![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তর, পিলখানায় ইতিহাসের বর্বরতম যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়, সেই হত্যাযজ্ঞের খলনায়কদের বিচারের রায় ঘোষিত হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। মাত্র ৪ বছর ৯ মাসের মাথায় এতো বড় একটি ঘটনার তদন্ত ও বিচারকাজ সম্পন্ন হওয়াকে তাই দল-মত নির্বিশেষে সবাই শেখ হাসিনা সরকারের অনন্য সাফল্য হিসেবে মূল্যায়ন করছেন। সাবেক বিডিআর বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তরে যখন বিডিআর বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, তখন মাত্র ৪৭ দিন বয়সী মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত ঠা-া মাথায় চূড়ান্ত ধৈর্য প্রদর্শন করে বিদ্রোহীদের
সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যুৎপন্নমতিতার পরিচয় দিয়ে বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হন। ওই বিদ্রোহের ঘটনায় ২০০৯ সালে অনেক কিছুই ঘটতে পারত। মাত্র দেড় মাস বয়সী মহাজোট সরকারের পতন ঘটতে পারত, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারত এবং দেশে বড় ধরণের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা প্রয়োগ করে কোনো ধরণের সংঘর্ষে না জড়িয়ে মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মাথায় বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হন। বিদ্রোহের পরপরই মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, ‘যারা ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে এবং দ্রুততম সময়ে পিলখানায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রেখেছেন। যেভাবে তিনি দ্রুততার সাথে বিদ্রোহ দমন করেছেন, সেভাবেই দ্রুততম সময়ে পিলখানায় হত্যাযজ্ঞের খলনায়কদের বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন। মহাজোট সরকারের অব্যাহত সহযোগিতায় গত বছরের ৫ নভেম্বর বিডিআর বিদ্রোহের রায় ঘোষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ন্যক্কারজনক হত্যাকা-ের কলঙ্কমোচন হয়। পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনের ফাঁসির আদেশ হয়। বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ হয় ২৬২ জনের। মামলায় খালাস পায় ২৭১ জন।
এই মামলাটি ছিল ফৌজদারি আদালতের ক্ষেত্রে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা। দ-াদেশের ক্ষেত্রেও পৃথিবীর সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এই মামলা। এই হত্যা মামলার রায়ে ফাঁসির হুকুম হয়েছে ১৫২ জনের। কোনো একটি মামলায় এতো বেশি সংখ্যক ফাঁসির আদেশের নজির আর নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে আসামির সংখ্যা বিবেচনায় এতো বড় বিচার কার্যক্রম কোথাও কখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। সঙ্গত কারণেই এই বিচারকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও প্রশ্নাতীত করার লক্ষ্যে চার বছর ৯ মাসের মতো সময় লেগেছে। তারপরও বলা চলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক আগ্রহ ও সহযোগিতায় এই মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন হয়েছে।
বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের মামলাটি যখন দায়ের করা হয় তখন অনেকেই বলেছিলেন, এই মামলাটি বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকবে। কোনো ধরণের নিষ্পতি না হয়ে একদিন এই মামলাটিও ফ্রিজ হয়ে যাবে। অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন ১৫ আগস্টের ঘটনার মতো, জাতীয় চার নেতার হত্যাকা-ের মতো, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার মতো, রমনার বটমূলে বোমা হামলার মতো এই ঘটনাটির বিচার প্রক্রিয়াও হবে দীর্ঘ। কিন্তু সব নিন্দুকের মুখে চুনকালি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাত্র চার বছর নয় মাসের মাথায় পিলখানায় বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, যা ইতিহাসে নজির হয়ে থাকবে।
মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দেড় মাসের (৪৭ দিন) মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য পরীক্ষা হয়ে এসেছিল বিডিআর বিদ্রোহ। নিষ্ঠুর সে ঘটনায় পিলখানায় ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের অনেকের লাশ গর্তে পুঁতে ফেলা হয়। সেসময় সেনাবাহিনীকে অপারেশনে পাঠানোর পরিবর্তে বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমঝোতার পথ বেছে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সমঝোতার মাধ্যমে পিলখানায় আরো ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানো সম্ভব হয়। সমঝোতার সিদ্ধান্তের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পেরেছেন। ঘটনার মাত্র ৪ বছর ৯ মাসের মাথায় দায়ীদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিজ্ঞা বাস্তব রূপ পায়।
সেদিন যা ঘটেছিল
