![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নতুন ইংরেজি বছরের তৃতীয় দিনে দেশবাসী ছিল কম-বেশি উৎকণ্ঠার মধ্যে। কেন না দুই বড় দল মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল, ৫ জানুয়ারি সামনে রেখে। সরকারি জোট এই দিবসটি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ আখ্যায়িত করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল। অন্যদিকে বিএনপি ‘গণতন্ত্রের হত্যা দিবস’ হিসেবে একই স্থানে সমাবেশের আহ্বান দিয়েছিল। দিনভর চলছিল তীব্র বাক্যবাণ ছোড়াছড়ি। এতে রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে উঠেছিল উত্তপ্ত। আবারো সংঘাত-সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পড়েছিল বিপাকে। স্বাভাবিকভাবেই ঘরপোড়া গরুর মতো দেশবাসীর মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত একটা ভাব দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছিল। বিগত দুই বছর শুরুর দিনগুলোতে বিএনপি-জামায়াত জোট যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে সন্ত্রাসী ক্যাডারদের রাস্তায় নামিয়ে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে অসংখ্য মানুষ নিহত বা আহত হয়, যানবাহন, দোকানপাট ঘরবাড়ি উপাসনালয় প্রভৃতি ধ্বংস হয়। ফলে গণমনে এমন একটা শঙ্কা দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছিল যে, এবারেও বছরের শুরুতে কি তেমন কিছু ঘটায় কি না বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোট।
সারা দিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটলেও বিকেল থেকে উত্তাপ কমতে থাকে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয় যে, বিএনপি শান্তি চায়। এ জন্য সংঘাত এড়াতে প্রয়োজনে নয়া পল্টনে অফিসের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি চাওয়া হবে। এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, পুলিশ যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে না দেয়, তাহলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করা হবে। সমাবেশের স্থান নিয়ে দুই দলই অবস্থান পরিবর্তন ও নরম করায় রাজনীতিতে উত্তাপ হ্রাস পায়। এমন খবর শুনে দেশবাসী আপাতত কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েই রাতের বিছানা নেয়। কিন্তু ভোর রাতে স্মরণকালের বড় ভূমিকম্পে মানুষের ভয়ভীতি-উৎকণ্ঠা চরমে পৌঁছে। তবে ভূমিকম্পে যত বড় ঝাঁকুনি হয়েছে, তাতে প্রাথমিকভাবে সবাই ধারণা করেছিল যে, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে। কিন্তু শঙ্কা অনুযায়ী মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ায় মানুষের মনে আপাতত একটা স্বস্তি মিলেছে। এদিকে ওই তারিখে রাতের খবরে মানুষ জানতে পেরেছে, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এবং বিএনপি নয়া পল্টনে শর্ত সাপেক্ষে সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে। এতেও আপাতত একটি স্বস্তি মিলেছে। এই দুই স্বস্তির মধ্যে ৫ জানুয়ারি সকালে বসে কলামটা লিখছি।
বস্তুত পক্ষে মানুষ শান্তি ও স্বস্তির মধ্যেই থাকতে চায়। প্রকৃতির প্রচণ্ড রুদ্ররোষের কাছে মানুষ অসহায়। কিন্তু মানুষসৃষ্ট অশান্তি ইচ্ছা করলেই মানুষ কাটাতে যে পারে, এর আবারও প্রমাণ মিলল, সমাবেশ নিয়ে দুই বড় দলেরই নমনীয় অবস্থানের ফলে। যদিও যে কেউই রাজনীতির গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে বলতে পারেন, বিগত বছর শেষে নাশকতা তো শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়ায় এবং দুই দুইবার ঘোষিত যুদ্ধে আর সর্বশেষে পৌরসভার ভোটযুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিপাকে পড়ে বিএনপি এবারে নমনীয়তা দেখাচ্ছে। তবুও বলা যায়, দুই বড় দল যে নমনীয়তা প্রদর্শন করেছে, তা অভিনন্দনযোগ্য। মানুষ প্রকৃত বিচারেই যেমন বিরোধী দলের কাছে গণসংশ্লিষ্টতাবিহীন পোড়াও-জ্বালাও, মারকাটধর্মী তথাকথিত আন্দোলন চায় না, ঠিক তেমনি ওই ধরনের তথাকথিত আন্দোলন করার ফলে সরকার বাধ্য হয়ে বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে না দিক, তাও চায় না। জনগণ চায় রাজনীতির নীতি-কৌশল, অবস্থান-পদক্ষেপ নিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক দলগুলোর তর্ক-বিতর্ক চলুক। যে যার রাজনীতি ব্যাখ্যা করুক, যুক্তিতর্ক তুলে ধরুক। যুক্তি-ব্যাখ্যা সব বিবেচনায় নিয়ে মানুষ চায় সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দল-জোটকে সমর্থন করতে এবং গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট দিয়ে সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে।
