থতার খতিয়ান দেখার চেষ্টা হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে এক একজন আলোচক এক একভাবে বিষয়গুলোকে দেখেছেন। গণমাধ্যমগুলো যার যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেশের রাজনৈতিক অবস্থানকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে থাকে। এই অবস্থানটি পেশাগত মানের দিকে ক্রমে ধাবিত হবেÑ এমনটিই প্রত্যাশা করা যেতে পারে। তবে তার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে।
গেলো ৪ বছর দেশ কতোটা এগিয়েছে, কতোটা পিছিয়েছেÑ এমন ধরনের কিছু প্রশ্ন মাঝেমধ্যে শোনা যায়। সব প্রশ্ন বা মতামত যথেষ্ট বাস্তবভিত্তিকÑ তা কিন্তু দাবি করা যাবে না। তবে অবশ্যই অনেক মতামতের গুরুত্বকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আবার মতামত রাখার ক্ষেত্রেও ভাবনা-চিন্তার শিক্ষাটি আমাদের আরো অর্জন করতে হবে। আমাদের শেখার মানদ-টিও এখনো পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। ফলে ধারণ করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি এখনো রয়েই গেছে। এ ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সময় বোধহয় আমাদের পার করতে হবে।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাংলাদেশ গত চার বছরে কতোটা এগিয়েছে এর হিসাব আমরা বিভিন্ন জরিপ থেকে কিছুটা লাভ করেছি। মোটা দাগে শিক্ষা, কৃষি, অর্থনীতি, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি, পররাষ্ট্র ইত্যাদি খাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা এই ৪ বছরে অব্যাহতভাবে ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এসব অর্জনকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বাংলাদেশ নিকট অতীতে এতোগুলো খাতে এক সঙ্গে ইতিবাচক ধারার অগ্রগতি অর্জনের অবস্থানে যায়নি। সরকারের এ মেয়াদে উন্নয়নের ধারা উল্লিখিত খাতসমূহে ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিলÑ যা বেশ বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো বিষয়। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে টালমাটালের যুগেও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে স্বস্তির একটি আবহ লক্ষ করা গেছে। এটি বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য বেশ বড় ধরনের অর্জনের বিষয়। অমর্ত্য সেন সে কারণেই বাংলাদেশের ব্যাপারে তার বেশ ইতিবাচক পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে থাকেন। তিনি বিষয়টিকে দেখেন বিশ্ব পরিসরে উন্নয়ন সমস্যার বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছেÑ এমন প্রবণতা স্মরণযোগ্য। এটিকে অব্যাহত রাখার তাগিদকে যেভাবে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে যে কোনো সমস্যাকে নিয়ে যতোবেশি সমালোচনা ও চেঁচামেচি হয়, বড় ধরনের কোনো অর্জনের বিষয়কে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এই মানসিকতাকে কাটিয়ে ওঠার তেমন চেষ্টাও নেই। ফলে গণমানসে জাতীয় অগ্রগতির ধারাকে সচল রাখার গুরুত্ব প্রায়শই চাপা পড়ে যায়। সে কারণে অতীতের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জন স্বীকৃতির আড়ালে চলে গেছে, ব্যর্থতার প্রচারণা ঘুরেফিরে বড় হয়ে এসেছে। যেমন ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছেÑ এ কথা শুনেনি এমন মানুষ কম আছে। কিন্তু কেন তা হয়েছিল সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা খুব কম মানুষেরই আছে। স্বাধীনতার পর যেসব গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলÑ সেগুলো মোটা দাগে বলতে পারবে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের জাতীয় জীবনের ছোট-বড় অর্জনসমূহকে আমরা বিবেচনায় রাখি না, আলোচনায় তুলে আনি না। তবে নেতিবাচক কোনো ঘটনা বা প্রবণতাকে বারবার তুলে ধরার মানসিকতা রাজনীতিতে বেশ প্রবল। ফলে সমাজকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমরা সুপ্ত গতিপ্রবাহকে উপেক্ষা করে থাকি। এই মানসিকতা এখনো প্রবলভাবেই বিরাজ করছে।
