নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র...

১১ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ১১:২৩

১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অল ইন্ডিয়া রেডিওর শিলিগুড়ি কেন্দ্রকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে সেখান থেকে ভাষণ প্রদান করেন। এরপর আরও কিছুদিন ওই কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের নেতাদের বক্তব্য প্রচার করা হয়। ২৫ মার্চের পরবর্তী কয়েকটি দিনের ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের নতুন পর্যায়ে প্রচারমাধ্যম হিসেবে বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। জাতীয় নেতাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং এমনকি বেতারের কর্মীদের চিন্তাধারা ছিল অভিন্ন। সে সময়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এবং ভারতে টেলিভিশন সম্প্রচার ব্যবস্থা ছিল সীমিত।

একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কি ক্লানডেসটিন বা গোপন বেতার কেন্দ্র ছিল? ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে এর প্রতিষ্ঠা হয়। কোত্থেকে এর প্রচার হতো, সেটা অনেকেরই জানা ছিল না। কিন্তু লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা এবং হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর কোটি কোটি নারী-পুরুষ প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য_ ইথারে যখন ভেসে আসবে 'জয় বাংলা, বাংলার জয়' সূচনা সঙ্গীত।

গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। স্পেনে ফ্যাসিস্টপন্থি জেনারেল ফ্রাঙ্কো ক্ষমতা দখলের পর কমিউনিস্ট পার্টি তৎকালীন সোভিয়েত ভূখণ্ডে ১৯৪১ সালে স্থাপিত একটি গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে ফ্রাঙ্কোকে উৎখাতের আহ্বান জানাতে নানা অনুষ্ঠান প্রচার করত। স্পেনের জনগণের জন্য তা ছিল অনুপ্রেরণা। ষাটের দশকে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরের বিরুদ্ধে গোপন বেতারে প্রচার চালায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও স্নায়ুযুদ্ধের সময় গোপন বেতার ব্যবহার করে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত। উত্তর আমেরিকায় কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মদদে বেতারে গোপন অনুষ্ঠান প্রচার করেছে নির্বাসিত কিউবানরা।

১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে ঠিক এ ধারার গোপন বেতার কেন্দ্র বলা যাবে না। এ বেতার কেন্দ্র প্রথমে চালু হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্র হতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের মাধ্যমে। এটি পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা অভিযান শুরুর পর তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মী (যেমন বেলাল মোহাম্মদ ও আবুল কাসেম সন্দ্বীপ) সিদ্ধান্ত নেন যে, স্বাধীনতার পক্ষে বাঙালিদের সচেতন করতে তারা এ বেতার কেন্দ্র কাজে লাগাবেন। তারা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের নাম দেন 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র'। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এ উদ্যোগে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেন। যেসব বাঙালি সৈনিক এবং ইপিআর বাহিনী-পুলিশ বাহিনীর সদস্য স্বাধীনতার আহ্বানে সাড়া দেন_ এ কেন্দ্র তাদের জন্যও প্রেরণা হয়ে ওঠে। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় এ কেন্দ্র থেকেই সে সময়ের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। পরদিন বেতার কেন্দ্র থেকে 'বিপ্লবী' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এই দু'দিনের অনুষ্ঠান ঢাকাতেও অনেকে শুনতে পান। ৩০ মার্চ বেতার কেন্দ্রে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী হামলা চালালে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পরের দিন বেতারের কয়েকজন দুঃসাহসী কর্মী সেখান থেকে একটি সম্প্রচার যন্ত্র উদ্ধার করেন এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে নিয়ে যান।

