![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
খবরদার! গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে কোনো মিথ্যাচার আমরা জনগণ সহ্য করব না। রাজনৈতিক দল কে কোথায় কার সঙ্গে আপস করল, তাতে গণজাগরণ মঞ্চের কী এসে যায়? তাদের তো দাবি একটিই, তা হলো_ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি_ ফাঁসি চাইছে তারা। একই সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি_ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি অথবা পণ্য হিসেবে ব্যবসা করাকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে। এ ছাড়া অন্য কোনো কথা তারা বলছে না। তারা যা বলছে তা উপস্থিত স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাগমেই বলছে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া তাদের বক্তব্য সরাসরি প্রচার করছে তাৎক্ষণিক। সুতরাং মানুষের কাছে মিথ্যাচার প্রচার করে কোনো লাভ হবে না, হচ্ছেও না। জনগণকে কেউ সমাবেশে যাওয়ার জন্য ডাক দেয়নি, ভাড়া করেনি কিংবা ধর্মান্ধদের মতো কান বন্ধ করে আসেনি। লোকমুখে জানতে ও শুনতে পেয়েই তারা শাহবাগ চত্বরে সমবেত হয়েছিল। চোখ-কান খোলা রেখেই এসেছিল। আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই, মেয়ে-মরদ, মজুর-কিষাণ সবাই এসেছিল। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করার উদ্দেশ্যেই অনলাইনে দেশ ও জনগণের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত করার জন্যই রাজপথে নেমে এসেছিল।
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যখন একাত্তরের পিশাচ_ সে দেশব্যাপী কসাই নামে পরিচিত। সেই কাদের মোল্লাকে বিচারের চূড়ান্ত রায়ে যখন ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করা হলো, ঠিক তড়িৎগতিতে সচেতন মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধের নবপ্রজন্ম এসে জমায়েত হয়েছিল শাহবাগ স্কয়ারে। কালক্রমে প্রতিদিন প্রতি প্রহরে ঘৃণার যে বিস্ফোরণ ঘটছিল এই গণসমাবেশে তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছে দেশবাসী। যারা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন, অথচ দেশপ্রেমের উদ্বুদ্ধ এই তরুণ দল কী প্রবল প্রাণশক্তি নিয়ে রাতকে দিন করে লড়াই- আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে সহযোদ্ধা হিসেবে এইদিন থেকেই অংশগ্রহণ করছে সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীবাহিনী। তারাও ওই অনলাইন যোদ্ধাদের দেশপ্রেমকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নেমে পড়েছে ময়দানে। একদিন দু'দিন সহমর্মিতা জানানো নয়, লড়াকু সাথী হিসেবে তারাও এই দেশপ্রেমের যুদ্ধে শামিল হয়েছে। ক্রমে এই চত্বর পরিণত হলো প্রজন্ম চত্বরে, কখনো বা স্বাধীনতা চত্বরে। এমনিভাবে মানুষের ঢল নামল। প্রথম যে মহাসমাবেশ ডাকা হয়েছিল শাহবাগ চত্বরে। সেদিনের কথা মনে আছে কি? সেদিনের মহাসমাবেশ যারা দেখেননি, তারা ভাবতেও পারবেন না কী ঘটেছিল সেদিন ঢাকায়। একবার চোখ বন্ধ করে শাহবাগ মোড়ের কথা ভাবুন, এবার চোখ মেলুন পুবে-পশ্চিমে, উত্তরে-দক্ষিণে, কোথা পর্যন্ত এর সীমানা ছিল। পূর্বে মৎস্য ভবন, পশ্চিমে সাইন্স ল্যাবরেটরি, উত্তরে রূপসী বাংলা ছাড়িয়ে প্রায় সোনারগাঁ এবং দক্ষিণে চারুকলা, টিএসসি পেরিয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত। আশপাশের বাড়ি এবং বাড়ির ছাদ পর্যন্ত মানুষে সয়লাব। কমপক্ষে পাঁচ লাখ তো হবেই। বেশি বই কম নয়। অথচ গত রোববার কোনো এক টিভি চ্যানেলে দুজন তরুণ সংসদ সদস্য ও তুখোড় তার্কিককে দেখলাম বহু কথাই বলছেন জামায়াত, হেফাজত, এমনকি গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে। বলুন। বলবেন না কেন? যখন মুখ আছে তাদের তারা তো কথা বলতেই পারেন। তবে