গত ৪ বছর যে রাজনৈতিক ধারায় দেশ পরিচালিত হয়েছে তাতে জঙ্গিবাদকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়া হয়নি, জঙ্গিবাদের কালো থাবা গ্রাস করতে পারেনি দেশের সমাজ ও রাজনীতিকে। তবে সমাজের অভ্যন্তরে চেষ্টা করা হয়েছে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর অবস্থানকে টিকিয়ে রাখার। দেশী এবং বিদেশী জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীসমূহ এর আগে বাংলাদেশের মাটিতে বেশ শক্ত ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছিল। বলা চলে বর্তমান সরকার এই গোষ্ঠীকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি একটি পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারাটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে কেউ ভাবতে পারেনি যে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে। তাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি যে পরিমাণ শক্ত হয়েছে তাতে এ কথা ভাবা অনেকের পক্ষেই বেশ কষ্টকর ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি যেভাবে এগিয়ে নিতে পেরেছেÑ তাতে সরকারের কথা ও কাজে দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া গেছে। এর একটি বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর। দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উদারভাবে জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, বিকৃত ইতিহাস পরিবেশন থেকে রাজনীতি, প্রচার মাধ্যম ও পাঠ্যপুস্তকসমূহ অনেকটাই গত বছর মুক্ত থাকতে পেরেছে। ফলে নতুন প্রজন্ম দেশ ও জনগণকে ১৯৭১-এর বাস্তবতায় জানা ও চেনার একটি নিরবচ্ছিন্ন সুযোগ পেয়েছে। এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সমাজ ও রাজনীতির চেতনা বিনির্মাণেও। ফলে বাংলাদেশ গত ৪ বছরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি নতুনভাবে তাগিদ অনুভব করতে পেরেছে যা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, জঙ্গিবাদের উত্থান রোধ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে সবচাইতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর ১৯৯৬-২০১১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি শুধুমাত্র জানান দিতে পেরেছিল, ২০০৮-পরবর্তী চার বছর এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। এর ফলে বাংলাদেশে উদার গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি বাংলাদেশে উদারবাদী গণতন্ত্রের শক্তি, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিতে একটি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭৫-এর পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত একটানা এবং ২০০১-২০০৬-০৮ সাল সময়ে রক্ষণশীল ধারায় পরিচালিত হয়েছিল, এর ফলে মানুষের মধ্যে সমাজ-অর্থনীতি ও রাজনীতির বিষয়গুলোকে রক্ষণশীলতা দিয়ে দেখা ও বোঝার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু গত চার বছরের বাস্তবতা জনগণকে অনেক কিছুই ভিন্নভাবে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। এই ভিন্নভাবে ভাবাটিই হচ্ছে আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মূল চিন্তা করা। সেই চিন্তাটি দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিল, ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। ফলে জনমানসে রক্ষণশীলতা বেশ গভীরে বাসা বেঁধেছিল, এর থেকে সহজে বের হয়ে আসা সম্ভব হয়নি। এখন ধারণা করা যাচ্ছে যে, গত চার বছরের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় মানুষকে ভাবতে অনেকটাই সহযোগিতা করেছে। আমার বিবেচনায় গত চার বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে এভাবেই দেখা উচিত। অথচ অর্জনের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটিকে গণমাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কমই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ আধুনিক উদারবাদী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এর অপরিহার্যতাকে কোনোভাবে উপলব্ধির বাইরে রাখা উচিত নয়। বরং বেশি বেশি গুরুত্ব পাওয়া দরকার।
তবে বাংলাদেশের এই চারটি বছর খুব মসৃণ ছিল না। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের মতো দুঃখজনক ঘটনা দিয়ে যাত্রাটি শুরু হয়েছিল, তাহরির স্কয়ারের মতো ঘটনা ঘটানোর চেষ্টাও কম ছিল না, দেশের অগ্রগতির চাকাকে পেছনের দিকে টেনে ধরার চেষ্টাও কম হয়নি। আন্তর্জাতিক নানা অপশক্তির তৎপরতা কম ছিল না। এসবই সম্মুখের দিনগুলোতে নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পাবে। এখন আগামী নির্বাচনকে প- করার ষড়যন্ত্র বেশ সক্রিয়ভাবে করা হচ্ছে, নির্বাচনটিকে ভ-ুল করার জন্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার দাবি জোরদার করা হচ্ছে। অথচ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার বিষয়টি যেভাবে প্রয়োজন ছিল সেভাবে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে না, সংসদকে কার্যকর করা হচ্ছে না। বছর শেষে ২০০৬-এর মতো রাজনৈতিক একটি সংকট তৈরির নীলনকশা কার্যকর হতে পারে এমন ধারণা করা যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক সকল শক্তিকে এ সম্পর্কে সচেতনভাবে পা ফেলতে হবে, সাফল্যের তালিকা ও গতিপ্রবাহকে আরো বেশি বেগবান করা গেলেই কেবল সূচিত ধারা স্থায়ী হতে পারে। সেটিই করা প্রয়োজন।
©somewhere in net ltd.