![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হারানো স্বজনদের স্মরণ করে জাতীয় শোক দিবসের সকালে নিজের ফেসবুক ফ্যান পেজে এক পোস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় লিখেছেন, ‘এটি সত্যিই দুঃখজনক যে খালেদা জিয়া প্রতিবছর জাতীয় শোক দিবসের এদিনে তার জন্মদিন পালন করতে পছন্দ করেন। বিভিন্ন দাপ্তরিক নথিতে তার (খালেদা) তালিকাভুক্ত ভিন্ন ভিন্ন জন্মদিন আছে, যার কোনোটিই ১৫ আগস্ট নয়।’ গত ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট জন্মদিনের কেক কেটে প্রমাণ করলেন তিনি দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না।’
পুরো জাতি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছে যে, বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া খুনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য দীর্ঘদিন থেকে ভুয়া জন্মদিন পালনের নামে আনন্দ-উল্লাস করে আসছেন। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যাকা-ের দিনটি তার কাছে ফূর্তির দিনে পরিণত হয়েছে।
১৯৭৫-এর পর থেকেই দিনটি মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হলেও ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্ট যাদের প্রকৃত জন্মদিন তারাও জন্মদিন পালন করেন না। কিন্তু খালেদা জিয়া ১৯৯৩ সাল থেকে নিজের জন্মদিন পালন করছেন এদিনে। অথচ প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় তাঁর জন্মদিন ১৫ আগস্ট নয় এবং তিনি মেট্রিক পাসও করতে পারেননি। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের রেকর্ড অনুযায়ী খালেদা জিয়ার জন্ম তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬। আর তিনি ১৯৬১ সালে দিনাজপুর সদর গার্লস হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিলেও অকৃতকার্য হয়েছিলেন। মোট ৯টি বিষয়ের মধ্যে তিনি কোনোমতে পাস করেছিলেন ৪টিতে। সে সময়কার গোটা পূর্ব পাকিস্তান মিলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ছিল মাত্র একটি, ঢাকা বোর্ড।
১৮/৮/১৯৯৭ তারিখে তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য অফিসারের কাছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড ঢাকার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের পাঠানো পত্রের বরাদ দিয়ে ১৯/৮/৯৭ তারিখে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘খালেদার জন্ম তারিখ ও পড়াশোনা : ঢাকা বোর্ডের দেয়া তথ্য’ শীর্ষক সংবাদ থেকে জানা যায়, খালেদা খানম, পিতা এসকান্দার, ঢাকা বোর্ডের অধীনে দিনাজপুর কেন্দ্রের দিনাজপুর সদর গার্লস হাইস্কুল থেকে ১৯৬১ সালের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। তার রোল ছিল ‘রোল দিন নং এফ-৭৯২’। রেকর্ডে তাঁর জন্ম তারিখ ০৫-০৯-১৯৪৬। বিষয়ওয়ারি প্রাপ্ত নম্বর ইংরেজি প্রথমপত্র-২৬, দ্বিতীয়পত্র-১৫, বাংলা প্রথমপত্র-৩৮, দ্বিতীয়পত্র-৩৭, গণিত-৫০, ইতিহাস-১৩, ভূগোল-২০, আরবী/উর্দু-৪২, ঐচ্ছিক বিষয়-১৩। ফলাফল : অকৃতকার্য। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস তাঁর যে জীবন-বৃত্তান্ত প্রচার করেছিল তাতে বলা হয়েছিল তিনি কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন, জন্ম তারিখ ১৯ আগস্ট। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার একজন ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক বাংলায় একটি কলামে তথ্য দেনÑ তাঁর জন্ম তারিখ ১৫ আগস্ট। সেই থেকে ১৫ আগস্ট তিনি জন্মদিন পালন শুরু করেন।
জাতীয় শোক দিবসে খালেদা জিয়ার ঘটা করে এই জন্মদিন পালনকে আমাদের মতো সাধারণ নাগরিক কোন দৃষ্টিতে দেখতে পারি। আমাদের দৃষ্টিতে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত দিবসের গাম্ভীর্য ম্লান করার জন্যই সুপরিকল্পিতভাবে একইদিন তাঁর জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। চলছে আনন্দ-উল্লাসে কেক কাটা। হৈ-হুল্লোড় করে দলীয় ফোরামে ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন পালনের পালায় বিরোধী দলের নেত্রীর কোনো কৃতিত্ব নেই বলেই আমরা মনে করি। কারণ বর্তমান সরকারের জনগণের প্রতি আস্থা আছে। জনগণের সেবা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা বড় কথা নয়; জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসই বড় কথা।
