নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিএনপি কি জিয়াউর রহমানের রাজনীতি থেকে সরে এল?

১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১০:১০

এক অভিজ্ঞতার কথা বলে লেখা শুরু করছি। সত্তরের দশকের শেষ দিক। তখন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী জেনারেল জিয়াউর রহমানের দোর্দ-প্রতাপ মন্ত্রী এবং নবগঠিত জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব। আমার এক আত্মীয় গুরুতর অসুস্থ, ঢাকা এসেছেন চিকিৎসা করাতে। তার ইচ্ছে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম সাহেবকে দেখানোর। কিন্তু তিনি তখন বিদেশে। অনন্যোপায় হয়ে আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর শরণাপন্ন হলাম, যার সঙ্গে বদরুদ্দোজা সাহেবের ভালো পরিচয় ছিল। 'এপয়েন্টমেন্ট' পাওয়া গেল। বদরুদ্দোজা সাহেব তখন প্রচ- কাজের চাপের মধ্যেও রোগী দেখতেন। কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেল আমার আত্মীয়ের। তিনি কেমন যেন উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। আমি নিয়ে যাবো বদরুদ্দোজা সাহেবের মগবাজারের বাড়িতে। তার নিরুৎসাহ দেখে আমিও আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কারণ তখন নূরুল ইসলাম- বদরুদ্দোজা সাহেবের 'এপয়েন্টমেন্ট' পাওয়া সহজ নয়। পীড়াপীড়িতে এক পর্যায়ে আমার আত্মীয় বললেন, আমাকে উনি ভালো করে দেখবেন তো ? আমি হতভম্ব, এ কি কথা ? মনোভাবে শেষ পর্যন্ত বুঝলাম, বদরুদ্দোজা সাহেব সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, আমার সরলপ্রাণ স্কুল শিক্ষক আত্মীয়ের আশঙ্কা, হয়তো বদরুদ্দোজা সাহেব তাকে ভালোভাবে দেখবেন না। আমি অবশ্য শেষ পর্যন্ত অনেকটা টেনেই নিয়ে গেলাম বদরুদ্দোজা সাহেবের বাড়িতে।
ঘটনাটা মনে পড়ল সম্প্রতি বদরুদ্দোজা সাহেবের একটি উক্তি দেখে। বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘকাল আগে সম্পর্ক ছেদ করে তিনি এখন বিকল্প ধারার সভাপতি। বদরুদ্দোজা সাহেব বলেছেন, বিএনপিকে জিয়াউর রহমানের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বলেছেন বিএনপির আরও কয়েকজন নেতা, সাবেক নেতা। জিয়াউর রহমানের ধারাটি কি? অতি সংক্ষেপে সেই ইতিহাস তুলে ধরা যায় এভাবে, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের চার মূলনীতি, যা দীর্ঘ মুক্তি-সংগ্রাম ও চূড়ান্ত পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা পরিবর্তন করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন (তখন জানা গিয়েছিল, দৈনিক ইত্তেফাকের তদানীন্তন সহকারী সম্পাদক খোন্দকার আবদুল হামিদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন এবং জিয়াকে দিয়ে তার সাংবিধানিক ভিত্তি দিয়েছিলেন। তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় 'মর্দে মুমিন' নামে কলাম লিখে মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাতেন। ইত্তেফাকে একই সুরে লিখতেন স্পষ্টভাষী নামে কলাম। জিয়াউর রহমান উপদেষ্টা করেন তাকে।) জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতির ধারা গড়ে উঠেছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা দখল করে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তা ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করেন, ষড়যন্ত্র শুরু হয় পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বঙ্গভবনে ছুটে এসে এ ব্যাপারে ভারত সরকারের কঠোর ও স্পষ্ট অবস্থান খন্দকারকে জানিয়ে দেয়ার পর ভীতসন্ত্রস্ত স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট (সংবিধানে এই পদটি রাষ্ট্রপতি হিসেবে বর্ণিত থাকার পরও তখন থেকে প্রেসিডেন্ট শব্দের ব্যবহার শুরু হয়।) এই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করলেও (বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করা হলেও মূল ক্ষমতার রাশ ছিল উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের হাতে। এক পর্যায়ে সায়েমকে সরিয়ে দিয়ে তিনি আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বও গ্রহণ করেন।) খন্দকারের ধারাবাহিকতায় মুসলিম বাংলার একটি তত্ত্ব উপস্থাপন শুরু হয়। তৎকালীন সংবাদপত্রে জিয়ার বক্তব্য-বিবৃতিতে মুসলিম বাংলার তত্ত্বটি নানাভাবে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চেতনায় যে পরিবর্তন এসেছিল তার খোলনলচে পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এ সময় মুসলমান-অমুসলমান বিভেদটি প্রকট হয়ে ওঠে, রাষ্ট্রাচার ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে সব ধর্মের সমান মর্যাদা নিশ্চিত হয়েছিল, জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনির্বিশেষে সব মানুষের সমান মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা হয় ধর্মহীনতা নামে, এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয় ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদকে উসকে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। পাকিস্তানের মতোই রাজনীতিতে ধর্ম হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, পুনর্বাসিত হয় একাত্তরের ঘাতক-দালালরা সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে। পঞ্চম সংশোধনী পরবর্তী সময়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ভিত্তি তৈরি করে।