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরের দরবার হলে শুরু হয় তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহ। বাংলাদেশ রাইফেলস সপ্তাহ উপলক্ষ্যে দরবার হলে বিডিআর মহাপরিচালক ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিডিআর সদস্যদের সমাবেশস্থল দরবার হল থেকেই এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে দরবার হলে একদল বিডিআর সদস্য আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে। সেনা কর্মকর্তারা হাত তুলে দরবার হল থেকে বের হতেই গুলি চালানো হয়। প্রথমেই বিডিআর মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বাকি কর্মকর্তারা আত্মরক্ষার্থে দরবার হলের বাথরুম, মঞ্চের গ্রীনরুমসহ পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করেন। কিন্তু বিডিআর সদস্যরা দরবার হলে খুঁজে খুঁজে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে। বিডিআর সদস্যরা অস্ত্রাগার লুট করে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নেয়। পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের কোয়ার্টারে হামলা চালিয়ে কর্মকর্তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের আটক করে কোয়ার্টার গার্ড-এ জিম্মি করা হয়। ঘটনা শুরুর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর পিলখানার আশেপাশে পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি সেনাবাহিনী অবস্থান নেয়। পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদ্রোহীদের মধ্য থেকে ১৪ বিডিআর সদস্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেন। কিন্তু বিডিআর সদস্যরা আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের একাধিক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর প্রধানরা পিলখানায় বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিলখানায় প্রবেশ করে বিডিআর সদস্যদের আগ্নেয়াস্ত্র জমা নেওয়া শুরু করলেও আধঘণ্টা পর আবারও বিডিআর সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নেয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে দেশের অন্যান্য ব্যাটালিয়নেও বিডিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করে। রাজশাহী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, সাতক্ষীরা, খুলনা চট্টগ্রাম, সিলেট, নওগাঁ, যশোর, কুমিল্লাসহ বেশিরভাগ ব্যাটালিয়ন ও সেক্টরে বিডিআর সদস্যরা বিডিআর কর্মকর্তাদের (সেনা কর্মকর্তা) জিম্মি করে। এদিন দুপুর ২টার দিকে শুরু হয় জিম্মি উদ্ধার। ২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা ৪টার দিকে সেনা কর্মকর্তারা পিলখানায় প্রবেশ করেন।
প্রায় ৩৬ ঘণ্টার এ বিদ্রোহের পর পিলখানা তৈরি হয় একটি মৃত্যুপুরীতে। চারিদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। বিদ্রোহে ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন অফিস ভাঙচুর করা হয়। সেনা কর্মকর্তাদের কোয়ার্টার জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কামরাঙ্গীরচরের একটি সুয়্যারেজ লাইন থেকে ৯ সেনা কর্মকর্তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি বিডিআর হাসপাতালের পেছনের একটি গণকবর থেকে উদ্ধার হয় ৩৯টি লাশ। এমটি গ্যারেজ মাঠের গণকবর থেকে উদ্ধার হয় আরো ৯ সেনা কর্মকর্তার লাশ। এ বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, ১ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, ১ জন সৈনিক, ২ জন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৭ জন বিডিআর সদস্য ও ৬ জন পথচারীসহ মোট ৭৪ জন নিহত হন।
ঘটনার তদন্ত ও অন্যান্য
বিডিআর হত্যাকা-ের পরপরই সরকার কালবিলম্ব না করে তিন পর্যায়ে এই ঘটনার তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে। তিনটি পর্যায় হলো, বিডিআর কর্তৃক তদন্ত, সেনাবাহিনী কর্তৃক তদন্ত এবং জাতীয় তদন্ত। তদন্ত শেষে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবিদাওয়া উত্থাপিত হয়। দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বিদ্রোহের বিচার সামরিক আইনে করা। সরকার অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সেনা কর্মকর্তাদের সকল দাবি পূরণ করেন। একই সাথে বিচার প্রক্রিয়াকে বিতর্কের ঊর্ধেŸ রাখার জন্য ২০০৯ সালের ১৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধানের আর্টিকেল ১০৬ এর অধীনে সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স প্রেরণ করেন। ২০০৯ সালের ১৯ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করা হয়। এরপর নানান প্রক্রিয়া শেষে গত বছরের ৫ নভেম্বর বিডিআর হত্যাকা-ের রায় ঘোষিত হয়। বিডিআর হত্যাকা-ের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই বিরোধিতায় নামে বিএনপি-জামায়াত জোট। এই জোট বিচার বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে বিরতিহীনভাবে এখনো নানাবিধ অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গেলে বিজিবি’র নাম পরিবর্তন করে আগের নাম এবং পোশাক বহাল রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। তাছাড়া এই জোট সেনা বিধি ৫ (পাঁচ) মোতাবেক সেনা আইনে এ বিদ্রোহের বিচারের বিরোধিতা করে; যা এখনো অব্যাহত আছে।