গত সাড়ে চার বছরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকা- কঠোরভাবে দমন করতে পেরেছে সরকার। জঙ্গিবাদের উত্থানকে প্রতিহত করেছে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার স্বাধীনতার চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধে দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। অন্যদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর জেনারেল জিয়া দেশকে আদর্শহীন ও নীতিহীন করেছিলেন। অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিলেন দেশকে। অপরাধীদের পুনর্বাসন করা ছিল তাঁর নীতি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের জিয়া লালন-পালন করেছিলেন। ১৯৯৬ সালের পরে সেই খুনিদের বিচার হয়েছে সাধারণ আইনে। জিয়ার ধারা অনুসরণ করে খালেদা জিয়া জাতির পিতার খুনিদের সংসদে বসিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রায় ঘোষণার দিন হরতাল পর্যন্ত ডেকেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষ এবং বিশ্ববাসীর সমর্থনে খুনিদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। পলাতক খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় আমরা এখন প্রহর গুনছি।
মূলত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারির ভাষণে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা (পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ)।’ ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি ছিল অনিবার্য। ‘যার যার ধর্ম তার তার’Ñ ধর্মনিরপেক্ষতার এই ব্যাখ্যা বঙ্গবন্ধুই প্রথম উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে ধর্মকে পৃথক করে স্বাধীনতা দান করা দরকার। অবশ্য এই স্বাধীনতার অর্থ অন্য ধর্মের প্রতি হস্তক্ষেপের অধিকার নয় বা ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা নয়। ভারতবর্ষের দাঙ্গার অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুর ছিল। ধর্মের নামে হানাহানির ঘটনা দেখেছিলেন তিনি। (সূত্র : অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।
পাকিস্তানি শাসনামলে ধর্মকে সামনে রেখেই পাকিরা আমাদের শাসন ও শোষণ করেছে। এজন্য সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করলেও বঙ্গবন্ধু ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করতেন। ধর্মকে মেনে নিয়ে উদারনৈতিক চিন্তাধারায় অভ্যস্ত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সব ধর্মের সহাবস্থান এবং বদ্ধ চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা পূর্ণতা পায়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিচরিত্র একটি অখ- সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত। তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে, জাতির জনক হিসেবে ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিধানে অন্য সব ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করেছিলেন। প্রথাবদ্ধ, ধর্ম-শাসিত সংস্কারাছন্ন জীবন তিনি পছন্দ করেননি। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার জন্য ধর্মের গ-ি ভেঙে প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে ছিল তাঁর নীতি-আদর্শ। বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপটিকে ধরতে চেয়েছেন তিনি তাঁর রাষ্ট্র পরিকল্পনায়, সংবিধান প্রণয়নে। আর এখানেই বঙ্গবন্ধু চিরস্মরণীয় একটি নাম।
এই চিরস্মরণীয় ও অনন্য ব্যক্তিত্বের ৩৭তম শাহাদত বার্ষিকীতেও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া জন্মদিন পালন করে প্রতিহিংসার রাজনীতিকে জিইয়ে রাখতে চাইলেন। ইনডেমিনিটি বিল করে যেমন স্বৈরশাসকরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে পারেনি; তেমনি ভবিষ্যতে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করেও জনগণের কাছে আসতে ব্যর্থ হবেন খালেদা জিয়া। কারণ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা নিজেদের মধ্যে আস্থা ও মনোবল সুদৃঢ় করেছেন। তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা অক্ষুণœ থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
©somewhere in net ltd.