একজন বললেন, 'আমার জীবনে এমন জনসমুদ্র দেখিনি'। জানি না তার বয়স কত; তিনি আবারো বললেন, 'পৃথিবীর কোথাও এতবড় মহাসমাবেশ হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।' তরুণ বন্ধুকে বলি, আপনি তো বিএনপি করেন, বাধ্যতামূলকভাবেই এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। তা-ই করেছেন। কারণ আপনি তো প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশ দেখেন না। আপনার নেত্রী তো, শাহবাগে আন্দোলনকারীদের 'নষ্ট' ও 'নাস্তিক' বলে আখ্যা দিয়েছেন, সেখানে আপনি যতই তার্কিক বা সংসদ সদস্য হোন না কেন, যে বস্নকের, সেখান থেকে তাদের প্রশংসা করা নিষেধ। তবে আপনারা দুজনই সেদিনের টকশোতে ইসলাম, কোরআন এবং নবীজি সম্পর্কে যে সব বয়ান দিচ্ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল, বুঝি আপনারা দুজনই সব জানেন, আর কারো জ্ঞান নেই। জামায়াত এবং হেফাজত সম্পর্কে যা বলছিলেন সেই সঙ্গে সরকারকেও, তাতে এটাই মনে হচ্ছিল আপনারাও কি...? একজন প্রশ্নকারী মহিলা চিকিৎসক তো দেশটাকে 'তালেবান' বানাতে চান কিনা জানতে চাইলেন। আপনি অবশ্য 'তালেবান' হোক, এটা চান না সে কথাও বলছিলেন বারবার।
এবার একটা প্রশ্ন, আপনাদের মতো বুদ্ধিমান তরুণ সংসদ সদস্যদের কাছে, আপনারা কি হেফাজতের এই মহাসমাবেশকে টঙ্গির তাবলীগ জামায়াতের বার্ষিক অনুষ্ঠান কিংবা পবিত্র হজ উপলক্ষে সমবেত মুসলিম জনগণের চেয়েও বেশি ভাবলেন? বিশ্বের এ দুটি জমায়েত আপনি বোধহয় দেখেননি। ছবিতে দেখে হয়তো বুঝতে পারেননি। থাকগে এসব মাপামাপির কথা। একটা কথা বলুন তো মতিঝিলের শাপলা চত্বরে কারা এসেছিলেন? তারা সবাই কি আমাদের মতো গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধী? এসব মানুষ হেঁটে কিংবা সুলেমানী গালিচায় চেপে আসুন না কেন, কাদের নেতৃত্বে তাদের জমায়েত করা হয়েছিল? কীভাবে জমায়েত হয়েছিল, তাকি আপনাদের মতো মানুষের অজানা? হেফাজতের জমায়েতে তাহলে, যাদের নাকি আপনারা (হেফাজতপন্থীরা) জামায়াতকে শত্রু ভাবেন, তারা কেন ছিল আপনাদের সমাবেশে? কেন বিএনপি সর্বাত্মক সমর্থন জোগান দিল; একেবারে মঞ্চে উঠে? স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদ ও বিপ্লবী কাজী জাফরের মাধ্যমে জাতীয় পার্টির সমর্থন ব্যক্ত করা বা সহমর্মিতা জ্ঞাপন করাই নয়, এই জনসমুদ্র যেন শুকিয়ে না যায়, সেজন্যও পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও নাকি করেছিলেন।
বিএনপি, জামায়াত, জাপার সহযোগ যদি বাদ দিই এবং জোর করে নিয়ে আসা কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের যদি বাদ দেন, তাহলে হেফাজতে ইসলামের শক্তিটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
পাশাপাশি ভেবে দেখুন ৮ ফেব্রুয়ারির শাহবাগ চত্বরের মহাসমাবেশ কী করে সংগঠিত হয়েছিল তাদের কে সহযোগিতা করেছিল? সেখানে সেদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং শহীদজননী জাহানারা ইমাম সূচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দাবি করা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। সেখানে কোনো ভাড়া করা লোক কিংবা জোর করে তালিকাভুক্ত ছাত্ররা ছিল না ছিল স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দুই মানুষের আগমন। তাই মা-শিশু, নানি-দাদি, বয়স্ক, অসুস্থ মানুষেরও উপস্থিতি গণজাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশকে আরো মহতী জনতায় পরিণত করেছিল। ক্ষোভের কী বিশাল বহিঃপ্রকাশ, তাই তো সেদিন সবার সামনে ফুটে উঠেছিল। তাই বুঝি অপপ্রচারে মত্ত জামায়াত-হেফাজত বিএনপিপন্থীরা উঠেপড়ে লেগেছে এর বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা জানে না, বাধা দিলে বাধবে লড়াই। আর জনগণেরও থাকে প্রত্যয়দৃপ্ত শপথ_ এ লড়াই জিততে হবে। ... সে যতই তাহরির