প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অবস্থা যদি চলতে থাকে, তবে রাজনৈতিক যুক্তিতর্ক দিয়ে ভালো-মন্দ বুঝে উঠতে পারা কোনো নাগরিকের পক্ষেই অসুবিধা হয় না। মুখোমুখি অবস্থান, টানটান উত্তেজনা, তথাকথিত আন্দোলনের নামে ক্যাডার-সন্ত্রাসী দিয়ে মানুষ পোড়ানো প্রভৃতির মধ্যে কিন্তু যুক্তিতর্ক সব ওঠে লাটে। হাত থাকতে মুখে কেন কিংবা জোর যার মুল্লুক তার প্রবাদগুলো তখন বাস্তবে রূপ নেয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ থাকলে ৫ জানুয়ারি দিনটা গণতন্ত্রের বিজয় দিবস নাকি গণতন্ত্রের হত্যা দিবস; তা বিবেচনায় নেয়া জনগণের কাছে একটুও কঠিন হয় না। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রের বিজয় নাকি হত্যা নিয়ে নানা যুক্তিতর্ক রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতোপূর্বে আলোচনায় উঠে এসেছে। এতদ্সত্ত্বেও ৫ জানুয়ারির সকালে কিছুটা স্বস্তির মধ্যে যুক্তিতর্কগুলো নিয়ে আলোচনায় যাওয়া যাক। বলা তো কঠিন! বিকালে সমাবেশ ইত্যাদির পর পরিস্থিতি কী রূপ ধারণ করে!
বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোট কোন কোন যুক্তিতে ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, তা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে মূলত তিন যুক্তিতে ওই জোট দিবসটি এই নামে চিত্রিত করতে চাইছে। প্রথমত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তী নির্বাচনগুলোও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোট ছাড়াও সিপিবি-বাসদ জোট, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রভৃতি দল অংশ নেয়নি। ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়েছে। তৃতীয়ত, বর্তমানে জেল-মামলা দিয়ে দমনমূলক নীতি কার্যকর করা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের এই যুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজের ‘অতি গণতন্ত্রী’ অংশ বলতে চাইছে যে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বলেছিল যে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন করতে হচ্ছে। দ্রুতই আর একটি নির্বাচন করা হবে। এই কথার বরখেলাপ হচ্ছে, তাই দেশে গণতন্ত্র নেই।
উল্লিখিত যুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করলেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ৫ জানুয়ারি বাস্তবে গণতন্ত্রের হত্যা দিবস কি না? এটা কার না জানা যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল বিএনপির মাগুরা মার্কা উপনির্বাচনের ফলে। যদিও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু নেই। নির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকা গণতন্ত্রের মৌল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় ওই ব্যবস্থা কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই গৃহীত হয়নি। বিএনপির কারণেই জাতি ওই ব্যবস্থায় যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে বিএনপির কারণেই ওই ব্যবস্থা ভ্রান্ত ও চরমতমভাবে ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হয়েছে। আর কেবল সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নয়, জনগণ কর্তৃকও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
একটু খেয়াল করলেই এটা স্মরণে আসবে যে, ১৯৯৬ সালে একদলীয় নির্বাচন করে বিএনপি যখন বাধ্য হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তাড়াহুড়া করে সংসদে পাস করে এবং দুই দিনের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দালাল রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস তাতে সম্মতি স্বাক্ষর করে দেন; তখন ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত কার্যকর করে পুনরায় ক্ষমতায় আসার উদ্দেশ্যে বিএনপি ওই ব্যবস্থায় বেশ কতক ফাঁক রেখে দেয়। ক্ষুদ্র এ কলামে ফাঁক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির কাছে রাখা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদও করেছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই খালেদা জিয়া সরকার পদত্যাগ করায় জাতি নির্বাচনে যায়। কিন্তু বিএনপি ফাঁক দিয়ে ঢুকে যে ফাল হয়ে বের হতে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করেছিল, তা রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস কর্তৃক সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে বাধ্যতামূলক অবসব গ্রহণ করানোর ঘটনার ভেতর দিয়েই প্রমাণিত হয়। ওই যাত্রায় জনগণের ভোট তথা গণতন্ত্র বেঁচে যায় জনগণ সজাগ থাকার ফলে এবং সর্বোপরি তত্তা¡বধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার জন্য।
