![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্ণ হলো। সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রথম বছরে অনেকের মাঝে এক ধরনের শঙ্কা ছিল। কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। কেননা বড় একটি রাজনৈতিক দল ও তাদের জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে এ সরকার কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা নিয়ে নানা প্রশ্নও দেখা দেয়। এমন একটি অবস্থার মধ্য দিয়ে নির্বাচন হয়, যাতে অনেকে মনে করেছিলেন একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেতে এ সরকারের পক্ষে কোনো অসুবিধা হয়নি। সরকারের স্থিতিশীল হতে কিছুটা সময় লেগেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরাও দ্রুতই নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য আগ্রহ ব্যক্ত করে।
গত দুই বছরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর কোনো ঝামেলা ছাড়াই ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমুদ্রসীমা জয় করতে পেরেছি। বর্তমান মেয়াদে সরকারের আরেক বড় সাফল্য হলো ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত চুক্তি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র থাকতে হয়। কিন্তু এ রকম মানচিত্র আমাদের ছিল না। তবে এ সমস্যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। সীমানা নিয়ে যে জটিলতা হতে পারে, তা অন্য কিছু নিয়ে হতে পারে না। বিভিন্ন দেশের মধ্যে সীমানা নিয়ে সংঘাত লেগেই আছে। জাপানের সঙ্গে চীনের, ইরাকের সঙ্গে ইরানের, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনেরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। আমাদেরও সীমানা নিয়ে সমস্যা ছিল। সঠিক সীমানা নির্ধারণ ৪৪ বছরেও হয়নি। আমাদের কতগুলো ছিটমহল এদিক এবং ওদিক ছিল। কোথাও কোথাও সীমানা ছিল বিভ্রান্তিকর। ৪৪ বছর ধরে আমরা রাজনীতিকদের মুখে আঙ্গরপোতা-দহগ্রামের কথা শুনে আসছিলাম। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসার মধ্য দিয়ে সীমানা সংক্রান্ত সমস্যা দূর হয়ে যায়, যা আমাদের পররাষ্ট্রনীতি তথা রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত সমস্যা নিরূপণ করেই বাংলাদেশ কেবল বসে থাকেনি বরং তার করণীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন, যা টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান সরকারের আরেকটি বড় সাফল্য হলো পদ্মা সেতু নির্মাণ। এটি নিয়ে নানা মহল থেকে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। বর্তমানে নিজস্ব অর্থায়নে সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশী-বিদেশী চক্রান্তের কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে দূরে সরে যায়। এটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। যে সেতু বদলে দেবে দেশ, সেই পদ্মা সেতু এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়, বরং বাস্তবতা। দীর্ঘদিন থেকে আমরা মেগাসিটি, মেট্রোরেল, ট্যানেল এবং পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র, ফ্লাইওভারসহ নানা বিষয় কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতায়ই শুনে এসেছি। এগুলো কেবল স্বপ্নই ছিল। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার তা বাস্তবে রূপ প্রদান করছেন। মেট্রোরেল, মনোরেল ও ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। চার লেনবিশিষ্ট সড়কপথ হচ্ছে। দাতা সংস্থাগুলো অর্থ প্রদানের জন্য ফের ফিরে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে জাইকাও পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছিল, তারা বর্তমানে তিনটি সেতু নির্মাণে আগ্রহী। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে ১০ কোটির মতো। প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, যা এক ধরনের বিপ্লব। মোটকথা, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অসাধারণ সাফল্য আমরা দেখতে পাচ্ছি। তথ্য এখন সব জায়গায় সহজে পাওয়া যাচ্ছে। আর এ তথ্যের মাধ্যমে মানুষের ক্ষমতায়ন বাড়ছে। আমরা তথ্যসমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হচ্ছি।
