![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখাটি যখন শুরু করেছিলাম তখনই জানা গেল, দেশব্যাপী বিরোধী দলের অবরোধ (পড়ুন ধ্বংসলীলা) আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মোটকথা এ সপ্তাহটির কার্যদিবসগুলো সবই চলে গেল এই ধ্বংসের গহ্বরে। অজ্ঞাত স্থান থেকে বিএনপির মুখপাত্র ভিডিওবার্তা পাঠিয়েছেন এ নির্দেশ দিয়ে। আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানে এরকম গোপন ও অজ্ঞাত স্থান থেকে তালেবান নেতারা বার্তা পাঠিয়ে সংবাদমাধ্যমকে জানান দেয় যে, তারা আছে এবং তারাই বোমা হামলা চালিয়েছে। আসলে তারা যা করছে তার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের পথে-ঘাটে লাশ পড়ে থাকে, রেলগাড়ি দুমড়েমুচড়ে ছিটকে পড়ে লাইন থেকে, বাসের ভেতর মানুষ পুড়ে মারা যায়, হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিটে মানুষের যন্ত্রণাদগ্ধ চিৎকারে পরিবেশ ভারি হয়ে থাকে অথচ এর দায় কেউ স্বীকার করে না। উল্টো এ দায় চাপানো হয় সরকারের কাঁধে। ওদিকে সরকার এতটাই দুর্বল (?) এবং ভালো (?) যে, যারা তাদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে তাদের বিরুদ্ধে কোন মানহানির মামলাও দায়ের করে না। এ কথা বলে না যে, তোমরা অভিযোগ করেছ, এবার প্রমাণ দাও যে সরকারই এ কাজ করেছে। আর এ কথাও আমরা জানতে-বুঝতে পারি না যে, যারা আগুন লাগিয়ে কিংবা রেললাইন উপড়ে পালাচ্ছে প্রায়শই তাদের ছবি গণমাধ্যমে আসা সত্ত্বেও তাদের পরে আর কেন খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের কাছ থেকেও কোন স্বীকারোক্তি আদায় করা যায় না যে, কাদের নির্দেশে এ সব করছে তারা। ফলে সবকিছুই থেকে যায় অন্ধকারে, কিন্তু জনগণের তো কিছুই করার নেই, পুড়ে মরা ছাড়া। সুতরাং আগুন জ্বলছে, জ্বলবে, মানুষ পুড়ে মরছে, মরবে।
যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আমরা আজ যাচ্ছি, এর নিশ্চয়ই একটা পরিণতি আছে। কারণ বিএনপি নামক একটি দল, যদিও তার জন্ম নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে হয়নি, হয়েছে অর্থের জোরে, ক্যান্টনমেন্টের ভেতর। তবুও এ দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে তার একটা গুরুত্ব ও অবস্থান তৈরি হয়েছিল বিগত বছরগুলোতে। সেই অবস্থানের জোরেই দলটি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে। জনগণের ভোটের একটা বড় অংশ তাদের পক্ষে পড়ে। এবারও পড়ত সন্দেহ নেই, যার প্রমাণ আমরা পেয়েছিলাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। কিন্তু দলটি কোনকালেই যেন জনগণকে একচুলও বিশ্বাস করে না। জনগণের শক্তির প্রতি অবিশ্বাস দলটির ক্ষেত্রে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। নইলে একটি নিয়মতান্ত্রিক দল কী করে এরকম ধ্বংসাত্মক খেলায় নামে? কী করে পারে বাসভর্তি মানুষকে পুড়িয়ে মেরে তাদের লাশ মাড়িয়ে ক্ষমতার সিঁড়ি ভাঙতে? ভোট চাওয়ার জন্য যে মুখ ও পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজন সেটুকুও যদি তারা হারিয়ে ফেলে সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে তো নির্বাচনে অংশ নেয়াই দুষ্কর হয়ে পড়বে, তা সে নির্বাচন ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তেই হোক কিংবা তারও পরে। এই যে, জনগণের কাতার থেকে সরে যাওয়া, সরাসরি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, এর পরিণতি নিয়েই আজকে কথা বলতে চাই। যদিও আজকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী লেখার কথা ছিল, শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়ার রাজনীতির মৌলিক পার্থক্য নিয়ে, কিন্তু মনে হলো, আজকে এই তত্ত্বকথা বলার সময় নয়, যে পার্থক্য মানুষ তার জীবনের বিনিময়ে বুঝতে পারছে, পুড়ে মরে যেতে যেতে অনুভব করছে সে বিষয় নিয়েই আবার তাদের কাছে হাজির হওয়াটা কাটা ঘায়ে নূনের ছিঁটার মতোই কাজ হবে। তাই আগামীতে কোন এক সময় এ বিষয়ে লেখার ইচ্ছে রইল।