স্কয়ার দেখে উৎফুল্ল হোন না কেন কিংবা তুর্কি প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে স্পন্দিত হোন, মনে রাখবেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের চরম নারকীয়, বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলার জনগণ তিতুমীর-সূর্যসেনের, উত্তরসূরিরা, কাজেম মাস্টার ও প্রীতিলতার অনুসারী বুকের রক্ত ঢেলেই কিন্তু এ দেশের সব ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরোধে এবং বাংলার মানুষের ঐতিহ্য সংস্কৃতির বিরোধিতাকারীদের সবসময়ই পরাজিত করেছে এবারো করবে। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়।
পঞ্চাশের দশকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তান ফুঁসে উঠেছিল, তখনো একটি সঙ্কীর্ণ রাজনীতির কুচক্রী মহল একে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের চক্রান্ত বলে অপপ্রচার করেছে, ফায়দা তুলতে চেয়েছে ফল হয়নি। জিতেছিল পূর্ববাংলার সে সময়ের সাড়ে চার কোটি মানুষ। আবার ১৯৫৪-তে মুসলিম লীগের বিরোধিতায় হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করলে তাকে ইসলামবিরোধী বলেই আখ্যায়িত করা হয়েছিল এবং যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে বলে ফতোয়া জারি করেছিল মোল্লা-মৌলভীরা। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়কে ঠেকাতে পারেনি মুসলিম লীগ। বরং মুসলিম লীগই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান দেশে ধর্মের নামে শাসন পরিচালনার চেষ্টা করে এবং ১৯৬১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদযাপনেও বাধার সৃষ্টি করে কিন্তু শতবর্ষের অনুষ্ঠান সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু সত্ত্বেও বিশাল আকারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল জনগণের বিপুল সমর্থনে।
মওলানা ভাসানীর ১৪ দফা, শেখ মুজিবের ৬ দফা এমনি ছাত্রদের ১১ দফাকেও তারা অনইসলামিক কার্যকলাপ আখ্যায়িত করে ভারতীয় চক্রান্ত ও বিচ্ছিন্নতা ষড়যন্ত্র বলে প্রতি ব্যবস্থা গ্রহণ করেও বাংলার মানুষের প্রবল মুক্তিসংগ্রামকে প্রতিহত করতে পারেনি। ৬ দফা জনগণের মুক্তিসনদ হয়ে নির্বাচনে শেখ মুজিবকে প্রবল পরাক্রমে বিজয়ী করলেও সামরিক জান্তা প্রধান আইয়ুবকে টপকে সিংহাসনে বসা জেনারেল ইয়াহিয়া কপটতার আশ্রয় নিয়েও মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে দমিত করতে পারেনি। '৭০ সালের নির্বাচনে কিন্তু জনগণই পক্ষে রায় দিয়েছিল নানা অপপ্রচার সত্ত্বেও। বাংলার বিজয়ী নির্বাচিত নেতৃত্বকে ক্ষমতায় বসতে না দিয়ে পাঞ্জাবি কূটরাজনীতি ও সামরিক জান্তা একত্রে চক্রান্ত করল বটে কিন্তু জনগণের বিস্ফোরণ ঠেকাতে পারেনি সেদিনও। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা এবং মুক্তিসংগ্রামী বাংলার জনগণকে নানাভাবে পর্যুদস্ত করতে এবং অস্ত্র বলে পরাভূত করতে কত যে চেষ্টা করেছিল এমনকি মার্কিনিদের মদদেও, তাও কিন্তু সফলকাম হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানকে ভারত দখল করে নেয়ার চক্রান্ত করেছে এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের 'জিহাদ' ঘোষণা করেও কিন্তু সেদিন পাকিস্তানিরা সাধারণ মানুষকে পায়নি। পেয়েছিল জামায়াত-শিবির, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়ত, রাজাকার ইত্যাদি শক্তি সংগঠিত করে বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে চেষ্টা করেছিল তাদের উত্থানকে প্রতিহত করতে, ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে এত প্রবল দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী সত্ত্বেও নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের হাতে সেই পাকিস্তানিদেরই নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পরাজয়বরণ করতে হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে দেশের বরেণ্যজন_ শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে নতুন বাংলাদেশকে বিকলাঙ্গ রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল। মার্কিন প্রশাসন নিরন্তর বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিরোধিতা করেছিল, যুদ্ধে সব মদদ দিয়েছিল, তাতেও মুক্তিসেনা ও মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় ঠেকাতে পারেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খন্দকার মোশতাককে পুতুল হিসেবে লোভনীয় স্বার্থসিদ্ধির টোপ ফেলেছিল, সেই মোশতাক মুক্তিযুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভায় থেকেও সে চক্রান্তে সফল হতে পারেনি। কেবলমাত্র মার্কিনিদের বিরোধিতা করায় বঙ্গবন্ধুর স্নেহ থেকে তাজউদ্দীন আহমদ বঞ্চিত হয়েছিলেন কিন্তু মোশতাক থেকে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য, সেই মোশতাকের ষড়যন্ত্রেই হত্যা হলেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। তারপর দেশকে আবারো সেই সেনাবাহিনীর অত্যুৎসাহীরাই বারবার দখল করে এবং ক্ষমতা অভিলাষী জেনারেল জিয়াই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ও পরাজিত পাকিস্তানিদের দোসর, ঘাতক-জল্লাদ জামায়াত-শিবিরকে নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিলেন। তারপর যুদ্ধাপরাধী কুলাঙ্গার-বিশ্বাসঘাতকদের প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হলো। তার মৃত্যু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। এই শূন্যতায় জিয়ার স্ত্রী দলে এলেন। প্রধান এবং সরকারপ্রধান হলেন। কিন্তু মাঝখানে মতলবি ও ক্ষমতালোভী জেনারেল এরশাদ কিছুদিন স্বৈরশাসনের চাকা ঘুরিয়ে গেলেন এই বাংলার ওপর। এই লোভ-লালসার নানা চক্রান্তে পরাজিত দালাল-দোসররা মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত বঙ্গবন্ধুর শাসনে, তারাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আজ তারা এতই শক্তিধর রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে এমনকি অস্ত্রেশস্ত্রে যে কাউকে তোয়াক্কাই করতে চায় না। করেও না। সেই যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের জল্লাদ জামায়াত-শিবির কূটরাজনীতির কলাকৌশলের বদৌলতে দেশে নারকীয় সন্ত্রাস '৭১-এর মতো হত্যা, গুম, খুন, চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু কি তাই, নিজেদের পরাজয়ের গ্লানি লোকচোখে মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণে নতুন দল ও গ্রুপগোষ্ঠী সৃষ্টি করে দেশময় জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটিয়েছে। সে তো আছেই কিন্তু মহাজোট সরকার দেরিতে হলে নির্বাচনের মাত্র এক-দেড়বছর বাকি থাকতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। সত্যিই বিচার শুরু হয়েছে কিন্তু শেষ হবে বলে শঙ্কা-সন্দেহ ছিল বহুজনের এবং প্রকাশও করেছেন তারা। এমন সীমিত লোকবল একটি দুটি ট্রাইব্যুনাল তদন্তের লম্বা সময়, সাক্ষ্য গ্রহণের নানান ফ্যাকরার জালে বাধা থাকলেও এবং ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিরোধী বিএনপির নানা প্রশ্ন উত্থাপন, জামায়াতিদের ট্রাইব্যুনাল বাতিল ও বন্দিদের মুক্তির দাবি আমাদের বিষ্মিত করেনি। সরকারি মনোভাবের টানাপড়েনই আজ এই বিচারকে এমনই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া যে পালিয়ে গেছে তার ফাঁসি অথচ তার চেয়ে দশগুণ বেশি অপরাধী যে 'কসাই' নামেই পরিচিত একাত্তরে তার নির্মম হত্যাকা-ের জন্য, তাকে যাবজ্জীবন দেয়া কিংবা তারপর সাঈদীকে ফাঁসির নির্দেশ দিয়ে আপিলের সুযোগ দেয়া_ এসব কী যুদ্ধাপরাধী বিচারের আন্তর্জাতিক রীতিসম্মত?