১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অল ইন্ডিয়া রেডিওর শিলিগুড়ি কেন্দ্রকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে সেখান থেকে ভাষণ প্রদান করেন। এরপর আরও কিছুদিন ওই কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের নেতাদের বক্তব্য প্রচার করা হয়। ২৫ মার্চের পরবর্তী কয়েকটি দিনের ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের নতুন পর্যায়ে প্রচারমাধ্যম হিসেবে বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। জাতীয় নেতাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং এমনকি বেতারের কর্মীদের চিন্তাধারা ছিল অভিন্ন। সে সময়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এবং ভারতে টেলিভিশন সম্প্রচার ব্যবস্থা ছিল সীমিত। বাংলাদেশ সরকার কিংবা অন্য কেউ এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনের কথা ভাবেনি। সে প্রযুক্তিও আয়ত্তে ছিল না। কিন্তু বেতার কেন্দ্র ছিল সব বিবেচনাতেই আয়ত্তের মধ্যে এবং বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তা দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগায়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আরও সংগঠিতভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ কাজে ভারত সরকারের দেওয়া শক্তিশালী ট্রান্সমিটার খুব সহায়ক হয়। এ সময়ে বেতার কেন্দ্রের কাজে অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানদের পাশাপাশি একদল শিল্পী-কলাকুশলীও মুজিবনগরে সমবেত হয়েছেন। সরকার নতুন পর্যায়ে বেতার কেন্দ্র চালুর দিন নির্ধারণ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ১১ জ্যৈষ্ঠ (সে বছর ২৫ মে)। কলিকাতার ৫৭/৮নং সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে স্থাপিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যালয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যে কোনো মানদণ্ডেই ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্র। অথচ এর প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সময় হাতে মিলেছিল মাত্র এক মাস সাত দিন। স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত ও নির্মূল করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা, বাংলাদেশের আপামর জনগণের মধ্যে সাহস ও ভরসার মনোভাব সৃষ্টি এবং শত্রুর মধ্যে শঙ্কা ও ভীতি জাগিয়ে তোলার মহৎ লক্ষ্য নিয়ে এ কেন্দ্র কাজ করে এবং তাতে পরিপূর্ণ সফলতা মেলে। এ কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধান কামাল লোহানী বলেছেন, 'আমাদের কাছে এ বেতার কেন্দ্র ছিল মনস্তাত্তি্বক যুদ্ধক্ষেত্র, যার মাধ্যমে আমরা জনগণের সাহস বাড়াতে সহায়তা করি।' সঙ্গত কারণেই অধিকৃত বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শ্রবণ ছিল গুরুতর অপরাধ। এ কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার 'অপরাধে' রাজাকার ও পাকসেনারা অনেকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আর 'সৌভাগ্যবান হলে' চরম হয়রানি-লাঞ্ছনা শেষে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন কেউ কেউ। শত্রুপক্ষ সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছিল এ কেন্দ্রের গুরুত্ব।

এ কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো যেসব অনুষ্ঠান সেগুলো হচ্ছে_ কোরআনের বাণী, সংবাদ, চরমপত্র, রণাঙ্গনের খবরাখবর, কথিকা, নাটক, মুক্তিযুদ্ধের গান ও কথিকা। এ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনেক গান বাঙালিদের মুখে মুখে ফেরে। সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল খ্যাতিমান সাংবাদিক এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্র। তিনি পুরনো ঢাকার জনপ্রিয় ভাষায় নিজের লেখা পাঠ করতেন অনবদ্য ঢঙে। প্রকৃত অর্থেই সে সময়ে চরমপত্র হয়ে ওঠে উদ্দীপনার অনন্য হাতিয়ার। এ কেন্দ্র থেকে যারা খবর পাঠ করতেন, স্বাধীন দেশে তাদের কেউ কেউ এ পেশায় হয়ে ওঠেন বিশ্বমানের খবর পাঠক। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি এবং উর্দুতে খবর পাঠ করা হতো। এ ধরনের সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল দূরদৃষ্টি। ইংরেজি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুল প্রচারিত ভাষা। আর উর্দু বেছে নেওয়া হয় অধিকৃত বাংলাদেশে উর্দু ভাষাভাষীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বার্তা পেঁৗছে দেওয়ার জন্য। সে সময়ে ঢাকা রেডিও স্টেশন চালু ছিল। শহরগুলোতে দেখা যেত ঢাকা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান। কিন্তু রাজাকার-আলবদর-শান্তি কমিটির কিছু সমর্থক ছাড়া সব বাঙালির কাছে আকর্ষণ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের। একইভাবে জনপ্রিয় ছিল আকাশবাণী কলিকাতার অনুষ্ঠান। বিবিসির বাংলা সার্ভিসও ছিল পরম কাঙ্ক্ষিত।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-কলাকুশলীদের মধ্যে প্রবীণ ও নবীন বয়সী নারী-পুরুষ আর শিশুরা ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অধিকৃত বধ্যভূমির জনপদ অতিক্রম করে তারা কলিকাতায় হাজির হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অবদান রাখার জন্য। এ বেতার কেন্দ্রের অন্যতম কর্মী আলী যাকের বলেন, দেশপ্রেম থাকলে সবকিছুই ঠিকঠাক চলে। এ বেতার কেন্দ্রে যারা কাজ করেছেন তাদের প্রত্যেকেই সেখানে হাজির হয়েছেন একটি মহৎ লক্ষ্য নিয়ে_ স্বাধীনতা। বলতে পারি যে, দক্ষতা ও যোগ্যতার সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রকাশ ঘটানোর জন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। ব্যক্তিগত স্বার্থ-সুবিধা এ সময়ে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল।

বেতার কেন্দ্রে কাজ করা অনেকের পরিবার অধিকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিল এবং এ জন্য কাউকে কাউকে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হয়েছে। আবার কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়েই নিজের নাম ব্যবহার করেছেন।

বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য একাত্তরে ১১টি সামরিক সেক্টরে ভাগ করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করে অনেকে যথার্থভাবেই বলছেন যে, এ প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে কাজ করেছে ১২তম সেক্টর হিসেবে। স্বাধীনতার জন্য এ কেন্দ্রের অবদানের তুলনা মেলা ভার।



অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক

[email protected]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.