![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমাদের বিজয়টা ছিল অখ- এবং পূর্ণাঙ্গ। আমরা যুদ্ধ করেছি দেহে ও মনে। আমরা জয়ী হয়েছি রাজনীতি ও সংস্কৃতির লড়াইয়ে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রকে বলা হতো যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট। তার জোরটা কম ছিল না। একটা জাতি বোবা হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে না। এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্র অমোঘ অস্ত্রের মতো কাজ করেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ প্রচার ও অব্যর্থ প্রেরণার অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। বেতার থেকে প্রচারিত গান, নাটক, কথিকা, খবর, সংবাদ বিশ্লেষণ সব সাংস্কৃতিক কর্মকা- যুদ্ধ জয়ের অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। মনে রাখতে হবে যে তখন বাঙালি জাতির মনের জোর বেড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। কী সাংঘাতিক কথা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কেউ বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। টলস্টয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' উপন্যাসে লেখা আছে যে, নেপোলিয়ান যখন রুশ আক্রমণ করল তখন বিনা আহ্বানে রুশ জাতি মুহূর্তের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফরাসি বাহিনীকে মোকাবেলা করে পরাজিত করেছে। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে নির্দেশ হিসেবে ধরে নিয়ে স্বেচ্ছায়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে। যার যা আছে তাই নিয়েই শত্রুকে মোকাবেলা করেছে। এক হাজার বছরের মধ্যে বাঙালিরা এভাবে কখনো জীবনের মায়া ত্যাগ করেনি। রাজাকার আল-বদরদের বাদ দিলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। যোদ্ধায় পরিণত হয়েছিল। বাঙালিরা যে যেখানে অবস্থান করছিল, সেখান থেকেই তার মতো করে যুদ্ধ করেছে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন লন্ডনে। ২৫ মার্চের বর্বর আক্রমণের খবর শুনে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, 'লন্ডনের রাস্তায় আমার লাশ পড়ে থাকবে তবু দেশে ফিরে যাব না।' শুধু লন্ডনের নয়, বিচারপতি চৌধুরী গোটা বিশ্বের প্রবাসী বাঙালিকে সংগঠিত করে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বের সভ্য দরবারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। তার লেখা 'মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসের দিনগুলি' বইতে এর বিস্তৃত বিবরণ আছে। আবদুল মতিন লিখেছেন 'মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি' সেখানেও অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা যে অবদান রেখেছেন তার তুলনা হয় না। তৎকালীন বাঙালিরা যে দেশেরই নাগরিক ছিলেন না কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একাত্ম হয়েছিলেন। সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ কি ফরাসি নাগরিক ছিলেন না? তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই নন্দিত কথাশিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা বুঝতে হলে নারী ও শিশুদের অংশ গ্রহণের দিকটি বুঝাতে হবে। বিভিন্ন লেখায় পেয়েছি কিশোররা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। নারীরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, ইজ্জতও দিয়েছে। যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা খান সেনাদের হাতে ধরা পড়েছে, তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ছেড়ে দিলে তুমি কী করবা? উত্তরে বলেছে, আবারো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব।
আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত 'বাংলাদেশ কথা কয়' ছোট গল্প সংকলনে পেয়েছি, এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা যখন তার অস্ত্র ঘাড়ে তুলে নিত তখন তার অস্ত্রটি মাটিতে ঠেকে যেত। এটা কাল্পনিক গল্প না, সত্য ঘটনা। অনেক সময় সত্য ঘটনা স্বপ্নকেও হার মানায়।
আমি তখন ম্যাট্রিক ক্যান্ডিডেট হলেও ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা কলেজের বিদুষী অধ্যাপিকা (বাংলা) জয়া সেন গুপ্তার নাম শুনেছিলাম। তিনি রূপসীও ছিলেন। আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম তার জন্য। খোঁজ নিয়ে জানলাম ম্যাডাম ভারতে চলে যেতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের সঙ্গে বিয়ে হয়। তিনি মনসা মঙ্গল কাব্যের ওপর পিএইচডি করেছেন।
আমাদের গ্রামে আনোয়ার দরবেশ নামে এক আধাপাগল ধর্মপ্রাণ আলেম ছিলেন। নির্ভীক ছিলেন। উচিত কথা বলতেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের দিকে আমাদের এলাকায় রাজাকাররা নারী ধর্ষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। একদিন ভাঙ্গা বাজারে এসে আনোয়ার দরবেশ বললেন, 'কী রে কী শুরু করেছিস তোরা? আল্লার গজব নামবে তোদের ওপর। পরের দিন আনোয়ার দরবেশকে রাজাকাররা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
আমি জানি, বাংলাদেশের অসংখ্য ধর্মপ্রাণ আলেম 'জয়বাংলা' সস্নোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এদের পর আলাদা গবেষণা হওয়া উচিত। ড. মুনতাসীর মামুনকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাব এই বিষয়ে লেখার জন্য।
হিন্দুদের ওপর মারাত্মক ক্রুদ্ধ ছিল খান সেনারা। সঙ্গত কারণে শরণার্থীদের মধ্যে হিন্দু নর-নারীই বেশি ছিল। খান সেনাদের কমন জিজ্ঞাসা ছিল, 'মালাউন কাহা হ্যায়ে?' যে ক'জন হিন্দু হাতের কাছে পেয়েছে তারা, বিলম্ব না করে হত্যা করে ইমানি দায়িত্ব পালন করেছে। ভাঙ্গা থানার বিখ্যাত অভিনেতা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা নারায়ণ চন্দ্র মলি্লককে চন্দ্রিদাসদী গ্রাম থেকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করেছে খান সেনারা। আজো ভুলতে পারিনি তাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডিসেম্বর মাসে শেষের দিকে কতিপয় পরাজিত খান সেনাকে একটি গাড়িতে করে ফরিদপুর সদরে নিয়ে যাচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। কী কারণে যেন ভাঙা বাস স্টেশনে মুক্তিযোদ্ধারা গাড়িটি থামান। ঘটনাক্রমে আমি ওখানে ছিলাম। দেখি, একজন হিন্দু বয়স্ক লোক ওই গাড়ির সামনে গিয়ে খান সেনাদের ব্যঙ্গ করে বলছেন, 'মালাউন কাহা হ্যায়, না? এইতো আমি মালাউন।' বুঝতে পারলাম, কত ক্ষোভ, কত অপমানের যন্ত্রণা তার বুক চিরে বের হলো।
ড. মুনতাসীর মামুন বলেছেন, মূলত আমরা অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্য রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। যেখানে স্বয়ং জিন্না ছিলেন বিধর্মী, সেখানে বাঙালিদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন, তারা মুসলমান কিনা। ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ফিরোজ খান নুন এক বক্তৃতায় বলেছিলেন 'বাঙালিরা হিন্দুর বংশধর, তারা একটা মুরগিও মুসলিম রীতিতে জবাই করে না।' এর উত্তরে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী বললেন, 'লুঙ্গি উঁচা কইরা দেখানো লাগবে যে আমরা মুসলমান কিনা।' ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খান সেনারা লুঙ্গি খুলে দেখেছে, বাঙালিরা মুসলমান কিনা। এর চেয়ে অপমান তো গাছে ধরে না। পাকিস্তানের জন্য যাদের দিল কাঁন্দে তারা কি ঘটনাটা জানেন না।'
