![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের উত্থানকালে একটি ছোট্ট দেশ হিসেবে আমাদের করণীয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিষয়টি এ জন্য তাৎপর্যপূর্ণ যে, এর সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তাজনিত বিষয় ছাড়াও রয়েছে সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার প্রশ্ন, অন্যদিকে আমাদের ভেতরগত স্থিতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত সার্বিক উন্নয়ন ও প্রগতি। ছোট দেশ, ছোট অর্থনীতি এই পরিচয় সত্ত্বেও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা যে দৃষ্টান্ত রেখেছি সেটি দক্ষিণ এশিয়াতেই শুধু নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীতেও হৈচৈ ফেলেছে। সামাজিক উন্নয়নের যে ধারা এখানে সূচিত হয়েছে, তা স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রকট দরিদ্রতাকে মুছে ফেলতে পেরেছে, কয়েক বছর আগেও যা কল্পনা করা কঠিন ছিল। খাবার ও বাসস্থানের অভাব ঘুচে গেছে মানুষের, চিকিৎসাসেবা এখন খুব কাছাকাছি এসেছে, ওষুধের মূল্যও হাতের নাগালে, মানুষের আয়ের ক্ষমতা বেড়েছে, নারী-পুরুষ বৈষম্য কমেছে, নারীরা এখন আর বন্দি নয় বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা এখন পুরুষের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে, শিশুরা এখন দলবেঁধে বিদ্যালয়ে যায়, ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, সামাজিক নিরাপত্তায় সরকার অনেক বেশি তৎপর। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ ধারা অব্যাহত রাখা গেলে অচিরেই পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান হবে ঈর্ষণীয়। তুলনামূলক অনগ্রসর রাষ্ট্রগুলো তখন আমাদের দেখানো পথে অগ্রসর হবে, আমরা হব আইকন। অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ এই ক্ষণে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ বিশেষত ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচড়া দিয়ে উঠছে, এর সঙ্গে উৎকণ্ঠা বাড়ছে আমাদেরও। এই উৎকণ্ঠা একদিকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেÑ আমাদের সজাগ করছে সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে, অন্যদিকে এই উৎকণ্ঠা যখন মাত্রাতিরিক্ত ও অসাবধানী প্রচারণায় রূপ নিচ্ছে তখন সেটি কিন্তু ভিন্ন বিবেচনায় উগ্রবাদের বিজ্ঞাপনও।
বাংলাদেশ যেহেতু পৃথিবীর বাইরের কোনো রাষ্ট্র নয়, সেহেতু ধর্মীয় উগ্রবাদের আঁচ এ পর্যন্ত পৌঁছবে এটিই হয়তো কোনো কোনো বিচারে স্বাভাবিক, তবে আশার কথা হলো বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ, সহিষ্ণু ও উদার সংস্কৃতি, যা উগ্রপন্থার সঙ্গে কোনোকালেই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না, অন্যদিকে বাঙালি মুসলমান হিসেবে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের দেখেছি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাপরায়ণ ও সহিষ্ণু হতে। উগ্রপন্থা কার্যকর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তাই দূর ভবিষ্যতেও এখানে দেখতে পাই না। সাম্প্রতিক সময়ে দুজন বিদেশি নাগরিকের দুঃখজনক হত্যাকা-ের পর কিছু দেশি-বিদেশি সংস্থা ও গণমাধ্যম বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদের ভিত্তিভূমি হিসেবে চিহ্নিত করতে তৎপর হয়ে ওঠে। এ কথা ঠিক যে, মাঝে মধ্যে বাংলাদেশে ভিনদেশি উগ্রবাদীরা শেকড় গাড়তে আগ্রহী হয়েছে, অথচ যখনই এই অপতৎপরতা আমাদের নজরে এসেছে আমরা তার মূলোৎপাটনে সফলও হয়েছি, এটি এই জাতির অগ্রগতির আরও বড় খবর। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের যেসব স্থানে সন্ত্রাসবাদের নামে যুদ্ধ এবং অস্থিতিশীলতা চালু আছে বা যে অঞ্চলগুলো বিভিন্ন পরাশক্তির প্রক্সিযুদ্ধের ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার পেছনে অনেক ঘটনা রয়েছে বলে আমরা জানি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যারা উগ্রবাদ এবং এর উত্থান নিয়ে পড়াশোনা, কাজ কিংবা গবেষণা করছেন তারা এই অস্বস্তিকর বিশ্বব্যবস্থার জন্য দায়ী করছেন সাম্রাজ্যবাদী লোলুপ দৃষ্টিকে, এই অশুভ শক্তিগুলো পৃথিবীতে গণতন্ত্র ও স্থিতির কথা বলে, উগ্রবাদ দমনের কথা বলে দীর্ঘমেয়াদি হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, এর সঙ্গে আছে অস্ত্র ও তেল-বাণিজ্য, যদিও সেগুলো একান্তই পলিটিক্যাল ডিসকোর্স বা রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়।
আমরা সমকালীন বাংলাদেশে উগ্রপন্থার উত্থান আশঙ্কায় যে দুঃসহ প্রহর গুনছি সেটি নিয়ে সতর্কতার অনেক বিষয় রয়েছে, তবে তাদের বক্তব্যকে আমরা জোরেশোরে নাকচ করতে চাইব যারা ভবিষ্যৎ বলেন এভাবে যে, বাংলাদেশ আফগানিস্তান কিংবা ইরাকের পরিণতি লাভ করতে পারে। এ বিষয়ে আমরা আশাবাদী যে, যারা এ ধরনের কথা বলছেন তাদের পর্যবেক্ষণ শুধু ভুল হিসেবেই পরিগণিত হবে না বরং তারা বিস্মিত হবেন আগামীর বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও এ দেশের মানুষের শ্রম, নিষ্ঠা ও সহিষ্ণুতা দেখে। দুজন বিদেশি নাগরিকের দুঃখজনক পরিণতি দেখে যারা গোটা বাংলাদেশকেই পেছনে ঠেলে দিতে চান তাদের বুদ্ধির দৌড় আমাদের হতাশ করে, সেসব বিচক্ষণ ভঙ্গির মানুষদের পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশগুলো দেশের কল্যাণে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