স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে গ্রামীণ বা তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রাধান্য পাচ্ছে। মানুষ বিনামূল্যে চিকিত্সা সেবা পাচ্ছে। গ্রামীণ ক্লিনিক সেবা চালু করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কারণে চারদলীয় জোট সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমানে বিনা চিকিত্সায় লোক মারা গেছে, এমনটি কোথাও দেখা যায় না। আমাদের গড় আয়ু এখন ৭০ বছর। শিক্ষা খাতেও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রবণতা কমেছে। বইয়ের একটি সংকট ছিল; তা দূর হয়েছে। প্রতি বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণ করা হচ্ছে। শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। দেশে উচ্চশিক্ষার চাহিদা বাড়ছে। মেডিকেলে মেয়েদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চশিক্ষা খাতে সমতা অর্জনের মাত্রা বেড়েই চলছে। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা বলতে আর কিছু নেই। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, পুষ্টি ও ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ বেড়েছে। দেশের খাদ্যাভ্যাসে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলতে আমরা কেবল পেট ভরে ভাত খাওয়াকে বুঝতাম। কিন্তু এখন তার পরিবর্তন হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা মাছ, ডিম, দুধ ও মাংস উত্পাদনে সাফল্য দেখিয়েছি। মিঠা পানির মাছ উত্পাদনে আমাদের দেশ পৃথিবীতে চতুর্থ। নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার পরও আমাদের মাছ উত্পাদন বেড়েছে।
কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে আমাদের মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, সবজি ও ফলের উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ভাতনির্ভর খাদ্যাভ্যাস কমে সুষম খাদ্যনিরাপত্তার দিকে আমরা অগ্রসরমান। আমরা এখন সুষম খাদ্য খাচ্ছি। এমনকি গ্রামেও এখন পোলট্রি ফার্ম রয়েছে। সেখানেও ছেলেমেয়েরা মুরগির মাংস-ডিম খেতে পারছে। অর্থাত্ শহরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গ্রামেও একই খাদ্যাভ্যাস দেখা যাচ্ছে। কৃষি খাতে আমরা যথেষ্ট সুফল পাচ্ছি। শস্য উত্পাদন বেড়েছে। স্বাধীনতার পরে অনেক ধানি জমি থাকার পরও সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উত্পাদন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন চাষযোগ্য জমি অর্ধেক হওয়ার পরও ১৫ কোটি ৭৯ লাখ মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করেও আমরা বিদেশে খাদ্য রফতানি করতে পারছি। নানা কারণে জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার পরেও আমরা দ্বিগুণ খাদ্য উত্পাদন করতে পারছি। কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার, উচ্চফলনশীল বীজ এবং কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করার জন্যই এ অবস্থায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে। বর্তমান সরকার কৃষকদের সব চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খাদ্য আমদানি করতে ব্যয় হতো। কিন্তু বর্তমানে তা না হওয়ায় রিজার্ভ বেড়েই চলছে। খাদ্য মানেই ভাত, এ ভাবনা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে। আমাদের দৈনিক খাবারের তালিকায় দেশে উত্পাদিত অনেক পুষ্টিকর খাবার যুক্ত হয়েছে। ফলমূল চাষের ক্ষেত্রেও দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে।
বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তবে বিনিয়োগের বড় একটি অন্তরায় উচ্চ সুদহার কমে আসছে। ১৫-১৬ শতাংশ থেকে নেমে তা বর্তমানে ১১ শতাংশে, যা আরো কমবে। নমনীয় রয়েছে মূল্যস্ফীতির হারও। বৈশ্বিক মন্দার কারণে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক রেমিট্যান্সের ওপর এক ধরনের প্রভাব পড়ে। আমেরিকা, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে নানা কারণে আমরা আশানুরূপ রেমিট্যান্স পাইনি। গুরুত্বপূর্ণ রফতানিমুখী খাত তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়েছে। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ বেড়েছে। তিন মাস নয়, সাত মাস ধরে আমদানি করলে যে পরিমাণ অর্থ দরকার, তার চেয়ে বেশি রিজার্ভ রয়েছে। বর্তমানে ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার আমাদের রিজার্ভ আছে। এ রিজার্ভের পরিমাণ সার্ক অঞ্চলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এটিকে বিনিয়োগে রূপান্তর করতে পারলে আমরা বড় ধরনের একটি সাফল্য পেতে পারি। জ্বালানি তেলের দাম কমতে কমতে এখন সর্বনিম্নে। ৩৬ ডলারে এক ব্যারেল তেল পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য আমাদের আমদানির বড় খাত জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় কমে গেছে। অন্যান্য খাতেও আমদানি ব্যয় কমে গেছে, যার কারণে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে। আমাদের এ রিজার্ভ কর্মসংস্থানের দিকে ব্যবহারের কাজে নজর দিতে হবে।
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
©somewhere in net ltd.