![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া প্যারিসে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন চলবে আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সম্মেলনে ১৯৫টি দেশের ডেডিগেট ও ১৫০টি দেশের প্রেসিডেন্ট, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা যোগদান করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও চীনের প্রেসিডেন্টসহ বিশ্ব নেতারা সম্মেলনে যোগদান করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে আছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত ও আবদুল মুকিত এবং সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ এমপি।
এবারের সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। এই সম্মেলনে সর্ব সিদ্ধান্তক্রমে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রাখার প্রস্তাব সমর্থিত হয়েছে। একই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি কমিয়ে আনার জন্য জীবাশ্মনির্ভর জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ জ্বালানি তেল ও কয়লার ব্যবহার ক্রমাগত কমিয়ে শূন্যের কোটায় আনার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত ও শিল্পসমৃদ্ধ দেশসমূহ যারা বেশি মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ ঘটায় তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের জীবাশ্মনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। হঠাৎ করে তাদের বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার সহজসাধ্য নয়। তবে সৌর শক্তির ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি করা জরুরি প্রয়োজন। তাই স্বভাবতই শিল্পসমৃদ্ধ দেশসমূহ আরো সময় নেয়ার দাবি জানাবে। তাছাড়া বিকল্প জ্বালানির ব্যাপারে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। তাও তারা এই মুহূর্তে জোগান দিতে রাজি আছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এভাবে কার্বন দূষণ হতে থাকলে এবং বনজসম্পদ বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত কমতে থাকলে বিশ্ব তাপমাত্রা এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে যে, উভয় মেরু অঞ্চলে বরফ গলার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চ হতে থাকবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে।
সম্প্রতি জার্মান থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিনের তথ্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ। বাংলাদেশ সরকার বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা এর আগেই দুটি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে নিজে উপস্থিত থেকে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতাদের স্মরণ করে দিয়েছিলেন। ফ্রান্স সম্মেলনে আলোচ্য বিষয় হিসেবে যা কিছু আলোচিত হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিপূর্বেই সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। এভাবে বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ যে বিপর্যয় ও ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং উপক‚ল ও নিম্নাঞ্চলের বসবাসরত জনগণকে ভিটা-বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র উদ্বাস্তু হতে হবে। তা তিনি ওই সম্মেলনে প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছিলেন। এরূপ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবে এবং বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি মানুষ অভিবাসন বলে বিবেচিত হবে। এখনই উপক‚ল অঞ্চলে বসবাসরত হাজার হাজার পরিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্ব স্ব অঞ্চল ছেড়ে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিয়ে স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। এসব জেনেশুনে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা যে সব দেশের কারণে আজ বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই বিপর্যয়কে মানবিক, নৈতিক ও যুক্তিযুক্ত দাবি বলে মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিগত দিনে কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের মতো এবারো কি ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত সম্মেলন সমস্যা নিরসনে কোনো বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে কিনা।
সংবাদ মাধ্যমে যা জানা গেছে তা সত্যিই দুঃখজনক ও নিরাশার কথা। কোপেন হেগেন সম্মেলনে বড় বড় অনেক কথা বলা হয়েছিল কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয়নি। কেননা জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এর ক্ষুদ্রাংশ মাত্র সরবরাহ করা হয়েছে। ওই সম্মেলনের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাব্যঞ্জক। একশ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব করা হলেও শিল্প উন্নত দেশসমূহ কে কি পরিমাণ অর্থের জোগান দেবেন সে ব্যাপারে সঠিক প্রতিশ্রæতি নেই বা ওয়াদা করেও ভঙ্গ করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশের দাবি বিষয়টি আইনগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে আইনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে আসা। বাংলাদেশের অনেক প্রস্তাব ও দাবিসমূহ ওই সম্মেলনে গৃহীত হলেও বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এই অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার দেশের সংকট বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় বাজেটের প্রায় ৬-৭ ভাগ অর্থ জলবায়ু পরিবর্তন সংকট মোকাবেলায় ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন এবং সাংবিধানিকভাবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। প্রাথমিক ফান্ড হিসেবে এক বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রæতির অর্থের বাংলাদেশ সরকার ২-৩ ভাগ অর্থের জোগান দিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল এখন ফ্রান্স সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবতার আশাবাদ নিয়ে সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ দাবিসমূহ তুলে ধরেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ ঐকমত্যে পৌঁছার ওপর জোর দিয়েছেন। তাছাড়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল মনে করে শিল্প সমৃদ্ধ দেশসমূহ যে অর্থ প্রদান করবে তা অনুদান হিসেবে দিতে হবে, কোনো ঋণ হিসেবে নয়। যা শিল্পোন্নত দেশগুলো ঋণ হিসেবে দিতে চায়। বাস্তবায়ন কৌশল হিসেবে তারা এটা বেসরকারি পর্যায়ের মাধ্যমে দিতে আগ্রহী। এতে তাদের পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ কার্যকর রাখা সম্ভব হবে। এই বিষয়টি সরকারিভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে বিধায় অনুদান সরকারের মাধ্যমেই ব্যয় করা সমীচীন। তাছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে পণ্য হিসেবে গণ্য করে যে অর্থ প্রদান করে থাকেন জলবায়ুর ক্ষেত্রে তা অনুকরণীয় নয় বলে বাংলাদেশ সরকার মনে করে।
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু বিপর্যয় সৃষ্ট বিশ্ব সমস্যা নিরসনে অবদান রাখায় জাতিসংঘ কর্তৃক ইতিপূর্বেই স্বীকৃতি পেয়েছে ও জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ পদকে ভূষিত হয়েছেন। আবার বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক ওয়াশিংটন ভিত্তিক প্রখ্যাত ম্যাগাজিন ‘ফরেন পলিসি’ এ তালিকা প্রকাশ করেছে ডিসিশন মেকারস ক্যাটাগরিতে শেখ হাসিনাকে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যু মোকাবেলায় তার অসামান্য অবদানের জন্য নেতৃস্থানীয় ‘আন্তর্জাতিক চিন্তাবিদ’ হিসেবে উপাধি দিয়েছে ‘ফরেন পলিসি’। আন্তর্জাতিক এ সব সম্মান অর্জন দেশের জন্য গৌরবের। শেখ হাসিনা এখন শুধু বাংলাদেশের নেত্রীই নন, বিশ্ব পরিমণ্ডলে একজন বড় মাপের চিন্তাবিদ। যিনি বিশ্ব সংকট ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে সক্ষম। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের মহল বিশেষ ও আন্তর্জাতিক সহযোগী শেখ হাসিনার এ সব গৌরবময় অর্জনকে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন।
ফ্রান্স সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে বিশেষ করে জলবায়ু সংকট নিরসনে যারা শেখ হাসিনার ওপর আস্থাশীল সবাই শেখ হাসিনার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। প্রত্যেক আলোচক শেখ হাসিনার চিন্তা-চেতনা, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনামূলক কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে ভূয়সী প্রশংসা করেন। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কপ কমিটির চেয়ারম্যান লবেন ফাবিয়াসের বক্তব্যেও শেখ হাসিনার জলবায়ু সংকট নিরসনে অবদান রাখার জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলও শেখ হাসিনার রূপরেখা তুলে ধরবেন এবং সম্মেলন মতো পার্থক্য সত্ত্বেও ফলপ্রসূ হবে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সেই প্রত্যাশাই করে। তবে এ কথা সত্য, গ্রহণযোগ্য আইনগত বাধ্যবাধকতা চুক্তি না হলে এই সম্মেলন ফলপ্রসূ হবে না। মূল সমস্যা হচ্ছে জ্বালানির উৎসের জন্য প্রয়োজনীয় কোটি কোটি ডলার। এ জ্বালানি উদীয়মান দেশগুলোর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি বাদ দিয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য একান্ত প্রয়োজন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং সতর্কতার সঙ্গে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে বলেই মনে করছেন বিশ্ব নেতারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে হলে সুরক্ষা আইন অতীব জরুরি। আর জার্মানভিত্তিক একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, মানবজাতি যদি গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন, বিশেষ করে যা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন হয়, সেটা আটকাতে না পারে, তাহলে সমুদ্রসীমার উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড়, বন্যা ও খরা আরো মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সর্বশেষ খবর নেতারা মতপার্থক্য সত্ত্বেও একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন, কল্যাণকর ও ভালো কাজে বাধা আসবে, তা মোকাবেলা করেই অগ্রসর হতে হবে।
ডা. এস এ মালেক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলাম লেখক।
©somewhere in net ltd.