![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এ দেশের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে দ্রুত বিচারের সক্ষমতা এবং আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো শিশু রাজন ও রাকিবকে পৈশাচিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে। রাজন হত্যার চার মাস ও রাকিব হত্যার তিন মাস পাঁচ দিনের মাথায় ছয় আসামির দণ্ড ও দুই রায়কে সব মহল থেকে দৃষ্টান্তমূলক আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এভাবে সব মামলার দ্রুত বিচার সম্পন্ন হলে দেশে অপরাধের মাত্রা অনেক কমে আসবে। বিচারব্যবস্থার প্রতিও মানুষের আস্থা বাড়বে। আসলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এ দেশের সুশাসনের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইন জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। অন্যদিকে মিডিয়ার ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে সাধারণ মানুষ সুরক্ষা পেয়ে থাকে। এ কথা ঠিক, আইন রক্ষা করবে জনস্বার্থ, নিশ্চিত করবে সবার সমান মর্যাদা ও অধিকার, সংরক্ষণ করবে মানবাধিকার এবং যেকোনো অধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকারের বিধান করবে। এসবই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি।
শিশু হত্যাকাণ্ড, ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক খুন, জঙ্গিবাদীদের অপতৎপরতাসহ বড় ধরনের অপরাধ আমাদের সমাজে নানা কারণেই বেড়েছে। তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজটি চলছে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে। এরই মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর করায়; যদিও কয়েকজন অপরাধীকে এখনো ফাঁসিতে ঝোলানো সম্ভব হয়নি। অবশ্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেই আলোকে আইনকানুন, নিয়মনীতি, পরিকল্পনা ও বিভিন্ন কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন অব্যাহত আছে; দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি, আইনকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগই যথেষ্ট নয়; তার জন্য সামগ্রিক ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ প্রয়োজন। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সামগ্রিক উদ্যোগের সহায়ক কৌশল হিসেবে 'সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় : জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল' প্রণয়ন করা হয়েছে। এই কৌশলটি বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সুধীসমাজ ও বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। চরিত্রনিষ্ঠতা আনার জন্য মানুষের জীবনের একেবারে গোড়া থেকে, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। রাজনীতিতেও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড এগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।' স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বহু ধরনের আইন, বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরো কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং এগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) শেখ হাসিনার সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল। 'রূপকল্প ২০২১' ও 'রূপকল্প-৪১' বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণীত 'বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা' শীর্ষক দলিলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এই আন্দোলনে সবাইকে অংশীদার হতে উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম যেসব আইন গত মহাজোট সরকারের সময় প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯', 'তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯', 'ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯', 'সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯', 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯', 'চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইন, ২০১০', 'জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১', 'মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২', 'মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২', 'প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২' ইত্যাদি। এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি প্রতিরোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর সে সম্পর্কে ব্রিটিশ আমল থেকেই বিধান চালু রয়েছে।
বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বস্তরে বিস্তৃত দুর্নীতি নির্মূল করলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত হবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, পুলিশ প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক নেতাদের অযাচিত প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এসব বাস্তবতা থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আগামী এক দশকে এ দেশে ক্ষুধা, বেকারত্ব, অশিক্ষা, বঞ্চনা ও দারিদ্র্য থাকবে না। দেশে বিরাজ করবে সুখ, শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি। সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে 'এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা' হবে, 'যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত' হবে। এই লক্ষ্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের অবশ্যকর্তব্য এবং সেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য পরাকৌশল। কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়; তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে নাগরিকরা চরিত্রনিষ্ঠ হয়, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সুধীসমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা পায়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মানুষকে নৈতিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ যেন সে অনুসরণ করে চলে। তার যেন সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য থাকে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি পর্যায়ে কর্তব্যনিষ্ঠতা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠতা খুব দরকার। এ জন্য বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়মনীতির সঙ্গে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই অঙ্গীকার কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি জনগণের প্রচেষ্টা গুরুত্ববহ। আগেই বলেছি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও অপরাধ দমনে মানুষের সচেতনতা অন্যতম দিক। রাজন ও রাকিব হত্যার পর মানুষের সামাজিক সচেতনতা লক্ষ করা গেছে। এই মামলায় ছয়জনের ফাঁসির রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছে।
৮ নভেম্বরের রায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে আশান্বিত করে তুলেছে। কারণ রাজন ও রাকিবের মা-বাবা কাঙ্ক্ষিত বিচার পেয়েছে। অন্যদিকে অপরাধী উপযুক্ত শাস্তি পাওয়ায় অন্য অপরাধীরাও সাবধান হয়ে অপরাধকর্ম থেকে দূরে থাকবে বলে আমরা মনে করছি। উপরন্তু ন্যায়বিচারের নজির সাধারণ মানুষকেও আইনের শাসনের ব্যাপারে সচেতন করে তুলেছে। প্রচলিত বিচার কাঠামোর ওপর আস্থা বেড়েছে। তবে রাজন ও রাকিবের মতো শিশু হত্যার দ্রুত বিচার সম্পন্ন হওয়ায় অন্যান্য অপরাধের মামলার রায়ও অনতিবিলম্বে নিষ্পত্তি হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। বিশেষত ব্লগার ও লেখক-প্রকাশক হত্যার বিচার দ্রুত নিষ্পন্ন হওয়া দরকার। কারণ এ দেশের সমাজে আইনের শাসনের স্তম্ভ হলো বিচারব্যবস্থার গতিশীলতা। মিল্টন বিশ্বাস
©somewhere in net ltd.