বিডিআর বিদ্রোহ চলাকালীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রহস্যজনক অবস্থান নিয়ে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। সে সময় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘বিডিআর সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তা হত্যার পেছনে ছিল রহস্য। সেখানে ষড়যন্ত্র করে সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করা হয়েছে।’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বেশ কয়েকবারই বিডিআর বিদ্রোহে ষড়যন্ত্রের কথা বললেও ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানা হত্যাকা-ের সময় তিনি কোথায় ছিলেন সে রহস্য উন্মোচন করেননি। ঘটনা শুরুর পরপরই খালেদা জিয়া কালো কাচ ঘেরা গাড়িতে করে সেনানিবাসের তৎকালীন বাসা থেকে বেরিয়ে যান। দুই রাত তিনি বাসায় ছিলেন নাÑএটা সকলেই জানেন। তিনি কেন সেনানিবাসের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন, বেরিয়ে কোথায় গেলেন, কেন গেলেন, বেরিয়ে যাওয়ার আগে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের সঙ্গে ৮৮ মিনিটের ফোনালাপ কেন করেছেনÑএ জাতীয় নানান রহস্যের কোনো ব্যাখ্যা কোনোকালেই খালেদা জিয়া বা তার দল দেয়নি। যা মানুষের মধ্যে বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বিডিআর হত্যাকা-ের বিচার এবং সরকারের সফলতা
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। এটি ছিল জাতির জীবনের অন্যতম কলঙ্কিত অধ্যায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুঃসহ অত্যাচার, অনাচার এবং দুর্নীতির প্রেক্ষিতে দেশের মানুষ নিজের অধিকার আদায়ের জন্য সর্বজন প্রশংসিত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে মহাজোটকে দেশ পরিচালনার ম্যান্ডেট দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করার মাত্র ৪৭ দিনের মাথায় এ ধরণের বর্বরোচিত হত্যাকা- সংঘটিত হয়। এই ঘটনায় সর্বমোট ৭৪ জন প্রাণ হারায়। যার মধ্যে ৫৭ জন ছিল দেশের মেধাবী সেনা কর্মকর্তা। এটি সহজে অনুমেয় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী অপশক্তি নব গঠিত সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্যই এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে।
নানা অপপ্রচার ও প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা ও দৃঢ় সংকল্পের কারণে সাড়ে চার বছর সময়ে দীর্ঘ এ বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ন্যক্কারজনক হত্যাকা-ের কলঙ্ক মোচন হলো। পিলখানায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ হয়েছে ১৬২ জনের। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় খালাস পেয়েছেন ২৭১ জন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বিএনপি-জামায়াত জোট আজ বিডিআর’র বিচার সংক্রান্ত বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে সেনাবাহিনী এবং দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে। তাদের অনেকেই ঐ সময় সেনাবিধি-৫ মোতাবেক সেনা আইনে এ বিদ্রোহের বিচারের বিরোধিতা করেছিলেন। বিডিআর বিদ্রোহ চলাকালীন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রহস্যজনক অবস্থান অনেকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। পূর্ববর্তী বিএনপি শাসনামলে ১৯৭৭-১৯৮১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ২১টি সামরিক অভ্যুত্থানে ১২০০’র বেশি সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য নিহত হলেও এসব অভ্যুত্থানের কোনো দৃশ্যমান বিচার হয়নি। এমনকি অনেক মামলার নথিও গায়েব হয়ে গেছে।
১৯৭১-এ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাজাকার নেতা গোলাম আযমকে জেলে পাঠানোর পর সেনাবাহিনীর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সদস্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চক্রান্ত নিয়ে একটি অভ্যুত্থানের ছক আঁকে এবং সেই ছকে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাতের নীল নকশাকে সরকার অত্যন্ত সফলতার সাথে দমন করে। বাংলাদেশে একটি বিরোধী চক্র বারবার সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছে গত ৪০ বছরে। সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কিছু সদস্য শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করতে চেয়েছে ক্ষমতা গ্রহণের কয়েকদিনের মাথায়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মদদপুষ্ট সেনা অফিসাররা স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারছে না। তাই তারা একটির পর একটি সেনা অভ্যুত্থানের চক্রান্তে মদদ দেওয়ার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আমরা যদি একটু পেছনে ফিরি, প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে খুন করেছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি কট্টরপন্থি বিপথগামী অংশ; সে ইতিহাস বিশ্ববাসীর জানা। ওই বছরের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেন প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাককে। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান হন গৃহবন্দি। অবশ্য এর ৪ দিনের মাথায় কর্নেল আবু তাহের, মেজর জলিলের নেতৃত্বে ‘সিপাহী জনতার বিপ্লব’-এ নিহত হন খালেদ মোশাররফ। কিন্তু সেনাপ্রধানের পদ ফিরে পেয়েই মুক্তিদাতা তাহের-জলিলকে বন্দি করেন জিয়া। পরে ফাঁসিতে ঝোলান তাহেরকে। এরপর ১৯৭৭ সালে সফল ‘ক্যু’-এর মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। তাঁর আমলে ২১ বার ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। মারা যান বহু সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি। কোর্ট মার্শাল-এর নামে প্রহসনের নাটক করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় প্রায় দেড় হাজার সেনা ও বিমানসেনা অফিসার এবং জওয়ানকে। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সফরের সময় মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুরের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী সেনাদের হাতে নিহত হন প্রেসিডেন্ট জিয়া।