১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর গণতন্ত্র ও সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যই আওয়ামী লীগ ওই ফাঁক বিবেচনায় নিয়েও গণতন্ত্র তথা নির্বাচন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ অবাধ হওয়ার স্বার্থে নিরপেক্ষ বলে সুপরিচিত বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। কিন্তু পরাজয়ের পর বিএনপি জামায়াতকে স্থায়ী পার্টনার করে নেয় এবং ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শুরু করে পরবর্তী নির্বাচনে বিজয় লাভের লক্ষ্য নিয়ে। যার পরিণতি হলো শা-ল-সা সরকার। ওই সরকার বিএনপি-জামায়াত জোটকে যে ভোট ডাকাতির ভেতর দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল, তা আজ দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। ক্ষমতায় বসে ওই জোট পরবর্তী ২০০৬ সালের নির্বাচনে জেতার জন্য যে নীলনকশা প্রণয়ন করে, তা টু ইন ওয়ান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়রিং’ নামে সুপরিচিত। ওটা করার জন্য বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো, নির্বাচন কমিশনকে আজিজ-জাকারিয়া-জকরিয়া মার্কা করা থেকে শুরু করে এ হেন অপকর্ম নেই যে তা করা হয় না। এতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়া হয়। যার পরিণতিতে দেশে আবারো আসে শক্তির জোরে জরুরি আইনের ১/১১-এর আর্মি ও নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজ ব্যাকড ফকরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের সরকার।
ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করার মতো পর্যাপ্ত উপাদান জোগায়। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে দিয়ে ‘কিংস পার্টি’ গড়ার প্রচেষ্টা এবং মাইনাস টু কার্যকর করতে যাওয়ার ভেতর দিয়ে উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। ক্ষুদ্র এ কলামে কতক বিষয় উল্লেখ করলেই বুঝা যাবে, কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ফেল প্রমাণিত হয়েছে। প্রথমত, সংবিধানের মৌল নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বিচারপতি হাবিবুব রহমান কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে অবস্থান নেননি। দ্বিতীয়ত, বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে বিচার ব্যবস্থাকে এবং প্রশাসনকে দলীয়করণ করে বিএনপি-জামায়াত জোট এই ব্যবস্থাকে সর্বনাশের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়ত, এই ব্যবস্থা ভ্রান্ত ও ব্যর্থ হওয়ার কারণেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই ব্যবস্থায় আদালতকে না জড়ানো এবং কার্যকর না রাখার পক্ষে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে। চতুর্থত, খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে নির্বাচন বয়কট করলেও কোনো রূপরেখা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। একবার তিনি রূপরেখা দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিতর্কিত হয়ে বিপাকে পড়ে তা প্রত্যাহার করে নেন। দাবি তুলে যদি কেউ বলেন, অপরে দিক রূপরেখা, তবে তা কি কখনো যথাযথ ও গ্রহণযোগ্য হয়!
সর্বোপরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সরকার পরিচালনা ব্যবস্থাকে বন্ধ্যত্ব ও নো রিটার্নের দিকে জাতিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। প্রতিবারের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলেই দেখা যাবে যে, সরকারপ্রধান কে হবেন কিংবা উপদেষ্টা কারা হবেন, তা নিয়ে গোল বাধে। যদি বড় কোনো দল অনঢ় অবস্থান নিয়ে কাউকেই না মানেন তবে কি অচলতা সৃষ্টি হতে পারে তা কি কল্পনা করা চলে। অতি মাত্রায় গণতন্ত্র করতে গিয়ে তখন গণতন্ত্রই টিকে না থাকার অবস্থা দাঁড়াবে। উল্লিখিত সব কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা টিকে থাকার যোগ্যতা হারালেও সংবিধান সংশোধন না করে ওই ব্যবস্থাকে বাতিল করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু জাতির সৌভাগ্য হচ্ছে এই যে, সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদে নিরঙ্কুশ সমর্থনের ভিত্তিতেই এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো- বিএনপি-জামায়াত জোট তখন বিতর্কে অংশ না নিয়ে সংসদ বয়কট করেছিল কেন? বিএনপিকে সংবিধান সংশোধনের জন্য কমিটিতে রাখলেও তারা তা বয়কট করতে গিয়েছিল কেন? দাবির পক্ষে যুক্তি দিতে পারবে না এবং পরবর্তী নির্বাচন ভণ্ডুল করার জন্যই যে তা করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিএনপি-জামায়াত জোটসহ কতক দল সংবিধানের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বয়কট করলে গণতন্ত্র হত্যা হয়ে যাবে, এমনটা কোনো যুক্তিতেই প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। নির্বাচন করা কিংবা না করা কোনো দলের নীতি-কৌশলের বিষয়। সত্তরের নির্বাচন ভাসানী ন্যাপ বয়কট করেছিল, ওই দলের মধ্যে থাকা চীনপন্থী কমিউনিস্ট গ্রুপগুলো স্লোগান তুলেছিল, ‘তোরা কর নির্বাচন, আমরা যাই সুন্দরবন’; তাতে কি নির্বাচন বাতিল হয়েছে! জিয়া সামরিক ফরমানে সামরিক শাসনের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচন দিয়েছিলেন এবং ওই সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন হয়েছিল; তাতে কি নির্বাচন বাতিল হয়েছে! আর নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনার প্রস্তাব দিলে তৎকালীন বিরোধী দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কেন? কেন প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তীকালিন সরকারে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলেও বিএনপি নেত্রী তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন?