একটি ঘটনা মনে পড়ছে। খুব সম্ভবত '৭৬ অথবা '৭৭ সাল। দীর্ঘদিনের প্রথা অনুযায়ী ২৫ বৈশাখ কবিগুরুর জন্মদিনে সংবাদসহ সব জাতীয় দৈনিকে [সংগ্রাম ছাড়া] প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি এবং সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় ও বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ফি বছর সম্পাদকীয় লিখতেন সন্তোষদা (সন্তোষ গুপ্ত)। তখন পিআইডি থেকে প্রতি রাতেই কয়েকবার ফরমান আসত। সেবারে রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন দুপুরের দিকে পিআইডি থেকে ফরমান এলো, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এতো হৈচৈ না করাই ভালো। দৈনিক সংবাদ-এ পিআইডির ফরমানগুলো একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করা হতো, যাতে প্রত্যেক শিফটে কাজ শুরুর আগে দায়িত্বপ্রাপ্তরা নির্দেশগুলো পড়ে [এবং মেনে] কাজ শুরু করতে পারেন। ঐ নির্দেশটা খাতায় লিখেছিলাম আমি। পড়ে বার্তা সম্পাদক সন্তোষদা এলে তাকে দেখাই। তিনি সম্পাদক আহমেদুল কবীরকে বিষয়টি জানান। কবীর সাহেব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন, বলেন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কোন নির্দেশ মানার দরকার নেই। আমি দেখব। এ ঘটনাটি ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়। যতদূর জানি, প্রত্যেক সংবাদপত্র অফিসেই পিআইডির ফরমানগুলো লিপিবদ্ধ হতো। ঐ সময়ের ফরমান_ খাতাগুলো নিয়ে কোন গবেষক কাজ করলে 'বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার' দাবির প্রকৃত চেহারা খুঁজে পাবেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় জারি করা অভিশপ্ত শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান সেই শত্রু সম্পত্তি আইন (অর্পিত সম্পত্তি রূপে পরিবর্তিত) পুনরুজ্জীবিত করেন এবং আরো কঠোরভাবে প্রয়োগ করেন। লুক্কায়িত শত্রু সম্পত্তি খুঁজে বের করার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে আমলাদের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়, ফলে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন সংখ্যালঘুরা। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণে ১৯৭৭ সালে রমনায় এক জাতীয় সম্মেলনে শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ পরিষদ গঠিত হয়, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এই পরিষদের সভাপতি এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন ভূমিমন্ত্রী ছিলেন এককালের ন্যাপ নেতা আবদুল হক। এই পরিষদের নেতৃবৃন্দ শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন বাতিল করার দাবি নিয়ে হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। হক সাহেব প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন। কিন্তু পরে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার নেতিবাচক অভিজ্ঞতা পরিষদ নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেন। হক সাহেব তার আগের রাজনীতির কারণেই সম্ভবত প্রেসিডেন্টের মনোভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মন্ত্রিসভায় আর বেশি দিন থাকতে পারেননি। লুক্কায়িত শত্রু সম্পত্তি খুঁজে বের করার পদক্ষেপ নেয়ার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এক বিরাট অংশকে ভিটেবাড়ি, জায়গা-জমি হারিয়ে দেশত্যাগ করতে হয়। এখানে উল্লেখ করতেই হয়, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা এই সদাশয় মানুষটির। কিন্তু তিনি যাতে প্রধান বিচারপতি হতে না পারেন, সে জন্য বিচারপতিদের অবসরের বয়স কমানো হয়। দেবেশ বাবু অবসর গ্রহণ করার পর আবার বিচারপতিদের বয়স আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাব থেকেই এটা করা হয়েছিল। প্রশাসনে এই মনোভাব ব্যাপকভাবে কাজ করেছিল।
এই ঘটনাগুলো তুলে ধরলাম জাতির জনকের হত্যাকা-ের পর দেশকে যে বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল তারই একটি খ-চিত্র উপস্থাপন করার জন্যে। জিয়াউর রহমানের বিএনপিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নীতি ও আদর্শ থেকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব কি সত্যিই সরে এসেছে? জিয়াউর রহমান মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতা ফিরিয়ে এনেছিলেন, খালেদা জিয়া মৌলবাদী ধর্মান্ধদের নিয়ে রাজনীতি করেন। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে মসজিদে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি ছড়িয়ে পড়ার কথা বলে পাকিস্তানি নেতাদের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। জিয়াউর রহমান একাত্তরের ঘাতক-দালালদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করেছিলেন, খালেদা জিয়া তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছেন। বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতা তারেক রহমান বিএনপি ও জামায়াতকে একই বৃন্তে দুটি ফুল বলেছেন। জিয়াউর রহমানের পথেই তো চলছে বিএনপি, সে আদর্শ থেকে তো বিচ্যুতি আসেনি। যারা বিএনপিকে জিয়াউর রহমানের ধারায় ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন, তারা তফাতটা কোথায় দেখছেন_ এটা আরো খোলাসা না করলে স্পষ্ট হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি ধারা ফিরিয়ে আনার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিয়াউর রহমান সেনাছাউনিতে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা হয়তো সফল হচ্ছে না। কিন্তু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি আন্তরিকভাবে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সময় হয়তো অনেক কিছু পাল্টে দিচ্ছে, কিন্তু জিয়াউর রহমানের পতাকা খালেদা-তারেক বহন করে চলেছেন, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করা বাতুলতা মাত্র।
- See more at: Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.