এরপর তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদের নির্দেশে দ্রুত বিদ্রোহ দমন করা হয়। নির্মমভাবে খুন করা হয় মেজর জেনারেল মঞ্জুরসহ কয়েকজন বিদ্রোহী সেনা অফিসারকে। জিয়া হত্যার অভিযোগে ফাঁসি দেওয়া হয় ১৩ জন সেনা অফিসারকে। যদিও পরবর্তীকালে বিভিন্ন মহল থেকে এরশাদকেই জিয়া হত্যার নেপথ্যচক্রী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও তার আগেই ১৯৮২ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে দেশের মসনদে বসেন জেনারেল এরশাদ। ১৯৯০ সালে এইচ এম এরশাদ সরকারের পতনের পরই রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়।
সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে একটি কুচক্রী মহল রয়েছে, যারা বারবার মাথা চাড়া দেওয়ার দুঃসাহস দেখায়; যারা দেশটির স্বাধীনতালগ্ন থেকেই ছক এঁকে চলেছেন। যারা দেশটির স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি, তারাই দেশের সর্ববৃহৎ সুশৃঙ্খল এই বাহিনীকে বারবার প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছেন। এর সর্বশেষ ছকটি আমরা পিলখানা হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে দেখতে পাই। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে বিএনপির একজন সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন পিন্টুর প্রত্যক্ষ মদদ ও তার দলটির ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনি ম্যান্ডেট অনুযায়ী ক্ষমতা গ্রহণের পর যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে দেশকে একটি অস্থিতিশীল অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়াই যাদের মূল লক্ষ্য ছিল।
এই ন্যক্কারজনক হত্যাকা-ের পর বর্তমান সরকার দ্রুততার সাথে বিডিআরকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সংস্থার নাম ও পোশাক পরিবর্তন করা হয়। বিজিবিকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে নতুন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ‘বর্ডার গার্ড আইন-২০১০’ সংসদে পাশ করা হয়েছে। ফলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশÑবিজিবি নামে আত্মপ্রকাশ করেছে বিডিআর। নতুন পোশাক, নতুন নাম ও সংশোধিত আইন নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান আবারও দৃঢ় পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে মাথা উঁচু করে। শুধু তাই নয়, বিদ্রোহে নিহত সামরিক অফিসারবর্গ ও তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সরকার নানাভাবে সহায়তা ও সহযোগিতা করে। বিডিআর হত্যাকা-ে শহীদ সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের পুনর্বাসন ও কল্যাণেও সরকারের পক্ষ হতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
ইতোপূর্বে বাংলাদেশে অনেক সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে। কিন্তু পূর্বেকার কোনো সরকার তার সুষ্ঠু বিচার করেনি। শুধু ১৯৭৫ থেকে ৮১ পর্যন্ত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে কয়েক হাজার সদস্য নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার এর কোনো বিচার করেননি। বলা হয়ে থাকে ওই সময় প্রায় ২২টির মতো ক্যু সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো কোনো রকম সুষ্ঠু বিচারের মুখ দেখেনি।
পরিশেষে এ কথা বলা যায়, নানান প্রতিকূলতা, অপপ্রচার ও চক্রান্তকে অতিক্রম করে বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত ও বিচার সম্পাদনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সঠিকভাবে সরকার তার দায়িত্ব পালনের কারণে যারা নানান ধুম্রজাল সৃষ্টি করে এ ন্যক্কারজনক হত্যাকা-ের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছিল তাদের অপপ্রয়াস নস্যাৎ হয়েছে। জাতি একটি কলঙ্কের দায় থেকে মুক্তি পেয়েছে। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে দ্রুত বিডিআর বিদ্রোহের রায় ঘোষিত হওয়ায় পুনর্গঠিত বিজিবি অতীতের গ্লানি ভুলে নতুন উদ্যমে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। একই সাথে শেখ হাসিনা সরকারের সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে বিজিবিতে এসেছে স্বস্তি এবং সেনাবাহিনীর মধ্যেও বর্তমান সরকারের অবস্থান হয়েছে আরো সুসংহত।
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:৪১
হাসান কালবৈশাখী বলেছেন:
কিছু প্রশ্নগুলোর উত্তর এখানে পাবেন
- কি ঘটেছিল সেদিন দরবার হলে? ৩ পর্বে।
Part 1
Click This Link
part2
Click This Link
Part 3
Click This Link