এসব দিক বিবেচনায় নিলে বুঝা যাবে, নির্বাচন বয়কট করার কৌশল বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোট নেয় সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই। আর এ লক্ষ্য থেকেই ২০১৩ সালের শেষ দিক থেকে আন্দোলনের নামে অরাজকতা-অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার জন্য মাঠে নেমেছিল। নতুবা সংসদ অবিরাম সংসদ বয়কট করেছিল কেন? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণে এটা প্রমাণিত হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ এবং অবৈধ শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ পরিষ্কার করতেই ওই জোট গৃহযুদ্ধ বাধাতে তৎপর হয়েছিল। তদুপরি ‘হাওয়া ভবন’ নিয়ন্ত্রিত দুষ্কর্ম জনগণের মনে স্থায়ী আসন গেড়ে রেখেছে বিধায়ও নির্বাচন বয়কট করে অবৈধ সরকার ক্ষমতায় আনতে চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। প্রসঙ্গত একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিস্তানও কিন্তু পরাজয়ে প্রতিশোধ নিতে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ চাইছিল। এটাই তো বাস্তব সত্য যে, গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে ৫ জানুয়ারির ভোটকে তথা গণতন্ত্রকে বিএনপি- জামায়াত জোট বানচাল করতে চেয়েছিল আর সংবিধানিক ধারা রক্ষা করতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট নির্বাচন করেছিল। এখন বিচার করুন. গণতন্ত্র হত্যা করল কে আর গণতন্ত্র রক্ষা করল কে? উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে পিণ্ডির দালালরা চেষ্টা করবে না তো কে করবে!
প্রকৃত বিচারে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সংবিধান ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছে। জনগণ অন্ধ কিংবা বোকা নয়। সেই পাকিস্তানি আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক দলগুলোর গণতন্ত্র ও জাতিবিরোধী রাজনীতির নীতি কৌশল দেখতে দেখতে পোড় খেয়ে দেশবাসী এখন যথেষ্ট সচেতন। আর সেই কারণেই বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোটের তথাকথিত ও জাতিবিরোধী হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিত আন্দোলনে রাস্তায় নামা দূরে থাকুক, ন্যূনতম সমর্থনও দেয়নি। বিদ্যমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ভারসাম্য বজায় রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে উন্নয়নের ধারায় শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে দেশ চলুক চেয়েছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের অংশগ্রহণ এবং পরাজয় প্রমাণ করে জনগণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবেই মনে করছে। আর বিদেশি যারা গণতন্ত্র গেল গেল বলে নানা দৌড়ঝাঁপ করেছিল, তারাও সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ধারায় প্রতিষ্ঠিত সরকারকেই বিএনপি-জামায়াতের দাবির মুখে ছাই দিয়ে মেনে নিয়েছে।
আর পেট্রলবোমা দিয়ে যারা নিরীহ মানুষ ও পুলিশ মেরেছে, আগুন দিয়ে সব পুড়িয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেতে চেয়েছে, যুদ্ধাপরাধিদের বিচার বন্ধ করে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে; তাদের আইনের আওতায় আনাটাই তো গণতন্ত্র ও সংবিধানসম্মত। জনগণ চায় আইন তার নিজস্ব গতিতে চলুক। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, আওয়ামী লীগের নেতৃতে ১৪ দল নির্বাচনের আগে বলেছিল, এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন এবং দ্রুতই আবার নির্বাচন হবে। ঠিকই আছে। তবে দেশবাসী মনে করে আগাম নির্বাচন করতে হলে বিএনপিকে প্রথমত সংবিধান মেনে নিয়ে নির্বাচন করবে বলে ঘোষণা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারের পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। তৃতীয়ত, নিবন্ধিত না হওয়া যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার ঘোষণা দিতে হবে। চতুর্থত পেট্রলবোমার তাণ্ডব সৃষ্টি করে মানুষ মারা ও জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। চতুর্থত, বিরোধী দল হলেও সংসদ বয়কট করবে না মর্মে ঘোষণা দিতে হবে। বলাই বাহুল্য. আওয়ামী লীগকেও গণতন্ত্রের স্বার্থে এই ঘোষণা দিতে হবে। এসব পূর্বশর্ত কার্যকর হলে জনগণ নিঃসন্দেহে আগাম নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়াবে। নতুন বছর শুরুর এই কলামে সব শেষে বলতেই হয় যে, জনগণ সব দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে নির্বাচন চায়, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করুক চায় ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে চায় জাতীয় চার মূলনীতির অন্য তিন নীতিরও বাস্তবায়ন।
শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।
©somewhere in net ltd.