যা বলছিলাম, বিএনপির নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে সন্ত্রাসের পথকে বেছে নেয়াটা বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতির জন্যও শুভকর নয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতির ইতিহাস কুসুমাস্তীর্ণ নয়। দলটি যত না ক্ষমতায় থেকেছে তার চেয়ে বেশি সময় থেকেছে ক্ষমতার বাইরে। আর কে না জানে যে, উপমহাদেশে ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর পরিণতি আসলে বেশিরভাগ সময়ই খ--বিখ- হওয়া কিংবা ক্রমশ দ্বিতীয় সারিতে চলে যাওয়ার ইতিহাসে ঠাসা। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। বিরোধী দলে থেকেও শক্তিশালী হয়েছে এমন ইতিহাসও রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকলেই যে তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ বিএনপি। জন্মের পর থেকেই ক্ষমতায় থাকাটাই যেন চরম সত্য দলটির কাছে, বিরোধী রাজনীতিও যে গণতন্ত্র চর্চার মৌলিকত্বের মধ্যেই পড়ে, এ শিক্ষা যেন দলটির হয়ইনি।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের বর্তমান আমলের প্রথম তিন বছর আমরা বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকে বলতে গেলে কোথাওই দেখিনি। বিএনপি নেতাদের দেখা যেত বিদেশীদের দেয়া ডিনারে এবং কখনও কখনও সংবাদ সম্মেলন করতে। এর বাইরে যেখানে তাদের দেখার কথা সেখানে বিশেষ করে সংসদে আমরা তাদের দেখিইনি। কিংবা রাজপথেও নয়। কিন্তু যে মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় ঘোষিত হতে শুরু করল ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপিকে আমরা প্রকাশ্য হতে দেখলাম। যদিও বিরোধী দল হিসেবে জনগণের দাবির পক্ষে নয়, সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে নয়, বরং জামায়াতের সঙ্গে মিলে দেশব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞের নেতৃত্ব দিতে। বাঘের ছাল পড়ে শেয়াল যেমন বন শাসন করতে নেমেছিল তেমনই বিএনপির ছাল পড়ে জামায়াত সারাদেশে যে তা-ব সে সময় চালিয়েছিল তাতে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিল, দেশটা কি আসলেই আফগানিস্তান বা পাকিস্তান হয়ে যাবে কিনা। কারণ নিয়মতান্ত্রিক ও নির্বাচিত কোন সরকারের পক্ষেই সে তা-বকে সামাল দেয়া বেশ কষ্টকরই ছিল। এই যে, বিএনপির পদস্খলন অর্থাৎ নিজেদের সাবেক অবস্থান থেকে সরে গিয়ে জামায়াতের খপ্পরে পড়ে ক্রমশ জঙ্গীবাদী হয়ে ওঠা- দেশের বিরোধী রাজনীতিকে একেবারে বলতে গেলে শেষই করে দিয়েছিল। মানুষ এর পর আর বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকে দেখেনি, দেখেছে যুদ্ধাপরাধের মদদদাতা, আশ্রয়দাতা এবং তাদের ফাঁসির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ক্ষমতা-আগ্রহী একটি দল হিসেবে। এবং নিশ্চিতভাবেই সেদিন থেকে বিএনপির ভোট ব্যাংকে বড় ধরনের এক ধস নামতে শুরু করেছিল। আর এখন তো যে কোন সূচকেই বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরের একটি অবয়ব হিসেবে চিহ্নিত হবে, সন্দেহ নেই।
আগেই বলেছি, এটা কারোরই কাম্য নয় যে, বিএনপির গণতান্ত্রিক মুুখটির জায়গায় জামায়াতের উগ্রবাদী চেহারাটি প্রতিষ্ঠিত হোক। আজকে যখন রাস্তায় মানুষ পুড়ে কয়লা হচ্ছে, দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে দেদার, তখন বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি নেতানেত্রীদের রাস্তায় থাকার কথা ছিল জনগণের একেবারে পাশটিতে। যেন জনগণ বুঝতে পারে যে, ন্যায্য বা ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের লক্ষ্যেই বিএনপি লড়ে যাচ্ছে। এবং তাতে কিছু প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও তার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠায় মানুষের সহানুভূতি আদায় করা সম্ভব হতো। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। তোরাবোরা গুহায় ওসামা বিন লাদেনের লুকিয়ে থাকার মতো বিএনপি নেতারাও আজকাল অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও টেপ পাঠিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার নির্দেশনা দিচ্ছেন।