অগি্নকন্যা মতিয়া চৌধুরী এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'পাকিস্তানি খান সেনারা কোরআন শরিফ গলায় ঝুলিয়ে এই দেশে এসেছিল। যে বাংকারে বাঙালি নারী ধর্ষণ করা হোত, সেই বাংকারেই কোরআন শরিফ ঝোলানো থাকত।'
মারাত্মক কথা এবং সত্য কথা। আজ (২৪/১১/১৫) দৈনিক 'যায়যায়দিন' পত্রিকায় পেলাম সিরিয়ায় আইএস এক ধরনের নেশাগ্রস্ত, মাদকজাতীয় ট্যাবলেট খেয়ে যুদ্ধ করে এবং এই মাদক জাতীয় ট্যাবলেট অন্যান্য দেশে চালান দিয়ে টাকা আয় করে, তা দিয়ে অস্ত্র কেনে। এরা আবার প্যারিসকে বলে 'পাপাচারের নগরী'। পাপ কাকে বলে তার সংজ্ঞা দিয়েছেন উর্দু ভাষার কথাশিল্পী সাদাত হাসান মান্টো।
আইএস আর বোকোহারামের মতো হঠকারিতার মাধ্যমে আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পথে, একটি নির্বাচনের রায়কে ভিত্তি করে, গণযুদ্ধের মাধ্যমে, বিশ্ববিবেকের সমর্থন নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। তাই আমাদের বিজয়টা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষেরও বিজয়। মার্কিন প্রশাসন আমাদের বিপক্ষে ছিল, কিন্তু মার্কিনের জনগণ ও বুদ্ধিজীবীরা আমাদের পক্ষে ছিলেন।
বিশ্ববাসী দেখেছেন, ভুট্টো, ইয়াহিয়া কী পরিমাণ নোংরা খেলা খেলেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ভুট্টো আর ড. কিসিঞ্জার নোংরামি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে পাকিস্তান এবং মার্কিন প্রশাসনের হাত ছিল। অথচ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন, এটা ছিল তার শান্তি প্রত্যাশার প্রতীক। এজন্যই তিনি 'জুলিও কুরি' শান্তির পদক পেয়েছিলেন।
পাকিস্তান ছিল একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সাম্প্রদায়িকতাকে কবর দিয়ে আমরা ভাষাভিত্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন করেছি। আমরা জাতিসংঘের সনদপত্র মেনে নিয়ে, রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। জাতিসংঘ কোনো ধর্মশালা নয়। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে অনেক দেশের মতো আমরাও দেশের উন্নয়ন করছি আর বিশ্বব্যাংক ইসলামী ব্যাংক নয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রকে জেনেভা কনভেনশন মেনে চলতে হয়, জেনেভা কনভেনশন কোনো ধর্ম চুক্তিপত্র নয়। একটি আধুনিক, বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেছি। ৩০ লাখ মানুষের রক্তকে হিন্দু-মুসলমানে বিভাজন করা একেবারে অসম্ভব। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি এসবের ধর্ম নেই। এসব হচ্ছে রাষ্ট্রের ভিত্তি। পাকিস্তানে আমাদের কোনো স্বাধীন অর্থনীতি ছিল না। এজন্য আমাদের দুই অর্থনীতির আন্দোলন করতে হয়েছে। এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
লেখাটি শেষ করার আগে পাকিস্তান প্রেমিকদের ইতিহাসের তিনটি বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেই। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতৃত্ব ইচ্ছে করে কলকাতা শহর ছেড়ে দিয়েছে, মাউনব্যাটনের সঙ্গে কোনোরকম বার্গেনিং করেনি, শেরে বাংলা সোহরাওয়ার্দীর মতো যোগ্য নেতাদের প্রতিনিধিত্ব করতে দেয়নি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর পাকিস্তান সরকার লাখ বাঙালির লাশের প্রতি ছিল উদাসীন। এই তিনটি কারণেও পাকিস্তানের অবাঙালি নেতৃত্বের ওপর আপামর বাঙালি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিল। পথ খুঁজছিল স্বাধীনতার।
মাহমুদুল বাসার: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক
©somewhere in net ltd.
১|
০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০৪
কৃষ্ণ চুড়ার ফুল বলেছেন: মুক্তি যুদ্ধের একজন প্রতক্ষদর্শী হিসেবে আপনার কাছ থেকে মুক্তি যুদ্ধের আর লেখা পাব বলে আশা করি।
সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