তবে দেশকে অকার্যকর করার ক্ষেত্রে উগ্রবাদের উত্থানের ষড়যন্ত্রও বেশ পুরনো। প্রাকৃতিক সম্পদের অজস্র সম্ভাবনা, মানবসম্পদের উপযোগিতা, পর্যটন শিল্পের ইতিবাচক হাতছানিসহ নানাদিক থেকেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বচ্ছ, দূরদর্শী ও সুযোগ্য নেতৃত্ব দ্বারা বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের অগ্রযাত্রা সূচিত করেছিলেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার সদস্যপদ লাভ, দেশ থেকে দারিদ্র্য নির্মূলের প্রক্রিয়া শুরু, তরুণদের দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ, শিল্প,-বাণিজ্য, কৃষিক্ষেত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই বিস্ময়কর সাফল্য সাধিত হচ্ছিল। সে সময়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যায় জড়িতরা উগ্রপন্থী ছিলেন। পঁচাত্তরে পটপরিবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একটি দলও গঠন করেন। এ দলের মাধ্যমে দেশের তরুণদের লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো উগ্র ও জঙ্গিবাদে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। পরে দেশে ফিরে তারা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। উগ্রপন্থী এ গোষ্ঠী এ দেশের সহজ-সরল মানুষকে ধোঁকা দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শক্ত একটি ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন। এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মাধ্যমে তারা দেশে উগ্রবাদকে ছড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এর সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক চক্রও। দেশব্যাপী অব্যাহত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এ বিদেশিদের হত্যা। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের কঠোর অবস্থান ও দেশবাসীর সচেতনতার কারণে এ গোষ্ঠী কখনোই সুবিধা করতে পারেনি।
বাংলাদেশ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচকে আঞ্চলিক অনেক দেশের তুলনায় প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে, তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের আশাবাদ আছে, ঢাকা এখন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম শহর, এ দেশে গড়ে উঠছে দক্ষ জনশক্তি, ঠিক এই সময়ে এসে উগ্রপন্থার উত্থানের কোরাস সন্দেহের খোরাক তৈরি করে। যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং সার্বিক প্রগতির ধারাকে বিভিন্ন কৌশলে রোধ করতে চায় তাদের বড় পরিকল্পনার অংশ কি না এই জঙ্গি-উত্থান-পর্ব সেটি অবশ্যই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। দেশে দেশে উগ্রপন্থীরা তাদের তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে মিশন নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বিশ্বমঞ্চে এসব উগ্রপন্থী নাটকের কুশীলব এবং অনুঘটকদের সে ভ্রান্ত ভাবনা এ দেশের মাটিতে কোনোদিনও সফল হবে না, কিছু পথভ্রষ্ট এবং অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের বিকৃত চিন্তায় যেমন বাঙালি কোনোদিন সায় দেয়নি, ঠিক তেমনি পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়Ñ এবারের পর্বেও তারা হতাশ হবেন।
তবে যারা উগ্রপন্থার বিকাশ চায় তাদের হারাতে হলে আমাদেরও শক্তি সঞ্চয় করতে হবে, আগামীর এই লড়াই হবে দেশকে বাঁচানোর, দেশের যে সঞ্জীবনী শক্তি সেই ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে সমুন্নত রেখে দেশ ও জনগণকে রক্ষার লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাইকে এক কাতারে এসে দাঁড়াতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্তিশালী করতে হবে, শৃঙ্খলা বাহিনীকে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় কোথায় তারা আস্তানা গাড়তে চায়, দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দেশের প্রয়োজনে কথা বলতে হবে, তবেই সম্ভব হবে জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদের শেকড় উপড়ানো। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ধর্মীয় জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ সম্পূর্ণ নির্মূলে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারের সুযোগ্য কর্মকৌশলে এ দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী উগ্রপন্থা দমনে খুবই সফল হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা। উগ্রপন্থা নির্মূলের লড়াই হয়তো সময়সাপেক্ষ, কিন্তু সে সাহস এবং দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে রয়েছে। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথেই সব বাধা-ভয়কে রুখে দিতে পারব। জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ ও সাহসী নেতৃত্বেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, যে উগ্রবাদমুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে এখানকার দেশপ্রেমিক ও উন্নয়নকামী সব মানুষ।
অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির
©somewhere in net ltd.