যা হোক, এই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য জামায়াতের লেজুড় বিএনপি প্রধান বিরোধী দল হয়েও আজ নানান কৌশলে জামায়াতকে সমর্থন দেয়ার চেষ্টা করছে। সেই পুরনো মার খাওয়া ধর্মান্ধতাকে ব্যবহার করে জামায়াত-বিএনপি ইদানীং হেফাজতে ইসলাম বনে নতুন একটি 'অরাজনৈতিক' বলে স্বঘোষিত অথচ রাজনৈতিক মিথ্যাচারী বক্তব্য, ১৩ দফা দাবি, শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ শেষে গণজাগরণ মঞ্চে হামলার ব্যর্থ চেষ্টা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেই প্রকাশ করে। ইদানীং জামায়াত-বিএনপি যে মিথ্যাচার করে শাহবাগে আন্দোলনকারীদের ইসলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়েছে বলে দেশের সরল ও ধর্মপ্রাণ মানুষের বিভ্রান্ত করার মতলব করেছে তাতে বাতাস দেয়ার জন্য হেফাজতের উদ্ভব হয়েছে। অথচ হেফাজতের বক্তব্যে ক'দিন আগেও জামায়াতের বিরুদ্ধে ছিল। মওলানা আহমদ শফির বইতেও একই কথার উল্লেখ রয়েছে। সবাই জানে হেফাজতে ইসলাম হাটহাজারীর একটি কওমি মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। কওমি মাদ্রাসা আছে কিন্তু তাদের তালেবে এলেমদের ভর্তির প্রথম দিন থেকেই যে ধর্মান্ধতার সবক দেয়া হয়, তা তো এ দেশের সচেতন নাগরিকরা জানেন। শফি সাহেব জামায়াতকেই শুনেছি 'মুরতাদ' আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কী এমন হলো যে তার দল হেফাজতে ইসলাম অনলাইন বোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে প্রচারিত মিথ্যাকে মানুষকে অন্তত তাঁর যারা অনুসারী তাদের মগজে ঢোকানোর জন্য জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেই কেন হাত মেলালেন? তবে কি সেই কানকথাটাই সত্যি? বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে এই 'জামায়াত-হেফাজত দোস্তি' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা দাবি বলে ওই সমাবেশে পাঠ করেছে 'জোশ ও ফাবোসে' তাতে মনে হয়েছে, এ তাদের জিহাদ। গত মঙ্গলবার এক হেফাজতিকে বলতে শুনলাম, বস্নাসফেমি আইন করবে না সরকার, আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বাধ্য করব এবং এ আইন করে ছাড়ব। ... এ যে মামাবাড়ির আবদার! হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এই অপশক্তির আস্ফালন দেখে বোঝা যাচ্ছে কোথাকার মদদে নাচছে তারা। তুবড়ির মুখে আগুন দিলে ফরফর করে ওঠে ঠিকই কিন্তু পরে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। জনগণও বলছেন, তাদের অবস্থাও তাই হবে। জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া আদৌ টিকবে না বেশিদিন। তারা দেশটাকে যে 'আইয়ামে জাহেলিয়ার'র যুগে নিয়ে যেতে চায় ওই তাদের দুশমন জামায়াতের সঙ্গে, তা কি আদৌ সম্ভব? অতীতের ইতিহাস কী সাক্ষ্য দেয়।
এ দেশের মানুষ মিথ্যাচারকে প্রতিহত করতে জানে। যখন প্রয়োজন হয় তখন প্রচলিত রাজনীতির পথে এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধারায় দেশবাসী তথা সাধারণ মানুষই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন_ এ ধরনের পশ্চাদগামী তমসাচ্ছন্ন অতীতকে পরিহার করে। আলোর পথযাত্রী সাধারণ মানুষ দেশের কল্যাণে যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করতে জানেন। তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের জানবাজির মহান মুক্তিযুদ্ধ। যার চেতনার প্রহরী এদেশের জনগণ। এবার সেই চেতনার নতুন প্রহরী গণজাগরণ মঞ্চ ও আন্দোলনকারী তরুণরা। বিপুল সম্ভাবনার এদেশের তরুণসমাজ রক্ত দিতে জানে। তারা যে ভয় পায় না তা অতীতের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। মনে রাখতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য এদেশে তরুণের অভাব নেই।
কামাল লোহানী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১২:০০
বাক স্বাধীনতা বলেছেন: প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নবীর দেখানো পথ অনুসারে, মদীনা সনদ মোতাবেক ও বিদায় হজ্বের ভাষনের নির্দেশনা মোতাবেক দেশ চলবে। এরপর আর কোন কথা নাই।