মানুষ কিভাবে এই দূরত্ব মেনে নেবে? আর কেনইবা তাদের পক্ষে দাঁড়াবে? যতই তাদের দাবি ন্যয়সঙ্গত হোক না কেন? আমাদের বিপদে ফেলে আপনারা থাকবেন নিরাপদে, এই আধুনিক ও বি-রাজনীতিকরণের যুগেও এই ত্যাগ মানুষের কাছে কি বিএনপি নেতারা আশা করতে পারেন? হ্যাঁ, আশা করতে পারতেন নিশ্চয়ই, যদি ক্ষমতায় থাকাকালে তারা জনগণের জন্য কিছু করতেন। যদি শত শত স্যুটকেসভর্তি দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার না করতেন। যদি দুইবার মাত্র ক্ষমতায় গিয়েই দেশের শীর্ষ ধনীদের অন্যতম না হতেন। যদি জনগণের জীবনের মূল্য দিতেন, যদি দেশব্যাপী বোমা হামলা না করতেন, যদি বাংলা ভাইকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে অবজ্ঞা না করতেন। আসলে মানুষের তো অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনাদের সম্পর্কে। আপনারা ক্ষমতায় থেকে দেশব্যাপী বোমা হামলা দিয়ে মানুষ খুনের চেষ্টা করেছেন, বিচারককে তাঁর এজলাশ থেকে তুলে হত্যা করেছেন, দেশব্যাপী সংখ্যালঘু আর বিরোধী রাজনীতিবিদদের পাখির মতো নির্বিচারে শিকার করেছেন, নারীর প্রতি সহিংসতা আপনাদের সময়ে সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছিল।
আপনারা বিরোধী দলে এসেও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ পুড়িয়ে মারছেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করছেন, গণতন্ত্রের কোন স্তম্ভের প্রতিই আপনাদের মায়া-দরদ বিন্দুমাত্র নেই, সংসদকে আপনারা কোনভাবেই কার্যকর দেখতে চান না, আপনাদের শ্রদ্ধাবোধ নেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। ক্ষমতায় থেকেও যা আপনারা, ক্ষমতার বাইরে গিয়েও আপনারা একই কাজ করছেন। আর এর সমস্ত প্রভাব গিয়ে পড়ছে জনগণের জীবনের ওপর, সম্পদের ওপর। কিন্তু এ সব করেও আপনারা নিজেদের বাঁচাতে চলে গিয়েছেন অজ্ঞাত স্থানে। এখন আপনারাই বলুন, জনগণ আপনাদের কী কারণে, কেন বিশ্বাস করবে? একটা যৌক্তিক কারণ দিন যে কারণে জনগণ আপনাদের পাশে দাঁড়াবে।
হ্যাঁ, এ কথা বলতেই পারেন যে, আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে চান আপনারা। কিন্তু সে যুক্তি কি ধোপে টিকবে? দুঃশাসন কী জিনিস, কত প্রকার ও কী কী তা তো জনগণ দেখেছে এবং তার অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে। আর দুর্নীতি? কোন ধরনের দুর্নীতিই গ্রহণযোগ্য নয়, সে কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেও মানুষ এ কথা দাবি করতে বলতে পারবে যে, আপনাদের আমলের দুর্নীতির সঙ্গে বর্তমান আমলের দুর্নীতির কোন তুলনাই টানা চলে না। কিন্তু এও কোন যুক্তির কথা নয়। এর জন্যও প্রতিবাদী হতে হলে আপনাদের জনগণের কাতারে নেমে, তাদের সঙ্গে নিয়েই প্রতিবাদ করতে হবে। এভাবে পালিয়ে, অজ্ঞাত স্থান থেকে নয়। এ দেশের জনগণ কিন্তু এ কথা খুব ভালভাবেই জানে যে, অজ্ঞাত স্থান থেকে সন্ত্রাসী কর্মকা- করা যায়, মূলধারার রাজনীতি নয়। মূলধারার রাজনীতি করতে হলে জেলজুলুম আর রাজপথের রোদ সইতে হয়, জনগণকে বোঝাতে হয়; জনগণকে সামাল করাও জনগণের পক্ষের রাজনীতির সবচেয়ে প্রধানতম কাজ। একেকটা প্রাণ একেকটা দাবি আদায়ের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারত যদি আজ আপনারা নিজেদের সফেদ পোশাক আর আরাম-আয়েশের চেহারা বাঁচাতে মাটির তলায় না যেতেন। এখন আপনারা মাটির তলা থেকে বের হবেনই বা কবে আর কবেই বা দেশের রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনবেন দিনের আলোর স্বচ্ছতায়? জনগণ যদি আপনাদের প্রশ্ন করে যে, জেলজুলুমকেই যদি এত ভয়, তাহলে রাজনীতিতে এলেন কেন? থাকতেন ব্যবসা নিয়ে। তখন কী উত্তর দেবেন আপনারা? অবশ্য, আপনাদের রাজনীতিতে জবাবদিহিতার কোন জায়গাই তো নেই।
তাই আপনারাও হয়ত ফিরে আসবেন দৌর্দ-প্রতাপে, হয়ত ক্ষমতায়ও এবং তখন জনগণই হবে আপনাদের প্রতিপক্ষ। জনগণ সে অপেক্ষাতেই থাকবে হয়ত, কিন্তু সব দিন তো আর সমান যায় না, তারা তো ঘুরেও দাঁড়ায় কখনও, দাঁড়ায় না? সে অভিজ্ঞতাও তো আপনাদের আছে, কী, নেই?
মাসুদা ভাট্টি, ঢাকা ॥ ২ ডিসেম্বর, সোমবার ॥ ২০১৩ ॥
©somewhere in net ltd.